মানুষের উৎপত্তি খুঁজতে গিয়ে গত দশকে মানব কৌ্লিতত্ববিদদের (হিউম্যান জেনেটিসিষ্ট) মধ্যে বারবার “মাইটোকন্ড্রিয়াল ঈভ” এবং “ওয়াই ক্রোমজোমাল এড্যাম” শব্দ দু’টো উচ্চারিত হত।

ডিএনএ১ নমুনা ছাড়া বহু পুর্বে মারা যাওয়া কারো জেনোম২ (কোন জীবের সম্পুর্ন বংশগতির বিবরন) পুনর্নিমাণ (রিকন্সট্রাক্ট) করা সম্ভব নয়।বংশধরদের ডিএনএ বিশ্লেষন করে আংশিক ভাবে পুর্ব পুরুষদের জেনোম সম্পর্কে ধারনা পাওয়া যায়।বিজ্ঞানীরা এই ভাবে পুর্ব পুরুষদের বংশগতি সম্পর্কে ধারনা পাওয়ার জন্য মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ৩ এবং ওয়াই ক্রোমোজোম ডিএনএ৪ বিশ্লেষন করেন।মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ সাধারনত অপরিবর্তিত অবস্থায় মা থেকে ছেলে এবং মেয়ে উভয় শিশুতেই যায়।তবে তা ছেলে শিশু থেকে পরবর্তী বংশধরে আর যেতে পারে না। কিন্তু মেয়ে শিশু থেকে পরবর্তী বংশধরে যায় এবং একই ভাবে তার পরবর্তি বংশধরে যায়।মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ শুধু মাত্র মেয়েদের মাধ্যমেই বংশানুক্রম ভাবে এক বংশ থেকে পরবর্তী বংশে যায় বলে একে রৈখিকমাতৃপরম্পারিক রেখা (ম্যাট্রিলিনেয়াল লাইন) ও বলা হয়।মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ দিয়ে মা থেকে তার মা, তার মা থেকে তার মা এবং এভাবে এক আদি মাকে খুঁজে বের করা হয়েছে যাকে মানব কৌ্লিতত্ববিদরা (হিউম্যন জেনেটিসিষ্টরা) আনুমানিকভাবে (হাইপোথেটিক্যালি) “মাইটোকন্ড্রিয়াল ঈভ” নাম দিয়েছেন।মানব কৌ্লিতত্ববিদরা “মাইটোকন্ড্রিয়াল ঈভ” কে এমন একজন নারী বলে চিন্তা করেছেন যার থেকে সমস্ত মানুষের মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ উৎপত্তি লাভ করেছে। কৌ্লিতত্ববিদরা সময় হিসাব করে বলেছেন যে “মাইটোকন্ড্রিয়াল ঈভ” প্রায় ১ লক্ষ ৪০ হাজার বছর আগে আফ্রিকায় বাস করতেন। এখানে উল্লেখ্য যে বাইবেলে বর্নিত ঈভের সাথে এই ঈভের কোন যোগসুত্র আছে কি নেই তা বিশ্লেষন করা হয় নি।

মজার ব্যাপার হল মানব কৌ্লিতত্বে “মাইটোকন্ড্রিয়াল ঈভে”র মত আনুমানিক (হাইপোথ্যাটিক্যালি) “ওয়াই ক্রোমোজোম এড্যাম” ও খুঁজে পেয়েছেন বলে দাবী করা হয়।কিন্তু এই দু’জনের পৃথিবীতে অবস্থানের সময় ছিল ভিন্ন। এড্যাম ঈভের চেয়ে প্রায় ৫০ থেকে ৮০ হাজার বছরের ছোট তবে তারও নিবাস আফ্রিকায় ছিল বলে মনে করা হয়।

