রাতের আকাশটা যেদিন খুব পরিস্কার থাকে এবং চাঁদের আলোও থাকে কিছুটা ম্রিয়মাণ, সদা হাস্যোজ্বল এবং শান্ত স্বভাবের মানুষ পাদ্রী রবার্ট ইভান্স অস্ট্রেলিয়ার সিডনী শহর থেকে ৫০ মাইল পশ্চিমে ব্লু মাউন্টেইন এলাকায় অবস্হিত বাড়ীর পিছনের ডেকে তারঁ ঢাম্বুশ আকারের টেলিস্কোপটি টেনে নিয়ে একটি অভূতপূর্ব কাজ করতে বসে যান। তিনি সুদূর অতীতের দিকে তাকিয়ে থাকেন আর মৃত্যুপথযাত্রী নক্ষত্র গুলোকে খুঁজে খুঁজে বের করেন।

অতীতের দিকে ফিরে দেখাটা আসলে খুবই সহজ। রাতের আকাশের দিকে চোখ তুলে তাকান, যা কিছু দেখা যাচ্ছে তার সবটুকুই ইতিহাস – সারা আকাশটা জুড়েই। যে নক্ষত্রগুলো দেখা যাচ্ছে সেগুলো বর্তমান সময়ের না বরং চোখের মণিতে পড়া আলো যখন তাদের উৎস ছেড়ে চলে এসেছিলো সেই সময়ের। আমরা শুধু নিশ্চিত করে এটুকুই বলতে পারি আমাদের অতি বিশ্বস্ত ধ্রুবতারার জীবন প্রদীপ হয়ত গতমাসেই বা ১৮৫৪ সালে অথবা চতুর্দশ শতাব্দীর প্রথম দিকের কোন এক সময়ই জ্বলতে জ্বলতে নিভে গেছে। কিন্তু সেই সংবাদটি এখনও আমদের কাছে এসে পৌছেনি। আমরা খুব বেশি হলে এটুকু বলতে পারি যে, ৬৮০ বছর আগে আজকের দিনটিতেও ধ্রুবতারা স্বমহিমায় তার আলো বিকিরণ করে যাচ্ছিলো।

নক্ষত্ররা মারা যাচ্ছে প্রতিনিয়তই। আজ পর্যন্ত বহু মানুষ এই মহাকাশীয় বিদায় মূহুর্তগুলিকে চিহ্নিত করেছেন, কিন্তু বব ইভান্স তাদের যে কারও চাইতে আরও অনেক বেশি দক্ষতার সাথে এই কাজটি করতে পারেন। দিনের বেলায় পাদ্রী ইভান্স অস্ট্রেলিয়ার ” ইউনাইটিং চার্চের” হয়ে আধা-অবসরপ্রাপ্ত সহৃদয় এক যাজক হিসাবে কাজ করেন। পাশাপাশি তিনি উনিশ শতকের ধর্মীয় আন্দোলনের ইতিহাস নিয়েও ফ্রিল্যান্স গবেষনার কাজ করেন। কিন্তু রাতের বেলায় তিনি অচিন্তনীয় ভাবে বদলে যান। হয়ে যান রাতের আকাশের অতিমানবীয় মেধার অধিকারী এক টাইটান। শিকার করে বেড়ান সুপারনোভা।

