বেশ্যা
মোজাফফর হোসেন


ছয়মন বানুকে মহল্লা ছাড়া করার সাত দিন হতে না হতেই গ্রামের উত্তর দিকের শেষ ঘরটিতে প্রথম কে যেন বলল,
-সফেলা বেশ্যা। আমি নিজ কানে শুনে এলাম।
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে মহল্লার সকলে বলল,
-সফেলা বেশ্যা।
মাসখানেকের মধ্যে গ্রামের সকলে জানলো,
-সফেলা বেশ্যা।
গ্রামের প্রতিটা ঘরে ঘরে, মোড়ে মোড়ে, দোকানে দোকানে আলোচনা হচ্ছে,
-সফেলা বেশ্যা।
আলোচনার সুবিধার্তে, গ্রামের মোড়ে মোড়ে মাচান বসানো হয়েছে। পুকুরে স্নান করতে গিয়ে মহিলাদের বাড়ি ফিরতে সন্ধ্যে হয়ে যাচ্ছে প্রতিদিনই। সদ্য স্কুলে পা দেওয়া ছেলে মেয়েরাও তাদের স্বভাবজাত আড্ডা ছেড়ে মেতে উঠেছে,
-সফেলা বেশ্যা।


গ্রামের মহিলারা দলে দলে জমায়েত হচ্ছে। তাদের এখন নাওয়া-খাওয়া কোন কিছুই ঠিক মত হচ্ছে না। স্বামীর দিকে নজর রাখতে রাখতে বেশির ভাগই ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। পুরুষদের জন্য বাড়িতে এখন ১১-ধারা জারি করা হয়েছে, সূর্য্যের আগে বাড়ি ফিরতে হবে!

সকলের মধ্য থেকে প্রথম কথা বলে মাঝবয়সী এক মহিলা,
-আমার মরদের ঈদ লাগছে, সবসময় গুনগুনিয়ে সিনেমার গীত গায়।
আরেকজন বলে,
-আমার মরদ কাজের বাহানাতে বাড়িতে ঢুকতেই চায় না।
সবথেকে রুগ্ন গড়নের মহিলাটি বলে,
-আমার স্বামী তো সারা রাত বিছানায় উস-পিস করে। ঠিক মত খাওন-গাওন করে না। মনে হয় ঐ মাগির ভুতে ধরছে।
সকলের মধ্যে থেকে স্বাস্থ্যবান মহিলাটি বলে,
-গ্রামের সব পুরুষদেরই এখন একই অবস্থা।
সবথেকে বয়স্কজন বলে ওঠে,
-হবে না! মিনসেদের কি দোষ বল? হুনুছি, ঐ মাগির গতর থেকে রস নাকি চুইয়ে চুইয়ে পড়ে! মধু যেখানে থাকবি, মাছি তো সেখানে ভন ভন করবিই। তাই তোগে মরদ গোরে বেশি চাপাচাপি না কইরা ঐ খানকিরে আগে গ্রামছাড়নের ব্যবস্থা কর।
একজন মহিলা তার পাশের জনকে বলে,
-আমার দেবর বলছিল, তোর ভাতার নাকি আজকাল ঐ মাগির বাড়ির পাশে খুব ঘুর ঘুর করে?
মহিলা ক্ষেপে গিয়ে চেচিয়ে বলে ওঠে,
-এই আমার কুদ্দুসের বাপের নিয়ে একটাও আজে বাজে কথা কবিনা কয়লাম! কেন, তুই আর দেবরের ফস্টি-নস্টির ঘটনাটা মনে হয় আমরা জানি না?
বয়স্ক মহিলাটা সবাইকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এই নিজেদের গায়ে কাদা ছোড়াছুড়ি বন্ধ কর তোরা। আগে মাগির সেটাই আগুন দিই, তারপর তোরা যত ইচ্ছে খিস্তি করিস।

