উড়ে যায় সাদা শকুন

মোজাফ্ফর হোসেন

ইংরেজী বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

আমি জন্ম নিলাম রাজপ্রাসাদে-
পরিত্যক্ত ঘোড়ার ঘরে।
প্রাসাদের সমবয়সিরা ছিল উদ্দাম
ফেরেস্তাদের মত সুন্দর কিন্তু আমি কুতকুতে কালো
যেন স্রষ্টার আশির্বাদ বঞ্চিত।

আমি গাইতাম ওদের থেকেও ভক্তি দিয়ে
অথচ পড়তোনা হাতে হাত, বাজতোনা বীণ
রাস্তার ছেলেরা বলতো-“নর্দমার কীট”
অথচ আমার জন্ম রাজপ্রাসাদে-
অসংখ্য তারকা খচিত কক্ষের মাঝে-
পরিত্যক্ত ঘোড়ার ঘরে!
যেন স্রষ্টার আশির্বাদ বঞ্চিত।

আজ দীর্ঘ ২৫ বছর পর দেশে ফিরছি। বিমানের তৃতীয় শ্রেণীর কামরায় বেশ স্বস্তির সাথেই বসে আছি। প্রথম শ্রেণীতে আসীন হবার সামর্থ্য থাকলেও ইচ্ছে হয়নি, নিম্নবিত্তের মানিয়ে নেওয়া এখনো মেনে চলছি। মানিকতলার সেই বাঁশ বাগানের নিচে একটি কুঁড়ে ঘর, স্যাঁতসেঁতে কলের পাড়, বাড়ীর সামনের পচা নর্দমায় একটি মাছের জন্য কেটেছে অনেকগুলো অলস দুপুর। মানিকতলার ‘১৪ বছর’ আমার জীবনে এতই সত্য হয়ে উঠেছিল যে দীর্ঘ ২৫ বছর আমেরিকার প্রগতিশীল যান্ত্রিক জীবনে থেকেও মুখ ফেরাতে পারিনি মানিকতলার সেই তীব্র হাহাকার থেকে। আমার ১৪ বছরের না খেতে পাওয়ার ক্ষুধা আর মিটবে না বোধ হয়; বেঁচে থাকার তীব্র জিজ্ঞাসা এখনো থেকে গেছে মনের গহীনে। শান্তি আছে অথচ স্বস্তি পাইনি কখনো; শান্তি তখনও ছিল বাঁশ বাগানের ঠান্ডা বাতাসে অস্থিসার দেহের ভার এলিয়ে, মায়ের পরম শাসনে, শিশির স্নাত দুর্বা ঘাসের আইল ধরে অজানার পথে ভেসে বেড়ানোতে, নর্দমার কাদাপানিতে শরীর ঠান্ডা করার ব্যর্থ প্রয়াশে। কিন্তু স্বস্তি পাইনি কখনো, না সেদিন বট বৃক্ষে চেপে , না আজ বিমানের তৃতীয় শ্রেণীতে চড়ে!

অনেকদিন পর দেশে ফিরছে স্বপন; একটু আবেগে আপ্লুত হবার কথা, একটু অন্যরকম ভালোলাগার কথা কিন্তু সে শীতল হয়ে বসে আছে, ভাবলেশহীন ভাবে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে, শুধু একটি নির্দিষ্ট বিরতি নিয়ে কেঁপে উঠছে চোখের পাতা, এটা দেখেই বিমানবালা বুঝে নিচ্ছে কোন লোকসান ঘটেনি এখনো।

মার সাথে খুব বেশি সখ্যতা ছিল না আমার; অভাবের সংসার, তার ওপর আমার ভবঘুরে বাবার মায়ের গর্ভে ঘনঘন বীজ বপণ। সংসারের দৈর্ঘ্য বেড়েছে প্রতি বছরে, বেড়েছে খাবারের সংকট । আমি তাঁদের দশম সন্তান। ১১ তম মারা গিয়েছিল জন্মের তিন দিন পরে। দীর্ঘ ১০ মাস পেটে থেকেও পুষ্ট হতে পেরেছিল না সে। তার পর ১২ তম সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে দুজনেই গেল। মা যতদিন বেচে ছিল জন্ম দিয়েছিল পাতি ছাগলের মত যত্রতত্র যেখানে সেখানে। ছাগল হলে অনেক বাজার দর হত মার যেটা সে মানুষ হয়েও পায়নি কখনো । সারাদিন অন্যের বাড়ীতে কাজ করে আমাদের অন্ন জোগানো, সন্ধ্যায় বাঁশের পাতা কুড়িয়ে রান্নার ব্যবস্থা করা, মধ্যরাতে ‘এক স্তন ধরে শিশুর কান্না অন্য স্তনে বাবার শক্তির পরীক্ষা’। এই একটি জায়গায় লোকটি হারেনি জীবনে। ব্যতিক্রম না ঘটলে মানুষ ৫ বছর পর্যন্ত স্তন্যজীবী প্রাণী থাকে, আমার বাবা ছিলেন সারাজীবন।

