একটি মৃত্যু কাহিনী

মোকছেদ আলী*

ওহে মৃত্যু তুমি মোরে কি দেখাও ভয়?
ও ভয়ে কম্পিত নহে আমার হৃদয়।

ভেড়ামারার প্রথিতযশঃ মশহুর ডাক্তার। সবাই বলে, ডাক্তারের হাতযশ আছে খুব। রোগীর গায়ে হাত দিলেই অর্ধেক রোগ সারিয়া যায়। সকাল হইতে রাত্রি ১০ টা নাগাদ, রোগীর ভীড় থাকে তাহার ডিসপেনসারীতে। মধ্য আকৃতির স্বাস্থ্যবান সুপুরুষ। কথা বলেন আস্তে ধীরে। হাঁটার চলন ধীরগতি। দেখলে মনে হয় যেন গুণে গুণে পা ফেলছেন। রাজনৈতিক বা ধর্মীয় কোন আলোচনাই করেন না কারো সঙ্গে। যা কিছু বলেন, রোগ ও রুগী সম্বন্ধে । ডাক্তারের ডিসপেনসারী আর আমার বাড়ি, মাঝখানে গজ পঁচিশেক ব্যবধান। আমার পরিবারের রোগ ব্যাধিতে তাহারই দেওয়া ঔষধ ব্যবহার করি। দীর্ঘ ১৬ বছর তিনি আমার পারিবারিক ডাক্তার। তিনি আমাকে পুত্রবৎ স্নেহ করেন।
আমার স্ত্রীর পায়ে আঘাত লাগিয়া কাটিয়া যায়। ৫ দিন ঔষধ ব্যবহার করিয়াও নিরাময় হয় নাই। শীতকাল। সকালবেলায় তাহার সঙ্গে দেখা করিয়া বলিলাম, চাচা মিঞা, আপনার মেয়ের পায়ের যন্ত্রণা বেশী হয়েছে; আপনি দেখে এসে ঔষধ দেন, আমি সকালের গাড়ীতে পাবনা যাব মালপত্র আনতে।
তিনি বলিলেন, আচ্ছা, তুমি যাও, আমি একটু পরে যাচ্ছি।
আমি পাবনা চলিয়া গেলাম। পরদিন বেলা দশটার ট্রেনে ভেড়ামারা ষ্টেশনে কুলির মাথায় মালপত্র চাপিয়া দিয়া ষ্টেশনের বাহিরে আসিতেই পরিচিত এক ব্যক্তি আমাকে জিজ্ঞাসা করিল, শুনছেন নাকি কিছু? পাল্টা প্রশ্ন করিলাম, কি শুনবো? সে বলিল, “গতকাল সকালে মোকছেদ ডাক্তার আপনার বাড়ি গিয়া মারা গেছে, ফারাকপুর গোরস্থানে বিকালে মাটি হয়েছে। কথাটা যে যথার্থই সত্য তাহার সাক্ষী দিল এক কুলি। বলিল, মোকছেদ ডাক্তার কাল আপনার বাড়ি গিয়া হার্টফেল করিয়া মারা গেছে।
মোকছেদ ডাক্তার মারা গেছে, শব্দটা কানে প্রবেশমাত্র আমার বুকের ভিতর ছ্যাৎ করিয়া উঠিল। আমার হাত পা কেমন যেন অবশ হইয়া গেল। কুলীদের বলিলাম, তোমরা দোকানে চলিয়া আসো, আমি রেক্‌সা নিয়া চলিয়া যাই। কুলিরা আমার অন্তরের ভাব বুঝিতে পারিয়া কহিল, যান্‌ যান্‌।
তেমাথার মোড় ঘুড়িয়া রিক্সা গলি পথে প্রবেশ মাত্র গলির দোকানদার খোদা বক্‌স ওরফে কেবি অত্যন্ত ব্যস্তভাবে কহিল, ভাই শুনছেন, মোকছেদ ডাক্তার কাল আপনার বাড়িতে মারা গেছেন।
রিক্সাওয়ালা কথাটার সাক্ষ্য দিল- কাল আপনার বাড়িতে লোকে লোকারণ্য।
বাড়িতে প্রবেশমাত্র এই অতি গুরুত্বপূর্ণ খবরটি আমার সন্তানেরা সমস্বরে বলিল, আব্বা, আব্বা, ডাক্তার নানা কালকে আমাদের বাড়িতে এসে মারা গেছে।
ঘরে ঢুকিয়া চৌকির উপর বসিতেই গিন্নী আসিয়া পাশে বসিল। ছেলেমেয়েরা আসিয়া মেঝেতে দাঁড়াইল। গিন্নী ধরা গরায় বিস্তারিত বিবরণ কহিল। শুনিয়া কেন জানি না আমার চক্ষু দিয়া অঝোরে পানি পড়িতে লাগিল। গিন্নীর দুইটা চোখ ভিজিয়া উঠিল। গিন্নী কহিল- তুমি বাড়ি হতে চলে যাওয়ার ১৫/২০ মিনিট পরেই ডাক্তার চাচা এলেন। ডাক্তারের সঙ্গে আব্বাও আসলেন। ডাক্তার দেখে বড় মেয়ে এই চৌকির উপর ফুলওয়ালা সুজনী চাদরখানা বিছায়ে দিল। আব্বা বসলেন ঐখানে, আর ডাক্তার চাচা বসলেন তুমি যেখানে বসে আছ, এখানে। আমি বড় মেয়েকে ওঘর থেকে চেয়ার আনতে বললাম। চাচা বাধা দিয়ে বললেন, চেয়ারের দরকার নাই। এই তো বেশ আছি। আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, তুমি চৌকির উপর উঠে দাঁড়াও, দেখি তোমার পায়ের