(পূর্ব-প্রকাশিতের পর…)

অস্পৃশ্য ও ব্রাহ্মণ্যবাদ পর্ব:[০১] [০২] [০৩] [০৪] [০৫] [*] [০৭] [০৮]

০৭
ধর্মীয় মোড়কে সম্ভবত ব্রাহ্মণ্যবাদই পৃথিবীর প্রাচীনতম বর্ণবাদী দর্শন। এবং বেদ-নির্যাস হিসেবে স্বীকৃত মনুস্মৃতি বা মনুসংহিতা যদি এ দর্শনের তাত্ত্বিক ও প্রয়োগিক ভিত্তিমূল হয় তাহলেই বলতেই হয়, এটা কেন সম্পূর্ণ মানবতা-বিরোধী একটা অসভ্য দর্শন হবে না ? একটা সমৃদ্ধ জনগোষ্ঠিকে জঘণ্যতম বর্ণাশ্রমে বিভাজিত করা এবং একজন কাল্পনিক সৃষ্টিকর্তা ব্রহ্মা’র নাম দিয়ে সমাজের উৎপাদনসংশ্লিষ্ট বৃহত্তর জনগোষ্ঠিকে ক্ষমতায় আসীন শাসক গোষ্ঠির প্রতিভূ বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ নামের এক স্বার্থান্বেষী পরভোজী শ্রেণীর সেবাদাস বানিয়ে ফেলা যে একটা চতুর রাজনীতি, তা বোধকরি বলার অপেক্ষা রাখে না। এ রাজনীতির পেছনে যে গভীর ও সূক্ষ্ম কূটাভাষ লুকিয়ে আছে তা হলো নিকৃষ্টবর্ণ শূদ্রসংশ্লিষ্টতায় কতকগুলো বর্ণবহির্ভূত অন্ত্যজ বা অস্পৃশ্য সম্প্রদায়ের সৃষ্টি। বর্ণাশ্রমের মাধ্যমে চতুর্বর্ণ সৃষ্টি করে গোটা জনগোষ্ঠিকে প্রথমে দুটো শ্রেণীতে ভাগ করে ফেলা হলো- উচ্চশ্রেণী ও নিম্নশ্রেণী। ক্ষমতালিপ্সু শাসক বা ক্ষমতাসীনরা উৎকৃষ্ট বা উচ্চশ্রেণীভুক্ত আর্য, আর শ্রমজীবী শাসিতরা হলো নিকৃষ্ট বা নিম্নশ্রেণীর অনার্য শূদ্র। এই শ্রেণীবিভেদ তৈরি করেই ক্ষান্ত হয়নি এরা। যেহেতু শাসিতরাই সংখ্যাধিক্যে বিপুল, তাই সুকৌশলে এদের মধ্যে আবার তৈরি করা হলো বিষাক্ত বিভেদের এক ভয়ানক বিচ্ছিন্নতা। আজব এক সত্ত্বার জন্ম দেয়া হলো- যার নাম অস্পৃশ্য (Untouchable)। মারাঠি ভাষায় যাকে বলা হয় ‘দলিত’, অর্থাৎ নির্যাতিত।

