ছয় মে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বিলেতের সাধারণ নির্বাচন । কারা এবার সরকার গঠন করবে তা এখনও নিশ্চিত নয় । বলা হচ্ছে এবার ঝুলন্ত পার্লামেন্টের সম্ভাবনা বেশী । সে ক্ষেত্রে লেবারের সাথে লিবারেল ডেমোক্রেটরা (লিবডেম) মিলে সরকার গঠন করতে পারে । তবে এ অবস্থা এ দেশে এখন কারোর-ই কাম্য নয় । বর্তমান অর্থনীতির চরম দুরবস্থার অবনতির সম্ভাবনাই তাতে আরো বেশী । এবারের নির্বাচনে অদ্ভুত এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যা আগের যে কোন সময়ের চেয়ে কিছুটা ভিন্ন । এবার এক বিরাট সংখ্যক ভোটার মন স্থির করতে পারছে না কোন দলকে ভোট দেবে । লেবারের জনপ্রিয়তা তলানিতে এসে ঠেকেছে তা বলাই বাহুল্য । কিন্তু কনজারভেটিভদের প্রতি জনসমর্থন যে হু হু করে বেড়ে গেছে তাও নয় । তাদের অনেক পলিসিই ভোটারদের পছন্দ নয় । মাঝখান থেকে লিবারেল ডেমোক্রেটদের অবস্থা হঠাৎ করে বেশ ভালো হয়ে গেছে । বিশেষ করে তিন নেতার লাইভ টেলিভিশন বিতর্কের পর থেকে । লিবডেমের নিক ক্লেগ ( Nick Clegg) এর কাছে অন্য দু’নেতাকে বেশীর ভাগ সময়ই নিষ্প্রভ এবং অনুজ্জ্বল লেগেছে । নিকের কথার প্যাঁচ এবং প্রশ্নবাণে জর্জরিত হতে হয়েছে দুজনকেই । সব দেখেশুনে অনেক ক্ষুব্ধ সাধারণ পাবলিক বেশ ‘মজা’ পেয়েছে । লাইভ বিতর্কের পর থেকেই মিডিয়া কাভারেজ থেকে শুরু করে পাবলিক এটেনশন সবই প্রচুর পরিমাণে পাচ্ছেন লিবডেমের এই নেতা । অনেকেই ইতিমধ্যে তাকে এ দেশের বিকল্প ত্রাণকর্তা ভাবতে শুরু করেছেন । যদিও সে এখনো অনেক দূরের পথ ।

আমার এলাকার এমপি হচ্ছেন গ্ল্যান্ডা জ্যাকসন । লেবার দল থেকে তিনি প্রার্থী হবার পর থেকে আমি এতদিন তাঁকে ভোট দিয়ে আসছি । এবারও হয়ত তার ব্যতিক্রম হবে না । ‘হয়ত’ বলছি এ কারণে যে, কিছুটা সিদ্ধান্ত হীনতায় যে ভুগছিনা, তা বলা যাবে না । রাজনীতির সাথে জড়িত মানুষগুলোর প্রতি ব্যক্তিগতভাবে আমি চরম ত্যক্ত বিরক্ত, হয়ত আমার মত আরো অনেকেই আছেন – তারপরও রাজনীতি বিমুখ থাকা আজকাল কারো পক্ষেই সম্ভব নয় । জোর করে মাঝে মাঝে উদাসীন থাকার চেষ্টা করি মাত্র, কিন্তু ঘুরে-ফিরেই ফিরে তাকাতে হয়, জানার-বোঝার চেষ্টা করি কী হচ্ছে আসলে ! আমাদের ভূত-ভবিষ্যতের রূপরেখাই বা কেমন এই মানুষগুলোর হাতে? সে যাক, আমার বর্তমান মাথাব্যথা আমার এলাকার এমপি গ্ল্যান্ডা জ্যাক্সনকে ভোট দেওয়া না দেওয়া নিয়ে । ব্যক্তি হিসেবে তাঁর অনেক সুনাম আছে । লোকজন তাকে পছন্দও করে বেশ । আমিও করতাম, এখনো করি না তা নয় ।

