দুটো কাল্পনিক চিঠি

গত ৫ এপ্রিল, ২০১০ এ ‘এক নাস্তিক পুত্রের নিকট পিতার পত্র’ পোষ্ট করি। এই লেখার উপর বেশ কিছু মন্তব্য আসে। সেগুলোর মধ্যে থেকে কয়েকটি উল্লেখ করছি:
নৃপেন্দ্র সরকার মন্তব্য করলেন, “এত বড় লেখাটি একদমে পড় ফেললাম!!! বিশ্বাসই হচ্ছেনা। সব ধর্মের সব বাবাদেরই মনের প্রতিফলন এই চিঠিখানি।”
আবুল কাসেম মন্তব্য করলেন, “আমি সাধারনতঃ বড় লেখা দুই তিন কিস্তিতে পড়ি; কিন্তু এই লেখা পড়ার সময় সময়ের জ্ঞান ছিল না। লেখাটা শুধু ভালই হয়নি– লেখাটাতে সবার জন্য শেখার কিছু না কিছু আছে।”
সৈকত মন্তব্য করলেন, “বা-বা-রে বাবা! এরকম একটা বাবা থাকলে আর কি লাগে?”
শাফায়েত মন্তব্য করলেন, “হাতে সময় ছিলনা, ভাবলাম লেখাটায় শুধু একবার চোখ বুলাবো। চোখ বুলাতে এক লাইনও বাদ দিতে পারিনি। পড়ে কমেন্ট অংশে দেখি অন্যদেরও এক অবস্থা। অসাধারণ।”

বিপ্লব রহমান তো চিঠির একটি অংশ তুলে ধরে আস্ত একখানা চিঠিই লিখে ফেললেন। ফরহাদও একটি চিঠি লিখলেন।

আমি সবগুলিই গভীর মনোযোগ দিয়ে পড়েছি এবং সকলের মন্তব্যের প্রতি আন্তরিক শ্রদ্ধা জানাচ্ছি।

