তামাক

মোকছেদ আলী*

এই তো সেদিন- মাঠভরা, ভার্জিনিয়া তামাকের মহাসমারোহ। কৃষকগণ, কেহ হাজার টাকার স্বপ্ন দেখিতেছে, কেহ লাখ টাকার স্বপ্ন দেখিতেছে। কেহ বলিতেছে- সাত্তার মিঞা কাম বাধাইছে, ১৫ বিঘা ১ নং ভার্জিনিয়ার, চোখ জুড়ায় পাতার চেহারা দেখিয়া। আরো কাম বাধাইছে গুঞ্জিওয়ালা।
সাত্তার সাহেব কয়, ওগো বাবাজী এযে ট্যাকার লেতুর।
গুঞ্জিওয়ালা মনে মনে গোনে, বাবাজীর যদি লেতুর হয়, তাহলে আমার তো ২৩ বিঘা, আমারও টাকার আবর্জনা।
টাকার লেতুর আর আবর্জনা হইতে বেশি দেরী নাই। বাজার দর এবার খুব ভালো। বিটিসি এবার কৃষককে ভার্জিনিয়ার চড়া মূল্য দিয়াছে।
তামাক কিউরিং করিতে আর মাত্র ৩০/২৫ দিন। তারপরই, কাজ হাসিল হইবে। তামাক ড্রাইয়িং এর ভাটা প্রস্তুত করা হইতেছে। খড়ি কাঠির সমাবেশ হইয়াছে। কল্পনার নেত্রে কৃষকগণ টাকার গাদা প্রত্যক্ষ করিতেছে- করগেট টিনের ঘর প্রস্তুত করা, নতুন হোন্ডা কেনার পরিকল্পনা করিতেছে। কেহ মেয়ে জামাইকে নতুন নতুন কত কি দেবার সখের ভাবনা ভাবিতেছে। কেহ আবার গ্র্যান্ড স্টাইলে পিকনিকের ভাবনা ভাবিতেছে- পিকনিকে কয়টা খাশি, কয় সের পোলাওয়ের চাল, কয় সের ঘৃত, তাহার সঙ্গে লুৎফরের খাসা দধির বায়নার কথা মনে মনে ভাবিতেছে। ভার্জিনিয়ার অগাধ অর্থে বিভিন্নজন বিভিন্ন সাধ মেটাইবার আকাংখা করিতেছে।
“কিন্তু হায়রে!
সকলি গরল ভেল।”
ফেব্রুয়ারীর শেষ পর্যায়। গাছে গাছে কচি আম, কাঠালের লিচুর সমারোহ। শিমুলের ফুলের রঙ-এ আগুন ধরিয়াছে। উত্তর আকাশে একখন্ড কালমেঘ দেখা দিল। বেলা তখন অপরাহ্ন। শুরু হইল ঝোড়ো হাওয়া, সেই সঙ্গে প্রবল বৃষ্টি। কিছুক্ষণ বাদ, বৃষ্টি রূপান্তরিত হইল- শিলাখন্ডে। আধা ঘন্টারও বেশি সময় ধরিয়া। শুধুই শিল পড়িতে লাগিল। গাছের পাতা সব ভাঙ্গিয়া চূর্ণ বিচূর্ণ হইয়া গেল। উঠানের বুকে ১ ফুট জমা হইল। শিলের জন্য উঠানে নামা যাইতেছে না। কন কনে ঠান্ডা। ছেলেরা উল্লাসে শিল তুলিয়া পাত্রে জমা করিল।
রাত্রের আকাশ পরিস্কার, এত শিল, এত ঝড়, এত বিদ্যুৎ কিভাবে থাকে ঐ একদম খাঁ খাঁ করা শূণ্য আকাশটায়? কে জমা রাখে এই অদৃশ্যভাবে? কে সে জন?
নিশির অবসান হইল। পোখপাখালিদের কলকাকলীতে জন মানবের নিদ্রা ভঙ্গ হইল। মসজিদের মিনার হইতে মোয়াজ্জেনের মধুর আজান ধ্বনিত হইল। পূর্বগগনে উষার আলোকচ্ছটা হেরিয়া কাল অন্ধকার পলাইয়া গেল।
ভার্জিনিয়া ক্ষেতের মালিকেরা সারারাত্রি উদ্বেগ উৎকন্ঠায়, বিছানার এপাশ ওপাশ করিয়াছে। তাদের এত পরিশ্রমের ফসল কি, নাহ্ আর কল্পনা করিতে পারে না। কল্পনার জাল ছিন্ন হইয়া যায়।
সূর্যের কিরণচ্ছটা মায়াময় ধরণীর বুকে না নামিতেই কৃষকগণ তাহাদের শয্যাসুখ পরিত্যাগ করিয়া ভার্জিনিয়া ক্ষেত্র অভিমুখে ছুটিয়া চলিল।
