পূর্ববর্তী পর্বের পর …

সতেরো

কলেজে আমি বিজ্ঞান নিয়েছিলাম—বড় বিজ্ঞানী হব সে আশায় নয়, ভাল চাকরি পাওয়া যাবে সে স্বপ্নে। ভুল করেছিলাম কিনা জানিনা, কিন্তু ওটাতে ঢুকে বুঝতে পারলাম আমি আর যা’ই হই, রাসায়নিক হব না। সবচেয়ে অপছন্দ করতাম আমি রসায়নের ক্লাসটাকেই। বিশেষ করে ল্যাব। ল্যাবের ধারেকাছে গেলে আমার বমি উগড়ে আসত, যখন বড় বড় গ্যাসের ধামা থেকে উগ্র গন্ধ বেরিয়ে চারদিকের বাতাসকে অসহ্য করে তুলত। যে গ্যাসটিকে আমি সভ্যতার ওপর অহেতুক আক্রমন বলে ভাবতাম সেটি হল হাইড্রোজেন সালফাইড। ওই গন্ধ সহ্য করে যারা সারাজীবন কেমিস্ট্রি নিয়ে ডুবে থাকে তাদের প্রতি একটু অতরিক্ত ভক্তি জন্মে গিয়েছিল আমার—তারা নিশ্চয়ই অতিমানব, নাহলে এই পুঁতি গন্ধ নাকে নিয়ে কেমন করে পুরো একটা জীবন কাটিয়ে দেয়, এবং পরম আনন্দের সঙ্গে। সত্য কথা বলতে কি, বিশ্ববিদ্যালয় গিয়ে এই ল্যাবের ভয়ে আমি পদার্থবিদ্যায় অনার্স নিয়েও ছেড়ে দিয়েছিলাম কেমিস্ট্রি পড়তে হত বলে।

সৌভাগ্যবশত আমার মত শুচিবায়ুগ্রস্ত পিতপিতে স্বভাব নিয়ে সবাই জন্মগ্রহণ করে না—তাহলে রসায়নশাস্ত্র নামক অসাধারণ রসালো বিষয়টি বেশিদূর এগুতে পারতনা, ফলে আধুনিক বিজ্ঞানও অর্জন করতে পারত না তার সবটুকু আধুনিকতা। আমার ঠিক বিপরীত মানসিকতা নিয়ে জন্মেছিলেন ফ্রান্সের জ্যাঁক চার্লস (১৭৬৫-১৮২৩)। কেমিস্ট্রির ল্যাব থেকে আমি দূরে থাকতাম, উনি গ্যাস নিয়ে খেলা করতেন। গ্যাস, যতরকমের গ্যাসের কথা জানা ছিল সেসময়, সবকিছুতেই তাঁর ছিল একটা অস্বাভাবিক কৌতূহল। কোন গ্যাসের কি রঙ কি গন্ধ, কি তার দোষ, কিই বা তার গুণ, এই ছিল তাঁর সার্বক্ষণিক চিন্তা। মজা পেতেন লক্ষ করে যে অম্লজান (oxygen) আগুন জ্বালায়, আর কার্বন ডায়ক্সাইডের কাজ হল সে আগুন নেভানো। ক্লোরিন দেখতে ভারি সুন্দর, সবুজশ্যামল, কিন্তু মারাত্নক, আবার নাইট্রাস অক্সাইড একেবারেই নিরীহ নিরেট, বেরঙ্গা, কিন্তু নাকে গেলে মানুষকে হাসাতে হাসাতে পেটে খিল ধরিয়ে দেয়। এরা সবই গ্যাস পরিবারে সদ্স্য, অথচ কত ভিন্ন তাদের চরিত্র। শুধু একটা ব্যাপারে ওদের সবারই ব্যবহার অবিকল এক, লক্ষ্য করল চার্লসের কৌতূহলী চোখ, সেটা হল, গরম লাগলে সবারই আয়তন বাড়ে, ঠাণ্ডায় সবাই কুঁচকায়। সবচেয়ে চমকপ্রদ হল উদজান (hydrogen) গ্যাসের আচারব্যবাহার। যেই না তাপ দেওয়া অমনি সে ফুলতে শুরু করে— অতি অল্প সময়েই ফুলে ঢাউস হয়ে যায়। বড় ভদ্র আর কোমল প্রকৃতির এই নিরীহ গ্যাসটি।( যদিও গন্ধকের (sulphur) সঙ্গে বেশি মেলামেশা করলেই দুজনে মিলে একটা বিশ্রি গন্ধ সৃষ্টি করে ফেলে।) হাইড্রোজেন গ্যাসের এই অল্প তাপে ফুলতে পারার গুণটি লক্ষ্য করেই চার্লসের মাথায় বুদ্ধি এলঃ তাইতো, একে যদি একটা বেলুনের ভেতরে ভরে কোনরকমে চুলোর মত কিছু একটা তৈরি করে তার নিচে বসানো যায় তাহলে সে তো ফুলতে ফুলতে পুরো বেলুনটাকেই মাটি থেকে তুলে ওপরে নিতে শুরু করবে। এবং যতই তাপ বাড়ানো হবে ততই ফুলবে গ্যাস, ফলে ততই উর্ধমুখী ছুটবে বেলুন। মনে রাখতে হবে যে হাইড্রোজেন গ্যাসের এই সহজে উড়ে যাবার ক্ষমতা, এর মূলে আরো একটা বর গুন আছে তার, তার আপেক্ষিক ওজন। যত গ্যাস আছে সংসারে তাদের সবার চেয়ে হালকা হল হাইড্রোজেন। মেণ্ডেলেভ সাহেবের মানচিত্রে ( periodic table) এর স্থানই সর্বপ্রথম। এই গুণটাকেই মানুষ কাজে লাগিয়েছে সবচেয়ে বেশি করে। আজকাল অবশ্য হাইড্রোজেনের চাইতে হিলিয়াম গ্যাসই বেশি পছন্দ করে বেলুনপ্রেমিকরা, যদিও হিলিয়ামের ওজন কিঞ্চিত্‌ বেশি, তার কারণ হাইড্রোজেন গ্যাসে সহজেই আগুন লেগে যাওয়ার ভয় বেলুনের ভেতর, হিলিয়াম গ্যসে সে ভয়টা নেই। চার্লসের সময়কালে অতসব জানা ছিল না, এবং তাঁর আগে কেউ আকাশে উড়বার কল্পনা করেনি। তিনিই প্রথম সে দুঃসাহসী পদক্ষেপটি নিলেন্‌ এবং অত্যন্ত সাফল্যের সাথে উঠতে উঠতে প্রায় দু-মাইল উচ্চতায় আরোহণ করেছিলেন। জাক চার্লসই ছিলেন পৃথিবীর সর্বপ্রথম বেলুনারোহী।

বিজ্ঞানজগতে চার্লস সাহেবে খ্যাতির প্রধান ভিত্তি কিন্তু তাঁর বেলুন নয়, ভিত্তি হল গ্যাসের গুণাগুন নিয়ে তাঁর মৌলিক তত্ব। তিনি দেখলেন যে তাপ যে পরিমান গ্যাসের স্ফীতির পরিমানও অনেকটা তাই—অর্থাত্‌ একের সঙ্গে আরেকটির আনুপাতিক সম্পর্ক। তাপ যদি কমতে কমতে শূন্যের কাছাকাছি পৌঁছায় তাহলে আয়তনও কমতে কমতে অস্তিত্বহীনতার পর্যায়ে পৌঁছে যাবে। এই তত্বটি বিজ্ঞানে ‘চার্লস ল’ নামে পরিচিত।

কিন্তু এক প্রশ্ন সবসময়ই আরেকটি প্রশ্নের ইঙ্গিত দেয়। আপাতদৃষ্টিতে চার্লসসূত্রে কোন ভুলত্রুটি ছিল না, তবে প্রশ্ন উঠছিল, ঠিক,আছে, বস্তু না হয় নিজের ভেতরে গুটোতে গুটোতে একেবারে শূন্য আয়তনে পৌঁছে গেল, তাই বলে তাপ কি করে শূন্য হয়ে যায়? তাপ, আয়তন সব শূন্য হয়ে গেলে তো কিছুই থাকে না পৃথিবীতে, বিশ্বজগত সব নিস্তব্ধ নিরাকার নিস্তাপ—গ্রহনক্ষত্র উদ্ভিদ প্রানী বস্তু কোনকিছুরই কোন অস্তিত্ব থাকে না। চার্লসতত্বের এই বিড়ম্বনাটি বিশেষভাবে লক্ষ্য করলেন বিলেতের লর্ড কেলভিন(১৮২৪-১৯০৭)।