মুক্তবুদ্ধির চর্চ্চা এবং যুক্তিবাদী হওয়ার আকাঙ্খা যাদের আছে, তাদেরকে এই মুক্তমনা প্লাটফর্মে আসতেই হবে। মুক্তমনার সংস্পর্শে এসে সাহসী হয়ে উঠেছেন, ধর্মীয় গোড়ামী দূর করেছেন, কুসংস্কার মুক্ত হয়েছেন, বিজ্ঞান মনস্ক হয়েছেন এমন অনেক সাক্ষ্য মন্তব্যের মধ্যে পেয়েছি। এ সম্পর্কে নৃপেন্দ্র সরকার বলেন, “কুসংস্কার, অন্ধবিশ্বাস, অপবিশ্বাসকে স্কুল জীবন থেকেই সনাক্ত করতে শিখেছি। কিন্তু সাহস নিয়ে জোড় গলায় বলার শক্তি মুক্তমনাই দিয়েছে। মুক্তমনা সত্য পথের প্রদর্শক।”
মুক্তমনা একটি বিদ্যাপীট। মুক্তমনা একটি স্কুলের নাম, একটি কলেজের নাম, একটি ইউনিভার্সিটির নাম। এখানে আমি বসি ক্লাস করতে। যারা লেখালেখি করেন, মন্তব্য করেন তারা সবাই আমার শিক্ষক। এরা সবাই এক একজন মানুষ তৈরীর কারিগর।
মুক্তমনার রেজাল্ট ভাল হলে বিনম্র চিত্তে ফরিদ বলে উঠেন- “মুক্তমনার প্রতি আপনার ভালবাসাটুকু হৃদয়ে স্পর্শ করে গেল। আপনাদের মত মানুষদের নিঃস্বার্থ প্রেমটাই এর সম্পদ। মুক্তমনায় অনেক বড় বড় লেখক আছেন এটা খুব সত্যি কথা। আমি নিজেও তাদের লেখার ভয়াবহ রকমের ভক্ত। ওগুলো পড়ে পড়েই বহু দিবস এবং রজনী অতিক্রান্ত হয়েছে আমার। এখন হুট করে সেই সমস্ত দীপ্তিময় লেখকদের কাতারে নিজের নাম দেখে দারুণভাবে বিব্রতবোধ করছি।”
কি অসম্ভব রকমের নম্রতা। এই নম্রতা মুক্তমনার সকলের মধ্যে জাগরিত হোক। ফরিদ ভাই ‘বানান নিয়ে বকবকানি’ নিবন্ধের শেষে লিখলেন- “এই লেখা লিখতে যেয়ে অজান্তে কারো মনে কষ্ট দিয়ে থাকলে আন্তরিকভাবে দুঃখিত।” লেখালেখি ছাড়াও আমরা আমাদের কথা, আচরণের দ্বারা জ্ঞাতসারে অজ্ঞাতসারে অন্যকে দু:খ দিয়ে থাকি। নিজের ভুল উপলব্ধি করেও নিজেদের জিদ বজায় রাখি।
ফরিদের উপলব্ধি চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অভিজিৎ বলতেই পারেন, ‍”ফরিদ ভাইয়ের মতোই মুক্তমনার প্রতি আপনার ভালবাসাটুকুর সন্ধান পেয়ে আমার হৃদয়ে স্পর্শ করে গেল। এই ভালবাসাটুকু বেঁচে থাকুক। এখানে অনেক বড় লেখকই আছেন, কিন্তু এমন আপন করে ভাবে কয়জনা? আমাদের গালাগালি করে লেখাই যায়, কিন্তু এ ধরণের একটা প্ল্যাটফর্ম গড়া আর টিকিয়ে রাখা যে চাট্টিখানি কথা নয়, তা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছেন। এর অবদান আপনার আমার আমাদের সকলের। এই প্রেরণাটুকু বেঁচে থাকুক।”
যখন দেখি- মুক্তমনার মানুষেরা জাতি ধর্ম নির্বিশেষে যেখানেই মানবতা লঙ্ঘিত হচ্ছে, সেখানেই সোচ্চার প্রতিবাদ করেছে। যখন দেখি- দূর্গত এলাকায় অসহায় মানুষের পাশে দাড়িয়েছে, যখন দেখি স্কুল নির্মানে সহযোগীতা করেছে, যখন দেখি- নির্মল সেনকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছে তখন তো বিবেক জাগ্রত হয়ই।
ফরিদ আহমদ যখন ‘একাত্তরের চিঠি’ গ্রন্থ থেকে বাবার কাছে লেখা ফারুকের চিঠিটি তুলে ধরলেন মুক্তমনায়, তখন তো তিনি চেয়েছেন, আমাদের মধ্যে মানসিক পরিপক্কতা, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি হোক, জাগ্রত হোক। চিঠি আমাদের শিক্ষা দেয়, অনুপ্রেরণা জোগায়, ভাবতে শেখায়।

পিতার চিঠি নিয়ে চিঠি চালাচালি হলো, সেগুলোর কোনটিই আজ পিতার কাছে পৌছবে না। কিন্তু আমরা যারা পিতা হিসেবে, সন্তান হিসেবে আছি আমরা তো পেয়েছি। জ্ঞান, বুদ্ধি, যুক্তি, বিশ্বাস অনুসারেই চলে আমাদের জীবন। কেউ একটি লাইন পড়ে তার বিশাল ব্যাখ্যা দাড় করাতে পারে আবার কেউ পুরোটা পড়েও তা করতে পারছে না।

এখানে আমি দুটি চিঠি তুলে ধরছি, একটি লিখেছে বিপ্লব রহমান অপরটি আমার। এই চিঠিগুলো থেকে আমাদের ভেতর আরও যুক্তিবোধ জাগ্রহ হোক এই কামনা করি।

বিপ্লব রহমান
Posted এপ্রিল ৫, ২০১০ at ৯:১৭ অপরাহ্ণ |

প্রকৃত জ্ঞানী আলেমের সোহবতে থাকিয়া যদি আসল ইসলামী জ্ঞান অর্জন করিতে, তবে স্পষ্ট দেখিতে পাইতে যে, সত্য সত্যই ইসলামী জ্ঞান সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে।