আমাদের অতি আপন সূর্য্যের চেয়েও অনেক অনেক গুন বড় একটা বিশালাকার নক্ষত্রের জীবন সায়াহ্নে যখন তার কাঠামোটি হটাৎ করেই ভেঙে পরে এবং অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের অবতারনা করে বিস্ফোরিত হয়ে মুহূর্তের মধ্যেই প্রায় ১০০ টা সূর্য্যের সমান শক্তি নিঃসৃত করে এবং তার আপন গ্যালাক্সিতে সবচাইতে উজ্ঝ্বল নক্ষত্র হিসাবে কিছু সময়ের জন্য জ্বলতে থাকে তখন সেই নক্ষত্র টিকে বলে সুপারনোভা। ইভান্স বলেন, “যদি এক ট্রিলিয়ন হাইড্রোজেন বোমা এক সাথে বিস্ফোরিত হয় তবে তার সাথে সুপারনোভার তুলনা করা যায়।” যদি আমাদের ৫০০ আলোকবর্ষের মধ্যেও কোনো সুপার নোভা ঘটে তবে বলা যায় আমাদের দিন শেষ। ইভান্স অনেকটা ঠাট্টা করেই বলেন, “সে দিন আমাদের খেলা সাঙ্গ হবে।” কিন্তু মহাবিশ্বটা আসলে এত বিশাল বড় আর সুপারনোভা গুলিও ঘটে এত দূরে দূরে যে আমাদের ক্ষতির কোন সম্ভাবনাই নেই। বস্তুতঃ পক্ষে বেশির ভাগ সুপারনোভাই ঘটে এতটাই অকল্পনীয় দূরে যে সেগুলোর আলো আমাদের চোখে খুবই দূর্বল ঝিলিক হিসাবে ধরা পরে। গড়ে প্রায় একমাসের মত সময় ধরে যখন সুপারনোভা গুলি দৃশ্যমান থাকে, সে সময়টাতে আকাশের অন্যান্য নক্ষত্র থেকে তাদের আলাদা করে চেনার উপায় হচ্ছে যে সেগুলো আকাশের এমন এক জায়গায় অবস্হান করে যে জায়গাটি আগে শূণ্য ছিলো। আর পাদ্রী ইভান্স রাতের আকাশের গম্বুজে নক্ষত্রদের ভীড়ের মাঝ থেকে এই ব্যতিক্রমী এবং অনিয়মিত ভাবে উদয় হওয়া সুপারনোভা গুলিকে খড়ের গাদা থেকে সূঁচ খোজার মত করে খুজে বের করেন।

এটা যে কত বড় একটা কৃতিত্বের কাজ সেটা বুঝতে হলে কল্পনা করুন একটি সাধারণ মাপের খাবার টেবিল কালো কাপড় দিয়ে ঢাকা আছে। এখন কেউ যদি একমুঠো লবণ টেবিলটা জুড়ে ছড়িয়ে দেয় তাহলে এই ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা লবণ দানা গুলোকে একটি নক্ষত্রপুন্জ্ঞ বা গ্যালাক্সি হিসাবে ভাবা যেতে পারে। এখন কল্পনা করুন আরও ১৫০০ টি টেবিল যেগুলোকে এক সারিতে সাজিয়ে রাখলে প্রায় দুই মাইল লম্বা হবে। প্রত্যেকটি টেবিল জুড়েই এলোমেলো ভাবে লবণের দানা ছড়ানো ছিটানো আছে। এখন একটা অতিরিক্ত লবণ দানা যদি কোন একটি টেবিলে রাখেন তবে বব ইভান্স টেবিল গুলির দিকে এক পলক তাকিয়েই বলে দিতে পারবেন কোন দানাটা নতুন যোগ করা হয়েছে। এই নতুন লবণ দানাটাই হচ্ছে সুপারনোভা।

