chika-01-biplob

১। আমার নকশালাইট বাবা আজিজ মেহেরের কাছে শুনেছি চিকা মারার (দেয়াল লিখন) ইতিকথা। ‘৭০ সালে কমরেড মনি সিং যখন পাকিস্তান সামরিক জান্তার কারাগার বন্দি হন, তখন পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকার কালো রাজপথে সাদা চুন দিয়ে লিখেছিলেন:

কমরেড মনি সিং এর মুক্তি চাই!

তবে চিকা মারা নাকি শুরু হয়েছিলো ‘৬৯ এর গণ অভ্যূত্থানের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। সে সময় ছাত্ররা জিগা গাছের ডালের এক মাথা থেঁতো করে বানাতো ব্রাশ। আর আলকাতরা দিয়ে দেয়ালে লেখা হতো স্বাধীনতাকামী নানা শ্লোগান। তো সেই সময় গ্রেফতার এড়াতে এ সবই করা হতো রাতের বেলা টর্চ জ্বালিয়ে।

হঠাৎ রাস্তার টহল পুলিশ দেখলে ছাত্ররা নাকি আলকাতরার টিন লুকিয়ে ফেলে জিগার সেই সব ডাল লাঠি বানিয়ে ঝোপে – ঝাঁড়ে এলোপাতাড়ি বাড়ি দেওয়ার ভান করতো। ‘এতো রাতে বাইরে কেনো’– পুলিশী এই জেরার সরল জবাব আগেই থেকেই তৈরি, ‘আমাদের হলে চিকার (ছুঁচো) খুব উৎপাত। এ জন্য আমরা চিকা মারতে বের হয়েছি।…’ এ ভাবেই নাকি দেয়াল লিখনের নাম হয়ে যায় — চিকা মারা।

‘৭০ এর সাধারণ নির্বাচনের সময় পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পাটি চিকা মেরেছিলো:

ভোটের আগে ভাত চাই! ভোটের বাক্সে লাথি মারো, সমাজতন্ত্র কায়েম করো!

‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের ওপর ফটো সাংবাদিক রশিদ তালুকদারের অ্যালবাম দেখে চমকিত হই। সেখানেও দেখি ঢাকার দেয়ালে আকাবাঁকা হরফে পূর্ব বাংলা সর্বহারা পার্টির চিকা:

জনগণ অস্র হাতে তুলে নিন! সাম্রাজ্যবাদ ও তার সমস্ত পদলেহী কুকুরদের পরাজিত করুন!

বাবার কাছেই শুনেছি, স্বাধীন বাংলাদেশে সর্বহারা পার্টি নাকি প্রতি বছর ১৬ ডিসেম্বর হরতাল আহ্বান করতো। তারা বিজয় দিবসকে বলতো ‘ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীর কাছে পূর্ব বাংলার আত্নসমর্পণ দিবস!’ তখন কোথাও হরতাল না হোক, সর্বহারা পার্টির সদর দপ্তর বৃহত্তর বরিশালে পালিত হতো কড়া হরতাল। সেখানে বড় রাস্তার দেয়ালে দু- একটা চিকা মারলে বা কয়েক রাউন্ড কাটা রাইফেলের গুলি ফুটালেই নাকি হরতাল হয়ে যেতো।

২। ১৯৮২ সালের ২৪ মার্চ জেনারেল এরশাদ সামরিক শাসন জারী করে ক্ষমতা দখল করলে সে সময় স্কুলের দেয়ালে চিকা পড়তে দেখেছি:

বন্যেরা বনে সুন্দর, সৈন্যরা ব্যারাকে।

১৯৮৩-৮৪ সালে এরশাদ বিরোধী মিছিলে পুলিশের ট্রাক চাপায় সেলিম – দেলোয়ার শহীদ হলে আবারও স্কুলের দেয়ালে চিকা পড়ে:

ট্রাক চাপা দিয়েছো, আন্দোলন থামেনি। ট্যাঙ্ক চাপা দিলেও আন্দোলন থামবে না।

তখন এ সব চিকা মারা হতো বেনামে।

আরো পরে ১৯৮৬ সালে শ্রমিক নেতা তাজুল ইসলাম শহীদ হলে জাসদ স্কুলের দেয়ালে চিকা মেরেছিলো:

