প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন বরণ অনুষ্ঠান। একটি ছাত্র তার সহপাঠী মেয়েকে জিজ্ঞেস করছে — নবীন বরণ অনুষ্ঠানে তুমি নিশ্চয়ই রবীন্দ্র সংগীত গাইবে।
মেয়েটি হা হা হি হি করে কতক্ষণ হেসে উত্তর দিয়েছে – আমি তো গানই জানি না। আর তোমার এমন ধারণা কী করে হল যে আমি গান গাইব আর গাইলে রবীন্দ্র সংগীতই গাইব।
ছেলেটি বিব্রত হয়েই উত্তর দিল — হিন্দু পরিবারে তো মা বাবারা মেয়েকে গান শেখায়ই, আবার তা রবীন্দ্র সংগীতই শেখায়।
মেয়েটি দুষ্টুমি ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করেছে— যদিও শেখায়নি, তবে কীর্তন আর ভজনও তো শেখাতে পারত। নাকি?
ছেলেটি আর তর্ক করেনি। বুঝতে পেরেছে এমন পুর্বানুমান করা ঠিক হয়নি।

একদিকে মেয়েটি গান জানে এ বাক্যটি হিন্দু পরিবারে সংস্কৃতির চর্চা হয় বলে একটি গতানুগতিক ধারণা। আবার অন্যদিকে হিন্দু পরিবারে রবীন্দ্র সংগীত শেখায় এ ধারণাটি কিন্তু পাকিস্তান আমলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে নিষিদ্ধকারীদের চেতনারই অনুধ্যান। রবীন্দ্রনাথ হিন্দুদের কবি এ ধারণাটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া ছাত্রটির চেতনায় সচেতনভাবে কাজ করেনি ; তবে সাম্প্রদায়িক সামাজিকীকরণের প্রতিফলন বলেই আমার মনে হয়। যদিও বাংলাদেশের নামকরা রবীন্দ্র সংগীত শিল্পীরা প্রায় সবাই অহিন্দু। যেমনঃ রেজোয়ানা চৌধুরী বন্যা, মিতা হক, অদিতি মহসিন। তাছাড়া, ছায়ানট তো হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন গড়েনি। এমন জাজ্বল্যমান উদাহরণ চোখের সামনে থাকার পরও যে অবচেতনে এ ধরণের ধারণা কাজ করে এর সামাজিক ও ঐতিহাসিক কারণ তো রয়েছেই।
এ ধারণাটি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ুয়া একজন ব্যক্তি ছাত্রের নয় — তা একটা গোষ্ঠীর ধারণা এবং তা শুধুমাত্র একজন ছাত্রীর প্রতি নয় — এ তো আসলে একটি সম্প্রদায়ের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি।
তবে অনেক হিন্দু পরিবারে মেয়েদের গান শেখানোর ঐতিহ্য রয়েছে এবং তা রবীন্দ্র সংগীতই হতে হয় এমনটি নয়। মেয়েটি বেসুরো হলেও অনেক সময় গান শিখতে হয়। এটা হিন্দুত্বের স্মারক নয়, তথাকথিত সাংস্কৃতিক আভিজাত্যের পরিচয় প্রকাশ ও প্রচার করতে।
প্রত্যেক নাগরিককে ধর্ম, গোষ্ঠী ও শ্রেনী নির্বিশেষে অন্যের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হবার শিক্ষা পৌরনীতি বইয়ে কৈশোরেই পড়া। কিন্তু ও বিষয়ে ইতিবাচক মনোভাব গড়ে উঠেনি বা এ সংস্কৃতির চর্চা আমাদের যাপিত জীবনে অচল। আর এ অচলয়াতয়নের নমুনা পাই প্রাত্যহিক জীবনের পরতে পরতে।