ধর্মের অলৌকিক মোড়কে ঘটানো এই রাজনৈতিক কূটচালে খুব স্বাভাবিকভাবে ধরাশায়ী হলো বিশাল এক জনগোষ্ঠি। লেখাপড়া বা শাস্ত্র অধ্যয়নের অধিকার থেকে চিরতরে বঞ্চিত করে তাদেরকে চিরকালের অন্ধ বানিয়ে রাখার ষড়যন্ত্রও খুব ভালোভাবেই নিষ্পন্ন হলো। একটা প্রাচীন সমৃদ্ধ সভ্যতার সামাজিক কাঠামোকে ভেঙেচুরে দুমড়েমুচড়ে তার জায়গায় ধীরে ধীরে কার্যকর করা হলো একটা তীব্র বর্ণবিদ্বেষী ব্যবস্থা ব্র্রাহ্মণ্যবাদ। যার নাম বৈদিক বা আর্য সভ্যতা। এভাবেই প্রাচীন ভারতবর্ষে বহিরাগত লুণ্ঠনকারী আর্যদের চাপিয়ে দেয়া ট্র্যাজিক অবদান হলো ব্রাহ্মণ্যবাদ। এরপর শত সহস্র বছর ধরে প্রতিপালিত এই বিষাক্ত বর্ণদর্শন মিশে গেলো প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই ভারতবর্ষের আর্থ-সামাজিক ও ধর্মীয় কাঠামোর অবশ্যপালনীয় উপাচার ও সংস্কৃতির রক্তে। তা থেকে আর মুক্ত হতে পারেনি এই সমাজ। মুক্ত হওয়া এখনো যে সম্ভব হয়নি তার প্রমাণ বর্তমান বাংলা ও ভারতীয় হিন্দু সমাজের বর্ণবাদী ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষঙ্গগুলো। বিবাহে, প্রয়ানে, সামাজিক অনুষ্ঠানে তথা সর্বক্ষেত্রে এই বর্ণাশ্রমের বিষাক্ত থাবা আজো আদিরূপেই বর্তমান। যদিও তা দৃশ্যমান স্বরূপে ততোটা আক্রমণাত্মক নয়, কিন্তু অন্তর্গত অবস্থানে কোনভাবেই কম ক্রিয়াশীল নয়।

ব্রাহ্মণ্যবাদের ভিত্তিমূল এই মনুসংহিতা অধ্যয়নে স্বাভাবিক কাণ্ডজ্ঞান খরচ করলেই এর তীব্র ফাঁকিটা ধরা পড়ে যায় খুব সহজেই। এমন মানববিদ্বেষী বিষাক্ত বিধান কোন স্রষ্টা নামীয় অলৌকিক মুখ থেকে নিঃসৃত হতে পারে কিনা তা সন্দেহ করা অযৌক্তিক হবে কি ? হওয়ার প্রশ্নই আসে না। সমকালীন সামাজিক বাস্তবতা ও বিদ্বেষমূলক জীবনাচারের প্রয়োজনেই এর শ্লোকগুলো বিভিন্ন সময়ে রচিত হয়েছে বলে মনে হয়। ভূমি নিয়ে বিরোধের প্রেক্ষিতে কিভাবে জমি ও বাসস্থানের সীমানা নির্ধারণ করতে হবে, সীমানায় কী গাছ বা উদ্ভিদ রোপন করলে স্থানচ্যুত হবার সম্ভাবনা থাকবে না। কিংবা যে লোক আবদ্ধ জলস্রোতের বাঁধ ভেঙে দেয় তার ব্যাপারে কী ব্যবস্থা নিতে হবে অথবা মাথায় বস্ত্রাদি বেষ্টন করে বা চর্মপাদুকা পরে ভোজন করা হলে পরিণতি কী হবে; নতুবা কোন্ বস্তু উষ্ণ অবস্থায়, কোন্ বস্তু ঠাণ্ডা অবস্থায়, কোন্ দ্রব্য তিনদিন পরেও খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা যাবে, রসুন কারা খেতে পারবে, কখন লবণ বিক্রি করা যাবে না বা রাজা দেবতার প্রতিনিধি ইত্যাদি বিধান রচনায় কোন অলৌকিক উৎস থাকার দাবী একান্তই হাস্যকর মনে হয়। প্রতিদিনের জীবনযাত্রার খুটিনাটি উপাচার ও কর্তব্য পালনের যে পৌনপুনিক অগুনতি বিধি রচিত হয়েছে তাতে এটা মনে করা অযৌক্তিক হবে না যে মনুসংহিতার এক বা একাধিক শাস্ত্ররচয়িতারা আসলে চলমান পরিবেশ-প্রতিবেশেই লালিত-পালিত স্বেচ্ছা-অন্তরালবর্তী কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠি।