3
গ্রামের সকলে বেশ চিন্তায় পড়ে গেল। বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় মেম্বার বাড়ির বৈঠকখানায় পঞ্চায়েত ডাকা হল। মিটিং শেষে মসজিদের মাইকে ঘোষণা করা হল,
-আগামীকাল বাদ জুম্মা, গ্রামের সকল মুমিন ভাইদের ঈদগার ময়দানে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হচ্ছে। ইমাম সাহেব ইসলামী শরিয়া আইন মোতাবেক বেশ্যা সফেলার (নাউজুবিল্লাহ, আসতগফিরুল্লাহ)বিচার করবেন।
পরদিন, যথারীতি জুম্মার নামাযের পর গ্রামের সকলে দলে দলে জমায়েত হল। এ পর্যন্ত কোনো ঈদে এত মানুষ এ ময়দানে জমায়েত হয়নি। ইমাম সাহেব তার বয়ান শুরু করলেন,
-প্রিয় ইমানদার ভাইয়েরা আমার, আমরা সব পবিত্র জুম্মার পর ওজু অবস্থায় এই ঈদগাহে হাজির হয়েছি একটা নেক মকছেদ পূরণ করার জন্য। গ্রামে আল্লাহর গজব নাজিল হয়েছে। আপনাদের দান খয়রাতের হাত দিনে দিনে ছোট হয়ে যাচ্ছে, তাই এই গজব। আজ আমরা একত্রিত হয়েছি, এক বেগানা মহিলার বিচার করার জন্য। ঐ নাপাক মহিলার নাম আজ মুখে নেয়াও পাপ। আল্লাহর পাক কালামে আছে, মহিলারা জ্যান্ত শয়তান, তারা মানব জাতিকে ধ্বংশের দিকে টানে। এজন্যই তাদেরকে টাইটের মধ্যে রাখার নির্দেশ আছে।
এখন বলেন, আপনারা সকলে কি ঐ বেগানা মহিলার পাপ কর্ম সম্পর্কে অবগত আছেন? থাকলে আওয়াজ তোলেন।
সকলে উচ্চস্বরে বলে ওঠে,
-হ্যাঁ হুজুর, আছি।
হঠাৎ এত জোরে শব্দ হওয়াতে আশে পাশের গাছ-পালা থেকে পাখিরা সব ঝট-পট করে যে যার মত রুদ্ধশ্বাসে উড়ে যায়।
-আপনারা কি আল্লাহর পাক কালাম বুকে নিয়ে সাক্ষি দিতে পারবেন? পারলে আওয়াজ তোলেন।
আবার প্রচন্ড শব্দে কেঁপে উঠল মাটি।
কিছুক্ষণ কি যেন ভেবে নিয়ে হুজুর আবারো বললেন,
-এখানে আজ গ্রামের সকলে উপস্থিত আছেন। কারা কারা ঐ বেগানা মহিলার কাছে গিয়ে নাপাক হয়েছেন, আওয়াজ তোলেন।
এবার আর কোন শব্দ হল না। যে কাশছিল, সে তড়িঘড়ি করে কাশি বন্ধ করে ফেলল। যারা ফিসফাস করছিল তারাও মুখ এঁটে রইল। কিছুক্ষণের জন্য জনশুণ্য হয়ে পড়ল সমস্ত মাঠ।
-যদি কেউ থেকে থাকেন, আপনারা মসজিদে সিন্নি দিয়ে পাপের প্রায়শ্চিত্ত করবেন। ঐ বেগানা মহিলার শাস্তি হওয়ার দরকার। চরম শাস্তি, যা দেখে দ্বিতীয়বার কেউ এ পথে পা বাড়ানোর সাহস পাবে না। আপনারা কি বলেন?
আবারো শব্দ বিস্ফোরণে ফেটে পড়ল মাঠ।
শরিয়া আইন মোতাবেক, কাল স্কুল ময়দানে ঐ বেগানা মহিলার গায়ে একশবার দোররা মারা হবে। আপনারা কি বলেন?
শেষবারের মতন শব্দ বিস্ফোরণে ফেটে পড়ল চারপাশ।

পরদিন, বাদ আছর, স্কুল ময়দানে সমস্ত গ্রামবাসীর সামনে সফেলাকে বেত্রাঘাত করা হল। গ্রামের মেম্বার, হেড মাস্টার, ইমাম, চোর, বাটপার সকলে পালাক্রমে দোররা মারলো। মহিলারা ঘেন্নায় স্যান্ডেল ছুড়ে মারলো। মাঝপথে সফেলা নিশ্চুপ হয়ে পড়লো, তবুও ডোজ কমপ্লিট করা হল। রাতে ভৌরবের ঘাটে পুতে ফেলা হল সফেলার দেহ।


সফেলার এক মাস যেতে না যেতেই, গ্রামের দক্ষিণ দিকের শেষ বাড়িটাতে কে যেন প্রথম বলল,
-আকলির মা বেশ্যা। আমি নিজ কানে শুনেছি।
সপ্তাহ খানেকের মধ্যে মহল্লার সকলে বলল,
-আকলির মা বেশ্যা।
মাসখানেকের মধ্যে গ্রামের সকলে জানল,
-আকলির মা বেশ্যা।
এখন গ্রামের প্রতিটা ঘরে ঘরে, প্রতিটা মোড়ে মোড়ে, দোকানে দোকানে আলোচনা হচ্ছে,
-আকলির মা বেশ্যা।