সংখ্যালঘু সম্প্রদায় মনস্তাত্ত্বিক সমস্যায়ও ভোগে। কোন কোন ইস্যুতে সংখ্যাগুরুদের প্রতিযোগী ভাবে,কখনো কখনো শত্রুও ভাবে বৈকি! তারা একটু আধটু সংস্কারাচ্ছন্ন হয় নিজস্ব সত্ত্বা বিলীন হয়ে যাবার আশংকায়। নিজের পরিচয় হারিয়ে ফেলার ভয়ে। যেমন, নাস্তিক ছেলেটি পূজায় ব্যস্ত। দূর্গা পূজার মন্ডপে কাপড় লাগাচ্ছে। আমি প্রশ্ন করেছি— কী ব্যাপার?
উত্তর দিয়েছে, নিজের শিকড়কে জিইয়ে রাখছি।
এ স্ব সম্প্রদায়ের সাংস্কৃতিক পরিচয়কে টিকিয়ে রাখার সংগ্রাম। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে ছেলেটি নাস্তিক নয় ; তাকে সংশয়বাদী বলা উচিত। কিন্তু আমার জানা মতে ঐ ছেলেটি অঞ্জলি তো নেয়ই না, পূজার সময় হোটেলে গিয়ে তাকে মাছ মাংস খেতেও দেখা যায় ; এমনকি গরুর মাংস হলেও আপত্তি নেই। কারণ বাড়িতে তো তখন নিরামিষ চলে। কাজেই পূজার সময়ের আচার – রীতি চর্চা নিয়ে তার কোন সংস্কার নেই। তাছাড়া আমি তার সাথে কথা বলে দেখেছি, ঈশ্বর, পরকাল, জীবন ও জগত সম্পর্কে তার ধারণা কি? সে তো অবলীলায়
নির্মলেন্দু গুণের “কসাই” কবিতাটি শুনিয়ে দেয়—–

একদিন এক বিজ্ঞ কসাই
ডেকে বললোঃ ‘এই যে মশাই,
বলুন দেখি, পাঁঠা কেন হিন্দুরা খায়,
গরু কেন মুসলিমে?’
আমি বললামঃ ‘ সে অনেক কথা,
ফ্রেশ করে তা লিখতে হবে
কর্ণফুলীর এক রীমে।‘
কসাই শুনে মুচকি হাসেঃ
‘বেশ বলেছেন খাঁটি,
আমি কিন্তু একি ছোরায়
এই দুটোকেই কাটি।‘

ছেলেটি ধর্মীয় কিছু আচার- অনুষ্ঠানকে সে সাংস্কৃতিক পরিচয়ের অংশ মনে করে বিধায় তা সমূলে উপড়ে ফেলতে চায় না।

শুধু মাত্র সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা দিয়ে কোন নাগরিককে সংখ্যালঘুর প্রতি সশ্রদ্ধ করা যাবে না। এ বাধ্যবাধকতাকে মানানোর দায় দায়িত্ব রাষ্ট্রের ও সরকারের। এ বিষয়ে নাগরিককে সচেতন, কর্তব্যপরায়ণ ও দায়িত্বশীল করে তোলার কৌশল প্রণয়ন করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থায় এর কৌশল থাকতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হতে পারে এর পরিচর্যার আদর্শ জায়গা। পাশাপাশি পারিবারিক পরিমন্ডলে চাই অসাম্প্রদায়িক চেতনার লালন ও পোষণ। কিন্তু শিক্ষাব্যবস্থায় নেই এর কোন উদ্যোগ। যেমন — বিদ্যালয় পর্যায়ে চিঠি লেখার নিয়ম শেখানো হয় ধর্মীয় পরিচয় দিয়ে। বাংলা ব্যাকরণ বইয়ে হিন্দু রীতি আর মুসলিম রীতি আলাদা করে উদাহরণ দেওয়া থাকে। হিন্দুরা লেখে শ্রী হরি সহায় বা ওঁ আর মুসলমানরা লেখে বিসমিল্লাহের রাহমানের রহিম। অর্থাৎ ভাবের আদান প্রদানে রয়েছে ধর্মীয় পরিচয়।
এ রীতিকে অনুসরণ করেই কি বাংলাদেশ সংবিধান শুরু হয়েছে বিসমল্লাহ রাহমানের রহিম দিয়ে!