তবু এটাই অবশ্যপালনীয় ধর্মীয় সামাজিক আর্যবিধান হিসেবে ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে। গৌতম বুদ্ধ এই অনাচারের বিরুদ্ধে প্রথম প্রতিবাদী হলেও এর পর সুদীর্ঘকাল এই ব্রাহ্মণ্যবাদের বিপক্ষে আর টু-শব্দটি করার মতো কেউ দাঁড়াতে যে পারে নি, তার কারণও যুগে যুগে এই ব্রাহ্মণ্যবাদের প্রতিভূ বর্ণবাদী নেতৃত্বের নির্লজ্জ আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গি ও সুকঠিন সামাজিক দ্বৈত-কাঠামো। এ বড় শক্ত দূর্গ।এ সবকিছু বিবেচনায় নিলে এটা ভাবা কি খুব অযৌক্তিক হবে যে জোর করে চাপিয়ে দেয়া বর্ণবাদী শৃঙ্খলে আবদ্ধ কোন নির্যাতিত শূদ্র বা অস্পৃশ্য জনগোষ্ঠি কখনোই তার সমকালীন সমাজকে দুষিত করেনি, বরং এক কাল্পনিক স্রষ্টা ব্রহ্মার নামে কোন চতুর স্বার্থান্বেষী ক্ষমতালিপ্সু গোষ্ঠি কর্তৃক সৃষ্ট মানবতাবিরোধী ব্রাহ্মণ্যবাদই আমাদের এই প্রাচীন মানব সমাজকে ভয়ঙ্করভাবে দুষিত করে দিয়েছে ? যার বিষাক্ত নীল ছোবল পবিত্র মানবাত্মাকেই কলঙ্কিত করেছে।

অতঃপর আরেক বিদ্রোহীর উত্থান
শাক্যমুণি গৌতম বুদ্ধের প্রয়ানের দীর্ঘ আড়াই হাজার বছর পর তাঁর আর এক সার্থক বিপ্লবী অনুগামীর আবির্ভাব হলো এই ভারতবর্ষেই। যিনি মনু’র মানবতাবিরোধী শাস্ত্রধারী হিন্দুদের প্রচলিত জাত-পাতের ব্যবস্থাকে অস্বীকার করে দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করলেন-

‘মনুসংহিতাকে হিন্দু ধর্মের আচরণবিধির পবিত্র গ্রন্থরূপে গণ্য করা হয়। মনুস্মৃতিকে ব্রাহ্মণ জগদীশ্বর বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে, শূদ্রের সম্পদ অর্জনকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে এবং ব্রাহ্মণেরা শূদ্রের সম্পত্তির ন্যায়সঙ্গত অধিকারী বলে স্বীকৃত হয়েছে। যে কোন বর্ণের নারী ব্রাহ্মণদের উপভোগের বস্তু। গ্রন্থটি ব্রাহ্মণ্যবাদের কালাকানুন এবং সভ্যসমাজের কলঙ্ক। কাজেই গ্রন্থটিকে অবিলম্বে ভষ্মীভূত করা প্রয়োজন।’

বর্ণবাদের অসভ্য উৎস হিন্দু সমাজের সংবিধান বলে খ্যাত মনুসংহিতা যে আদৌ কোন ধর্মগ্রন্থ হতে পারে না, কিছু কুচক্রী স্বার্থান্বেষী লোভী ভণ্ড প্রতারক মানুষের শোষণের হাতিয়ার কেবল, আম্বেদকরই প্রথম উচ্চারণ করলেন তা। এবং খুব স্পষ্টভাবে ইতিহাস ঘেটে ঘেটে যুক্তি ও প্রমাণ সহকারে। এমন তীব্র ও স্পষ্ট বক্তব্য এর আগের সুদীর্ঘ অতীতে আর কারো মুখ থেকে উচ্চারিত হতে শুনা যায় নি। কিন্তু চলমান বাস্তবতাকেও অস্বীকার করার উপায় নেই তাঁর। তাই তিনি এও বলেন-

আমার কাছে আমার জীবন অপেক্ষা আমার দেশের স্বার্থ অনেক বড়। আমার অসহায় এবং নির্যাতিত দলিত সমাজের স্বার্থ তার চেয়ে বড়।
শিক্ষা সংহতি ও সংগ্রামী ঐক্যই শূদ্র, দলিত-শোষিত সমাজের মুক্তি আনতে পারে। তোমরা সংঘবদ্ধ হও অধিকার আদায় করে লও।