বাড়ি বলতে আমাদের যা ছিল তা হলো দুই খোপযুক্ত একটি কবুতরের খাঁচা। তারই মধ্যে দশ দশটি ‘প্রাণ,’ প্রাণ না বলে ‘দেহ’ বলাই ভালো। আশে পাশে জায়গার অভাব ছিল না যদিও তবুও স্বপন সাহেবের বাবার এই দয়াটুকুই ছিল আমাদের জন্য উপচে পড়া যার ঋণ আমার বাবা-মা না পারলেও অনেকখানি পুশিয়ে দিয়েছিলো আমার বোনেরা। আমি প্রবাস জীবনে বহুবার প্যাডের পৃষ্ঠার মাঝখানে ক্ষুদ্র একটি বিন্দু বসিয়ে এঁকেছি আমার বাড়ির মানচিত্র। এতকথা যে জন্য বলছি, এক ঘরে আমি, বাবা, মা সঙ্গে আরো দু’ভাই-বোন থাকতাম।

মাঝে মধ্যে মধ্যরাতে মাকে লাথি মেরে উঠে যেত বাবা তবে বেশির ভাগ সময় মা করতো সমঝোতা। বৈবাহিক সম্পর্কে ভালোবাসা না থাকলেও চলে। প্রাচীন শাস্ত্রে মনু বলেছেন, “পুত্রার্থে ক্রিয়াতে ভার্যা” অর্থাৎ পুত্র জন্ম দেওয়ার জন্য বৌ আনা। আধুনিক শাস্ত্রে বলা হয়েছে, “তোমাদের স্ত্রী তোমাদের শয্যাক্ষেত্র, তাই তোমরা তোমাদের শয্যাক্ষেত্রে যেভাবে খুশি প্রবেশ করতে পারো”। আসলে সব রসুনের এক পুটকি। তা না হলে খাল কেটে কুমির আনবে কে! তাছাড়া প্রতি রাতে কিছু না টিপলে আমাদের পুরুষদের চলে না। পতিদেব না সাজলে তাদের অত্যাচারের যে ধরন তাতে করে প্রতিরাতে মেয়েদের লাথি খেতে হত। পুরুষদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন যে তাঁদের সৃষ্টিকর্তাকে তাঁরা তাঁদের আদলেই পেয়েছে। তাছাড়া, বিজ্ঞান বলে সন্তান জন্ম দিতে ভালোবাসা লাগে না। ‘ধর্ষণ করলে কি গর্ভ হয় না?’ আসলে আমরা এক একজন ছিলাম এক একটি ধর্ষণের চূড়ান্ত পরিনাম। আমার মেজো বোন দেহের ক্ষুধা সহ্য করতে না পেরে সর্দার চাচার (স্বপন সাহেবের বাবা) সাথে ধরা পড়লো; গ্রাম শুদ্ধ লোক তাঁর বিচার করলো অথচ আমার মাকে প্রতি রাতে বলপূর্বক ধর্ষণ করেও বিচার হয়নি আমার পিতৃদেবের। বাঙলাদেশে শতভাগ মেয়েই ধর্ষণের শিকার হয় এবং তা বিবাহ নামক ধর্মসিদ্ধ অতি পুণ্যকর্মটি সম্পাদন করার পরেই, এ জন্যই কোন বিচার হয়না। ফলস্বরূপ জন্ম হয় আমাদের মত এক একটি অসুস্থ্য সত্ত্বার। তিনবার কবুল বলা অথবা আগুনকে কেন্দ্র করে সপ্তপাকে চক্কর দেওয়ার সময়টুকুকে যদি পরবর্তী দশ, বিশ অথবা পঞ্চাশ বছরের জীবন থেকে বড় করে না দেখা হয় তাহলে আমরা বাঙালিরা বেশিরভাগই এক একটি নির্মম ধর্ষণের পরিকল্পিত (!) ফসল। জন্মনিয়ন্ত্রণ কিম্বা গর্ভপাতের কথা উঠলেই আমার বাবা-মা ধর্মের কত শত অজুহাত এনে খাঁড়া করতো অথচ তাঁদেরকে আমি নামায পড়তে দেখিনি কোনদিন। জন্মনিয়ন্ত্রণ এবং গর্ভপাত নাকি শিশুহত্যার শামিল আর শিশু হত্যা হচ্ছে মহাপাপ। তাই আমাদের জন্ম দিয়েছে হিড় হিড় করে তারপর তিলে তিলে মেরেছে। আমরা জীবিত থেকেও মৃতের স্বাদ পেয়েছি প্রতিটা ক্ষণে। তবু খুশি হয়েছেন সৃষ্টিকর্তা তাঁর ভক্তকুলের অনাবশ্যক বিস্ফোরণ দেখে, স্বস্তি পেয়েছেন আমাদের পিতা-মাতা, কী স্টুপিড সেন্টিমেন্ট!