লর্ড কেলভিন লর্ড হয়ে জন্মগ্রহন করেননি। বেলফাস্টের এক সাধারণ আইরিশ পরিবারে তাঁর জন্ম, ফরাসী বিজ্ঞানী চার্লসের মৃত্যুর ঠিক এক বছর পর—নাম ছিল উইলিয়ম ঠমসন। বিজ্ঞানের নেশা ও নিয়তি এঁদের দুজনকে যুক্ত করে দেয় ইতিহাসের পাতায়। গ্লাসগো আর কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনার পাট চুকিয়ে তিনি গ্লাসগোতেই অধ্যাপনা শুরু করেছিলেন এবং ওখানেই ৫৩ বছরের দীর্ঘ পেশাজীবন অতিবাহিত করেছেন। নিযুক্তিকালে তাঁর বয়স ছিল ২২। তার দুবছর পর তাঁর যুগান্তকারি আবিষ্কার—ধ্রুবমানক(absolute scale), যাতে করে চার্লস সূত্রের ‘শূন্য’তাপ, যেখানে বস্তুর আয়তন লোপ পায়, চিহ্নিত হয়, যদিও প্রকৃত বিচারে সেটা ঠিক তাপ একেবারে মুছে যাওয়া বোঝায় না। আসলে লর্ড কেলভিনের ‘ধ্রুবশূন্য’( absolute zero) মানে হল সাধারণ সেলসিয়াস স্কেলে -২৭৩.১৬ ডিগ্রি, ফারেনহাইটে -৪৫৯.৬৯ ডিগ্রি। ‘ধ্রুবশূন্য’ তাপ অর্থ হল এতে পৌঁছাতে পারলে (যা আসলে কখনোই সম্ভব নয় আক্ষরিকভাবে)পদার্থ, কঠিন তরল বায়বীয় যা’ই হোক, সব নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে—বস্তু থাকবে কিন্তু অবয়ব থাকবে না, স্থল থাকবে না, কার্যত অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে। দৈনন্দিন জীবনে কেলভিন স্কেলের দরকার হয়না, কারণ জনপ্রানীর জীবনধারণের জন্যে যেরকম তাপ আর বায়ুচাপের প্রয়োজন হয় তাতে ধ্রুবমাত্রার ধারেকাছে যাবারও কোন প্রশ্ন ওঠেনা। আমাদের ক্যানাডার কোন কোন অঞ্চলে মাঝে মাঝে এমন ঠাণ্ডা হয় শীতকালে যে সকালবেলা বাইরে বেরুলে ঠোঁটে ঠোঁটে জোড়া লেগে যায়, নিঃশ্বাস জমে যায়, গাড়ির তেল জমে যায়। তবু সেখানেও তাপমাত্রা কখনোই -৫০ কি বড়জোর -৬০ এর নিচে নামে না। -২৭৩ তা থেকে অনেক দূর। তবে বৈজ্ঞানিক প্রয়োজনে অনেক সময় গ্যাসকে গলাতে হয়( লিকিড হ্যাইড্রজেন, লিকিড হিলিয়ামের কথা অনেকেই শুনে থাকবেন) তাপ কমিয়ে, এত কম যে ধ্রুবশূন্যের কাছাকাছি চলে যায় কখনও কখনও। কেলভিনের শূন্য শুধু এই জানিয়ে দিচ্ছে, এর নিচে যাওয়ার উপায় নেই। তাঁর এই আবিষ্কার বিজ্ঞানের একটি নতুন শাখা সৃষ্টির পথ খুলে দিয়েছিল—যাকে বলা হয় থারমোডায়নামিক্স–তাপবলবিদ্যা। এই বিদ্যার প্রথম সবক হল প্রকৃতির একটা সহ্যসীমা আছে, যার বাইরে কোন জনপ্রানীরই যাওয়া সম্ভব নয়। সেখানে দণ্ডায়মান এক সর্বশক্তিমান সত্তা–সংসারের কঠোরতম দৌবারিক—ধ্রুবশূন্য। শূন্য সেখানে সশরীরে উপস্থিত। মজার ব্যাপার এক্যে কেলভিনের প্রায় দু’শ বছর আগে তাঁরই স্বদেশী সহবিজ্ঞানী, আইজ্যাক নিউটন, তিনি মানবজাতিকে পথ দেখিয়েছিলেন মহাশূন্যের, যেখানে গ্রহনক্ষত্রদের মেলা, যেখানে মানুষ তার চিন্তার রথে করে ঘুরে বেড়াতে পারে যেখানে খুশি সেখানে, বাধাবন্ধহীন মুক্ত বিহঙ্গদের মত ডানা মেলে উড্ডীন হতে পারে এক সীমানা থেকে আরেক সীমানায়। প্রকৃতির দুয়ার অবারিতভাবে উন্মুক্ত হয়ে গিয়েছিল তাঁর কাজের মধ্য দিয়ে। লর্ড কেলভিন তার দু’শ বছর দেখালেন প্রকৃতির এক ভিন্ন মূর্তি। দেখালেন এক দুয়ার খুলে দিয়ে প্রকৃতি কেমন করে আরেকটি বন্ধ করে রেখেছে চিরকালের জন্যে—চিরকালের জন্যেই তার গায়ে লেখাঃ এখানে প্রবেশ নিষিদ্ধ, এদুয়ার বিদ্ধ করে প্রকৃতির গুপ্তপুরির সন্ধান পাওয়া বস্তুজগতের সাধ্যের বাইরে।

‘ধ্রুবশূন্য’ এবং এজাতীয় আরো কিছু মৌলিক কাজের জন্যে উইলিয়ম ঠমসন ‘লর্ড’ উপাধিতে ভূষিত হয়েছিলেন ১৮৬৬ খৃষ্টাব্দে। বিজ্ঞানের ইতিহাসে তাঁর নাম স্বর্ণখচিত।
উল্লেখ্য যে ধ্রুবশূন্য আইডিয়াটির সূত্র ধরে একটি প্রাচীন আইডিয়া নতুন করে আত্মপ্রকাশ করে—গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস ( ৪৬০-৩৬০খৃঃপূঃ),এপিকিউরাস( ৩৪২-২৭০খৃঃপূঃ), এঁদের সেই দৃঢ় বিশ্বাস বস্তুর আণবিকতার ওপর, যার সবচেয়ে জোরালো প্রবক্তা ছিলেন লুক্রেসিয়াস(৯৮-৫৫খৃঃপূঃ)। অণু আবার বিজ্ঞানীদের মনোযোগ আকর্ষণ করতে শুরু করে।
প্রথম পর্যায়ে আসে তাপবলবিদ্যা, যা একটু আগেই উল্লেখ করলাম। নিউটনের বলবিদ্যার মত এই বলবিদ্যাও তিনটে প্রধান স্তম্ভের ওপর দণ্ডায়মান—এগুলোকে বলা হয় তাপবলবিদ্যার তিনসূত্র (three laws of Thermodynamics)। প্রথম সূত্রের মূল বক্তব্য হলঃ পেশিশক্তি বা যান্ত্রিক শক্তি (mechanical energy) মূলত একই জিনিস, একটি আরেকটিতে রূপান্তরিত হতে পারে, এবং শক্তির উত্‌স ছাড়া কোনকিছুই অনির্দিষ্টকাল চালু থাকতে পারেনা। অর্থাত্‌ নিজে নিজেই শক্তি উত্‌পাদন, সেটা সম্ভব নয়। মোদ্দা কথা, এসূত্রের মূলমন্ত্র হল শক্তির প্রাকৃতিক সংরক্ষণ(conservation of energy)।

এক হিসেবে ত্রিসূত্রের দ্বিতীয়টি, second law of thermodynamics বলে খ্যাত, হল গোটা বিষয়টিরই প্রাণ। এ থেকে অনেক শাখা প্রশাখা গজিয়েছে, ছড়িয়েছে নানাদিকে। এর প্রয়োগ সর্বত্র। এতে বিজ্ঞান আছে, গণিত আছে, এমনকি দর্শনও। এর অনেক রহস্য। এতে বলছে যে প্রকৃতি ভয়ঙ্কর একরোখা। সংসারে যা কিছু ঘটে সবেরই লক্ষ্য এক—শান্ত অবস্থাতে, বা সমতার (equilibrium)পরিস্থিতিতে পৌঁছানো। এসড়ক একমুখী—উল্টোদিকে যাবার উপায় নেই। এটা one-way। একটা বায়বীয় পদার্থকে যদি নিজের ওপর ছেড়ে দেওয়া হয়, অন্য কারো সঙ্গে কোনরকম সংস্পর্শের সম্ভাবনা না থাকে, তাহলে বেচারির একটাই গতি–একটা স্থিতাবস্থাকে লক্ষ্য করে সেদিকেই চোখকান বন্ধ করে ছোটা। ধরুণ ঘরের এক কোনাতে একটা কৌটার মুখ খুলে একটু রঙ্গিন গ্যাস ছেড়ে দিলেন। তারপর চেয়ে দেখুন গ্যাসটির মতিগতি। কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত ঘরের বাতাসের সঙ্গে মিশে নিজের রঙ তো হারাবেই, আলাদা কোন অস্তিত্বই বোঝা যাবে না তার। অর্থাত্‌ এই তার স্থিতাবস্থা–এতেই তার শান্তি। শুধু তার নয়, তার পরিপার্শ্বেরও।

