বন্ধুত্বের একটা পর্যায় তুমি থেকে তুই-তে উত্তোরিত হয়, আর কিছু বন্ধুত্ব তুমিতেই থেকে যায়, তাতে তার গাঢ়ত্ব কিছুমাত্রায় লঘু হয় না।

সিঙ্গাপুর বিমানবন্দরের নানাবিধ বিপনীর উজ্জ্বলতায় রকমারি জিনিস কিনছিলাম, কাঁধের ওপর একটা হাত পড়লে ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি বাঙ্গালী চেহারার লোক, আমার মতই বয়স হবে।

“আকাশ না? কি হল, চিনতে পারলে না, আমি হানিফ।”

স্মৃতি শক্তি আমার কোন সময়ই প্রখর ছিল না, আর আজ সময়ের অদৃশ্য আঘাতে সেই স্মৃতির আধার – আমার মস্তিষ্ক – আরো খণ্ডিত, আরো ভঙ্গুর। আমার চোখে কোন উজ্জ্বলতা না দেখে হানিফ বলল, “আমি দুলাল, এবার চিনতে পারলে তো?”

হানিফের ডাক নাম দুলাল, কি করে ভুলি? নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের মত একগাদা স্মৃতি মনকে ভাসিয়ে দিল। হানিফের সঙ্গে বন্ধুত্ব আমার শৈশবের নোঙর। সপ্তাহের এমন বিকেল ছিল না যখন হানিফ বনগ্রাম থেকে আমাদের নারিন্দার বাসায় না আসত। শাহ সাহেব লেন পার হয়ে ছিল এক বিরাট মাঠ, আমরা সেখানে ক্রিকেট আর ফুটবল খেলতাম। হানিফ সাংঘাতিক বোলার ছিল, তার বলের আঘাতে একবার আমার কোমরের হাড় প্রায় ভেঙ্গে যাবার জোগাড় হয়েছিল, ভাঙ্গে নি, তবে প্রায় মাস খানেক ব্যথা ছিল। আজ এই শহরের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সেই মাঠ সঙ্কুচিত হয়ে সৃষ্টি করেছে এক বিসদৃশ অট্টালিকার। মা আমাকে একটা কন্সট্রাকশন সেট কিনে দিয়েছিলেন, আমি সেটা দিয়ে কিছুই করতে পারতাম না, হানিফ এসে সেই সেট দিয়েই বানাত কত কিছু – ক্রেন, হেলিকপ্টার, সেতু, ট্রাক্টর। আমরা দুজনেই ডাকটিকিট সংগ্রহ করতাম, কি যে নেশা ছিল আমাদের। সারা পুরোনো ঢাকায় শুধু নবাবপুরে একটা দোকানে কিছু ডাকটিকিট কিনতে পাওয়া যেত, আমরা দুজনে সেই দোকানদারকে যে কত জ্বালাতন করেছি।

কিন্তু এসব থেকেও বড় কথা হানিফ আর আমি একই স্কুলে একই ক্লাসে পড়তাম। বাংলাবাজার পেরিয়ে ফরাসগঞ্জের একটা জরাজীর্ণ বড় দালানে ছিল আমাদের স্কুল। খেলার মাঠের তুখোড় ছেলে পড়াশোনার ক্ষেত্রেও ধারাল ছিল, পরীক্ষায় হানিফ সব সময়ই প্রথম হত। ক্লাস নাইনে জ্যামিতি পরীক্ষায় আমাকে বাঁচিয়েছিল, একটা কি যেন সম্পাদ্য প্রমাণ পারছিলাম না, হানিফ জানতো আমি ওটা পারব না, সবার অলক্ষ্যে তার খাতা আমাকে দেখিয়েছিল।

আমাকে কেউ সহজে আবেগপ্রবণ বলবে না, কিন্তু আমি হানিফকে জড়িয়ে ধরে বলি, “কত বছর পরে তোমাকে দেখলাম, কেমন আছ?”