আমাদের এই এলাকা কনজারভেটিভদের শক্ত ঘাঁটি হওয়া সত্ত্বেও তিনিই প্রথমবারের মত লেবার পার্টি থেকে মনোনয়ন পেয়ে জয় চিনিয়ে আনেন । যদিও প্রথমবার জিতেন অল্প কিছু ভোটের ব্যবধানে । কিন্তু সেটিই তখন তার ব্যক্তিগত বিরাট বিজয় হিসেবে দেখা হয়েছিল, কারণ এই নির্বাচনী এলাকায় এর আগে লেবার কখনই সুবিধা করতে পারেনি । তারপর থেকে একনাগাড়ে আঠারো বছর ধরে তিনি এই এলাকার এমপি । এমপি হিসেবে তিনি কেমন, সফল নাকি ব্যর্থ, তা বলার আগে তাঁর পরিচয় কিছুটা বলে নেওয়া যাক । ব্রিটিশ পার্লামেন্টে তিনিই একমাত্র এমপি যিনি অস্কার বিজয়ী । তাও একবার নয়, দু – দুবার । ৯মে ১৯৩৬ সালে ইংল্যান্ডের চেশায়ারে তাঁর জন্ম । বলা হয়ে থাকে বর্তমানকালের ব্রিটিশ ইতিহাসে খুব কম ব্যক্তিই আছেন যিনি একেবারে সাদামাঠা ‘ওয়ার্কিং ক্লাস’ এ(পিতা ছিলেন একজন ব্রিক লেয়ার) জন্ম নিয়ে নিজ যোগ্যতা বলে গ্ল্যান্ডা জ্যাকসনের মত এতটা পথ পাড়ি দিয়ে আজকের এই জায়গায় এসে পৌঁছুতে পেরেছেন । নিজ বুদ্ধিমত্তা, প্রতিভা আর যোগ্যতা বলে অস্কার বিজয়ী অভিনেত্রী থেকে আজ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের দাপটে সদস্য এবং নেত্রী ।

তাঁর রাজনীতি নিয়ে বলার আগে অভিনয় জীবন নিয়ে কিছুটা আলোকপাত করা যাক । তিনি চারবার অস্কার নমিনেশন পেয়েছেন, জিতেছেন দুবার । প্রথমবার ১৯৭১ সালে ‘Women in Love’ চলচ্চিত্রে শ্রেষ্ঠ অভিনেত্রী হিসেবে এবং দ্বিতীয়বার ‘A Touch of Class’ চলচ্চিত্রে ১৯৭৪ সালে ।এ ছাড়া তাঁর ঝুলিতে বাফটা (BAFTA) সহ আরো অনেক গুরুত্বপূর্ণ পুরস্কার যুক্ত হয়েছে । তিনি সর্বমোট ষোলবার বিভিন্ন পুরস্কার এর জন্য মনোনীত হন এবং সমান সংখ্যক পুরস্কার জিতেও নেন । রাজনীতিতে আসার আগে একজন অভিনয় শিল্পী হিসেবে ব্রিটিশদের কাছে তিনি অত্যন্ত মর্যাদা সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব ছিলেন । চলচ্চিত্রের সাথে সাথে অসংখ্য ভালো টিভি সিরিয়ালেও তিনি অভিনয় করেন ।

রাজনীতিতে যুক্ত হওয়ার পর অভিনয়কে বিদায় জানান গ্ল্যান্ডা জ্যাকসন । প্রথম ১৯৯৪ সালে তিনি লেবার দল থেকে মনোনীত হন এমপি হিসেবে নির্বাচনের জন্য । তাও এমন এক এলাকায় যেখানে আগে কখনো লেবার দল জিতেনি । তারপর সবই ইতিহাস । এখনো পর্যন্ত ধরে রেখেছেন এই আসন । অভিনয়ের মত রাজনীতিতেও তিনি সফলতা অর্জন করেন । ব্যাপক ভাবে নানা কর্মকাণ্ড জড়িয়ে নেন নিজেকে । সাধারণ ভোটারদের খুব কাছাকাছি গিয়ে জানার বোঝার চেষ্টা করেন বিভিন্ন স্থানীয় ইস্যুগুলোতে তাদের মতামত । কারণ এদেশে জাতীয় ইস্যুর চেয়ে কোন অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় স্থানীয় ইস্যু । অনেক সময় ভোটারদের কাছে বরং স্থানীয় ইস্যুগুলোই প্রাধান্য পায় বেশী । তিনি যখন নির্বাচনে জিতে প্রথম ‘হাউস অফ কমন্স’এ প্রবেশ করেন,তখন বিরোধী দলের এক নেতা তাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন ‘আপনি এখানে কি করতে এসেছেন,আপনি তো এমনিতেই বিখ্যাত’! গ্ল্যান্ডা জ্যাক্সন পরবর্তীতে কাজ করে প্রমাণ করেছেন তিনি অভিনেত্রী হিসেবে যেমন যোগ্য ছিলেন, রাজনীতির ময়দানেও কিছুমাত্র কম যাননি ।

