ফ্যালানী
মোকছেদ আলী*
খুপরী একটা ঘর। তার এক চিলতে বারান্দা। ফ্যালানী শহরের ড্রেনের পাশ থেকে তুলে আনা কচু, গিমা, শান্তির শাকগুলি বাছছিল। অদুরে বসে আছে ৪ বৎসরের মেয়ে কুড়ানী। মাথায় ঝাকড়া চুল। মায়ের শাক বাছার দিকে নজর দিয়ে বলল, “এ্যাই মা, রোজ রোজ আর কচু ঘেচুর শাক ভাল্ লাগে না। তুই মাছ দিয়া ভাত দিস্ না ক্যান? বাজান কত সোন্দর সোন্দর মাছ আনতো, ইলশা মাছ। ইলশা মাছ না দিলে আমি ভাত খামু না।”
ফ্যালানীর শাক বাছা হাত দুইটা থেমে গেল। মেয়ের কথায় পেট্রোল ভেজা কাগজের মত জ্বলে উঠলো দপ করে। দেহের সবটুকু শক্তি কণ্ঠে জমা করে বলল, “ইলশা মাছ খাইবো। শখ কত হারামজাদী মাগীর। প্যাটে পড়ে না দানা, আবার ইলশা মাছ খাইব, ইলশা মাছ স্যাটার মধ্যে দিমু।”
মেয়েও চুপ করে থাকে না। সমান তালে মুখ চালায়। তোর কাছে কিছু চাইলেই দেস তো না, খালি গাইল দেস। বাজান কত ভাল আছিল, কত মাছ…। কুড়ানী অবশিষ্ট কথাটুকু শেষ কোরতে পারলো না। আর থাকতে পারে না, ফ্যালানী ছুটে এসে খুব জোরে জোরে গোটা তিন কিল দেয় কষে কুড়ানীর পিঠে।
কুড়ানী পিঠ বাঁকা করে হাত দিয়ে পিঠ বুলাতে থাকে। চোখে ঝরে টলটলে পানি। ফ্যালানী দাঁত কিড়মিড় করে কয়, “যা তোর বাপের কাছে, এতই যখন বাপ সোহাগী। তয় তোর বাপে বিয়া করলো ক্যান আরেকখান?”
একথার উত্তর কুড়ানীর জানা নাই। সে গোমরা মুখে চুপ করে থাকে।
গত বছর হঠাৎ করেই ওদের বাবা একটা বিয়ে করে ঘরে ফিরে ফ্যালানীকে তিন তালাক দিয়ে তাড়িয়ে দেয়। বাপ ছিলো নিমতলার আড়ৎদার। স্বচ্ছল অবস্থা ছিলো। ফ্যালানীকে মোটামুটি সুখেই রেখেছিল। কেন যে এমন মতিগতি হলো কে জানে। ফ্যালানীকে যখন বাড়ি থেকে বের করে দেয় তখন দশ বছরের ছেলে মানিককে কাছে রেখে দিতে ভোলেনি লোকটা। মেয়ের হাত ধরে চলে এসেছে ফ্যালানী। এই বাড়ি ঐ বাড়ি কাজ করে মা মেয়ের কোন রকমে চলে যায়।
আজ ফ্যালানীর মন মেজাজটা বিক্ষিপ্ত। কেমন যেন অন্য রকম ভাবনার আনাগোনা চলছে তার মনে। ওহ্ কিচ্ছু ভালো লাগছে না। তাই সে আজ পরামানিক বাড়ি কামে যায় নাই। কথাটা নিয়ে মন নাড়াচাড়া করছে। ঘটনার সূত্রপাত কয়েকদিন আগে।
বিকালে পরামানিক বাড়ির কাজ সেরে ক্লিক মোড়ের ধান কলের দেয়াল ঘেষে ঘরে ফিরছিল। দেয়ালের মোড় ঘুরতে ডাক্তারখানা থেকে বেরিয়ে আসা একটি লোকের সঙ্গে বুকে বুকে ধাক্কা লাগলো। ফ্যালানী কষে একটা গাল দিল। লোকটা মুখ তুলে লাজুক লাজুক হেসে বললো, “বেশী জোরে লাগছে বইন? আমি আপনারে দেখি নাই। মাফ কইরা দেন।” লোকটার নরম কথায় আর কিছু বলল না। মনের মধ্যে একটা তপ্ত আগুনের শিখা নিয়ে ঘরে এলো।