এই যে একমুখি গতি প্রকৃতির, একে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন entropyর ক্রমবর্ধমান চরিত্র। এর কোনও বাংলা প্রতিশব্দ আছে কিনা জানিনা। আপাতত ‘এন্ত্রপি’ বলেই চালিয়ে দেব আমি। একে দাড়িপাল্লা দিয়ে মাপজোক করা যাবে না, সেই শক্তিরই মত। এর বৈশিষ্ট্য হল যতক্ষণ না স্থিতাবস্থা স্থাপিত হচ্ছে ততক্ষণ ওটা বেড়েই যাবে, বেড়েই যাবে, নিরন্তর।
এই বেড়ে যাওয়াটা, প্রকৃতির একটি দৃষ্টিগোচর বৈশিষ্ট্য হলেও, প্রকৃতির অন্যান্য নিয়মকানুনের সঙ্গে যে পুরোপুরি খাপ খায় তা নয়। যেমন নিউটনের গতিবিষয়ক ত্রিসূত্রের যে চিত্রটি আমরা একটু আগেই দেখলাম, সেতত্ব অনুযায়ী, একটা অনু যদি একসময় একটা বিশেষ দিকে ভ্রমণ করে কোনও কারণবশত, তাহলে তাত্বিকভাব্‌, তার কোনও বাধা নেই একটু পরে ঠিক বিপরীত দিকে চলতে শুরু করা। এটাকে বলা হয় reversibility—বৈপরীত্য। সূক্ষদৃষ্টিতে, আনবিক পর্যায়ে গতির কোন বিশেষ দিকবিচারের পক্ষপাতিত্ব নেই। অথচ উল্লিখিত উদাহরণটি যেন বলতে চাইছে যে প্রকৃতির বাহ্যিক ব্যবহার কিন্তু তা নয়—শিশি-থেকে-ছাড়া-পাওয়া সেই রঙ্গিন বাতাসের গোলাটি ঘরের বাতাসের সঙ্গে মিশে যাবার পর কোন অবস্থাতেই সে আর ঘরের কোনাটিতে ফিরে আসবে না, নিউটনের গতিতত্ব যা’ই বলুক না কেন। দুই তত্বে এই যে বিরোধ, বা আপাতবিরোধ, এর রহস্য উদ্ধার করবার ভাবনা নিয়েই জন্ম নেয় বিজ্ঞানের এক নতুন শাখা—পরিসাংখ্যনিক বলবিদ্যা (statistical mechanics)। এর প্রধান উদ্দেশ্য ধ্রুপদী অনুভিত্তিক বলবিদ্যা(classical mechanics) ও তাপবলবিদ্যা (thermodynamics), এদুয়ের মাঝে সেতু স্থাপন করে একটা বোঝাপড়া সৃষ্টি করা, দুয়ের মাঝে সমন্বয় সৃষ্টি করা। অর্থাত্‌ অনুর গতিবিজ্ঞান দিয়েই অনুসমূহের গতিপ্রকৃতির ব্যাখ্যা আবিষ্কার করা। অন্যভাবে বলতে গেলে reversibilityর আইনকানুনের সঙ্গে বাইরে থেকে প্রয়োজনীয় দুচারটে আইডিয়া যোগ করে(probabilistic concepts) সামগ্রিক গতির irreversibility কে যুক্তির আঙ্গিনায় প্রতিষ্ঠিত করা। পরবর্তী অধ্যায়ে এই বিষয়গুলো নিয়েই একটু সময় কাটাব। পাঠক হয়ত ভাবছেন এতে তো ‘শূন্য’ বা ‘অসীমে’র কোনও ভূমিকা দেখছি না। একটু ধৈর্য ধরুণ, ‘শূন্য’ যথাসময়ে দেখা দেবেই—অনাহুত অতিথির মত সে যখন তখন চলে আসে না বলেকয়েই।

আর হ্যাঁ, তাপবলবিদ্যার তৃতীয় সূত্রটি নিয়ে টুঁশব্দটি করলাম না, সেটাও হয়ত সজাগ পাঠকদের দৃষ্টি এড়ায়নি। এটি মূলত তাপমাপন যন্ত্র (যেমন নিত্যব্যবহৃত থারমোমিটার)তৈরি করার কি নিয়ম সে বিষয়টির বৈজ্ঞানিক রীতিনীতি। মজার ব্যাপার এক্যে এ আইনটিকেও মাঝে মাঝে ‘zeroeth law of thermodynamics’ বলে আখ্যায়িত করা হয়। কৌতূহলী পাঠককে তার বিস্তারিত বর্ণনার জন্যে বিজ্ঞানের বই ঘাটতে হবে।

আঠারো

পরিসাংখ্যানিক বলবিদ্যা বিষয়টি একটা নিজস্ব রূপ নিতে শুরু করে বলতে গেলে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে। কিন্তু এর মূল আইডিয়াগুলোর গোড়াপত্তন হয়েছিল অনেক আগেই, সেই গ্রীক আমল থেকেই বলা যায়, যার ইঙ্গিত আগেই দিয়েছিলাম আমি। তারপর সেসব আইডিয়া বিবর্তিত হতে হতে ড্যানিয়েল বার্নুলির হাতে বাস্পীয় গতিতত্ব (kinetic theory of gases) নামে প্রতিষ্ঠালাভ করে। এই তত্বের মূল ভিত্তি হল সেই আনবিক বিশ্বাস—সূক্ষ্ণ, অনুবীক্ষণদৃষ্টিতে পদার্থের মৌলিক রূপ হল কণা, অত্যন্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা, যা খালি চোখে দেখার কোন উপায়ই নেই, যা চিরচঞ্চল, চির অস্থির, যাদের সংখ্যা গুনিতব্যতার বাইরে, কোটি, অর্বুদ নির্বুদ, এজাতীয় কোন সংখ্যাই যাদের সঠিক পরিমাপ দিতে পারবে না। তবু অকাট্য এবং অখণ্ডনীয় বাস্তব হল যে পদার্থমাত্রই কনা—জল, বায়ু, পাথর, মানুষ, গাছ, ফুলের তোড়া, পাহাড়, নদী, যা কিছু দিয়ে রচিত হয়েছে এই বিশ্বভুবন। এই মৌলিক ধারণা থেকেই উত্‌পত্তি তাপবলবিদ্যার বিবিধ বিষয়গুলোর ব্যাখ্যা শুধু নয়, তাদের যৌক্তিক শৃঙ্গখলার মধ্যে সংগাবদ্ধ করবার প্রয়াস। যেমন বস্তুর ঘনত্ব বলতে কি বোঝায়? তাপই বা কি? চাপ? সান্দ্রতা(viscosity)? একটা জিনিস গরম বা ঠাণ্ডা হলে কি হয়? আবহাওয়ার খবরে বায়ুচাপ কমে গেলে বলা হয় ‘লোপ্রেসার’ অর্থাত্‌ বৃষ্টিবাদলের সম্ভাবনা। চাপ বেড়ে যাওয়া মানে মেঘ কেটে সব পরিস্কার হয়ে যাওয়া। এসবের পেছনে অনুপুঞ্জের কি ভূমিকা সেটাই হল বাস্পীয় গতিবিদদের গবেষণার বস্তু। ছোট্ট উদাহরণ দেওয়া যাক একটি—‘তাপ’এর সংগা কি? অণুরা চিরচলমান, একমুহূর্তও থেমে নেই তারা। কিন্তু সংখ্যায় এত বিশাল তারা যে নড়তে গেলে একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা লাগতে বাধ্য—একটা এক ঘনমিলিমিটার মাপের কৌটোর ভেতর আনুমানিক ২.৭৫*(১০)^(১৬)টি কণা বা মলিকিউল আছে বলে ধারণা করা হয়, স্বাভাবিক তাপ এবং বায়ুচাপের পরিবেশে। ষোলটি শূন্য বসিয়ে সংখ্যাটি লেখার চেষ্টা করুন, আপনার ঘাম ছুটে যাবে (১০ভিত্তিক গণনাপদ্ধতির বিরাট সুবিধার মধ্যে এই একটি)। চিন্তা করুণ, গোটা বিশ্বব্রম্মাণ্ডে কত কণা আছে! কথা হল ধাক্কা লাগার পর কি হয় কণাগুলোর? তারা অন্যদিকে চলে যায়। অন্যদিকে আবার ধাক্কা খায়, ক্রমাগত ধাক্কা খেয়েই যাচ্ছে। যতই ধাক্কা খায় ততই তাদের উত্তেজনা বাড়ে, অর্থাত্‌ গতিবেগ বাড়ে। যতই গতি বাড়ে ততই বাড়ে ধাক্কার মাত্রা। এভাবে একটা হুলস্থুল বেধে যায় তাদের মধ্যে। তার ওপর বাইরে থেকে যদি আরো উস্কানি দেওয়া হয় (উত্তেজনা বাড়ানোর মত কোন বিশেষ তেজ প্রয়োগ, যেমন চুলায় আগুন ধরানো), তাহলে তো কথাই নেই। মহা উত্তেজিত হয়ে তারা চতুর্দিকে ছুটোছুটি করতে শুরু করবে। এই যে উত্তেজিত হয়ে ছোটা, সেটা যদি কোনভাবে মাপার উপায় থাকত তাহলে দেখতেন কণাগুলোর গতির একটা গড়মাত্রা আছে—সেই গড়ের চারপাশে যে এলোপাথাড়ি (random) ছুটোছুটি করা তার গড়কেই বলা হয় ‘তাপ’(এই গড় নির্ধারণ করারও একটা নিয়ম আছে, নির্ভর করে কণাগুলোর কি বৈশিষ্ট্য, কোন্‌ পদার্থের কনা তারা, ইত্যাদি)। মোটকথা, তাপ হল উত্তেজিত কণাসমূহের উত্তেজনামাত্রার একটা গড় পরিমাপ। উত্তেজনা কমে গেলে তাপ পড়ে যায়। সেকারণে কোথাও আগুন লাগলে চারদিকের দালানকোঠা, বায়ু জল গাছ প্রানী সব গরম হয়ে ওঠে—আবার জল ঢাললেই শান্ত হতে শুরু করে। সবই সেই উত্তেজনার উঠানামার ব্যাপার।