আকাশের কোন নক্ষত্রটি কোথায় আছে এটা মনে রাখবার ক্ষেত্রে ইভান্সের মেধাশক্তি এতটাই ব্যতিক্রমী যে নিউরোলজিস্ট অলিভার স্যাক্স মস্তিস্কের ইন্দ্রিয় সমস্যায় আক্রান্ত কিন্তু অসাধারন কৃতিত্বের অধিকারী কিছু মানুষকে নিয়ে লেখা তাঁর “An Anthropologist on Mars” বইয়ের একটি অধ্যায়ে মনোবৈক্যলের অধিকারী কিন্তু অসাধারন গুনীদের (Autistic-Savant) নিয়ে আলোচনায় পুরো একটি প্যাসেজে ইভান্সকে নিয়ে লিখেছেন। সাথে সাথে তিনি এও বলতে ভুলেননি যে তিনি মনে করেন না যে ইভান্স মনোবৈক্যলে ভুগছেন (Autistic)। ইভান্স কখনও স্যাক্সকে সামনা সামনি দেখেননি। তিনি Autistic কিংবা Savant হতে পারেন এই সম্ভাবনার কথা শুনে মৃদু হাসেন। কিন্তু তিনি নিজেও তাঁর এই অসাধারন গুনের ব্যাখ্যা দিতে অক্ষম । তিনি বলেন, “আমি সহজাত প্রবৃত্তি বশেই আকাশের কোন তারাটা কোথায় আছে খুব সহজেই মনে রাখতে পারি। কিন্তু এমন আরও অনেক জিনিষ আছে যে গুলোতে আমি খুবই দুর্বল। যেমন আমি মানুষের নাম একদমই মনে রাখতে পারিনা।” ইভান্সের স্ত্রী এলেইন-ও স্বামীর সাথে একমত। তিনি কৌতুক করে বলেন, “ইভান্স কোন জিনিষটা কোথায় রেখেছে এটা মনে রাখতে পারে না।”

আকাশের দিকে মাথা তুলে তাকালে মহাবিশ্বের খুবই ক্ষুদ্র একটা অংশ আমরা দেখতে পাই। খোলা চোখে মাত্র ৬ হাজারের মত নক্ষত্র দেখা যায়। আর কোন একটা নির্দিস্ট স্হান থেকে সংখ্যাটা মাত্র দুই হাজারের মত। দূরবীণ দিয়ে দেখলে সংখ্যাটা একলাফে ৫০ হাজারে গিয়ে দাড়ায়।তবে খুবই ছোট একটা ২ ইন্ঞ্চি টেলিস্কোপের সাহায্যে প্রায় ৩ লক্ষ নক্ষত্র দেখা সম্ভব। আর দূরবীনটা যদি হয় ১৬ ইন্ঞ্চির তাহলে নক্ষত্রের বদলে আপনাকে গ্যালাক্সি গুনতে হবে। ইভান্স বাসার পিছনের ডেকে বসে তার ১৬ ইন্ঞ্চি দূরবীণের সাহায্যে ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষ গ্যালাক্সি পর্যবেক্ষণ করতে পারেন। প্রতিটা গ্যালাক্সিতেই রয়েছে বিলিয়ন বিলিয়ন নক্ষত্র। সংখ্যাটা খুবই সমীহ জাগানো কিন্তু তার পরেও সুপারনোভারা খুবই বিরল।

লক্ষ কোটি বছর ধরে একটা নক্ষত্র জ্বলতে পারে কিন্তু সেটা একবারই মৃত্যু বরণ করে এবং সে মৃত্যু হয় খুবই তড়িৎ। সে তুলনায় আবার খুবই কম সংখ্যক নক্ষত্র বিস্ফোরিত হয়। বেশিরভাগেরই জীবন প্রদীপ নিভে যায় নিরবে, ভোর বেলা ক্যাম্প ফায়ারের আগুনের মত। শত শত বিলিয়ন নক্ষত্র সমৃদ্ধ একটা সাধারণ গ্যালাক্সিতে ২ থেকে ৩ শ বৎসরে ১ টা সুপারনোভা সংঘটিত হয়। যার ফলে সুপার নোভার দেখা পাওয়া অনেকটা এ্যাম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের অবজারভেশন ডেকে দাড়িয়ে টেলিস্কোপের সাহায্যে ম্যানহাটনের অগনিত জানালার ফাক দিয়ে কোনও একজনের ২১তম জন্মদিনের কেক কাটার দৃশ্য খুজে পাওয়ার মত।

ইভান্স যখন ১৯৮০ সালে সুপার নোভা খোজা শুরু করেন তখন পর্যন্ত পুরো এ্যাস্ট্রনমিকাল সোসাইটি ৬০টিরও কম সুপার নোভার সন্ধান পেয়েছিলো। আরো ২০০১ সালের আগস্ট মাস পর্যন্ত ইভান্স একাই ৩৪ টি সুপার নোভার সন্ধান পান। ৩ মাস পরেই খুজে পান তার ৩৫তম সুপার নোভার এবং ২০০৩ সালের প্রথম দিকে ৩৬তমটি।