তিনি উপমহাদেশের কোটি কোটি লাঞ্ছিত, দলিত ও মানবিক অধিকারহীন জনগণের মুক্তিদাতা, সারা বিশ্বে মানবাধিকার যোদ্ধা নামে খ্যাত এক দলিত পুরুষ বাবা সাহেব ড. ভীম রাও রামজি আম্বেদকর (Baba Saheb D. Bhima Rao Ramji Ambedkar)। তিনি ছিলেন একই সঙ্গে সমাজ বিজ্ঞানী, রাষ্ট্র বিজ্ঞানী ও অর্থনীতিবিদ। তাঁর স্পষ্ট বক্তব্য-

‘দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক ও সামাজিক স্থিতিশীলতার জন্য এ অঞ্চল থেকে বর্ণ-বৈষম্য শোষণ নির্মূল করা দরকার। …দক্ষিণ এশিয়ায় সমাজ বিকাশের শত্রু হল ব্রাহ্মণ্যবাদ, সামন্তবাদ ও পুঁজিবাদ।’

তাঁর এ কথা বলার নেপথ্যশক্তি তিনি প্রজাতন্ত্রী ভারতের সংবিধান প্রণেতা কিংবা ভারতের প্রাক্তন আইনমন্ত্রী বা বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ পন্ডিত ও মনীষী বলে নয়। তিনিই ভারতের প্রথম দলিত (Dalit) গ্রাজুয়েট। যিনি তাঁর গোটা জীবনটাই কাটিয়ে দিলেন দলিত জনগোষ্ঠির মুক্তির লক্ষে বর্ণবাদী অনাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ আর আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। মৃত্যুর আগ-মুহূর্ত পর্যন্ত যিনি এই যুদ্ধ থেকে এক পা’ও পিছু হঠেননি। আদর্শের প্রশ্নে ছেড়ে কথা বলেননি ভারতের বর্ণবাদী হিন্দুদের কট্টর প্রতিনিধি মহাত্মা গান্ধীর চাতুর্যপূর্ণ রাজনৈতিক স্ট্যান্টবাজিকেও। আম্বেদকর মহাত্মা গান্ধীর ‘হরিজন’ (harijan) শব্দটিকে বাতিল করে দেন এই যুক্তিতে যে, গান্ধীর (Gandhi) এই পদক্ষেপ নিতান্তই হঠকারী সমাজ-সংস্কারমূলক ফাঁকা বুলি মাত্র৷ গান্ধীর উদ্দেশ্য দলিতদের মুক্তি নয়, বরং সংগঠিত দলিতদের জোটবদ্ধ আন্দোলনকে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার কূট-রাজনীতি। উপমহাদেশের নিপীড়িত দলিত সম্প্রদায়ের মুক্তি বিরোধী গান্ধীর এসব রাজনৈতিক কৌশলের সাথে কখনোই আপোষ করেননি আম্বেদকর। গোটা ভারত জুড়ে সর্বতোমুখি এক দলিত আন্দোলনের সূত্রপাত ঘটান তিনি। তাঁর হাত দিয়েই দলিত সাহিত্য নামে এক মাটিবর্তি সাহিত্যের জন্ম হয়, যার মাধ্যমে তিনি হিন্দু বর্ণবাদের মুখোশ উন্মোচন করে দলিত আন্দোলনে তাত্ত্বিকভাবে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ শক্তি যুক্ত করে সফল আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়ে যান। ১৯২৭ সালের ২৫ ডিসেম্বর তাঁর নেতৃত্বে দলিতরা হাজার বছরের নিগড় ভেঙে বর্ণ হিন্দুদের সংরক্ষিত চাভাকর লেক বা চৌদার পুকুর থেকে জলপান করেন, অসংখ্য দলিত অনুসারী নিয়ে তিনি ভারতীয় বর্ণবাদের আকরগ্রন্থ ‘মনুসংহিতা‘ পুড়িয়ে এর মানবতাবিরোধী অবস্থানের প্রতি সম্পূর্ণ প্রতীকী ও প্রত্যক্ষ অনাস্থা প্রকাশ করেন। দলিতদের শিক্ষার প্রতি ব্যাপক দৃষ্টি দিয়ে, যা এর আগে কল্পনাও করা যায় নি, তাঁর প্রচেষ্টায় ১৯২৮ সালে গঠিত ‘ডিপ্রেসড কাশেস এডুকেশন সোসাইটি’র মাধ্যমে ১৯৪৬ সালে বোম্বেতে সিদ্ধার্থ কলেজ ও ১৯৫১ সালে আওরঙ্গবাদে মিলিন্দ কলেজের প্রতিষ্ঠা তাঁর ধারাবাহিক প্রচেষ্টার ফসল৷ তাঁর নেতৃত্বে দলিতরা নিজেদের সংস্কৃতির প্রতি সচেতন হয়ে ওঠে। ভারতীয় সমাজ ও রাজনীতিতে আম্বেদকরের এই বিপুল অবদান, যা সংক্ষেপে বলে শেষ হওয়ার নয়। আম্বেদকর আর দলিত আন্দোলন একই প্রতীকী ব্যঞ্জনায় উদ্ভাসিত।