বিপ্লবের লাল ফুল, শহীদ কমরেড তাজুল।

কলেজে উঠে আমি নিজেও জড়িয়ে পড়ি এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে। ‘৮৮ সালের মহাপ্লাবনের সময় এই অধম নিজেই বিশ্রী হাতের লেখায় ঢাকার দেয়ালে চিকা মেরেছিলো:

বানের জলে ভাসছে মানুষ, সেই মানুষের খাদ্য চাই।

chika-02-biplob

সে সময় আমরা চিকা মরতাম বেশ সহজ উপায়ে। আরামবাগের প্রেসগুলো থেকে কেনা হতো ছাপার কালো কালি। সেই ঘন কালিতে তারপিন তেল মিশিয়ে তরল করা হতো। তারপর আসবাব রং করার ব্রাশ দিয়ে লেখা হতো চিকা। মোটা হরফের জন্য ব্যবহার করা হতো জুতার ব্রাশ।

সুন্দর হাতের লেখার জন্য কদর ছিলো মনিরুল ইসলাম কচির। সিলেট মেডিকেল কলেজের ছাত্র কচি ভাই ছুটিতে ঢাকায় এলে তাকে নিয়ে চিকা লেখার ধুম পড়ে যেতো। ঢাকার দেয়ালগুলো অলংকৃত করা শেষে কচি ভাইকে নিয়ে আমরা ছুটে যেতাম জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকা — আরিচা মহাসড়কের দেয়ালেও চিকা মারা চলতো দেদার।

ডাকসু কি জাকসু নির্বাচনের সময় পোস্টারিং এর পাশাপাশি আমরা চানখাঁর পুল থেকে ‘রূপবান’ টিনে ডিমাই সাইজের স্টেনসিল কেটে ভোটের চিকা মারতাম।

১৯৮৮ কি ১৯৮৯ সালের এক রাতে কার্জন হলের দেয়ালে কয়েকজন চিকা মরছি। হঠাৎ দেখি কক্ষচ্যূত মেধাবী কবি সফতার সিদ্দিকী বারান্দার এক কোনে মোমবাতি জ্বালিয়ে বই পড়ছেন। আমি তখন লিখছি:

মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, ধ্বংস হোক – নিপাত যাক!…

আমাদের মধ্যে একজন দুষ্টুমী করে কবিকে জিগেষ করে, ‘আচ্ছা ভাই, ধ্বংস বানান কি তালেবশ্য শ’ না দন্তস্য?’

কবিও পাল্টা দুষ্টুমী করে জবাব দেন, ‘ধ্বংস নেতি বলে দন্তস্য। তবে অংশ ইতি বলে তালেবশ্য শ’!’

৩। এরশাদ বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় লাইব্রেরির দেয়ালে অলংকরণসহ ছাত্র ইউনিয়নের এক বিশাল চিকা দেখে আমরা হাসাহাসি করতাম এর বয়ান দেখে। সেখানে লেখা হয়েছিলো:

আমরা সশস্ত্র হবো, অজস্ত্র মৃত্যূতে।…

আহা, যেনো মৃত্যূ কতো শস্তা জিনিষ!!

তখন সবচেয়ে প্রশংসিত ছিলো ছাত্র ফ্রন্টের চিকা। সুন্দর হরফে লাল কালিতে তারা চিকা মারতো। তাদের একটা চিকা এখনো আমার চোখে ভাসে:

শিক্ষা সুযোগ নয়, অধিকার।

ঢাকার বাইরে গেলেই রেল স্টেশনগুলোতে দেখতাম তাদের পত্রিকা পড়ার আহ্বান জানিয়ে চিকা:

ভ্যানগার্ড পড়ুন।

ছাত্র ফ্রন্টের চিকাও নিয়েও আমাদের হাসাহাসি ছিলো খুব। আমাদের মুখে মুখে ফিরতো একটা মজার বুলি:

তুমি ছাত্র ফ্রন্টের চিকার মতোই সুন্দর,
সরকারি প্রেসনোটের মতোন মিথ্যে তোমার ভাষণ!