সুপার নোভাগুলি কয়েক ধরনের হতে পারে। যেমন Ia, Ib, Ic, এবং II. এই বিভাজন গুলি করা হয় সাধারনতঃ তাদের থেকে নির্গত বর্নচ্ছটার বিশেষ বৈশিষ্ট্যের উপর এবং সময়ের সাথে সাথে আলোর উজ্জ্বলতার যে পরিবর্তন হয় (লাইট কার্ভ) তার উপর ভিত্তি করে। এদের মধ্যে Ia ধরনের সুপারনোভা মহাকাশ বিজ্ঞানীদের কাছে বিশেষ ভাবে গুরুত্বপূর্ন। কারণ এ ধরনের সুপার নোভা গুলি সাধারণত একই ভরের হয়ে থাকে এবং এদের বিস্ফোরণের ধরনটাও সবসময় একই রকম হয়। আর এদের উজ্জ্বলতাও সবসময় এক রকম হয়। এ কারনেই এই ধরনের সুপারনোভাগুলিকে একটি স্ট্যান্ডার্ড হিসাবে ধরে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের সম্প্রসারনের হার নির্নয় করে থাকেন।

খুব স্বাভাবিক ভাবেই আমাদের মনে যে প্রশ্নটা আসে সেটা হলো, এ রকম একটা নক্ষত্র আমাদের খুব কাছেই কোথাও যদি বিস্ফোরিত হয় তাহলে কি হবে? আমাদের সবচাইতে কাছের নক্ষত্রটা হচ্ছে ৪.৩ আলোকবর্ষ দূরে অবস্হিত আলফা সেঞ্চুরি। তাই এরকম মনে হওয়াটা স্বাভাবিক যে ওটা যদি বিস্ফোরিত হয় তবে আমাদের হাতে ৪.৩ বছর সময় আছে ঘটনাটা পর্যবেক্ষণ করার। পৃথিবীর বুকে মানুষের জীবন যাত্রা তখন কেমন হবে? যদি মানুষ জানতে পারে যে আর মাত্র ৪ বছর ৪ মাস সময় আছে মহাপ্রলয় হতে, মানুষকি তখনও তার দৈনন্দিন কাজে যাবে? কৃষকেরা কি যাবে ক্ষেতে ফসল বুনতে? কেউ কি যাবে দোকানে প্রয়োজনীয় জিনিষ কিনতে?

আসলে, সেরকম কিছুই ঘটবে না। এর রকম একটা ঘটনার সংবাদ আলোর গতিতে ছুটে চলে, আর সেই সাথে সাথে তার ধ্বংসযজ্ঞ চালানোর ক্ষমতাও। ফলশ্রুতিতে আমরা যে মূহূর্তে জানব এই ঘটনার কথা, সেই একই মূহুর্তে আমাদের মৃত্যুও ঘটবে। কিন্তু এটা নিয়ে আমাদের দুঃচিন্তার কোন কারন নেই। সুপারনোভার বিস্ফোরনের ফলে পৃথিবী ধ্বংস হতে হলে নক্ষত্রটাকে রিডিকুলাসলি আমাদের সন্নিকটে থাকতে হবে।