তাঁর উত্থানও এই হাজার বছরের অত্যাচারিত অছ্যুৎ দলিত সম্প্রদায় থেকেই। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিপরীতে দাঁড়িয়ে তাঁর রক্তে মাংসে মনে মননে দলিত হবার কষ্টই বেজে গেছে আজীবন। কিন্তু হাজার হাজার বছরের গভীর শিকড়ে প্রোথিত পাহাড়ের মতো জেকে বসা এমন একটা অসম অটল ব্যবস্থার বিপরীতে তাঁর ছোট্ট জীবনের সর্বসত্ত্ব কতোটুকু আর ! গোটা দেশ জুড়ে তীব্র এক ঝড় উঠালেও টলাতে পারেননি তিনি এই অসম ব্যবস্থাকে। শেষপর্যন্ত বুদ্ধের মতোই বর্ণান্ধ হিন্দু সমাজ ও নেতৃত্বের বিরুদ্ধে আরেকটি সামাজিক বিদ্রোহের সূচনার দিকেই এগিয়ে গেলেন, লক্ষ লক্ষ দলিত অনুসারী নিয়ে।

দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন-

“…নির্যাতিত শ্রেণীর মানুষদের হিন্দু হয়েও যদি সম অধিকার থেকে বঞ্চিত থাকতে হয়, বিগত ১৫ বছর ধরে বিভিন্ন আর্থ-সামাজিক, শিক্ষা, রাজনৈতিক শোষণ, বঞ্চনার বিরুদ্ধে আন্দোলন বা সংগ্রাম করেও তাদের কাছ থেকে বিন্দুমাত্র ন্যায়বোধের পরিচয় পাওয়া না যায় তাহলে নির্যাতিত সমাজকে ভাল করে ভেবে দেখতে হবে। তাই দীর্ঘ বাস্তব অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদেরকে আত্মসম্মান ও মানবিক অধিকার লাভ করতে হলে হিন্দু ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হতে হবে। … আমার চরম দুর্ভাগ্য যে, অস্পৃশ্য সমাজে জন্মেছি বলে আমাকে আত্মসম্মানহীন অপমানজনক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে দিন কাটাতে হচ্ছে।”

এবং দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন-

“আমি অস্পৃশ্য হয়ে জন্মগ্রহণ করলেও অস্পৃশ্য হয়ে মরবো না।”