পাঠক যেন ভেবে না বসেন যে অণুপুঞ্জের গতি দিয়ে তাপ ব্যাখ্যা করা যত সহজ অন্যগুলোকে হয়ত তত সহজে ব্যাখ্যা করা যায়না। অবশ্যই যায়। শুধু জানতে হয়, সেই ‘গড়’ নেওয়া ব্যাপারটা কি। সাধারণ কতগুলো গাণিতিক সংখ্যার গড় আর এই গড় ঠিক এক নয়—খানিক টেকনিকেল বিষয় আছে এতে। ওই পথ না হয় এড়িয়েই যাই আজকে। হাজার হলেও আমি লিখছি ‘শূন্য’ নিয়ে—এখানে পরিসংখ্যানবিদ্যার খুঁটিনাটি নিয়ে ঘাঁটাঘাটি না করলেও চলে।

বিশ্বসৃষ্টির মূল চারটে উপাদান—মাটি, জল, বায়ু, অগ্নি। কথাটা বোধ হয় এরিস্টটোলই প্রথম বলেছিলেন। এর সবকটিই জীবজগতের জন্যে অবশ্যপ্রয়োজনীয়— একটা গ্রহে যে জীবিত কিছু থাকা সম্ভব তার প্রধান পরীক্ষাই এ উপাদানচতুষ্টয়ের উপস্থিতি কেবল নয়, প্রাচুর্যও। আমাদের বর্তমান আলোচনার জন্যে প্রথম তিনটে উপাদানের মূল উপকরণের মধ্যে যে কণার প্রাধান্য আছে সেটা হয়ত খুব দুর্বোধ্য নয়—কে জানে হলে হতেও পারে। চামড়ার চোখে যখন দেখবার উপায় নেই, এমনকি অত্যাধুনিক অনুবীক্ষণ যন্ত্র দিয়েও দেখা সহজ নয়, তখন বড় বড় বৈজ্ঞানিকদের মুখের কথা বিশ্বাস ছাড়া উপায়ই বা কি আমাদের। কিন্তু যেটা কিছুতেই বিশ্বাস হবার নয়, মনে হবে এর চেয়ে বড় ধাপ্পা আর হতে পারেনা (আমরা কিছু বুঝিসুঝিনা বলে মাথায় হাত বুলিয়ে বোকা বানানোর চেষ্টা হচ্ছে), সেটা হল আলো, যা আমরা সূর্য থেকে পাই, যা বাতাসের মত কখনও শান্ত কখনও উতাল, যা পানির মত নদীনালা ভরে রাখেনা, যা মাটির মত শক্ত নয়, তাতে আবার কণা থাকতে পারে কেমন করে। এবং অনেকটা সেকারণেই, অন্য তিনটি উপাদান থেকে সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র তার প্রকৃতি, তাই আলো ছিল চিন্তাবিদ, দার্শনিক আর বিজ্ঞানীদের চিররহস্যের বিষয়। একেক যুগে একেক মণীষী আলোর একেকটি দিক নিয়ে তাঁদের ধ্যানধারণা ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু আলো জিনিসটা আসলে কি সে রহস্যের মোড়ক উদ্ঘাটন হতে বেশ কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়েছে বিজ্ঞানজগতকে। রেনেসাঁর ইউরোপেই সম্ভবত প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ হতে শুরু করে আলোর ওপর। আইজ্যাক নিউটনের অন্যতম নেশাই ছিল আলো নিয়ে নানারকম পরীক্ষা নিরীক্ষা করা। তিনি কৌতূহলী হয়ে উঠলেন কাচের ভেতর দিয়ে আলো প্রবেশ করার পর কি হয় তা দেখতে। সাধারণ কাচ দিয়ে চমকদার কিছু দেখা যায়না বলে তিনি একটা ত্রিকোনী কাচ(prism) নিয়ে তাতে আলো ফেললেন। ওমা! জাদুর মত ঘটনা ঘটতে শুরু হয়। সাদা আলো নানা রঙ্গে ছড়িয়ে পড়ে—-একটি নয় দুটি নয়, পাকা সাতটি রঙ, লাল থেকে শুরু করে নীল বেগনি পর্যন্ত। দারুন মজার ব্যাপার। ঠিক যেমন করে বর্ষার পর কখনো কখনো আকাশ জুড়ে রংধনু ছড়িয়ে পড়ে নানারঙ্গের পুচ্ছ ধারণ করে। আলো আর ত্রিকোনী কাচের এই মজার খেলা তাঁর আগে কারো চোখে পড়েনি, কিন্তু এটা ছিল আলোবিজ্ঞানের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার। এই নানা রঙ্গে ছড়িয়ে পড়ার ব্যাপারটির একটা ব্যাখ্যা পাওয়া গিয়েছিল পরে, কিন্তু নিউটন নিজে যা ভেবেছিলেন তা থেকে স্বতন্ত্র। তাঁর ধারণা ছিল অন্যান্য বস্তুর মত আলোও অণু দিয়ে তৈরি। আলোর ভেতর দিয়ে যাবার সময় বিভিন্ন জাতের কণা ভিন্ন ভিন্ন গতিতে ভিন্ন ভিন্ন পথে চলে যায় বলেই নানা বর্ণের শোভা ছড়িয়ে পড়ে চতুর্দিকে। কিন্তু এই অণুতত্ব মনঃপূত হয়নি ইউরোপের সমসাময়িক পদার্থবিজ্ঞানী-জ্যোতির্বিদ ক্রিশ্চিয়ান হাইগেন্সের(১৬২৯-১৬৯৫)। নেদারল্যাণ্ডসে জন্মলব্ধ এই অসাধারণ মানুষটিরও ছিল বহুমুখী প্রতিভা, যিনি ষোল বছর বয়সেই সেসময়কার সবচেয়ে প্রভাবশালী ইউরোপিয়ান দার্শনিক-বিজ্ঞানী-গাণিতিক ডেকার্টের কিছু কাজকর্মের ভুলভ্রান্তি ধরতে পেরেছিলেন, যদিও সেটা প্রকাশ্যে প্রচার করার মত সাহস তখনো হয়নি তাঁর। আলোর প্রকৃতি নিয়ে তাঁরও দারুণ কৌতূহল ছিল। বেশ কিছু মূল্যবান কাজও করে গেছেন তার ওপর। তাঁর মতে আলোর বৈশিষ্ট্য অণু নয়, তরঙ্গ। ঠিক কিসের তরঙ্গ তা অবশ্য আবিষ্কার হয়নি তখনও, সেটা পুরোপুরি উদ্ঘাটন হতে আরো অনেক সময় লেগেছিল। যাই হোক কণা না ঢেউ এ নিয়ে বিলেত আর ইউরোপে বড়রকমের কোনও বিতর্ক সৃষ্টি হয়ে যায়নি যেমনটি হয়েছিল ক্যালকুলাসের আবিষ্কার নিয়ে। তার প্রধান কারণ, আলোর প্রকৃতি নির্ভুলভাবে বুঝতে হলে যেসব পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে হয় তার উপযোগী যথেষ্ট যন্ত্রপাতি তখনো আবিষ্কার হয়নি।
তবে আলোকরশ্নির একটা বৈশিষ্ট্য ধরা দিয়েছিল টমাস ইয়াং(১৭৭৩-১৮২৯) নামক এক ব্রিটিশ পদার্থবিদের কাছে—যা থেকে তার তরঙ্গতার সপক্ষে একটি বড় যুক্তি দাঁড় হয়ে যায়। এই ভদ্রলোকও শুধু পদার্থবিজ্ঞান নিয়েই পড়ে থাকতেন না—আরো একটা বড় গুণ ছিল তাঁর। একদিকে এডিনবার্গ আর কেম্ব্রিজ থেকে ছিল বিজ্ঞানের ডিগ্রি, আবার জার্মানীর গেটিঙ্গেন থেকে মেডিক্যাল ডিগ্রি ১৭৯৬ সালে। উপরন্তু তিনি ছিলেন নামকরা মিশরবিশারদ পণ্ডিত। সেকালের মানুষ বর্তমান যুগের মত অতিবিশেষত্বের বাতিকে ভুগতেন না বলেই হয়ত তাঁদের বিশ্বদৃষ্টি ছিল বিশ্বব্যাপীই বিস্তৃত।

