মৌলবাদকে প্রতিহত করার উদ্যোগ বিষয়ক বিপ্লব পালের লেখাটা খুবই সময়োপযোগী এবং তাৎপর্যপূর্ণ একটা লেখা। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাকে সাধুবাদ জানাচ্ছি মুক্তমনায় এমন বাস্তবধর্মী একটা পদক্ষেপের অবতারনা করার জন্যে। তবে বিষয়টা যেহেতু খুবই গুরুত্বপূর্ণ, কাজেই আমার মনে হলো উদ্যোগটার সাথে সম্পৃক্ত কিছু কিছু সুক্ষ্ণ ব্যাপারে উদ্যোগীদের দৃষ্টি আকর্ষন করা দরকার। আর সে কারনেই আজকের লেখাটার অবতারনা।

বিপ্লব পাল মৌলবাদের উত্থানকে প্রতিহত করার জন্যে বাস্তবমুখী কিছু কিছু কর্মপদ্ধতি হাতে নেয়ার পাশাপাশি প্রাতিষ্ঠানিকভাবে রাজনীতি করার প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রচুর কমেন্ট পড়েছে। বিপ্লব পালকে বাহবা দেয়ার পাশাপাশি অসংখ্য পাঠক বিভিন্ন কর্মকান্ডের প্রস্তাব দিয়েছেন। শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রচার ও প্রসারের পাশাপাশি সদস্য সংগ্রহ করা, নিজেদেরকে অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী করা, রাজনীতিতে জড়ানো (যা eventually ক্ষমতায় যাওয়া),…… অনেক অনেক পরামর্শ এসেছে। খুবই আশার কথা।

মজার ব্যাপার হলো, এই মূল কথাটার প্রায় কাছাকাছি একটা কথাই আব্দুর রহমান আবিদ দু’দিন আগেই তার নিবন্ধ তিনটাতে (অতিরিক্ত ধর্মীয় গোঁড়ামী চরমপন্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে, মডারেট মুসলিম, ধর্মকে না বলা কতখানি বাস্তব?) লিখলো, “কেবল ইসলামী মৌলবাদ বা সন্ত্রাসের উত্থানই নয়, সমসাময়িক অন্যান্য ধর্মগুলোতেও আশংকাজনকভাবে মৌলবাদী মনোভাবের উত্থান হচ্ছে”। এবং সে এটাও দেখালো বিশ্বাসী মুসলমানদেরই একটা অংশ কিভাবে ইসলামী মৌলবাদী মনোভাবকে প্রতিহত করছে কিম্বা বাংলাদেশে রাজনৈতিকভাবে মানুষ কিভাবে পরাজিত করেছে তথাকথিত ‘ইসলামী শাষন’এর স্বপ্নদ্রষ্টা ধর্মীয় সন্ত্রাসীদেরকে। ভারতের সেক্যুলার কংগ্রেস পার্টির একজন কল্পিত নেতার বিভিন্ন কল্পিত কর্মপদ্ধতির মাধ্যমে মানুষকে ধর্মীয় সহনশীলতা শিক্ষা দেয়ার ব্যাপারটাও সে খানিকটা দেখানোর চেষ্টা করলো। বিপ্লব পালকে বাহবাদানকারীই অনেক পাঠক সেদিন ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন আমার ওপর- ‘ভন্ড’, ‘হিপোক্রিট’, ‘মুখোষধারী’, ইত্যাদি অসংখ্য বিশেষনে ভরা সম্বোধন করে। এর বাইরে বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্যগুলোর কথা নাহয় নাইবা বললাম। ভাবখানা ছিল যেন “ব্যাটা তুই প্র্যাক্‌টিসিং মুসলমান; তুই নিজেই তো মৌলবাদী। মৌলবাদ নিয়ে কথা বলার তুই কে”? তখন কিন্তু কেউ বলেননি (সম্ভবত আদিল, আতিক আর মিঠুন ছাড়া), “ঠিকই তো, আসলেই তো চারিদিকে আশংকাজনকভাবে মৌলবাদী মনোভাবের উত্থান হচ্ছে; তা ঠেকানোর জন্যে কি কি করা যায় চলুনতো আমরা সবাই মিলে ভাবি”। নিজেদের প্ল্যাটফর্মের নাস্তিক কেউ একজন ভাল একটা কথা বললে তিনি বাহবা পাবেন, চারিদিকে ধন্য ধন্য রব উঠবে, হাজার জন হাজার সুপরামর্শ দেবেন। তাতে নিশ্চয় কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। কিন্তু তেমনই একটা ভাল কথা একজন বিশ্বাসী মুসলমান বললে আপনাদের অনেকে ঘৃনায় মুখ ফিরিয়ে নেবেন শুধু এ জন্যে যে মানুষটার একটা ধর্মীয় পরিচয় রয়েছে- এটা আপনাদের কারো কারো কতখানি সাম্প্রদায়িক, অহংকারী মানসিকতা তা কি কখনও খেয়াল করেছেন?