অতঃপর দার্শনিক স্থিরতা দিয়ে মানুষের সাম্যের জায়গাটাকে খুঁজে গেছেন আজীবন।

মহারাষ্ট্রের অত্যন্ত গরীব ও একেবারে নিচু তলার এক দলিত মাহার (Mahar) বা চর্মকার পরিবারে সর্বকনিষ্ঠ সন্তান হিসেবে জন্ম আম্বেদকরের। মহারাষ্ট্রে অনেকগুলো দলিত সম্প্রদায়ের বাস হলেও এদের মধ্যে মাহাররাই ছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ। কিন্তু মাহারদের আলাদা কোন গ্রাম বা পল্লী ছিলো না। প্রতিটা হিন্দু গ্রামের উপান্তে বা প্রান্তসীমায় দু-চার ঘর মাহার থাকতো। গ্রামের প্রধান এলাকার বাইরে ঘর বেঁধে থাকতে হতো। তাদের কাজ ছিলো গ্রাম পাহারা দেয়া, গ্রামের মরা পশু অপসারণ করা, গ্রাম-প্রধান বা মোড়লদের হুকুম অনুযায়ী সমাজের সামষ্টিক কাজে বেগার খাটা, ময়লা পরিষ্কার করা ইত্যাদি।
মাহারদের অসংখ্য কর্তব্য থাকলেও কোন জীবিকার ব্যবস্থা ছিলো না। বর্ণ হিন্দুদের বাড়ির এঁটো কুড়িয়ে, কাটা ক্ষেতের পরিত্যক্ত ফসল কুড়িয়ে, মরা পশুর চামড়া ছাড়িয়ে বিক্রি করে, আর মরা পশুর মাংস খেয়ে জীবন কাটাতে হতো তাদের৷ এদের অস্পৃশ্যতা এতোটাই তীব্র ছিলো যে, তাদের ছোঁয়া লাগলে, এমনকি ছায়া মাড়ালেও উচ্চ শ্রেণীর স্পর্শদোষ ঘটত৷ বর্ণভিত্তিক সমাজে এরা শূদ্রেরও অধম। এক সময়ে তাদের গলায় মাটির পাত্র বাঁধতে বাধ্য করা হতো, যাতে তাদের থুতু মাটিতে পড়ে দূষণ সৃষ্টি না করে৷ আরেকটি বাধ্যবাধকতা ছিল, পেছন দিকে ঝাড়ু বেঁধে রাখা যাতে অন্যদের চোখে পড়ার আগে তাদের পায়ের ছাপ মুছে যায়৷ এরকম একটি পরিবারে জন্ম নিয়ে ভবিষ্যৎ যে কোথায় নির্ধারিত হয়ে যায় তা কল্পনারও বাইরে। কিন্তু যে অছ্যুৎ জাতির জন্য একজন আম্বেদকরকে পেতে হবে তাদের প্রথম স্বপ্ন তৈরি হতে, নিজের দিকে ফিরে তাকাতে, আত্মমুক্তি ঘটাতে, তাদের বৌদ্ধিক উত্তরণ ঘটাতে, তাদের জন্য একজন আম্বেদকরের জন্ম হয়ে যায় ঠিকই।

স্কুলজীবনের শুরুতেই হিন্দু সমাজের বর্ণবাদী জাতিভেদ প্রথা তথা অস্পৃশ্যতার অভিশাপের বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতা তাঁর শিশুমন মর্মে মর্মে উপলব্ধি করতে থাকে। ছাত্রজীবনের অপমানজনক দুর্ব্যবহার ও অত্যাচার তাঁর সংবেদনশীল কোমল হৃদয়ে গভীর রেখাপাত সৃষ্টি করে। যা পরবর্তীকালে হিন্দুধর্ম সম্পর্কে তাঁর মনে প্রবল ঘৃণার সৃষ্টি করে। অস্পৃশ্যের সন্তান বলে স্কুলে বেঞ্চটুলের পরিবর্তে ক্লাশের একেবারে পেছনে ছালার চটে তাঁকে বসতে দেয়া হতো। ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা তাঁর বইখাতা স্পর্শ করতেন না, থুথুর ছোঁয়ায় বাতাস দুষিত হবে বলে তাঁকে ক্লাশে কোন পড়া জিজ্ঞাসা করা হতো না, এমনকি খড়িমাটি অপবিত্র হয়ে যাবে এই শংকায় তাকে বোর্ডে পর্যন্ত লিখতে দেয়া হতো না। স্কুলে স্বহস্তে জল পান করতে পারতেন না। তাঁর মুখের উপর পাত্র উঁচু করে জল ঢেলে দেয়া হতো। উঁচু বর্ণের সহপাঠিদের টিফিন বক্সগুলোয় যাতে তাঁর কোনরূপ ছোঁয়া না লাগে সেজন্য সাবধানে দূরে সরিয়ে রাখা হতো। এরকম বহু নির্মম ঘটনা তাঁকে প্রতিনিয়ত দগ্ধ করেছিলো অবশ্যই। কিন্তু এসবই একজন মুক্তিকামী আম্বেদকরের উন্মেষ ঘটায়। অস্পৃশ্যদের মুক্তির দিশারী দলিত আন্দোলনের বীজ হয়ে মানবতার খোঁজে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ করে দেয় আম্বেদকরকে। পরবর্তীকালের প্রতিটা আন্দোলনের উৎস ও ফলাফল বিশ্লেষণ করলে একটাই প্রতিপাদ্য পেয়ে যাই আমরা, মানবতার সন্ধান। মানুষ হয়ে যে সমাজের মানুষদের মধ্যে মনুষ্যত্বের লেশমাত্র নেই তাদের প্রতি ঘৃণায় ক্ষোভে বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন তিনি। পাশাপাশি খুঁজতে থাকেন মানবতার সাম্যের অমিয়বাণীর উৎসটাকে।