এখন বলি তরঙ্গের এই ‘পরস্পরের সঙ্গে ঘাতসঙ্ঘাত’ ব্যাপারটা কি। বৈজ্ঞানিক ভাষায় একে বলা হয় Interference (ব্যতিচার)। একটা উদাহরণ দিয়ে বুঝাবার চেষ্টা করা যাক। বস্তুজগতে যে তরঙ্গ আছে তা চামড়ার চোখে দেখবার সবচেয়ে সহজ উপায় হল কোনও জলাশয়ের সামনে দাঁড়ানো—ক্ষুদে ক্ষুদে খালবিলেতেও ঢেউ ওঠে, যত ছোটই হোক সে ঢেউ। শান্ত পুকুরে একটা ঢিল ছুঁড়ুন। কি হবে? ঢিলটি টুপ করে পড়ার সাথে সাথে পরিপার্শ্বের জল খানিক উত্তেজিত হয়ে উঠবে, এবং সে উত্তেজনা (তেজ, energy) ঢেউএর আকারে ছুটবে চারদিকে, নিখুঁত বৃত্ত রচনা করে, যেন মা-প্রকৃতির কাছ থেকে এমনি করে সার বেঁধে চলারই শিক্ষা গ্রহণ করে এসেছে তারা। একমুহুর্ত পরে আরো একটা ঢিল ছুঁড়ুন প্রায় একই জায়গা তাক করে। এবার কি দেখা যাবে? দ্বিতীয় ঢিলটি দ্বিতীয় বৃত্তমালা সৃষ্টি করবে। দুটি ঢিলের দুটি বৃত্তস্রোত যখন একসাথে মেলে তখন কি চোখে পড়বে? ভাল করে খেয়াল করলে দেখা যাবে কোন কোন জায়গায় ছোট ছোট ঢেউগুলো একসাথে মিলে বেশ বড়সড় একটা ঢেউ বানিয়ে ফেলেছে, আবার কোথাও তারা পরস্পরের ‘পায়ে ল্যাং মেরে’ দুজনই কাত হয়ে পড়ছে, অর্থাত্‌ কোন ঢেউই থাকছে না। দুটি পাশাপাশি মোটরবোটের পেছন-ফেলা ঢেউরাশির মাঝামাঝি একটা জায়গাতে লক্ষ্য করলে মনে হবে, লঞ্চ বা নৌকা কোনকিছুরই আনাগোনা ছিল না সে জায়গাটুকুতে বিগত সময়টুকুর মধ্যে। এই ঘটনাটির বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হল এই যে, ব্যতিচার প্রণালীতে দুটি ঢেউ যখন একই কলাতে(phase) চলে তখন তাদের সম্মিলিত তেজ বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হয়, যাতে করে ঢেউএর উচ্চতাও বেড়ে যায়। কিন্তু যখন কলাবৈষম্য ঘটে তখনই তারা পরস্পরের গতিপথ রুদ্ধ করে দেয়, একহিসেবে, যার ফলে দুটি ঢেউএর কোনটিরই নিজস্বতা বজায় থাকে না। এটা শুধু পানিতে নয় শব্দেও লক্ষ্য করা যাবে, কারণ শব্দও একপ্রকার ঢেউ। শব্দতরঙ্গের জারক ও বাহক হল বায়ু—বায়ুতে চাপ দিলে কুঁচকায়, চাপ তুলে নিলে ফাঁপে (অনেকটা হাপরের মত)। এই চাপা-ফাঁপা থেকেই সৃষ্টি হয় শব্দের শক্তি—যা সৃষ্টি করে বায়ুকম্পন এবং যার ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য বহিঃপ্রকাশ ঘটে শব্দরূপে। শব্দতরঙ্গের সবচেয়ে নাটকীয় প্রদর্শনী দেখতে চাইলে একটা পশ্চিমা অর্কেস্ট্রাতে যান, দেখবেন কত বিচিত্র তরঙ্গের কত বিচিত্র ধ্বনি কেঁপে কেঁপে ঊঠছে হাজারটে বাদ্যযন্ত্র থেকে, কত সহস্র ব্যতিচার (out of phase) আর সমচার (in phase) তরঙ্গ মিলে রচনা করে যাচ্ছে এক সম্মোহনী সুরের জগত।

অনুরূপ ঘটনা ঘটে আলোর জগতেও—শুধু খালি চোখে সে ঢেউ দেখবার কোনও উপায় নেই। খালি চোকঝে যেটা দেখবার উপায় আছে সেটা হল রঙের বাহার—সাদারঙ, লাল, কালো, হলুদ, সবুজ, নীল, বেগনি। একটাতে চোখধাঁধানো রক্তিম উজ্জ্বলতা, আরেকটাতে শীতল কোমলতা। আরো একটি গায়ে লাগলে চামড়া পোড়ার উপক্রম হয়। এদের একেকটির একেক বৈশিষ্ট্য তাদের ভিন্ন ভিন্ন ‘দৈর্ঘ্যের’ জন্যে। আজকাল সবার বাড়িতেই নানারকম ইলেক্ট্রনিক দ্রব্যের ছড়াছড়ি—আমাদের দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি মুহুর্তই বলতে গেলে হাজাররকম ওয়েভলেংথ আর ফ্রিকুয়েন্সির ঝোপঝাড়ে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে। বাড়ির পেছনে ফুলের বাগান করে রঙের বৈচিত্র্য সৃষ্টি করবার উপায় হয়ত নেই আগের মত, কিন্তু শব্দ ও আলোকরশ্মির তরঙ্গবৈচিত্র্য দিয়ে বাসগৃহের তরঙ্গকানন অবশ্যই আমরা কানায় কানায় পূর্ণ করে রাখতে পারছি।

আইজ্যাক নিউটন তাঁর ত্রিকোণী-কাচের-কুহরে-ফেলা শুভ্র আলোর সপ্তবর্ণে বচ্ছুরিত হয়ে যাবার তাত্‌পর্য এই ছিল যে সাদা আলোর মাঝেই আছে নানাবর্ণের আলোকণার বীজ—যাদের একেক্টির একেক দৈর্ঘ্য থাকার কারণেই একেক রঙের পুচ্ছ ধারণ করে স্বচ্ছ কাচের ঘন মাধ্যম দিয়ে প্রবেশ করবার পর। এই রঙ্গগুলো আমরা চোখে দেখতে পাই এবং এরা আমাদের চোখের কোন ক্ষতি করে না, কারণ এরা অপেক্ষাকৃত মাঝামাঝি দৈর্ঘ্যের ঢেউ যাদের তেমন ক্ষতিকর উপকরণ নেই। সবচেয়ে বাড়া হল লালের দৈর্ঘ্য, এবং দৃষ্টিসীমার সবচেয়ে হ্রস্ব হল বেগনি। আলোকরশ্মির দৈর্ঘ্য মাপার বৈজ্ঞানিক একক হল ‘এংস্ট্রম’ (সুইডিশ বিজ্ঞানী এ যে এংস্ট্রমের (১৮১৪-১৮৭৪)নামানুসারে), অর্থাত্‌ ১০^(-১০) মিটার। ব্যবহারিক বিজ্ঞানে আজকাল ‘নেনোমিটার’ও ব্যবহার করা হয়। ১ নেনোমিটার মানে ১/১০০০,০০০,০০০মিটার। সেহিসেবে লাল রঙের দৈর্ঘ্য হল ৭০০ নেনোমিটার, আর বেগনির ৪০০। বেগনিরও রকমফের আছে—৪০০এর নিচে চলে গেলেই যাকে বলে short wave (হ্রস্বতরঙ্গ) এর রাজ্য চলে আসে। এগুলো খালি চোখে দেখবার উপায় নেই। এদের মধ্যে সবচেয়ে পরিচিত যে কটি নাম তার মধ্যে এক্সরে আর আল্ট্রাভায়োলেটের কথা আমরা নিত্যই শুনে থাকি। ওদিকে আবার লালের চেয়ে লম্বা ঢেউ হলেও বিপদ—সেগুলোও আমাদের দৃষ্টিসীমার বাইরে, এবং প্রায় একইরকম ক্ষতিকর। Infrared, microwave, এগুলো হল লম্বা তরঙ্গের উদাহরণ। গায়ে লাগলে এরা যে কত ক্ষতি করতে সেটা কাউকে বলে দিতে হবে না।
এবার আমরা মূল বিষয়টির কাছাকাছি পৌঁছে গেছি। লম্বা আর খাটো ঢেউ বলতে কি বোঝায়? পানির ঢেউ নাহয় খালি চোখেই দেখতে পারি, ঢেউগুলো কিভাবে উঠানামা করছে তা পরিস্কার দেখা যায়, কিন্তু শব্দ আর আলোর ঢেউ চোখে দেখব কি করে? ওগুলোর দৈর্ঘ্য বলতে কি বোঝায়? তার একটা ভাসা ভাসা ধারণা পেতে চাইলে মনে মনে একটা পাহাড়ি অঞ্চলের ছবি আঁকুন, যেখানে অনেকগুলো উঁচুনিচু টিলা আছে। টিলাগুলো নড়ছে না বটে, কিন্তু দূর থেকে দেখতে তো ঢেউএর মতই মনে হবে। এবার কল্পনা করুন দুটি পাশাপাশি ঢেউএর মাঝের দূরত্বটুকু—পাহাড়ের ওপর এর কোন পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু বাতাসেও ঠিক এমনিরকম ঢেউ তৈরি হচ্ছে নিত্যনিয়ত, শব্দ এবং আলো উভয়ক্ষেত্রে। এই যে দুটি লাগালাগি ‘টিলা’ তাদের যে দূরত্ব তাকেই বলা হয় ওয়েভলেংথ। প্রকৃতির বৈশিষ্ট্যই হল যে ৪০০ এর নিচে আর ৭০০ এর ওপরে যে তরঙ্গের আলো সেগুলো দৃষ্টিগোচর নয়, এবং সেগুলো সাধারণ ব্যবহারের জন্যে খুব উপযোগী নয়।