হানিফের মত পরিষ্কার বুদ্ধির লোক আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি। আমাকে প্রথমেই বলল, “তোমার প্লেন কখন?” আমার ঢাকাগামী বিমান ছাড়তে আরো ঘন্টা দুই তখনও বাকি। হানিফ ঢাকা থেকে আসছে, টোকিয়োতে কি যেন একটা ট্রেনিংএ যাচ্ছে। আমি আমেরিকা থেকে ঢাকা যাচ্ছি।

কাগজের কাপে কফি নিয়ে দুজনে বসলাম। আমাদের পেছনে ছিল যত্ন করে গড়া সবুজ বিষুবীয় বাগান, তার মধ্য দিয়ে স্বচ্ছ জলের ধারা, দু-একটা লাল মাছ।

“শোন, আমি তো তোমার আমেরিকায় গিয়েছিলাম, তবে প্রায় বছর চারেক আগে।”

“ইস, আমাকে খোঁজ করলে না?”

“আর বল না, আমি গিয়েছিলাম প্রায় ছয় মাসের জন্য, স্ট্যানফোর্ডের একটা প্রোগ্রাম আছে তুলনামূলক শিক্ষার ওপর। একটা লোকের সাক্ষাৎ পেলাম না যে তোমার হদিশ দিতে পারে। তুমি কি বাঙ্গালীদের সাথে যোগাযোগ রাখ না? যাইহোক তুমি বোধহয় জানো না আমি এখন শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আছি, অ্যাডিশানাল সেক্রেটারি।”

বাংলাদেশে কে সেক্রেটারি আর কে মন্ত্রী বা পদানুযায়ী অ্যাডিশানাল সেক্রেটারী কত নম্বর হতে পারে সে সম্বন্ধে আমার জ্ঞান খুবই সীমিত ছিল। এটা যে বিরাট একটা পদ সেটা অনুমান করে বলি, “বল কি? বিশাল ব্যাপার, তোমাকে তাহলে বড় অভিনন্দন জানাতে হয়।”

হানিফ বলে, “তুমি তো অল্প বয়েসেই বিদেশ চলে গেলে, আমি গেলাম বুয়েটে, ইঞ্জিনীয়ার হব, হলামও কিছুটা, কিন্তু পাশ করে গেলাম সিভিল সার্ভিসে। ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে যে কত জায়গায় গিয়েছি ভাবতে পারবে না, ঠাকুরগাঁও, বাগেরহাট, ফেণী, মাগুরা, কক্স বাজার।”

“তোমার মত লোক শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে আছে, ভাবতেও ভাল লাগছে,” আমি বলি।

হানিফ হাসে, তার মাঝে বিষণ্ণতা থাকে, বলে, “তুমি ভাল করেই জান শিক্ষার কি হাল, আর আমি নেহাৎ চাকার পাখি, চাকাতো আমি চালাই না।” প্রসঙ্গ পাল্টে বলে, “শোন তুমি আমার একটা উপকার করে দেবে, ঢাকা ছাড়ার সময় খেয়াল হল আমি বেশ কিছু টাকা, হাজার পাঁচেক হবে, ভুলে সাথে নিয়ে এসেছি। আমার ফিরতে ফিরতে এক মাস হয়ে যাবে। তুমি তো তোমার পুরোনো বাসাতেই যাচ্ছ, তাহলে এই জায়গাটা খুব বেশী দূর হবে না সেখানে থেকে।”

হানিফ হাতব্যাগের পকেট থেকে একটা মোচড়ানো হলুদ খাম বের করে, খামটা হাত দিয়ে সমান করে, তারপর মানিব্যাগ থেকে টাকা নিয়ে তাতে ঢোকায়। খামের ওপরে নাম, ঠিকানা লিখে আমাকে দেয়। আমি খামটা কোটের ভেতরের পকেটে ঢুকিয়ে রাখি।