এবারের নির্বাচনে তাই ভূতপূর্ব লন্ডন মেয়র কেন লিভিংষ্টোন তাকে সমর্থন করছেন এই বলে যে, “Glenda voted against the Iraq war, and there is nothing so remarkable as discovering an MP with a backbone.”

গ্ল্যান্ডা ইরাকযুদ্ধ ইস্যুতে টনি ব্লেয়ারের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেন এবং ব্লেয়ারের কঠোর সমালোচনা করেন। এমনকি এক পর্যায়ে টনি ব্লেয়ারের পদত্যাগ দাবি করেন । তাছাড়া তখনকার বিভিন্ন যুদ্ধবিরোধী প্রচার-প্রচারণায় ব্যপকভাবে অংশ নেন । এসব কারণে তার জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণ যোগ্যতা সাধারণ জনগণের কাছে সব সময়ই অন্য অনেক রাজনীতিকের চেয়ে বেশী ছিল এবং এখনো আছে । লেবার পার্টিতে তিনি একজন ‘ট্রেডিশন্যাল লেফট ইউঙ্গার’ হিসেবে পরিচিত । যুদ্ধবিরোধী অবস্থান ছাড়াও তখনকার লেবার সরকারের বিশেষ করে ব্লেয়ারের নেওয়া নানা সিদ্ধান্তের তিনি বিরোধিতা করেছেন । গ্ল্যান্ডা জ্যাক্সন বারো জন লেবার এমপি্র একজন, যিনি স্কটিশ ন্যাশন্যাল পার্টির সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে ইরাকযুদ্ধের ইনকোয়্যারী দাবি করেন । ব্লেয়ারের আমলে তিনি জুনিয়র ট্রান্সপোর্ট মিনিষ্টার ছিলেন এবং এ ক্ষেত্রে অনেক ভালো কাজ করেছেন । পরে অবশ্য এই পদ থেকে পদত্যাগ করেন লন্ডন মেয়র পদে নির্বাচনে লড়ার জন্য কিন্তু শেষ পর্যন্ত দল থেকে মনোনয়ন পান নি ।

বর্তমান নির্বাচনে এই এলাকায় গ্ল্যান্ডার শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বী হচ্ছেন লিবডেমের প্রার্থী । তারা তাঁর বিরুদ্ধে জোর প্রচারণা চালাচ্ছে এই বলে যে, তিনি একজন অলস এমপি ! পার্লামেন্টে খুব কম যান । তাছাড়া থাকেনও অন্য এলাকায়, তিনি এই এলাকার কেউ নন । এখানে ভোটে একটা বড় বিষয় হয়ে দেখা দেয় ‘অন্য এলাকা’ ইস্যু । বিশেষ করে বিরোধীরা এই প্রচারণা চালাতে ভালোবাসেন বেশী !

আমি ভাবছি আমার ‘ভোট’ নিয়ে ! এতকাল তো গ্ল্যান্ডা জ্যাকসনকে দিলাম, এবার কি ভিন্ন চিন্তার সময় এসেছে ! লিবডেমের তরুণ নেতা টগ্‌বগ্‌ করে ফুটছেন, নতুন উদ্যমে মাঠে নেমেছেন । বলছেন লেবারের ‘পরিবর্তন’ নয়, সত্যিকারের পরিবর্তন এনে দেবে তার দল । ওদিকে গ্ল্যান্ডার বয়স ও হয়েছে । ৭৩ বছর । কাজে – কর্মে, উদ্যমে শ্লথ গতি আসতেই পারে । একটা সময়ের পর কারো কারো হয়ত থামা উচিত ।

দেখা যাক এবারের ভোটের ফলাফল কী বলে ।