প্রায়ই মনে হয়, এইতো সেদিন! আমার ছোট বোন, তার বয়স তখন বার, সে যে বাড়ীতে কাজ করতো সেই বাড়ীর সদ্য লেখা পড়া শেষ করে ফেরা স্বপন সাহেব, আমি কত গর্ব করেছি যাঁর নামে আমার নাম হওয়াতে, দশ টাকার লোভ দেখিয়ে আমার বোনকে নিয়ে গেলেন বিছানাতে, আমি দরজার এপাশে দশ টাকায় কী কী কিনতে পারি সেই হিসাবে পাগলপ্রায়। তারপর সে যখন ঘর থেকে বের হল তার পায়জামা রক্তে ভিজে একাকার। ঐ রক্ত নিয়েই ছুটে গেছি আমরা গঞ্জের হাটে; রক্ত ঝরতে ঝরতে সাত দিনের মাথায় মারা গেল সে। ভাবতে ভালো লাগে অনেক কিছুই ‘মন ভরে’ খেয়েছিলাম সেদিন। ভাই বোনের অভাব আমার ছিল না। যদিও শেষ পর্যন্ত এই অভাবটাই সব অভাবকে ছাড়িয়ে যায়। বড় দুই ভাই ডাকাত দলে নাম লেখানোর ৫ দিনের দিন মারা পড়লো। এক ভাই জেলে, আরেক ভাই এর ওর বাড়ীতে থেকে লেখাপড়া শিখে শহরে চলে গেল আর ফেরেনি কখনো। বড় বোনের ‘পেটের ক্ষুধা আর দেহের ক্ষুধা’ যেদিন একাকার হয়ে গেল চলে গেল মালো পাড়ায়, বাবা মা আর ঘরে তোলেনি তাঁকে। সমাজকে তাঁরা বড় বেশি মান্য করতো যদিও সমাজপতিরা আমার বাবাকে ‘মুচি’ ছাড়া ডাকেনি, আমার মেজো বোনকে গর্ভধারণ করিয়ে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করেছে; আমার তিন বোনের যে কোন একটি যদি বেশ্যাবৃত্তি করতো আল্লাহর কসম আমাদের কোন অভাব থাকতো না। সমাজপতিরা তাদের স্বার্থেই বাঁচিয়ে তুলতো আমাদের। আমরা যখন প্রতিটা ক্ষেত্রেই সমঝোতা করে চলেছি এক্ষেত্রে করলেই কী বা এমন ক্ষতি হতো। সমাজ-নীতির দোহাই দিয়েছেন আমার বাবা-মা; যে সন্তান বাঁচতে চেয়েছে তাকেই করেছেন ত্যাজ্য; অথচ আমার মা যখন মারা গেলেন, জানাযা হল না তাঁর, পুতে রাখা হল গর্তে। আমার বয়স তখন ৮। বাবা আবার বিয়ে করলেন। সংসারের এত ঘাটতি সহ্য হলেও এই একটি জিনিসের ঘাটতি তিনি কিছুতেই মানতে পারলেন না। আমার আশ্রয় হল দাদীর কাছে। ৮০ বছরের বৃদ্ধা, অভাবের সংসারে তাঁর এই অনর্থক দীর্ঘজীবিতে আমি কোন যুক্তি খুঁজে পেতাম না। মাঝে মধ্যে মনে হত বালিশ চাপা দিয়ে মেরে দিই বুড়িকে। না মেরে ফল অবশ্য ভালোই হয়েছে। ওই বুড়ির কারণে আরও চারটা বছর বাড়িতে ঠাঁই হয়েছিল। দাদীর মৃত্যুর পরপরই আমি মানিকতলা ছেড়েছি, ছেড়েছি আমার পরিচয়। আজ খুব দাদীর কথা মনে পড়ছে। মানুষটা খুব কষ্ট পেয়েছেন জীবনে তবুও নিয়মের এদিক ওদিক হননি এক বিন্দুও। মাঝে মাঝে দাদার কথা বলে খুব কান্নাকাটি করতো। লোকটি নাকি ‘অসম্ভব ভালো’ ছিল, দাদীকে ভালোবাসতো প্রচন্ড ! আমার বাবা যখন পেটে, দাদীর বয়স তখন তের, দাদীর দেখাশোনা করার জন্য তাঁর বিধবা বোনকে বাপের বাড়ী থেকে আনালেন, ১০ দিনের দিন সকালে দাদা আর দাদীর বোনকে খুঁজে পাওয়া যায়নি, খুঁজে পাওয়া যায়নি দাদীর সারা জীবনের গোছানো সঞ্চয়, মাঝখান থেকে রেখে গেছে আমার বাবাকে, দাদীর কাছে যা যক্ষের ধন হলেও বাস্তবে ছিল বড় রকমের যন্ত্রণা। দাদীকে খুব ভালোবাসতো দাদা – দাদী এই বিশ্বাস নিয়েই ৭১ বছর পার করে দিলেন অনায়াশে। মানুষ মাঝে মাঝে তাঁর ঈশ্বরকেও ছাড়িয়ে যায়। দাদী তা পেরেছিলেন কিনা জানিনা তবে দাদী যে দিন মারা গেলেন আমি তাঁর পায়ে মাথা রেখে বলেছিলাম, যতদিন সত্যিকারের কারো সন্ধান না পাচ্ছি ততদিন তোমাকেই রেখে দিলাম। দাদী মারা যাওযার আগে পোলাও খেতে চেয়েছিলেন। মানুষ মারা যাওয়ার আগে পুনরায় শিশু হয়ে যায়, বড় আজব আজব ইচ্ছা পোষণ করে তখন। আমার দাদী চেয়েছিলেন পোলাও খেতে, যা ছিল আমাদের সামর্থের শেষ সীমানায়, বাবা তাই এড়িয়ে গেছেন বিষয়টি। একদিন ভর দুপুরে দাদী স্বপন সাহেবদের রান্না ঘরের পিছনে বসে ছিলেন। আমিও ছিলাম। খুব অদ্ভুত একটা জিনিসের গন্ধ পাচ্ছিলাম আমরা। দাদী অনেকক্ষণ বসে ছিলেন তারপর বাড়ীতে এসে পিঁড়িতে মাদুর পেতে শুলেন, আর ওঠেননি। অনেক পরে জানতে পেরেছিলাম সেই গন্ধটি ছিল পোলাওয়ের। আজ ভাবতে ভালো লাগে জীবনে শেষ ইচ্ছেটার অন্তত খুব কাছাকাছি যেতে পেরেছিলেন তিনি।