আমাদের কফি ততক্ষণে শেষ। হানিফকে কেন যেন একটু অন্যমনস্ক দেখায়, কফির কাপটা হাত দিয়ে দুমড়ায়, তারপর প্রায় হঠাৎ করেই বলে, “তোমাকে একটা কাহিনী বলি শোন। বছর চারেক আগে আমি তখন স্ট্যানফোর্ড যাচ্ছি, ঢাকা বিমানবন্দরে এসেছি, যা হয় – লোকে লোকারণ্য, লোকজন পারস্য উপসাগর যাচ্ছে, মালয়েশিয়া যাচ্ছে। ছোট গেট, ঢুকতেই পারছি না। এর মধ্যেই শুনি কে যেন ডাকছে, হানিফ ভাই, হানিফ ভাই! ঘুরে দেখি ইকবাল। ইকবালকে বোধহয় তোমার খেয়াল নেই, আমাদের এক ক্লাস নিচে পড়ত, ওয়ারিতে থাকত। আমাকে বলে, হানিফ ভাই, আমার এক পরিচিত ভায়ের স্ত্রী আমেরিকা যাচ্ছে, প্রথম বিদেশ যাচ্ছে, একা যাচ্ছে, আপনি যদি একটু সাহায্য করতেন। এত ভিড় বুঝলে, বেশি কিছু বলার উপায় নেই। আমি বলি, ঠিক আছে। ইকবাল আমাকে দাঁড়াতে বলে ভীড়ের মধ্যে অদৃশ্য হয়ে গেল, তারপর সে এক মহিলাকে নিয়ে এল, পুরো বোরখা আচ্ছাদিত, মুখটা খোলা অবশ্য। চুল না দেখে আমার পক্ষে সুশ্রীতার বিচার সম্ভব নয়। যাইহোক সেই মহিলাকে নিয়ে ঢুকলাম, ব্যাংকক হয়ে আমার বিমান লস এঞ্জেলেস যাচ্ছে, আর লস এঞ্জেলেস হয়ে সে যাচ্ছে হিউস্টন। তার নাম দেখলাম নাদিরা বেগম, মনে হল নাদিরা ইংরেজী লিখতে বা পড়তে পারে না। পরে বুঝলাম বাংলাও সেরকম পড়তে পারে না।

আমি ভাবি এই কাহিনী কোথায় যাচ্ছে।

“বিমান ছেড়ে দিল, নাদিরা পাশে বসা। আমি খুব কৌতূহলী, বুঝলে, এই মেয়েটা কোথায় যাচ্ছে, কার কাছে যাচ্ছে। আমি ওকে জিজ্ঞেস করি, “আপনার কে আছে আমেরিকায়?” সে বলল, স্বামী। ধীরে ধীরে তার কথায় বুঝলাম কয়েক মাসে আগে মাত্র তাদের বিয়ে হয়েছে। স্বামী আমেরিকায় কি যেন কাজ করে, সে বলতে পারল না। তার ব্যাগ থেকে একটা ফোল্ডার মত বার করে আমার হাতে দিল, বলল, এইখানে সব লিখা আছে, খুব বড় চাকরি করেন উনি।

“আমি ফোল্ডার খুলে দেখি টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্রসুর, তার স্বামীর নাম লুৎফর রহমান। ড. লুৎফর রহমান সিভিল ইঞ্জিনীয়ারিংএর ফ্যাকাল্টি, চেন নাকি?”

আমি মাথা নাড়িয়ে না বলি।

“আমার অবস্থা বুঝলে, দুয়ে দুয়ে চার মেলাতে পারছি না। লুৎফর রহমান দেখলাম আবার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়, আর্বানা-শ্যাম্পেন ক্যাম্পাস থেকে পি.এইচ.ডি করেছেন।”

“ভাল বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই পি.এইচ.ডি. করেছে,” আমি মন্তব্য করি।

“হ্যাঁ, নাদিরার সঙ্গে ড. লুৎফরের যোগাযোগটা কি ধরতে পারছিলাম না। শোন, আমাকে ভুল বুঝো না। আমি এখন শিক্ষার লোক, বুয়েটে স্বল্পকালের জন্য হলেও বামপন্থী রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলাম। নাদিরার মত প্রায় নিরক্ষর মানুষদের জন্য আমরা প্রোগ্রাম তৈরি করছি, কিন্তু এই ক্ষেত্রে ব্যাপারটা অনেকটাই মনোভাবের ব্যাপার, শ্রেণী-সংগ্রামের ব্যাপার নয়। তোমরা মার্কিন দেশে একে এলিটিস্ট বল, কিন্তু এটা আমি কোন এলিট দৃষ্টিভঙ্গী থেকে বলছি না।”