মুসলমান শুধু আল্লাহ আছে কি নেই, পৃথিবীতে জ্বিন আছে কি নেই, কোর’আনে বিজ্ঞানময় আয়াত আছে কি নেই এসব নিয়ে আপনাদের সাথে তর্ক করবে। আর এসব তুচ্ছ বিষয়ে তাদেরকে অবধারিতভাবে পরাজিত করে (যেহেতু বিশ্বাস যুক্তির কাছে স্বভাবতই দূর্বল) সগর্বে বিজয়ের নিশানা ওড়াবেন। এর বাইরে যে একজন বিশ্বাসী মুসলমান সমাজের জন্যে, মানবতার জন্যে ভাল-মন্দ কিছু চিন্তা করতে পারে, ভাল কোনো পরামর্শ দিতে পারে, মৌলবাদের উত্থানের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে- সেসব মুখে স্বীকার করা তো দূরে থাক, মনে আসার সম্ভাবনাকেও যারা দূর্বলতা মনে করেন, নাস্তিকদের সংগঠন বানিয়ে, রাজনীতি করে এবং ক্ষমতায় গিয়ে তারা বিশ্বমানবতার কতখানি উপকার করবেন তা নিয়ে কারো সন্দেহ হওয়া বোধহয় খুব একটা অমূলক নয়।

ওপরের কথাগুলোকে মুক্তমনার সদস্যদের প্রতি আমার জেনারালাইজ্‌ড্‌ দৃষ্টিভঙ্গী বা পর্যবেক্ষণ হিসেবে ধরে নেবেননা প্লিজ। কথাগুলো বলার একমাত্র উদ্দেশ্য হলো, নিজেদেরকে মুক্তবুদ্ধিসম্পন্ন ও যুক্তিবাদী মনে করলেও আপনাদের অনেক সদস্যের মাঝেই যে অসহনশীল, প্রতিক্রিয়াশীল ও সুপ্রিম মনোভাবের প্রবনতা ও প্রাবল্য রয়েছে, সেটা আপনাদের উপলব্ধি করা দরকার। ধর্মীয় মৌলবাদীদের চালিকাশক্তি সাম্প্রদায়িকতা, প্রতিক্রিয়াশীলতা এবং ভিন্ন ধর্মাবলম্বী বা মতাবলম্বীদের প্রতি অবজ্ঞা, ঘৃনা ও বিদ্বেষ। মৌলবাদীদের প্রতিহতকারী যোদ্ধারা এসবের ওপরে উঠতে না পারলে বিজয় পাবেন বলে মনে হয়না। কেননা শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রচার বা প্রসার যাই বলেন, এ সবকিছুরই প্রয়োগের ক্ষেত্র কিন্তু রক্তমাংসের মানুষ। এবং যাদেরকে সুশিক্ষিত, বিজ্ঞানমুখী করে তোলার প্রজেক্ট হাতে নিচ্ছেন, তাদের অধিকাংশই সম্ভবত অবধারিতভাবে আস্তিক এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রে ধর্মচর্চাকারী। তাদের প্রতি ভেতরে ভেতরে অবজ্ঞা, অসন্মানবোধ বা বিদ্বেষ পুষে রেখে চুড়ান্ত সফলতা বা বিজয় অর্জন করা মনে হয়না সম্ভব হবে। যে কোনো যুদ্ধে জয়ী হওয়ার অন্যতম প্রধান শর্ত হলো, নিজেদের সীমাবদ্ধতা বা দূর্বলতাগুলোকে সনাক্ত করতে পারা।

মানবতাবাদীদের শক্তির সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে ক্ষমতাবান উৎস হলো জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের প্রতি ভালবাসা, যা ধর্মীয় মৌলবাদীদের মধ্যে অনুপস্থিত। ধর্মীয় বা আদর্শগত পার্থক্য বা পরিচয়ের ওপরে উঠে একজন মানুষকে মানুষ হিসেবে সন্মান করতে না পারলে মৌলবাদীদের সাথে মানবতাবাদীদের মৌলিক পার্থক্যটা কোথায় রইলো?

সবশেষে আবারও বলবো, শিক্ষা ও বিজ্ঞানের প্রচার ও প্রসারে মুক্তমনার বাস্তবমূখী উদ্যোগের প্রতি আমারও সর্বাত্মক মোরাল সাপোর্ট রইলো। এর পাশাপাশি নিজেদের সীমাবদ্ধতাগুলো সনাক্ত করার ব্যাপারেও আপনারা সচেষ্ট হবেন আশা করি। আদর্শগত বা বিশ্বাসগত পার্থক্য থাকলেও ধর্মীয় মৌলবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার প্রত্যেক মানবতাবাদীকে, প্রত্যেক যোদ্ধাকে আমি অন্তত সহযোদ্ধা মনে করি। (পুনশ্চঃ কেউ আবার ধরে নেবেন না, আমি ‘মানবতাবাদী’ বা ‘সহযোদ্ধা’ হিসেবে প্রকারান্তরে কারো স্বীকৃতি চাচ্ছি। আমার নিজের অবস্থান সম্পর্কে আমি যথেষ্ট সচেতন, যেখানে কারো এ্যাপ্রুভাল বা ডিস্‌এ্যাপ্রুভাল খুব একটা গুরুত্ব বহন করেনা)।

পাঠকদেরকে অনুরোধ রইলো মন্তব্য করার জন্যে। আমি চেষ্টা করবো আলাদা আলাদা ভাবে সবার মন্তব্যের উত্তর দেয়ার (অবশ্য কেউ বিশেষনপূর্ণ বা বিদ্বেষপূর্ণ সম্বোধন বা মন্তব্য করলে সেগুলো বাদে)। সময়াভাবে তা না পারলে অন্তত সবগুলো মন্তব্য স্ক্যান করে ক্রিটিক্যাল বিষয়গুলো (গুরুত্বপূর্ণ বলছিনা কেননা প্রত্যেক পাঠকের মন্তব্যই আসলে গুরুত্বপূর্ণ) একটা প্রত্যুত্তরের মধ্যে লিখে দেয়ার চেষ্টা করবো।

সবাই ভাল থাকুন। ধর্মীয় মৌলবাদকে নির্মূল করার মুক্তমনার উদ্যোগ সফল হোক।

জুন, ২০১০