অবস্থা। ডাক্তারের ঔষধ রাখার চামড়ার ব্যাগটি আব্বা হাতে করে এনে চৌকির উপর রেখেছিলেন, ব্যাগটা একটু সরিয়ে আমি চাচার সামনে দাঁড়ালাম। চাচা আমার পায়ের কাটা আঙ্গুলটা ভাল করে দেখলেন, তারপর একটু চাপ দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, খুব ব্যাথা লাগে? আমি মাথা নেড়ে বললাম, জ্বী। তিনি বললেন, “বসো, ইনজেকশন দিতে হবে। বলেই তিনি চামড়ার ব্যাগটি খুলে, ঔষধ ও সিরিঞ্জ বের করে, স্পিরিটে সিরিঞ্জ পরিষ্কার করলেন। আব্বা, আমি আর ছেলে ডাক্তারের সিরিঞ্জ পরিষ্কার করা দেখতেছিলাম। ডাক্তার আমাকে বললেন, মাজেদা, আমার যে মাথা ঘুরে গেল। চাচার কথা শুনে আমি তাড়াতাড়ি একটি বালিশ টেনে চাচার কাছে দিয়ে বললাম, চাচা, একটু কাত হোন। চাচা বালিশের উপর ধপাস করে পড়ে গেল, হাত থেকে সিরিঞ্জ ছিটকে পড়ল। আব্বা সিরিঞ্জটি তুলে রেখে, দৌড়ায়ে ডাক্তারের বাড়ীতে গেলেন। মিনিট তিনেক পরেই ডাক্তার চাচী ও আব্বা ঘরে ঢুকলেন, আমি তখন একটি হাতপাখা দিয়ে ডাক্তার চাচার মাথায় বাতাস করতেছিলাম। চাচী, চাচার হাত ধরে নাড়ী পরীক্ষা করে, তাড়াতাড়ি চামড়ার ব্যাগ থেকে কোরামিন ইনজেকশন বের করে চাচাকে ইনজেকশন দিলেন। আব্বা বের হয়ে গেলেন। আমি চাচীকে সব কথা খুলে বলতে লাগলাম। মিনিট ১০ শেকের মধ্যেই, সিদ্দিক ডাক্তার, সামছুল ডাক্তার, নিতাই ডাক্তার, মহি ডাক্তার আরো কয়েকজন আমি তাদের চিনি না, আসলেন। একসঙ্গে এতগুলি ডাক্তারকে আমাদের বাড়ীতে ঢুকতে দেখে বাজারের সব দোকানদার কুলি কামিন সবাই আমার বাড়ীর ভিতর এল। উঠানে ঘরে বারান্দায় লোক গিজ গিজ করছে। সিদ্দিক ডাক্তার আর নিতাই ডাক্তার, ডাক্তার চাচার গায়ে হাত দিলেন। সামছুল ডাক্তার অভিজ্ঞ বৃদ্ধ মানুষ, দুর থেকে দেখেই বললেন, ও ছিদ্দিক ও নিতাই তোমরা দেখছ কি? উনি তো ১৫/২০ মিনিট আগেই চলে গেছেন। এখন যা করবার তাই কর, কলেমা শাহাদত পড়। সামছুল ডাক্তারের কথা শুনে চাচী ডোক্কার দিয়ে কেঁদে উঠলেন। সকলেই তখন কাঁদতে লাগলো। আমার দুই চোখ দিয়া পানি ঝর ঝর করে পড়তে লাগল। তখন সকলে ধরাধরি করে উত্তর শিয়রে শোয়ালেন। সামছুল ডাক্তার বললেন, একটা চাদর দিয়ে ঢেকে দাও। আমি উঠে বাক্‌সো খুলে একটা সাদা চাদর বের করে দিলাম। সামছুল ডাক্তার নিজ হাতে চাদর দিয়ে ঢেকে দিলেন। আর আব্বা তাকে সাহায্য করলেন। চাচীমা কান্না থামিয়ে পাথরের মূর্তির মত নিঃশ্চল হয়ে বসে রইলেন। খবর ছড়িয়ে গেল। লোকের ঢল নামল আমাদের গলিতে। বোধ করি হাটের দিনও এত লোক হয় না। তুমি বাড়ি ছিলে না- থাকলে দেখতে বুঝতে সেই করুণ দৃশ্য। তারপর ছেলেদের কাছে ফোন করে দেয়। তারা আসলে, বিকালে লাশ নিয়ে যায়। দাফন কাফন দিতে রাত দশটা হয়।
ডাক্তার চাচা ছিলেন আমার পিতৃতূল্য। তিনি আমাকে পুত্রবৎ স্নেহ করিতেন। তাহার এই মৃত্যুতে কেন জানি না, নিজে বড়ই অসহায় বোধ করিতে লাগিলাম।
আমি আমার শ্বশুড়ের প্রমুখাত শুনিয়াছি, ডাক্তার চাচা প্রায়ই বলিতেন, “জানো আজিরুদ্দিন, আমার মৃত্যু হঠাৎ হবে। এ কারণে আমি দূরের কলে যাই না। তবে মৃত্যুকে ভয় করি না। আমি সর্বদাই মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকি।”
যে ডাক্তার মানুষকে মৃত্যুর কবল হইতে ছিনিয়া নিয়া আসে, আজ সেই ডাক্তার মৃত্যুর কবলে। কুল্‌লু নাফসুন জায়েকাতুল মাউত।

————
মোকছেদ আলী (১৯২২-২০০৯)। স্বশিক্ষিত।

অনুলেখক: মাহফুজ।