ঊনিশ

পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক। এই যে ছোট ঢেউ আর বড় ঢেউএর কথা বলছি, যা চোখে দেখা যাচ্ছে না, এদের দৈর্ঘ্য নাহয় মানা গেল, কিন্তু তার তাত্‌পর্যটা কোথায়? তাত্‌পর্য হল দুটির দুরকম তেজ(energy)। দৈর্ঘ্যে যত ছোট হয় ততই তাদের কম্পনাঙ্ক (frequency), যার ফলে ততই তাদের তেজবিক্রম। তেজ না হলে কাঁপুনির মাত্রা বাড়বে কেমন করে। আল্ট্রাভায়োলেট, যা আমরা চোখে দেখি না, অথচ সারাদিন রোদে পুড়লে আল্ট্রাভায়োলেত রস্নি গায়ে লেগে চামড়ার সমূহ ক্ষতি হবার সম্ভাবনা। মাত্রাতিরিক্ত রঞ্জনরশ্নি(X-ray) গায়ে লাগলে তার যে বিকিরণশক্তি সেটা একসময় ক্যান্সাররূপে দেখা দিতে পারে। যাই হোক, মাঝারি দৈর্ঘ্যের দৃষ্টিগ্রাহ্য রশ্মিগুলো, লাল থেকে বেগনি, সেগুলো সাধারণ সাদা আলোর উপকরণ হওয়াতে সাদা আলো যখন বর্ষাস্নাত আকাশে রঙ্গধনুর বর্ণালীতে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে, তখন কবির চোখে পড়ে আকাশজোড়া রঙের খেলা, আর বিজ্ঞানী দেখেন মেঘেরা কি অদ্ভূত উপায়ে সারে সারে দাঁড়িয়ে গেল ত্রিকোণী কাচের আকার নিয়ে। সাদার মাঝে লুকিয়ে থাকা নানা দৈর্ঘ্যের নানা রঙ নিজ নিজ পথে নিজ নিজ গতিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ল। কিন্তু সমদৈর্ঘ্য হলে কি হবে, তাদের সেই পরস্পরের পথ রুখে (interference) রাখার স্বভাব দূর হবার নয়। সেটাই লক্ষ্য করেছিলেন ইয়াং সাহেব তাঁর ১৮০১ সালের পরীক্ষাতে। পুকুরের জলে কাছাকাছি দুটি ঢিল ছুঁড়লে ঢেউগুলোর যে দশা হয় আলোতেও অনেকটা একই রকম ঘটনা ঘটে। একটা মোমবাতি জ্বালুন ঘরে। অদূরে একটা পিচবোর্ডের বড়সড় পাত দাঁড় করিয়ে ছোট্ট একটা ছিদ্র করুন মাঝখানে। সেই ছিদ্রের অপরপাশে আরো একটা পাত দাঁড় করান, ছিদ্রমুক্ত। দেখবেন ওদিকের মোমবাতির আলো এসে এদিকের পর্দাটিকে আলোময় করে তুলল, এবং সে আলোতে কোনও ফাঁকফোকর নেই। এবার এক কাজ করুন— ওই ছিদ্রটির খুব কাছে আরো একটি ছিদ্র করুন, তারপর দেখুন, বেশ মনোযোগ দিয়ে দেখুন, ওপাশে কি হচ্ছে। দেখবেন যে দুটি ছিদ্র দিয়ে ঢোকার পর আলোরেখাগুলো অনেক জায়গায় পরস্পরের সঙ্গে সহযোগিতা করে উজ্জ্বলতর করে তুলছে জায়গাটা, আবার কোন কোন জায়গায় পরস্পরকে বাধা দিয়ে একেবারে অন্ধকার সৃষ্টি করে ফেলছে। এই হল ইন্টারফেরেন্সের লক্ষণ। এতে কি প্রমাণ হয়? আলো যদি ইটপাথরের মত কণাজাত হত তাহলে কি এরকম আচরণ হত তাদের? মনে হয়না। সুতরাং এ-পরীক্ষা ঊনবিংশশতাব্দীর পদার্থবিদ্যা জগতে বদ্ধমূল বিশ্বাস এনে দেয় যে আলো আসলেই একপ্রকার ঢেউ। সুতরাং হাইগেন্সের ধারণাই ঠিক, নিউটনেরটি নয়। ঠিক কিধরণের ঢেউ সেটা আবিষ্কার হয় আরো খানিক বাদে—-এ হল তড়িত্‌-চৌম্বিকতরঙ্গ, যার প্রকৃতি শব্দতরঙ্গের চেয়ে আলাদা। শব্দ চলে সোজাসুজি, একেবারে নাক বরাবর(longitudinal), আর আলো যায় আড়াআড়ি (transverse),তাড়চা পথে । অর্থাত্‌ তেজ ছোটে একদিকে, আর ঢেউ চলে তার সমকোণে। এই তরঙ্গতত্বটি বিজ্ঞানজগতের অকাট্য বেদবাক্যের রূপ ধারণ করে ঊনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে। শুধু তাই নয়। পদার্থের অণুতত্বে বিশ্বাসী, এবং অণুবিশ্বাস দিয়ে প্রকৃতির যাবতীয় ঘটনাসমূহের ব্যাখ্যাদানের যে প্রচেষ্টা পরিসংখ্যানতাত্বিকদের, সেই বিশ্বাসের সঙ্গেও এর সুন্দর সংহতিপূর্ণ সমন্বয় সৃষ্টি হয়ে যায়। অণুতাত্বিকদের মতানুযায়ী বস্তুর দ্রুতচারী কণাগুলো চলার বেগে তেজের তরঙ্গমালা সৃষ্টি করে কোন-না-কোনও ভাবে, যার বহিঃপ্রকাশ ঘটে আলোর বিকিরণে। কণা যত গতিশীল তত তাদের তাপ, তত তাদের তেজোশক্তি, এবং ততই তাদের আলোবিকিরণ। এ-দুয়ের মাঝে সেতু বেঁধে দেওয়া হয় লুডভিগ বলজম্যান (১৮৪৪-১৯০৬) ও জোসেফ স্টেফান (১৮৩৫-১৮৯৩)নামক দুই অস্ট্রিয়ান পুদার্থবিদ দ্বারা—তাঁদের তত্বটি স্টেফান-বলজম্যান সূত্র নামে পরিচিত। এই সূত্র অনুযায়ী একটা ‘আদর্শ বস্তু’(ideal body) যাকে কৃষ্ণদেহী(black body)বলে আখ্যায়িত করা হয় বিজ্ঞানে, তার বিকিরণের পরিমাণ হল ওটির যে তাপমাত্রা তার চারঘাতি অনুপাতে(fourth degree)। উদাহরণস্বরূপ, তার অর্থ তাপ যদি হয় ২ ডিগ্রি, বিকিরণ হবে ১৬। তদানীন্তন বিজ্ঞানের পরিপ্রেক্ষিতে এ ছিল আলোর তরঙ্গতত্ব ও পরিসংখ্যানতত্বের পরম মিলনসূত্র। এতে শুধু কতখানি আলো বিকীর্ণ হচ্ছে তাই নয়, সাথে সাথে কতটা তাপ সৃষ্টি হচ্ছে সেটাও প্রকাশ পাচ্ছে। কথিত আছে যে এ-সূত্রের সাহায্যে কোনও এক ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি অঙ্ক কষে বের করেছিলেন যে স্বর্গের আনুমানিক তাপমাত্রা হল ৫০০ ডিগ্রি (ধ্রুবস্কেলে)!