“তুমি তো মার্কিন বুলি ভালই রপ্ত করেছ,” আমি হেসে বলি।

“যাইহোক, দীর্ঘ সময়ের যাত্রার বদৌলতে আমি ধীরে ধীরে নাদিরার কাহিনী জানলাম। তোমার সময় নেই, আমি সংক্ষেপে বলি। নাদিরারা তিন বোন, নাদিরা, নাজিয়া আর নাইমা। নাদিরা সবচেয়ে বড়। তারা থাকে তাদের মা’র সাথে, বাবা নেই। মা’র নাম মজিদা। মজিদা বেগম বিভিন্ন বাড়িতে ফাই-ফরমাস খেটে সংসার চালায়। মেয়েরা বড় হচ্ছে, মেয়েদের জন্য সে খুব চিন্তিত। তারা থাকে পুরোনো ধোলাই খালের সাথে লাগান এক দোতলা বাড়িতে, নিচের তলায় একটা ঘর নিয়ে। তাদের পাশের ঘরে থাকে আলি ও তার স্ত্রী সালমা। সালমার সঙ্গে মজিদার খুব খাতির। আলি দারোওয়ানের কাজ করে ধানমণ্ডির এক বাড়িতে, ওখানেই রাতে থাকে, সপ্তাহে এক দিন ছুটি পায়, তখন বাসায় আসে। ধানমণ্ডিতে যে বাসায় আলি কাজ করে সেখানে থাকেন শুধু এক মহিলা, ওনারও স্বামী বিগত, একটি ছেলে, সেও বিদেশে। সেই ছেলের নাম লুৎফর রহমান।

“তুমি হয়তো কিছুটা অনুমান করতে পারছ এই কাহিনী কোন দিকে এগুচ্ছে। আলির কাছে মজিদা শোনে আলির নিয়োগকর্ত্রীর কথা, মহিলার ছেলে মার্কিন দেশ থেকে ছুটিতে বেড়াতে এসেছে, মা নাকি ছেলের জন্য পাত্রী খুঁজছে। মজিদা আলিকে পীড়াপীড়ি করে তাকে ধানমণ্ডির বাড়িতে নিয়ে যেতে। আলি মজিদাকে নিয়ে যেতে একেবারেই অনাগ্রহী, অন্য লোককে সেই বাড়িতে নিয়ে যাওয়া নিষিদ্ধ। কিন্তু এর মধ্যে একটা ঈদ পড়ে এবং এই উপলক্ষে আলি তার স্ত্রী সালমা, মজিদা বেগম ও নাদিরাকে নিয়ে ধানমণ্ডির বাড়িতে নিয়ে যায়।”

আমি ঢাকা যাবার বিমান সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ঘোষণা শুনলাম।

“তোমার বিমানের সময় হয়ে এসেছে আকাশ, আমি আরো সংক্ষেপে বলছি। সেই ঈদের দিনে মজিদা লুৎফর রহমানের মা’র সঙ্গে দেখা করে। নাদিরা আমাকে বিস্তারিত ভাবে এই প্রথম দেখার কথা বলে। দেখ আকাশ, জীবনের কিছু জিনিস হয়ত যুক্তি দিয়ে বোঝান সম্ভব নয়। তুমি গথিক গল্পের কথা জান যে গল্পের মাঝে বিভীষিকা ও প্রেমের রোমাঞ্চ একই সাথে বর্তমান। ফ্রাঙ্কেনস্টাইন, এডগার এলান পো, ইত্যাদি। আমি কি তোমাকে বোঝাতে পারছি? আমি ভাগ্য বা নিয়তিতে বিশ্বাস করি না, কিন্তু সম্মোহনের শক্তি বলে কিছু থাকলেও থাকতে পারে। আমাদের সময় নেই, নইলে তোমাকে মজিদার সঙ্গে লুৎফরের মা’র পরবর্তীতে প্রতিটি সাক্ষাৎ বর্ণনা করতাম। এটা একটা ক্লাসিক কাহিনী। এক জেলে মাছকে খেলিয়ে খেলিয়ে জালে তুলছে। মজিদা বেগমের তান্ত্রিক জাল। ধীরে ধীরে লুৎফরের মার দৃঢ় প্রত্যয় হয় নাদিরা হচ্ছে তার উপযুক্ত পুত্রবধু। বোঝো অবস্থা! সেই ঈদের দিনের এক মাসের মধ্যে নাদিরার সঙ্গে লুৎফরের বিয়ে হয়ে যায়।