(সম্ভাব্য উত্তর)
শ্রদ্ধেয় আব্বাজান,
আশাকরি কুশলে আছেন। সব সময় আপনার ও আম্মাজানের কথা মনে পড়ে।
পর সমাচার এই যে, আপনার দীর্ঘপত্রের জবাবে অনেক কিছুই বলিতে পারিতাম; কিন্তু সময় সংক্ষিপ্ত। তাই আপাতত ওই একখানি বিষয় দিয়া ইতি টানিব। সময় ও সুযোগ পাইলে না হয়, অন্যান্য বিষয়ে আবার জবাবী পত্র দেওয়া যাইবে।
আব্বা, সেদিন কাগজে পড়িলাম, মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চল সুদানে বহু বছর ধরিয়া নিরব দুর্ভিক্ষ চলিতেছে। গুগল ঘাঁটিয়া বেশ কিছু তথ্য ও ছবি পাইয়া রীতিমত চমকাইলাম। ইথোপিয়া, সুদান এমন কি মুসলিম অধ্যুষিত আমাদের উত্তরবঙ্গের মঙ্গা পীড়িত অঞ্চলের মুসলমানগণ সামান্য খাদ্যের জন্য যার-পরনাই কষ্ট পাইতেছে। বিশ্বের অন্যান্য মুসলিম অধ্যুষিত অঞ্চলেও প্রতি বছর ক্ষুধা ও অপুষ্টিতে শত শত, হাজার হাজার মানুষ মরিতেছে।
বলিতে পারেন, ইহাদের অপরাধ কী? ইসলামেই বা ইহার সমাধান কী? সুদানের নিস্পাপ শিশুটিকে কেনো ক্ষুধার জ্বালায় ধুঁকিয়া ধুঁকিয়া অবশেষে শকুনের খাদ্য হইতে হইবে?
আপনি বলিতে পারেন, ইহা তাহাদের ভাগ্য পরীক্ষা; তাহারা সকলেই বেহস্ত নসিব হইবেন। আব্বাজান, মহান সর্বজ্ঞানীর ভাগ্য পরীক্ষা (নাকী লীলা?) কেনো বাছিয়া বাছিয়া বারংবার দুর্বল ও মুসলিম দেশগুলির প্রতিই হইবে? কেনো নাস্তিক কমিউনিস্ট চীন বা ইহুদি – নাসারাদের দেশ আমেরিকা-ইংল্যান্ড-জার্মানি-ইসরায়েলে নহে? সর্বশক্তিমানের গিনিপিগ হইবার জন্য কী ইহারাই উপযুক্ত নয়?
বাড়ির সকলকে শ্রেণী ও বয়স ভেদে আমার কদমবুছি ও স্নেহাশিষ জানাইবেন।
বিশেষ আর কী। নিবেদন ইতি–