কিন্তু কণাবিজ্ঞান আর আলোবিজ্ঞানের এই মধুর মিলনসম্পর্ক দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। ব্রিটেনের লর্ড রেলে আর স্যার জেমস জিন্সের একটি পরীক্ষায় পূর্ববর্তী তত্বের আংশিক সমর্থন ছিল বটে, সাথে সাথে কতিপয় প্রশ্নও দাঁড় করিয়ে দেয়। তাঁরা মাঝারি মাপের ঢেউ নিয়ে কাজ করেছিলেন বলে তাঁদের প্রদত্ত সূত্রটি ঢেউ ছোট হলে যে তাপ অতিমাত্রায় বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে সেটা পুরোপুরি ধরা পড়েনি। তবে যেটা ছিল সুস্পষ্টভাবেই সেটা হল বিপদের আভাস—সত্যি তো, তরঙ্গের দৈর্ঘ্য যদি কমতে কমতে শূন্যের দিকে ধাবিত হয় তাহলে তাপমাত্রাও বাড়তে বাড়তে সীমার বাইরে চলে যাবে? তাহলে তো সর্বনাশ। কেয়ামতই এসে যাবে—বিশ্বজগত সব পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে।‘শূন্য’ আর ‘অসীম’ আবার এসে উঁকি মেরে জানান দিল তাদের উপস্থিতি। এই ভয়াবহ সম্ভাবনাকে বিজ্ঞানীরা নাম দিয়েছেন ultraviolet catastrophe( রঙ্গোত্তরের বিপর্যয়)।

আশু মহাবিপর্যয়ের সম্ভাবনা কোনও সত্যিকার বিজ্ঞানমনা মানুষের চিন্তায় গ্রহণযোগ্য মনে হবে না।সুতরাং গণ্ডগোলটা নিশ্চয়ই প্রকৃতিতে নয়, বিজ্ঞানের বিশ্বাস-অবিশ্বাসের মধ্যে। এই সমস্যার সমাধান খুঁজতে খুঁজতেই পদার্থবিদরা আবিষ্কার করলেন কুন্টাম বলবিদ্যা নামক সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র একটি বিষয়, যা সাধারণ বুদ্ধিকে হার মানায়, আদিকালের সমস্ত অভ্যস্ত ও চিরাচরিত বিশ্বাসকে প্রতিহত করে, বিজ্ঞানবহির্ভূত জগতকে হতভম্ব করে দেয়। এই তত্বের আদিজনক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় জার্মানীর ম্যাক্স প্ল্যাঙ্ক( ১৮৫৮-১৯৪৭) নামক এক সূক্ষদর্শী পদার্থবিজ্ঞানীকে, যদিও জ্ঞানবিজ্ঞানের কোন ক্ষেত্রেই কোনও বিশেষ ব্যক্তিকে তার একক জনক হিসেবে চিহ্নিত করা খুব বিচক্ষণ বলে গণ্য করা হয়না, যার ইঙ্গিত আগেই দেওয়া হয়েছে একবার।

ম্যাক্স প্লাঙ্ক গোড়া থেকে নিশ্চিত ধারণায় ছিলেন যে রেলে-জিন্সের সহজ সমীকরণ হয়ত একটু অতিরিক্ত সহজ, যা সব ক্ষেত্রে সমান প্রযোজ্য সম্ভবত নয়। এটা কোনক্রমেই বিশ্বাসযোগ্য হতে পারেনা যে তরঙ্গের দৈর্ঘ শূন্যতে পৌঁছানোর অবস্থা দাঁড়াবার সাথে সাথে তার তেজ বেড়ে আকাশ ছোঁবার অবস্থায় এসে যাবে। রেলে-জিন্সের সূত্র ব্যবহার করতে গিয়ে যদি পৃথিবী ধংস হয়ে যায় তাহলে তো মুস্কিল। সুতরাং কিছু একটা করা দরকার। একটা নতুন কিছু, একটা মৌলিক কিছু। আপাতদৃষ্টিতে রেলে-জিন্সের সূত্রে বিজ্ঞান অনুযায়ী কোন ফাঁকফোকর দেখা যাচ্ছে না, অর্থাত্‌ প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান দিয়ে এর সমাধান খোঁজা অর্থহীন। তিনি ঠিক করলেন, রেলে-জিন্স যে বিজ্ঞানের ওপর প্রতিষ্ঠিত সে-বিজ্ঞানই ভুল। পরমাণবিক জগতে হয়ত সেবিজ্ঞান অচল। বড় আকারের পদার্থজগত যে নিয়ম কানুন মেনে চলে, ছোট কণাদের জগতে সে নিয়ম অকেজো। ম্যাক্স প্লাঙ্ক এক দুঃসাহসী চিন্তা প্রশ্রয় দিলেন নিজের মনে—ছোট কণারা বড়দের মত একটানা রাস্তায় গড়িয়ে গড়িয়ে চলে না, তারা চলে অনেকটা লাফিয়ে লাফিয়ে, ব্যাং যেমন করে চলে। সাধারণ বুদ্ধিতে এটা কল্পনা করা কঠিন, কারণ আমরা থাকি বড়দের পৃথিবীতে, সুতরাং আমরা বড়দের আইনকানুনেই অভ্যস্ত। আমাদের পক্ষে কল্পনা করা শক্ত যে, মনে করুন, একটা গাড়ির গতিবেগ শূন্য থেকে এক লাফে দশ মাইল বেগে উঠে যাবে, তারপর যত চেষ্টাই করুন, দশ থেকে আস্তে আস্তে ওপরে উঠতে উঠতে এগারো বারো ইত্যাদিতে না গিয়ে চলে যাবে কুড়িতে, তারপর চুপচাপ, পরে হঠাত্‌ করে ত্রিশ। এমন অদ্ভুত কাণ্ড কেউ শুনেছে কোনদিন? না, আমাদের বাপদাদা চোদ্দপুরুষের কেউ শোনেনি। শোনেনি কারণ এরকম ঘটনা ছোটদের রূপকথার বই ছাড়া আর কোথাও পাওয়া যাবে না। কিন্তু জার্মানীর সেই দুঃসাহসী যুবক ঠিক সেই প্রস্তাবই পেশ করলেন বিজ্ঞানজগতে এবং তাঁর সপক্ষে যুক্তি দাঁড় করালেন এই বলে যে এই ধারণার ভিত্তিতে যে ফলাফল তিনি পেয়েছেন সেটা বৈজ্ঞানিক তথ্যের সঙ্গে হুবহু মিলে যায়—রেলে-জিন্সের সীমাহীন তেজবৃদ্ধির পরিবর্তে একটা পর্যায়ে গিয়ে তেজ আসলে বাড়ার বদলে কমতে শুরু করে। এই ব্যাপারটিকে নামকরণ করা হল ‘কুয়ান্টাম’(quantum) বলে। পরমাণবিক পর্যায়ে বস্তুজগতের বাস্তবতা ভিন্ন আইনের বশবর্তী হয়—সেখানে অণুকণার গতিবিধি, তাদের তেজশক্তি, নিরবচ্ছিন্নতার চরিত্র হারিয়ে খণ্ডীভূত, কাটাকাটা চিত্র ধারণ করে। সেখানে পৃথিবী খোপে খোপে ভাগ করা, এক খোপ থেকে আরেক খোপের মাঝে একটা ফাঁক আছে। তেজের বেলায় এই ‘খোপ’গুলোকে বলা হয় এনার্জি লেভেল—গ্যাস পেডেলে যত চাপই দিন না কেন গাড়ির গতিবেগ শূন্য থেকে এক লাফেই হয়ত দশে উঠে যাবে, ক্রমে ক্রমে প্রতিটি অঙ্ক পার হয়ে উঠবে তা নয়।
অষ্টাদশ আর উনবিংশ শতাব্দীর সুপ্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানজগতে এধরণের আজগুবি চিন্তার কোন প্রশ্রয় ছিল না। তাঁরা ম্যাক্স প্লাঙ্কের বৈজ্ঞানিক গবেষণার প্রশংসা করতে কার্পণ্য করেননি, কারণ তাঁর তত্ব অনুযায়ী রেলে-জিন্স সমস্যার সন্তোষজনক সমাধান তো ছিলই তাতে, কিন্তু তাঁরা প্লাঙ্কের গাঁজাখুরি তত্ব বেদবাক্য হিসেবে মেনে নিতে প্রস্তুত ছিলেন না। তাঁরা ভেবেছিলেন এ এক তরুণ উচ্চাভিলাষী বিজ্ঞানীর কল্পনাপ্রসূত উদ্ভট চিন্তা যার একমাত্র উদ্দেশ্য বাস্তবতাকে জোর করে তাঁর পরীক্ষার সঙ্গে খাপ খাইয়ে একটা জোড়াতালির ব্যবস্থা করা। একটা সাময়িক সমস্যার সাময়িক সমাধান মাত্র—তার বেশিকিছু নয়।