‘তিনটি শব্দের মধ্যে আমার জীবন দর্শন খুঁজে পাই। স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্ব। যদিও আমরা ভারতীয় সংবিধানে রাজনৈতিক কারণে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের নীতিকে গ্রহণ করেছি বস্তুত আমাদের সমাজ জীবনে এগুলোর কোন অস্তিত্ব নেই। এগুলো আমি বুদ্ধের বাণী থেকে গ্রহণ করেছি। হিন্দু ধর্মে স্বাধীনতা, সাম্য ও ভ্রাতৃত্বের কোন স্থান নেই, তাই বুদ্ধের আদর্শ গ্রহণ করলে ভারতীয় রাজনৈতিক ও সামাজিক আদর্শ পরস্পরের পরিপূরক হবে।’

কেন আমি বৌদ্ধধর্ম পছন্দ করি’ শীর্ষক প্রচারিত এক বক্তৃতায় বলেন-

‘আমি তিনটি নীতির জন্য বৌদ্ধধর্ম পছন্দ করি। প্রথমটি হলো প্রজ্ঞা (অলৌকিক ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুক্তিসংগত জ্ঞান), দ্বিতীয়টি হলো করুণা (প্রেম অর্থাৎ সমস্ত প্রাণীর প্রতি ভালোবাসা) এবং তৃতীয়টি হলো সাম্য (সমতা অর্থাৎ সমস্ত মানুষকে সমান মনে করা)।’

শেষপর্যন্ত তিনি তাঁর লক্ষ লক্ষ অনুগামী নিয়ে এই বৌদ্ধধর্মেই দীক্ষা নিয়ে অস্পৃশ্যতার কলঙ্ক মুছে এক নবজন্ম নিয়েছিলেন, এবং দিয়েছিলেন অন্যদেরকেও। অস্পৃশ্য হয়ে জন্মালেও অস্পৃশ্য হয়ে মরেননি তিনি। বুদ্ধের পবিত্র আলো বুকে ধরে এক মহান পাহাড়ের সৌম্য স্থিরতা নিয়ে মহানির্বাণে প্রস্থান করলেন।

আজ আম্বেদকর নেই। রয়ে গেছে তাঁর কর্মযজ্ঞ। অথচ বর্ণান্ধতার গোঁড়ামি থেকে হিন্দু সমাজ মুক্ত হতে পারলো না আজো। এ আমাদেরই নিরন্তর মূর্খতা, অনপনেয় কলঙ্ক। একজন আম্বেদকর কষ্টে, যাপনে, বিদ্রোহে, সাম্যে সারাটা জীবন পথ দেখিয়ে গেছেন ঠিকই। চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন। তারপরও যদি মহামূর্খ আমরা চোখ বন্ধ করেই থাকি, অধোগামিতার প্রলয় কি বন্ধ হবে আদৌ ?

(চলবে…)