এধরনের বিস্ফোরনে অনেক ধরনের বিপদ হতে পারে….বিভিন্ন কসমিক রে’র তেজস্ক্রিয়তা সহ আরও অনেক কিছু। বিস্ফোরনের ফলে আধিভৌতিক আলোর তৈরি তিরতির করে কাপতে থাকা একটা চাদরের মত চমৎকার সব আলোর বর্ণচ্ছটা তৈরি হবে। তবে সেটা আমাদের জন্য মোটেও সুখকর কোন সংবাদ হবে না। এই রকম শক্তিশালী প্রদর্শনির ক্ষমতা থাকলে সেটা ম্যাগনেটস্ফিয়ার স্তরকে ছিন্নবিছিন্ন করে দেবে। আর ম্যাগনেটস্ফিয়ার হলো আমাদের বায়ুমন্ডলে অনেক উঁচুতে অবস্হিত একটা স্তর যেটা আমাদেরকে সুর্য্যের ক্ষতিকর অতি বেগুনি রশ্মি সহ বিভিন্ন ধরনের মহাজাগতিক রশ্মির আক্রমণ থেকে রক্ষা করে। ম্যাগনেটস্ফিয়ার স্তর ছাড়া কেউ যদি সূর্য্যের আলোর নীচে দাড়ায় তবে মূহুর্তেই সে পুড়ে যাওয়া পিৎজার চেহারা ধারন করবে।

কিন্তু যে কারণে আমরা মোটামুটি নিশ্চিত যে আমাদের গ্যালাক্সিতে এ ধরণের কিছ ঘটবে না সেটা হলো প্রথমতঃ একটা বিশেষ ধরণের নক্ষত্র হলেই শুধুমাত্র বিস্ফোরিত হওয়া সম্ভব। এরকম একটা নক্ষত্রকে হতে হবে সূর্য্যের চেয়ে কমপক্ষে ১০ অথবা ২০ গুন বড় এবং সেটাকে কমপক্ষে আমাদের থেকে ৫০০ আলোকবর্ষের চেয়ে কম দুরত্ব্বের মধ্যে তাকতে হবে। খুশির খবর হলো অতবড় নক্ষত্র আমাদের কাছে ধারে কোথাও নেই। সৌভাগ্যক্রমে মহাবিশ্বটা বিশাল বড়। আমাদের সবচাইতে কাছের সম্ভাব্য প্রার্থী নক্ষত্র হলো বিটেলগিজ, যার বিভিন্ন ধরণের অনিয়মিত কার্যকলাপ থেকে বোঝা যায় যে কিছু একটা ঘটতে পারে সেখানে। কিন্তু বিটেলগিজ আমাদের থেকে ৫০ হাজার আলোকবর্ষ দুরে অবস্হিত।

লিপিবদ্ধ সময়ের ইতিহাস থেকে দেখা যায় মাত্র অর্ধ-ডজনবার এমন সুপার নোভা ঘটেছিলো যেটা খালি চোখে দৃশ্যমান ছিলো। ১০৫৪ সালে ঘটেছিলো এরকম একটা বিস্ফোরণ যেটা থেকে সৃষ্টি হয়েছিলো ক্রাব নেবুলার। সবশেষ সুপার নোভা, যেটা শুধুমাত্র দক্ষিণ গোলার্ধ থেকে দেখা গিয়েছিলো, ঘটেছিলো ১৯৮৭ সালে। কিন্তু সেটাও ছিলো ১৬৯০০০ আলোকবর্ষ দূরে।

সুপারনোভা বিজ্ঞানীদের কাছে খুবই গুরুত্ত্বপূর্ণ। কারণ, একটি বিশেষ ধরনের সুপারনোভাকে (Ia) স্ট্যান্ডার্ড ক্যান্ডল হিসাবে ধরে বিজ্ঞানীরা মহাবিশ্বের সম্প্রসারনের হার নির্নয় করে থাকেন। আরও একটি বিশেষ কারনে সুপারনোভাগুলি আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মহাবিশ্বের শুরুতে বিগ ব্যাং প্রচুর পরিমানে হালকা গ্যাস তৈরী করলেও কোন ভারী উপাদান বা এলিমেন্ট তৈরী করেনি। সেগুলোর উৎপত্তি হয়েছিলো বিগ ব্যাংয়ের আরও অনেক অনেক পরে। অনেকদিন ধরেই বিজ্ঞানীরা কোনভাবেই বুঝতে পারছিলেন না পরে সেগুলো কিভাবে তৈরী হলো। সমস্যা হলো কার্বন এবং আয়রন সহ অন্যান্য ভারী এলিমেন্ট বা উপাদান তৈরীর জন্য দরকার ভয়ানক উত্তপ্ত কিছু, এমনকি সবচেয়ে উত্তপ্ত নক্ষত্রের কেন্দ্রের চেয়েও উত্তপ্ত কিছু। আর এই উপাদানগুলি না তৈরী হলে দুঃখজনক হলেও সত্যি আমারাও হতাম তাৎপর্যহীন।