বিমানবালা স্বপনের দিকে টিস্যু পেপার এগিয়ে দেয়। স্বপন টের পায় না কিছুই। বাঙালিদের কাঁদতে হয় না, কান্না নিজ থেকেই আসে। প্রতিটা শিশু মায়ের পেটে থাকতেই এমন করে জব্দ করে আসে এই কঠিন শিল্পটা যে ভবিষ্যতে এর থেকে সহজ আর কোন কিছুই হয়ে ওঠে না। গরীবের সন্তানেরা ছোট থাকতে কারণ অকারণে এত বেশি কাঁদে যে পরবর্তীতে কান্নার প্রতি এক প্রকার বিতৃষ্ণা চলে আসে। তবে স্বপন খুব বেশি কাঁদেনি জীবনে, কাঁদতে পারলে অন্তত নিজেকে ভুলিয়ে রাখা যেতো। এখন একটু কাঁদবার চেষ্টা করে সে তারপর আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়ে।

“কেমন আছিস খোকা?”

মা তোমাকে না কতবার বলেছি আমাকে খোকা বলবে না। আমার খুব ভাল একটা নাম আছে ।

“ও তাই তো! আমার মনে থাকে না বাবা। তা কেমন আছিস স্বপন?”

মানিকতলার কুঁড়ে ঘরের এক ছেলে, ‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়’ এমন যাদের অবস্থা, এখন সে বিমানে বসে আয়েশ করে ঘুম পাড়ছে, তার কি খারাপ থাকা উচিৎ হবে?