মাহফুজ এর জবাব:
এপ্রিল ৭, ২০১০ at ৬:৩২ অপরাহ্ণ
@বিপ্লব রহমান,
(আজ লেখক বাঁচিয়া নাই, তিনি বাঁচিয়া থাকিলে এবং মুক্তমনা সম্পর্কে ধারণা রাখিলে কী ধরনের জবাব দিতেন জানি না। তবে তাহার পক্ষ হইয়া জবাব দিতেছি)
বাবা বিপ্লব
দোওয়া নিও। তোমার পত্র পাইয়া খুশি হইয়াছি। কাহারো চিঠির জবাব দেওয়া সুন্নত। তুমি সেই সুন্নত রক্ষা করিয়াছ। সেজন্য তোমার সর্বদিকে কামিয়াবী কামনা করি।
আমি জানি দিনে দিনে তোমার ব্যস্ততা বাড়িয়াই চলিয়াছে। কারণ তোমার কাধে যে দায়িত্ব অর্পন করা হইয়াছে তাহা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একটু এদিক ওদিক হইলেই বড়ই সমস্যা হয়। সাংবাদিকদের কারণে অনেক মূল্যবান প্রাণ যেমন রক্ষা পাইয়াছে আবার তাহাদের অবহেলার কারণে মৃত্যুমুখে পতিত হইয়াছে। সব সময় চেষ্টা করিবে সত্য সংবাদ পরিবেশন করিতে। এমন সংবাদ পরিবেশন করিও না যাহা দ্বারা সমাজের অমঙ্গল হয়, বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে।
তুমি যে দূর্ভিক্ষের কথা উল্লেখ করিয়াছ, তাহা সম্পর্কে আমিও অবগত আছি। যাহারা নিয়মিত পত্রিকা পড়ে তাহারা জানে ইথিওপিয়ার অবস্থা। গুগলের যে লিংক দিয়াছ, তাহা দেখিয়া তুমি যেমন চমকাইয়াছ। আমি কিন্তু চমকাই নাই। বরং চিত্র দেখিয়া কষ্টে কান্না আসিবার উপক্রম হইয়াছে। বড়ই আফসোস যে উহাদের জন্য কিছুই করিতে পারি নাই। আমাদের দেশের অবস্থা সম্পর্কেও আমি ওয়াকিফহাল। আমাদের উচিত উত্তর বঙ্গের মঙ্গার সময় তাহাদের পাশে দাড়ানো। তোমাদের মুক্তমনা কুড়িগ্রামে যে সাহায্য করিয়াছে তাহার জন্য আমি পুলকিত। খুবই সোয়াবের কাম করিয়াছে। আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করি- তোমাদের মুক্তমনাকে যেন তিনি দীর্ঘজীবি করেন।
তুমি আমার চিঠির উদ্ধৃতি দিয়া জবাব দিয়াছ।
বাবা, আমি বলিয়াছি প্রকৃত জ্ঞানী আলেমের সোহবতে থাকিতে, তুমি কি তাহা খুজিয়া পাইয়াছ? না পাইলে তোমাকে জানাইতেছি। তুমি কী ফতে মোল্লা ওরফে হাসান মাহমুদ এর নাম শুনিয়াছ। তিনি ইসলাম ও শরিয়া নামে একটি বই রচনা করিয়াছেন। আমি তোমাদের মত কম্পিউটার চালাইতে জানি না। জানিলে তোমার মত লিংক করিয়া দিতাম। যাহা হউক তাহার বইয়ের শেষে একটি গল্প রহিয়াছে। গল্পটির নাম লাব্বায়েক। গল্পটি পড়িয়া দেখিও। ইসলামের সমাধান পাইবে। আমার তো মনে হইতেছে ফতে মোল্লা বর্তমান জমানার মোজাদ্দেদ। তুমি তাহার সোহবতে থাকিলে কামিয়াব হইবে এবং ইসলামের নানাবিধ সমস্যার সমাধান পাইবে।
আর একটি কথা, যাহারা সাহায্য সহযোগীতা করিতেছে, এই কাজ মুসলমানদের করার কথা ছিল। কিন্তু তাহারা করিতেছে না। বরং যাহারা সাহায্যের হাত আগাইয়া দিয়াছে সে ইহুদী হোক, আর নাসারা হোক, তাহারাই কিন্তু প্রকৃত মানুষ।তাহারাই প্রকৃত মুসলমান।
বাবা তুমি তো স্বচক্ষে কোন দূভিক্ষের মধ্যে পড় নাই। আমার এই দীর্ঘ জীবনে বেশ কয়েকবার দূর্ভিক্ষের কবলে পতিত হইয়াছি। তুমি তো জানো আবাদের মৌসুমে ধানের আবাদ না করিয়া লোভের বশবর্তী হইয়া ১৫ বিঘা তামাক লাগাইয়াছিলাম। কিন্তু আল্লাহ শিলা বৃষ্টি দিয়া সব নষ্ট করিলেন কেন? কারণ ঐ হারামের জিনিস যেন আমি আর আবাদ না করি। আমাকে সতর্ক করিয়া দিলেন। ইহার পর হইতে আর তামাক আবাদ করি নাই। তামাক সমাজের জন্য দেশের জন্য তথা জাতির জন্য মারাত্মক ক্ষতির কারণ হয়। তুমি আমার প্রাণাধিক পুত্র, একটা উপদেশ দেই- তুমি কখনও ধুমপান করিও না। বরং ঐ টাকা তুমি তোমার আশে পাশে যাহারা এক বেলা না খাইয়া আছে তাহাদের জন্য বরাদ্দ রাখিও।
আমার উপর বালা মুছিবত আসার পরও আমি আল্লাহর উপর একিন হারা হই নাই। কোরানে আছে- আল্লাহ ফকিরকে বাদশাহ বানান এবং বাদশাহকে ফকির বানান। তাই, কখন কি ঘটিয়া যায় তাহা বলা মুশকিল।
অধিক আর কি, পারলে একবার বাড়িতে আসিয়া তোমার আম্মাজানকে দেখিয়া যাইও।
তোমার সর্বাঙ্গীন মঙ্গল কামনায়-
তোমার আব্বা।