ছাত্র রাজনীতি শেষে ১৯৯৩ সালে সাংবাদিকতার পেশাগত কাজে টেকনাফে গিয়েছি। একজন সহকর্মি দেখালেন চট্টগ্রামের আঞ্চলিক উচ্চারণে আর কাকের ঠ্যাঙ – বকের ঠ্যাঙ মার্কা হাতের লেখায় এক চিকা। খালেদা জিয়াকে ইঙ্গিত করে লেখা সেই চিকায় লেখা ছিলো:

‘৭১ এর পামিলা, আর করিস না জামিলা।…

৪। অশান্ত পাবর্ত্য চট্টগ্রামের বেশ কিছু চিকার কথা প্রায়ই মনে পড়ে। পাহাড়ি ছাত্র পরিষদ ১৯৯২ – ৯৩ সালে চিকা মেরেছিলো:

জেলা পরিষদের সমীরণ (সমীরণ দেওয়ান; এখন শরণার্থী পুনর্বাসন বিষয়ক টাস্কফোর্স চেয়ারম্যান), পাহাড়িদের দুশমন ।

আরেকটি:

জুম্ম (পাহাড়ি) জাতির নেতা এমএন লারমা, লও লও লাল সালাম!

১৯৯৭ সালের ২ ডিসেম্বর পার্বত্য শান্তিচুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর বাঙালি সেটলারদের ভূঁইফোড় সংগঠন প্রথমে ‘পার্বত্য গণ পরিষদ’, পরে ‘সম অধিকার আন্দোলন’ পাহাড়ে প্রচুর চিকা মারে:

বাঙালি গণহত্যাকারী সন্তু লারমার ফাঁসি চাই।
পার্বত্য কালো চুক্তি মানি না, বাতিল করো।
আঞ্চলিক পরিষদ কার্যালয় জ্বালিয়ে দাও, পুড়িয়ে দাও।…

ইসলামী ছাত্র শিবিরের মতো কটকটে নীল কালিতে লেখা ‘কষ্টে আছে আইজুদ্দীন’ – চিকাটি অনেকেই অনেকদিন মনে রাখবেন।

এই সেদিন জে. মইন-ফখরুদ্দীনের এক-এগারোর সেনা সমর্থিত অস্বাভাবিক সরকারের সময় চালের দাম যখন রাতারাতি কেজিতে ২০ টাকা+ থেকে ৪০ টাকা+ এ দাঁড়ালো, তখন প্রেসক্লাবের দেয়ালে রঙিন চক দিয়ে লেখা একটি চিকা দেখে চমকে উঠেছিলেন অনেকেই:

মর বাঙালি না খেয়ে ভাত, ফখরুদ্দীনের আশির্বাদ!

সবাই জানেন দেশ জুড়ে চিকা মারার মহোৎসব শুরু হয় ভোটের সময়। তবে এবার নির্বাচন কমিশন আইন করেছে, রাজনীতি এবং নির্বাচনী সব ধরণের কাজে দেয়াল লিখন করা যাবে না। রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মততিতে এটি প্রথমে নির্বাচনী আচরণবিধি ও পরে আইনে পরিনত হয়। তাই গত স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনের সময় যেমন কৃচ্ছতার হাঁড়িকাঠে এক কোপে বাদ দেওয়া হয় রং-বেরং এর চোখ ধাঁধানো সব চিকা।

এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাড়া তেমনভাবে আর চিকার দৌড়াত্ব চোখে পড়ে না। এর বাইরে আছে কোচিং সেন্টার, অর্শ-গেজ-ভেগন্দর-পাইলস চিকৎসাসহ আরো নানান সব বিচিত্র বিজ্ঞাপনী চিকা।

তো আইন হয়ে কী শেষমেষ হারিয়েই যাবে আমাদের চিকা সংস্কৃতি?…

ছবি: জে. মইনের পদত্যাগ দাবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ২১ আগস্ট ২০০৭, বিডিনিউজ টুয়েন্টিফোর ডটকম।