“স্ট্যানফোর্ডে আমাদের প্রোগ্রাম শেষে আমরা কয়েকটা শহর ভ্রমণের সুযোগ পেলাম, এর মধ্যে হিউস্টনও ছিল। নাদিরা হিউস্টনে পৌঁছেছে কিনা সেটা জানতে আমি ড. লুৎফরকে ফোন করেছিলাম, কাজেই এইবার হিউস্টনে পৌঁছে হোটেল থেকে তাকে ফোন করলাম, বললাম আপনার সঙ্গে দেখা হলে ভাল লাগত। সে সন্ধ্যায় আমাকে গাড়ি করে নিয়ে গেল তার বাসায়। সুন্দর সাজানো বাগানসহ ছিমাছাম বাসা। আমার ভীষণ কৌতূহল ছিল নাদিরা-লুৎফরের দাম্পত্য জীবন কেমন চলছে জানতে। কিন্তু জানো সেই সন্ধ্যায় নাদিরা আমার সামনে প্রায় এলই না। তার কাপড়ে-ঢাকা মাথাকে ক্ষণকালের জন্য মাত্র দেখলাম। ড. লুৎফর আমাদের থেকে বয়েসে কিছুটা ছোট, আমি বুয়েটের ছাত্র ছিলাম শুনে সোতসাহে তার কাজ সম্পর্কে বলতে শুরু করল, দেখলাম সে কিছুটা তাত্ত্বিক লোক। যাইহোক, আমি তাদের জীবন কেমন চলছে তার সম্পর্কে কোন গূঢ় তথ্য জানলাম না। আমি বলব না লুৎফর খুব বিষাদ্গ্রস্ত ছিল, তবে তার কাজ নিয়ে সে উৎসাহিত থাকলেও জীবন সম্পর্কে কোন উচ্ছলতা তার মাঝে আমি দেখি নি।

“কিন্তু আমার মনটা খুব উচাটন ছিল। লুৎফর কি করে এত সহজে নাদিরাকে মেনে নিল? ঢাকা ফিরে ভাবলাম মজিদা বেগম কে সেটা আমাকে দেখতে হবে। খুঁজে বার করলাম ইকবালকে, বললাম আমাকে নাদিরাদের বাসায় নিয়ে যাও। ইকবাল বলল, হানিফ ভাই, আপনি আমাকে অন্য যে কোন আদেশ দিন, আমি অক্ষরে অক্ষরে তা পালন করব, শুধু এই অনুরোধটা আপনার রাখতে পারব না। আমি বললাম, কেন? ইকবাল বলল, তা আমি আপনাকে বলতে পারব না। আমি বললাম, তুমি না যাও, আমাকে ঠিকানা দাও, আমি যাব।

“ঠিকানা হচ্ছে ধোলাই খাল রোড। আমি এক সকালে গিয়ে দরজায় টোকা দিলাম।”

হানিফের কথার পৃষ্ঠেই আমার পেছনে এক রমণী কন্ঠস্বর শুনলাম। “এই যে তুমি এইখানে! আমি তো তোমারে সারা এয়ারপোর্ট চইষ্যা খুযতাসি,” আমি পিছনে তাকিয়ে দেখি এক বোরখা-পরা মহিলা, তার মুখটা সে ঢাকে নি। হানিফের দিকে সহাস্যে তাকিয়ে আছে। হানিফ আর আমি এক সাথেই দাঁড়ালাম। হানিফ আমাকে বলল, আকাশ, ইনি আমার স্ত্রী, নাজিয়া।”