যখন একটা নক্ষত্র বিস্ফোরিত হয় তখন সেটা প্রচুর পরিমাণে তাপ উৎপন্ন করে – প্রায় ১০০ মিলিয়ন ডিগ্রি বা তারও বেশি। আর এই অতি উচ্চ তাপমাত্রায় নিউক্লিও সিনথেসিস পদ্ধতিতে ভারী এলিমেন্ট বা উপাদান গুলো তৈরী হয়ে থাকে এবং মহাশুন্যে ছড়িয়ে যায়। ১৯৫৭ সালে বিজ্ঞানী ফ্রেড হয়েল দেখান কিভাবে সুপারনোভা বিস্ফোরনের সময় এই ভারী এলিমেন্টগুলি তৈরী হয়। আর তার পরেই বিজ্ঞানীদের পক্ষে সম্ভব হয় আমরা কিভাবে এলাম তার সম্ভাব্য দৃশ্যপট গুলি নির্মান করা। বিস্ফোরিত নক্ষত্রগুলি যখন মহাশূণ্যে এই ভারী এলিমেন্ট গুলি ছড়িয়ে দেয় তখন এরা নতুন এক গ্যাসীয় মেঘ বা আন্তর্নক্ষত্রিক মাধ্যম সৃস্টি করে এবং পরবর্তিতে এই গ্যাসীয় মেঘগুলি একত্রিত হয়ে সৃস্টি করে নতুন একটি সৌর জগতের ।

প্রায় ৪.৬ বিলিয়ন বছর আগে এক বিশাল গ্যাসের ঘূর্ণি এবং ধূলিকণা, আমরা এখন যেখানে আছি সেখানে, প্রায় ১৫ বিলিয়ন মাইল জুড়ে বিস্তৃত মহাশূণ্যে জড়ো হয় এবং বাড়তে থাকে। মোটামুটি পুরোটাই, আমাদের সৌরজগতের ৯৯.৯% ভরই, এক জায়গায় সংগঠিত হয় এবং সৃস্টি করে সূর্য্যের। আর ভেসে বেড়ানো অন্যান্য রয়ে যাওয়া গ্যাস এবং ধূলিকণা থেকে দুটি মাইক্রোস্কপিক কণা ভাসতে ভাসতে কাছাকাছি চলে আসে এবং ইলেক্ট্রোস্ট্যাটিক বলের কারণে পরস্পরের সাথে সংযুক্ত হয়। আর সেটাই ছিলো আমাদের গ্রহের সৃস্টির সবচাইতে আদি মূহুর্ত। পুরো বিশৃঙ্খল সৌরজগৎ জুড়েই তখন প্রতিনিয়তই ঘটে চলেছে এরকম অসংখ্য ঘটনা।

এই সমস্ত ধূলিকণার সংঘর্ষের ফলে একটু একটু করে তৈরী হচ্ছিলো আরেকটু বড় বড় পিন্ডের। আর একটা সময় এই পিন্ডগুলি আরও বড় হতে হতে তৈরী হলো ছোট ছোট মহাকাশীয় পাথরখন্ডের। এই অন্তহীন ধাক্কা এবং সংঘর্ষ কখনও কখনও এগুলোতে ফাটল ধরাত বা ভেঙ্গে ফেলত অথবা পুণরায় জোড়া লাগাত। আর এভাবেই এলোমেলো ভাবে চলতে থাকে অন্তহীন বিন্যাস এবং পুনর্বিন্যাসের। প্রতিটা সংঘর্ষেরই একটি বিজেতা ছিলো আর কোন কোন বিজয়ী আকারে আরও বড় হতে থাকলো এবং একটা পর্যায়ে যেয়ে এমন আকার ধারণ করলো যে, যে কক্ষপথে সেটি ভ্রমন করছিলো সেটিতে আধিপত্য বিস্তার করা শুরু করলো।