একি, দৃষ্টিশক্তির কি বিভ্রম ঘটিয়াছে, অথবা পথ ভুলিয়া অন্য মাঠে আসিয়াছে। নাতো, পথ তো ভুল হয় নাই। ঐ যে, মাঠের শেওড়া গাছটি, ঠিক জায়গায় দাঁড়াইয়া আছে। পার্শ্বের বাবলা গাছগুলিও, কিন্তু পাতা নাই যে।
আঁখি কচলাইয়া দেখে, কৈ কৈ আমার ভার্জিনিয়ার ক্ষেত। গাছ তো কিছুই দেখা যায় না। সব শূণ্য।
পদ আর চলিতে চাহে না। কেহ বুঝাইয়া না দিলেও বুঝিতে বিলম্ব হয় না। হোন্ডা কেনা, পিকনিক করা, মেয়ে জামাইয়ের আবদার রক্ষা করা, সর্ব্বোপরি ঋণের জাল ছিন্ন করা। সব, সবই ধুলিস্যাৎ হইয়া গেল!
কখন যে ভার্জিনিয়ার আইলের উপর আসিয়া দাঁড়াইয়াছে, পথ যে কোথা দিয়া পশ্চাতে চলিয়া গিয়াছে টের পাই নাই এতটুকু।
সুন্দরবনের ভিতর দিয়া প্রবাহিত হরিণঘাটা নদীতে থাকে কামট মাছ। স্নানার্থী ব্যক্তি অবগাহনের জন্য পানিতে নামিলে কামট মাছ তাহার পায়ের মাংশ খুবলে খায়, টের পায় না। কিন্তু জল হইতে উঠামাত্র হাওয়ার পরশে প্রচন্ড যন্ত্রণা শুরু হয়, চিৎকারে আকাশ বাতাস মথিত করিয়া তুলে।
কৃষকের অবস্থা এখন তদ্রুপ। সম্মুখে ভার্জিনিয়ার বিস্তীর্ণ ক্ষেত।
কতশত লাঠিয়াল বাহিনী তাহাদের বলিষ্ঠ বাহুর মহা আক্রোশে শক্ত লাঠির প্রচন্ড আঘাতে সব ভার্জিনিয়ার গাছগুলি থেঁতলাইয়া দলিত মথিত করিয়া চূর্ণ বিচূর্ণ করিয়া দিয়াছে। গতকাল যে ভূমি ছিল নয়নতৃপ্তিকর, আশা আকাঙ্খা বাস্তবায়নের মূর্ত্ত প্রতীক, আজ সেই ক্ষেত শূণ্য মরুভূমি।
কৃষকের যখন চমক ভাঙ্গিল, সম্বিত ফিরিয়া পাইল, কামটের কামড়ের যন্ত্রণা শুরু হইয়া গেল। তাহার হৃদয়ে ঝড় উঠিল। তোলপার করিতে লাগিল। গণ্ড বাহিয়া দুচোখের অশ্রু অঝোড়ে ঝড়িয়া বুকের বসন ভিজাইয়া দিল।
ঘরে ফিরিতে মন চাহিতেছে না। স্ত্রী পুত্রদের কি করিয়া প্রকাশ করিবে এই নিদারুন কথা। তাহাদেরও যে কত আশা আকাঙ্খা। তামুক উঠিলেই সব পাইবে। শাড়ী জামা জুতা সব, সব পাইবে।
সেদিন দুপুরে ছোট্ট মেয়েটি গলা জড়াইয়া ধরিয়া গালের উপর তুলতুলে নরম গালটি ঠেকাইয়া কত আবদার করিয়া বলিয়াছিল- “আব্বা গো, এবার তামুক উঠিলে ঐ বাড়ির সুমির মতন লাল নতুন জামা কিইন্যা দিবা, আর আর নতুন জুতা, স্যান্ডেল নেব না, হ্যাঁ আব্বা।”
মহা উল্লাসে মেয়ের মুখে চুমো দিয়া বলিয়াছিল, “সুমির থনে ভাল জামা দেবো।” পিতার প্রতিশ্রুতি পাইয়া মেয়ে আনন্দে উল্লাসে বগল বাজাইয়াছিল, রে, রে।
আজ কন্যাকে কি বলিয়া এই নিদারুন সংবাদ দিবে? হৃদয়ের গভীর হইতে একটি প্রচন্ড দীর্ঘশ্বাস বাহির হইল।
—————-
*মোকছেদ আলী (১৯২২-২০০৯) স্বশিক্ষিত। সিরাজগঞ্জ জেলার বেলতা গ্রামে জন্ম। গ্রামটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে।

অনুলেখক: মাহফুজ।