আমি আবার ঢাকাগামী সিঙ্গাপুর এয়ারলাইন্সের ঘোষণা শুনলাম।

আমি চেয়ার থেকে ব্যাগ তুলে নিলাম, টেবিলের ওপাশে দাঁড়ান দুজনকে বললাম, “আমার বিমান ছেড়ে দিচ্ছে।” তারপর হতচকিত সেই দুজনকে ফেলে আমি দৌড়লাম, আমি দৌড়লাম সারি সারি লাল রেমু মার্টিন কনিয়াক বোতলের মধ্য দিয়ে, দৌড়লাম উজ্জ্বল সোনালী গোল বুলোভা ঘড়িদের আতিশয্যের পাশ দিয়ে, দৌড়লাম সোনি ও ক্যানন কোম্পানির সুগঠিত চকচকে কালো ক্যামেরাদের পেছনে ফেলে, দৌড়লাম স্বারোভস্কী ভাস্বর স্ফটিক আর টিফানির মণি-কাঞ্চনের বন পেরিয়ে, শ্যানেল ৫’এর সুগন্ধের কুয়াশাকে ভেদ করে আমি দৌড়লাম দোকানের মনোহরী পোষাক-পরা সুতন্বী সিঙ্গাপুরী সাহায্যকারী মেয়েদের দৃষ্টি এড়িয়ে। কিন্তু সেই দৌড়ের মাঝেও, শত-সহস্র ক্যামেরা, ঘড়ি, পারফিউম, স্ফটিক, স্টারবাকস কফি, বোর্দো ওয়াইন আর ফ্যাবারঝে চকোলেটের মধ্যেও, মজিদা বেগমের দীর্ঘ হাতকে আমি যেন অনুভব করলাম আমার পিঠে। ছোটার শেষে অপেক্ষা করছিল বিমান, সুহাসিনী বিমানবালা সিট দেখিয়ে দিতে তাতে বসলাম। আমার কপালে ঘাম জমেছিল, পিঠ ঘামে ভিজে গিয়েছিল।

লুৎফরের পর হানিফ, নাদিরার পরে নাজিয়া, আমি কল্পনা করি বুজে যাওয়া ধূসর ধোলাই খালের পারে এক পরিত্যক্ত অট্টালিকার এক কোণে মজিদা বেগম চক দিয়ে ছক কাটে, চাল ছড়ায়, কড়ি চালে, গভীর প্রার্থনায় মগ্ন থাকে। তারপর আমার মনে পড়ে পকেটে একটা খাম রয়ে গেছে, সেই খাম বের করে তার ওপর ঠিকানা দেখি, লেখা আছে ধোলাই খালের রাস্তা। ভাবি জ্ঞাত বা অজ্ঞাত যে কোন কারণেই হোক আজ হানিফ মজিদা বেগমের বুনট জালের তন্তু, গথিক নায়ক।

এর পরের কাহিনীটুকু আমার জন্য নিতান্তই লজ্জাজনক। হানিফের মত আমার মনও অনেক দিন উচাটন ছিল, তার যৌক্তিক দিক এই ঘটনাকে কাকতালীয় বলে পরিত্যাগ করতে চাইলেও আমার সাহস হল না সেই বাসায় খামটা পৌঁছে দিতে। অন্যদিকে এই কাহিনীর কোন যথার্থ পরিণতি আছে কিনা সেটাও আমি দেখতে চাইছিলাম। তাই কিছুটা কাপুরুষতায়, কিছুটা voyeurismএর বশবর্তী হয়ে আমাদেরই এক নিকট বন্ধুকে দিয়েছিলাম খামটা পৌঁছে দিতে। সেই বন্ধুর কি পরিণতি হয়েছিল সেটা না হয় নাই লিখলাম। তৃতীয়ার কাহিনী আজকের মত না হয় অজ্ঞাতই থাকুক।
____________________
এই গল্পের ঘটনা ও প্রতিটি চরিত্র কাল্পনিক