এই সবই ঘটেছে অত্যন্ত দ্রুত। ছোট একটা ক্লাস্টার থেকে শত শত মাইল বিস্তৃত একটা শিশু গ্রহে পরিণত হতে সময় লেগেছে মাত্র হাজার বছর। এরপর আরও ২০০ মিলিয়ন বছর বা তারও কম সময়ে পৃথিবী সৃস্টির কাজ মোটামুটি ভাবে শেষ হয়ে গিয়েছিলো। যদিও সেই সময় পৃথিবী ছিলো উত্তপ্ত এবং গলিত অবস্হায়। আর তখনও মহাশূণ্যে ভেসে বেড়ানো ধ্বংসাবশেষ নিয়মিতই পৃথিবীর বুকে আছড়ে পরত। ঠিক এই সময়ে ৪.৫ বিলিয়ন বছর আগে মঙ্গল গ্রহের আকারের একটা বস্তু পৃথিবীর বুকে আছড়ে পরে এবং পৃথিবীর একটা উল্লেখযোগ্য অংশকে পৃথিবী থেকে আলাদা করে ফেলে। কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ছুটে যাওয়া পদার্থগুলো পুনরায় জোড়া লাগলো এবং বছর না ঘুরতেই একটা গোলাকার পাথরের আকার নিলো যেটা আজও আমদের সঙ্গ দিয়ে যাচ্ছে। সৃস্টি হলো চাঁদ।

চাঁদের বেশিরভাগ পদার্থই এসেছে পৃথিবীর উপরিভাগের আস্তর থেকে, মধ্যভাগ থেকে নয়। আর সে কারণেই চাঁদে লোহার পরিমাণ খুবই কম, যেখানে পৃথিবীতে লোহা আছে প্রচুর পরিমাণে। পৃথিবী যখন এখনকার চেয়ে এক তৃতিয়াংশ আকারের সমান ছিলো তখনই এর বায়ূমন্ডল গঠনের কাজ শুরু হয়। সে সময় বায়ু মন্ডলে প্রধানতঃ ছিলো কার্বন-ডাই-অক্সাইড, নাইট্রোজেন, মিথেন, এবং সালফার। যেগুলো কিনা কোনভাবেই প্রাণ ধারনের উপযোগীতার সাথে সংশ্লিষ্ট করা যায় না। কার্বণ-ডাই-অক্সাইড একটা শক্তিশালী গ্রীণ হাউস গ্যাস। এটার একটা ভালো দিকও ছিলো। সূর্য্যটা তখন আরও অনেক কম উত্তপ্ত ছিলো। কার্বন-ডাই-অক্সাইডের গ্রীণ হাউস ইফেক্টের সুবিধাটা না থাকলে পৃথিবীটা চিরস্হায়ীভাবে বরফ হয়ে থাকত আর জীবন সৃস্টির প্রথম পদক্ষেপটা হয়ত কখনই সম্ভব হতনা। কিন্তু, জীবন শুরু হয়েছে।

পরবর্তি ৫০০ মিলিয়ন বছর তরুণ পৃথিবী ক্রমাগতভাবে ধুমকেতু, উল্কাপিন্ড, এবং অন্যান্য মহাকাশীয় ধ্বংসাবশেষ দ্বারা আক্রান্ত হতে থাকলো । যার ফলশ্রুতিতে সাগরগুলো ভরে গেলো পানি এবং অন্যান্য জীবন গঠনের সহায়ক উপাদানে। আরও চার বিলিয়ন বছর পরে মানুষ ভাবতে লাগলো কিভাবে সবকিছুর শুরু হয়েছিলো। আর তার পরের গল্পটা সবারই জানা।

সূত্রঃ এ শর্ট হিস্ট্রী অব নিয়ারলী এভরিথিং – বিল ব্রাইসন এবং ইন্টারনেট।