“এভাবে বলছিস কেন বাবা? তুই কি তবে ভালো নেই?”

আমার কথা বাদ দাও মা, তোমার কথা বলো।
আচ্ছা মা সৃষ্টিকর্তা কি সত্যিই আছেন?

“ছি: বাবা এভাবে বলতে হয় না, তিনি রাগ করবেন।”

সৃষ্টিকর্তা রাগ করলে কি খুব বড় ধরনের ক্ষতি হয়ে যাবে মা? মানিক তলার সেই স্বপন সাহেবদের তিনতলা সাদা ধবধবে বাড়ীর পাশে এক পরিত্যক্ত ঘোড়ার ঘরে জন্ম হল আরেক স্বপনের। সৃষ্টিকর্তার আমাদের ওপর অনেক রাগ, তাই না মা?

“এমনিতেই তিনি অনেক নরম, দয়ার অথই দরিয়া, তিনি তাঁর মমতাকে একশভাগ করে মাত্র এক ভাগ তাঁর সকল সৃষ্টির মাঝে বিলিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু রেগে গেলে তাঁর থেকে কঠিন বস্তু আর মিলবেনা। তাঁর যে কথা শুনবেনা তাকে দিবেন এমন শাস্তি যা আমাদের ধারনার বাইরে”।

আমি তোমার অবাধ্য হয়েছি যখন তখন। কই তুমি তো আমাকে একচুলও আঘাত করোনি। তাহলে এত দয়ার সাগর যিনি তিনি তাঁর সন্তানদের এত কঠিন শাস্তি দিবেন কেমন করে?

“কার সাথে কার তুলনা! তাঁর শক্তি সীমাহীন তিনি অনেক কিছুই করতে পারেন।”

শক্তি থাকলেই অনেক কিছু করা যায় তাই না মা? এজন্য বাবা তোমার ওপর যখন যা ইচ্ছা যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে করেছে, বাবার ওপর করেছে স্বপন সাহেবরা, আর সবার ওপর সৃষ্টিকর্তা, আচছা মা সৃষ্টিকর্তা কি বাবার থেকে অনেক বেশি শক্তিশালী?

“পাগল ছেলে আমার! তুলনারও তো যথার্থ উপলক্ষ থাকা চাই।”

তাহলে তো তোমার কষ্টের পাল্লাটা এখন আরো ভারি?

“তা তো একটু হবেই, পাপ করেছি শাস্তি হবে না!”

তুমি আবার পাপ করার সময় পেলে কখন! যতদিন বেঁচে ছিলে গাধার মত সংসার টেনেছো, ভার বয়েছো আমার বাবার গন্ডারের মত দেহের। উনি কেমন আছেন মা?

“খুব ভালো আছেন। শুনেছি মৃত্যুর আগে খুব অসহায় একটা মেয়েকে বিয়ে করে “সামাজিক স্বীকৃতি” দিয়েছিলো তাই সৃষ্টিকর্তা তাঁর সমস্ত গুনাহ মাফ করে দিয়ে জান্নাত বাসী করেছেন। তাঁর জন্য দোয়া করিস বাবা”।

সৃষ্টিকর্তা ‘সত্যি সত্যিই’ খুব ‘দয়ালু,’ তাই না মা?

“হু!”

টানা নি:শ্বাস ছাড়ে মা। তারপর অনেকক্ষণ কেউ কথা বলে না।
দাদী কেমন আছেন মা?

বিমান বালার আলতো স্পর্শে ঘুম ভেঙ্গে যায় স্বপনের।

“স্যার আপনি ঘামছেন”।

তারপর স্বপনের দিকে টিস্যু পেপার এগিয়ে দেয়।
“আপনি ফ্রেস হয়ে নিন আমরা কিছুক্ষণের মধ্যে বাংলাদেশে অবতারণ করবো।”

এদের আতিথেয়তায় মুগ্ধ না হয়ে পারেনা স্বপন। সাধারণত বাসে যারা কাজ করে তাদেরকে বলা হয় ‘হেলপার’, ট্রেনে যাঁরা কাজ করে তাঁরা হল ‘টিটি’ আর বিমানে ‘বিমানবালা’। পেশাটা একই অথচ হেলপারদের মানুষ বলে মনে করা হয় না, টিটিরা মানুষের মত, আর বিমানবালারা পরিপূর্ণ মানুষ। যানবাহন সমাজে বিমান হচ্ছে ‘মৌ-লোভী’ গোছের তাই তো এখানে রাখা হয়েছে উচ্চ প্রজাতির সেবিকাদের। ভোগ করার ক্ষমতা যাদের আছে তাঁরা শুনবে কেন? হাসতে হাসতে বিমান থেকে নেমে পড়ে স্বপন। মাটিতে পা দিয়ে টানা নি:শ্বাস নিয়ে মনে মনে বলে ওঠে “আমার মানিকতলা”।