লোকটা পরের দিন কড়ই গাছের তলায় যেখানে ধাক্কা লেগেছিল সেখানেই দাঁড়িয়ে আছে। ফ্যালানীকে দেখে মাথা নিচু করে তার সামনে এসে দাঁড়ালো লোকটা। “বইন আপনে আমারে মাফ কইরছেন তো? আমি কিন্তুক ধাক্কাটা দেইখ্যা দেই নাই।” গোখরো সাপের মত ফস কৈরা চেইত্যা উঠলো ফ্যালানী, “অইছে, অইছে, অত ভালা মানুষী দেহান লাগবো না।”
তারপর থেকে প্রতিদিনই দেখা হয়েছে লোকটার সাথে, কথাও হয়েছে, কেমন যেন ঘনিষ্ঠতাও হয়েছে দুজনার মধ্যে।
সেদিন লোকটা এদিক ওদিক তাকিয়ে একটা প্রস্তাব দিয়েছে ফ্যালানীকে। প্রস্তাবের সাথে নিজে পরিচয় দিতেও ভুল করেনি লোকটা। একাই থাকে। বিয়ে থাওয়া করে নি। ধান মিলে চাকরী করে। মিলের মালিক বড় ভালো লোক, পয়সা কড়ি যখন যা লাগে তা দেয়।
৫ টার সময় কারেন্ট অফ হয়। তারপর সে এই দোকানের সামনে আড্ডা দেয়। ফ্যালানীকে দেখেই লোকটার অন্য রকম লেগেছিল। বিশেষ করে ফ্যালানীর দেহের অটুট বাঁধন তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিল। ফ্যালানীকে না দেখলে যেন সে এক দন্ড থাকতে পারে না।
ফ্যালানীর বয়স বছর তিরিশেক হবে। শরীরের শক্ত বাধুনী। ঘাড় নিচু করে নিজের উন্নত দেহটার দিকে তাকিয়ে নিজেরই গর্ববোধ হয়। অথচ সে দুইটা সন্তানের জননী। কালো মুখখানা ঢলো ঢলো লাবণ্যমন্ডিত। বয়স কম বলে বোধ হয়।
ফ্যালানীর চিন্তার স্রোত লোকটা হয়ত জানে না, ও দুই সন্তানের মা। জানলে বিয়ের প্রস্তাব কি সে ফিরিয়ে নেবে? আজ সকাল থেকেই এই চিন্তাই ফ্যালানীর মনকে তোলপাড় করছে।
এতদিন সে বিয়ের কথা ভাবেনি। কিন্তু এইভাবে কতদিন থাকা যায়। পরের বাড়ি কাজ করে আর কতদিন কাটাবে। মেয়েসহ লোকটা কি তাকে গ্রহণ করবে? যদি গ্রহণ না করে, ভাবতে ভাবতে মেয়ের প্রতি অকারণেই মন তার বিষিয়ে ওঠে। ওর বাপ তো ওর কথা ভাবে নি, আমি কেন ভাবতে যাবো? হ্যাঁ, শেষে সিদ্ধান্ত নিয়েই ফেলে ফ্যালানী। মেয়েকে ফেলেই সে পালাবে।
সিনেমার পর্দার ছবির মত তার মনের মুকুরে সংসারের ছবি ভেসে ওঠে। সেখানে সে লাজ নম্র নববধু। ধীরে ধীরে নতুন সংসারে প্রবেশ করছে। যার কোন অতীত বলতে কিছু নাই। আছে শুধু অনাগত উজ্জ্বল সুন্দর ভবিষ্যৎ।
কুড়ানী চিলতে বারান্দায় একটা ছেড়া মাদুরের উপর শুয়ে অঘোরে ঘুমাচ্ছে। সুন্দর ঝাকড়া চুলগুলি ঘাড়ের উপর এলিয়ে আছে।
ফ্যালানী কম্পিত পায়ে, মেয়ের কাছে যায়। আস্তে করে একটু চুমু দেয় মেয়ের কপালে। শেষ চুম্বন।
———-
মোকছেদ আলী (১৯২২-২০০৯)। স্বশিক্ষিত। সিরাজগঞ্জ জেলার বেলতা গ্রামে জন্ম। গ্রামটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

অনুলেখক: মাহফুজ।