কিন্তু এটা যে সাময়িক কিছু নয়, আসলেই একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার যাতে করে প্রকৃতির একটি গভীর রহস্য উদ্ঘাটন হয়ে গেছে, সম্ভবতঃ ম্যাক্স প্লাঙ্কের নিজেরই অজান্তে, সেটা পরিস্কার হল আরেকটি যুগান্তকারী গবেষণায়, যার নায়ক ছিলেন আরো এক জার্মান যুবক, তখনও সম্পূর্ণ অজ্ঞাতনামা, এবং পরবর্তীকালে যার নাম বাংলাদেশের রিক্সাওয়ালাদেরও মুখে মুখে ঘোরে—আলবার্ট আইনস্টাইন।

আইনস্টাইনের বয়স তখন ছাব্বিশ—পদার্থবিদ্যায় সর্বোচ্চ ডিগ্রি করা সত্ত্বেও বলতে গেলে একরকম বেকার, সামান্য এক পেটেন্ট অফিসে ছোটখাট একটা চাকরি নিয়ে কোনরকমে সংসারের খরচ চালাচ্ছিলেন সদ্যবিবাহিত যুবক। তিনি চেয়েছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার চাকরি, সেটা পাননি কারণ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক (প্রফেসর ওয়েবার)তাঁকে চাকরির সংসাপত্র(recommendation letter) দিতে অসম্মতি জ্ঞাপন করেছিলেন (কারণ আইনস্টাইন তাঁকে হের প্রফেসর ওয়েবার না বলে শুধু হের ওয়েবার বলে সম্বোধন করতেন, অনেকটা স্বেছাকৃত অবজ্ঞাবশতঃই)। যাই হোক পেটেন্ট অফিসের চাকরিটা নেহাত্‌ খারাপ হয়নি তাঁর জন্যে। ১৯০৫ সালের কথা সেটা। চাকরির কাজে খুব কম সময়ই ব্যয় করতে হত তাঁকে, ফলে দিনের বেশির ভাগ সময়ই তিনি নিজের গবেষণার কাজে ব্যবহার করতে পারতেন। ইতিহাস এর সাক্ষী যে ১৯০৫ সালটিই ছিল আইন্সটাইনের গবেষণা জীবনের সবচেয়ে গৌরবময়, সবচেয়ে ফলপ্রসূ সময়। এবছর তিনি একটি নয়, তিনটে বড় বড় কাজ করে ইতিহাসে চিরস্মরণীয় মণীষীদের শীর্ষস্থান দখল করে রেখেছেন। তাঁর প্রথম কাজটি ছিল বস্তুর আপাতদুর্বোধ্য আলোক-তড়িত ক্রিয়া (photoelectric effect)র একটা সন্তোষজনক ব্যাখ্যা দানের ওপর। আলোক-তড়িত বিষয়টি প্রথম চোখে পড়েছিল ১৮৮৭ খৃষ্টাব্দে, জার্মানীরই আরেক প্রসিদ্ধ পদার্থবিজ্ঞানী হাইনরিখ হারত্‌সের (Hertz) (১৮৫৭-১৮৯৪)—একটা ধাতব পাতের ওপর রঙ্গোত্তর দৈর্ঘ্যের (ultraviolet) রশ্মি নিক্ষেপ করলে কি এক অদ্ভূত কারণে সেই পাতের এটম থেকে ধপাধপ ইলেট্রন নিক্ষিপ্ত হতে থাকে—অনেকটা ঢিল মেরে দেয়ালের বালিকণা খসিয়ে ফেলার মত। সনাতন অনুবিজ্ঞান দিয়ে এর ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল না। আইনস্টাইন বললেন, ব্যাখ্যা পাওয়া যাচ্ছিল না তার কারণ সনাতন বিজ্ঞানে আলো যে ‘ফোটন’ নামক একটা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা দিয়ে তৈরি যা অনেকটা সেই ঢিলের মতই কাজ করে যখন ওটাকে পাতের দিকে ছোড়া হয় সেটা জানা ছিল না। হ্যাঁ, আলো তরঙ্গ ঠিকই, আবার কণাও—বিশেষরকম কণা, যাকে আইনস্টাইন বলতেন ওয়েভপ্যাকেট (কণার মত করে দলাপাকানো ঢেউ)। সে প্যাকেট বিশেষ বিশেষ তেজে পাতের ওপর ঘা খেলে তার এটম থেকে ইলেট্রনগুলো একে একে খসিয়ে আনবে। তা’ও একটা তেজসীমার কমে চলে গেলে সেই খসানোটা হঠাত্‌ করেই বন্ধ হয়ে যাবে। আল্ট্রাভায়োলেট লাইটের এই আশ্চর্য গুণ বিজ্ঞান জগতের এক দারুণ আবিষ্কার। এর যে কত ব্যবহারিক এবং বানিজ্যিক উপকারিতা তা বর্তমান যুগের প্রযুক্তিক্ষেত্রে কারুর অজানা নেই। সঙ্গত কারণেই এই যুগান্তকারী কাজটির জন্যে আইন্সটাইন নোবেল পুরস্কার পেয়েছিলেন। বলা বাহুল্য যে তাঁর এই আবিষ্কার নানাভাবে পরীক্ষিত-নিরীক্ষিত হয়েছে শত শত বিজ্ঞানী গবেষক দ্বারা, এবং প্রতিবারই তাঁর তত্ব নির্ভুল প্রমানিত হয়েছে। আইনস্টাইনের আলোকতড়িত তত্ব আরেকটি বড় কাজ সিদ্ধ করেছে—ম্যাক্স প্লাঙ্কের সেই ‘কুয়ান্টাম তত্বকে’ যুক্তিযুক্ত হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সাহায্য করেছে।

আলো আমাদের দৈনন্দিন জীবনের নিত্য সঙ্গী, অথচ এই বস্তুটিকেই আমরা কত কম জানি। শুধু আমরা কেন গোটা বিজ্ঞানজগতকেই চরম ধাঁধায় ভুগিয়েছে যুগযুগান্ত ধরে। নিউটন বললেন আলো ইঁটপাথরের মতই একরকম পাথর, খুব ছোট পাথর যদিও। হাইগেন্স বললেন কণা নয়, ঢেউ। এদিকে আইনস্টাইন যা বলছেন তাতে তো মনে হয় কণাও হতে পারে, আবার ঢেউও হতে পারে। ধাঁধা যেন আরো বেড়ে গেল। একই জিনিস ঢেউ আর কণা একই সঙ্গে কি করে হয়। পরে ডিব্রগ্লি নামক আরেক বিজ্ঞানী এসে প্রমান করলেন যে হ্যাঁ, হয়, পদার্থের এই দ্বৈত চরিত্র, যত অবিশ্বাস্যই হোক, এটাই হল প্রকৃতির প্রকৃত রূপ। এ রূপের পূর্ণ ব্যাখ্যা আছে বিংশ শতাব্দীর কুন্টাম তত্বের মাঝে।

পাঠক নিশ্চয়ই ভাবছেন, কিন্তু মশাই, এখানে শূন্যের জায়গাটি কোথায়। আছে, ভাই, আছে। ভুলে যাবেন যে কুয়ান্টাম তত্বের আলোচনাটি শুরুই হয়েছিল সেই তরঙ্গের দৈর্ঘ্য শূন্যে গেলে কি তেজ অসীমে পৌঁছুবে কি না পৌঁছুবে না, সে প্রশ্নের মোকাবেলা করতে গিয়ে। কুয়ান্টাম বিজ্ঞানে তার আংশিক জবাব পাওয়া গেল—না, অসীমে যায় না, কারণ তার আগেই বিজ্ঞানের আইনকানুন বদলে যায়, তেজ সেখানে ধাপে ধাপে এগোয় বা নামে, হুট করে ওপরে উঠে যায় না বা নিচে নামে না। কুয়ান্টাম তত্ব অনুযায়ী শূন্য মানেই শেষ নয়, শূন্য তেজেরও একটা অর্থ আছে। বরং বলা যায় শূন্য লেভেলে যে সঞ্চিত শক্তি সে শক্তি মহাবিশ্বের জানা অজানা সকল শক্তিকে একত্রিত করলেও তার সমান শক্তি তৈরি করতে পারবে না কোন মরপ্রানী। এটাই আইনস্টাইনের সুবিখ্যাত সমীকরণ E=mc2 এর অন্তর্নিহিত বানী। একটা স্থির বস্তু,‌ m ভরযুক্ত সামান্য একটি কণা, যার গতির তেজ শূন্যতে নেমে গেছে, তারও ভরজাত সঞ্চিত তেজ হল এই সমীকরণের ডানপাশের বিপুল সংখ্যাটি( এখানে c এর মান হল প্রতি সেকেণ্ডে প্রায় ৩০০,০০০ কিলোমিটার)। আইনস্টাইন বুঝিয়ে দিলেন যে ক্ষুদ্র বস্তুকে তার ক্ষুদ্রতার জন্যে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা উচিত নয়। এই ক্ষুদ্র বস্তুটিকেই যদি তার ভরসম তেজে রূপান্তরিত করা যেত তাহলে সে পৃথিবী ধংস করে দিতে পারত। শূন্যেরও অসীম ক্ষমতা।