‘মানিকতলা’ এখন আর ‘মানিকতলা’ নেই, হয়ে গেছে ‘স্বপন নগর’। মানিক নামের এক ব্যক্তি, আজ থেকে শত শত বছর আগে, এই গ্রামের পত্তন ঘটায়, গ্রামটির নাম হয় ‘মানিকতলা’। শহর থেকে, সভ্যতা থেকে অনেক দূরে একটি লোকালয়, ‘মানিকতলা’, আজ নিজেই যেটি একটি পরিপূর্ণ শহর হয়ে উঠেছে, হয়ে উঠেছে সভ্যতার চারণক্ষেত্র, ‘স্বপন নগর’। স্বপন সাহেবের দানবাকৃতির দুইটা ফ্যাক্টরি এখন এই গ্রামের ত্রান কর্তা। ‘ধন’ থাকলে ‘ধনের’ চাহিদাও বেড়ে যায়। ভাবতে ভালো লাগছে আমার মানিক তলায় আর আমার মত স্বপনের জন্ম হয়না। জন্ম হয় স্বপন সাহেবের।

স্বপন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও তার কোন আপনজনদের সন্ধান পায় না, সন্ধান পায় না অস্তিত্বের। ত্রিশ বছরের মধ্যে একটা পরিবার বিলীন হয়ে যায় চিরতরে। স্বপনের কোন পরিচয় থাকে না, থাকে না কোন ঠিকানা।

এখন স্বপন সাহেবের গেষ্টরুমে বসে আমি। বাইরের কেউ এই গ্রামে আসলে স্বপন সাহেবের বাড়িতে বিশেষ ‘আদর আপ্যায়ন’ পায়, আমি এখন বাইরের কেউ। স্বপন সাহেবের বাড়ীর উত্তরে ভূতুড়ে এক বাঁশ বাগান ছিল, যার নিচে ছিল আমাদের কুঁড়ে ঘর, সেখানে গড়ে উঠেছে “স্বপন ক্যাবলস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ”। ইতিমধ্যে আমার সামনে বিভিন্ন ধরনের দেশি-বিদেশি খাবার দেওয়া হয়েছে, ঘৃতান্নও আছে তার মধ্যে। এই স্বপন সাহেবের কাছে নানান ভাবে ঋনী আমরা। স্বপন সাহেবের বাবার কল্যাণে আমার মেজো বোন আত্মহত্যার একটি উপযুক্ত উপলক্ষ খাঁড়া করতে পেরেছিল, মরেই বেঁচেছিল বেচারি। ভাবতে ভালো লাগে মরবার আগে অন্তত ‘দেহের ক্ষুধাটা’ মিটেছিল তার। স্বপন সাহেবের বিশেষ কৃপায় সেদিন ঐ দশ টাকায় অনেক কিছুই খেয়েছিলাম আমরা, তাঁদের বদৌলতে আমার দাদীর শেষ ইচ্ছাটা অনেকাংশে পূরণ হয়েছিল। খাওয়া শেষ করে চলে আসবার সময় স্বপন সাহেবের হাতে হাত মেলায় স্বপন যে হাতে একদিন পিষ্ট হয়েছিল তার বোনের কচি দেহ, টিকে থাকার পূর্বশর্ত এটাই। স্বপন শুধু বেঁচে থাকতে চায় না টিকেও থাকতে চায়। মেইন গেটের বাইরে এসে পিছনে ফিরে তাকাই স্বপন, বড় বড় স্বর্ণাক্ষরে লেখা “হাজী স্বপন ভবন”। নিজের নামটা এভাবে দেখে গর্বে বুকের ভেতরটা ‘হু হু’ করে জ্বলে ওঠে। বাম দিকে মায়ের বুকের ওপর গড়ে উঠেছে অতিকায় “স্বপন ক্যাবলস এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ”। মা’র মত ক্ষুদ্র একটা মানুষের এত বড় সম্মাননা! আনন্দে অশ্রু এসে যায় স্বপনের।