“ওয়াই ক্রোমোজোমাল এড্যাম” হল এমন একজন পুরুষ যাকে সমস্ত পুরুষের ওয়াই ক্রোমোজোমের ডিএনএ এর উৎস মনে করা হয়। ওয়াই ক্রোমোজোম সব সময় পুরষ থেকে পুরুষে যায়। পুরুষের পৌরষ্যত্ব প্রকাশক যত বৈশিষ্ট্য তা এই ওয়াই ক্রোমোজোমে কোড করা থাকে। মানুষসহ প্রায় সব স্তন্যপায়ীর লিংগ নির্ধারনী ক্রোমোজোম হল এক্স এবং ওয়াই। ক্রোমোজোম সব সময় জোড়ায় জোড়ায় থাকে। পুরুষের লিংগ নির্ধারনী ক্রোমোজোম জোড়ার নাম হল এক্স-ওয়াই অন্যদিকে নারীদের লিংগ নির্ধারনী ক্রোমোজম জোড়ার নাম হল এক্স-এক্স।“মাইটোকন্ড্রিয়াল ঈভে”র মত “ওয়াই ক্রোমোজোম এড্যাম” বাইবেলে বর্নিত এড্যাম বা কোরানের আদমের সাথে কোন যোগসুত্র আছে কি নেই তা নিয়ে কোন গবেষনা হয়নি এবং কেউ এদের মধ্য যোগসুত্র খুজছেন কিনা তাও জানা নেই।এই নামটি নিতান্তই কৌতুহলের বশে বিজ্ঞানীদের দেওয়া যেখানে তারা এমন একজন পুরুষের কথা বলেছেন যার থেকে সমস্ত পুরুষের ওয়াই ক্রোমোজোমের উৎস।

ওয়াই ক্রোমোজোম এড্যামকে রৈখিকপিতৃপারম্পারিক আদি পুরুষ বা দ্যা প্যাট্রিলিনেয়াল মোষ্ট কমন এন্সেষ্টর বলা হয়। আবার মাইটোকন্ড্রিয়াল ঈভকে রৈখিকমাতৃপারম্পারিক আদি নারী বা দ্যা মোষ্ট রিসেন্ট কমন ম্যাট্রিলিনেয়াল এনসেষ্টর বলা হয়।

নোটঃ

১।ডিএনএঃ ডিঅক্সিরাইবো নিউক্লিক এসিড।এটা একটা নিউক্লিক এসিড। এটা সমস্ত জিবিত প্রানী এবং কিছু ভাইরাসের বৃ্দ্ধি এবং তাদের কর্মক্ষম রাখার প্রয়োজনীয় কৌ্লিতাত্বিক তথ্য ধারন করে। ডিএনএ অনুর প্রধান কাজ হল বংশগতির তথ্য সমুহের দীর্ঘকালীন সংরক্ষন।ডিএনএ কে কোন কিছুর মৌলিক কাঠমো বা ব্লুপ্রিন্ট, রেসিপি বা উপাদন এবং মুল একক বা কোড এর সাথে তুলনা করা যায়।এরা কোষের জন্য অত্যাবশ্যকীয় অন্যান্য উপকরন যেমন প্রোটিন এবং আরএনএ সংশ্লেষনের জন্য প্রয়োজনীয় নির্দেশাবলী ধারন করে। ডিএনএ এর যে অংশে বংশগতির তথ্য থাকে তাকে জিন বলে। তবে অন্যান্য অংশ গাঠনিক উদ্দেশ্য এবং তথ্য নিয়ন্ত্রনের জন্য কাজ করে (নন কোডিং সিকোয়েন্স)।

২।জেনোমঃ কোন জীবের বংশগতির সম্পুর্ন তথ্যকে জে্নোম বলে। জেনোমে জিন এবং ডিএনএ এর নন কোডিং সিকোয়েন্স থাকে।সাধারনত এটা ডিএনএ তে কোড করা থাকে তবে অনেক ধরনের ভাইরাসে এটা আরএনএ তে কোড করা থাকে।তবে সাধারন ভাবে জেনোম বলতে নিউক্লিয়ার জে্নোমকে বোঝায়।নিউক্লিয়াসের সম্পুর্ন জেনেটিক মেটেরিয়াল মানে ক্রোমোজোম বা ডিএনএ কে বোঝায়।যেমন সাধারন ভাবে মানুষের জেনোম বলতে ৪৬টি বা ২৩ জোড়া ক্রোমোজমকে একত্রে বোঝায়। কিন্তু মাইটোকন্ড্রিয়াতে যে জেনেটিক মেটেরিয়াল বা ডিএনএ থাকে তাকে মাটোকন্ডিয়াল জেনোম বলে।তেমনি ভাবে ক্লোরোপ্লাষ্টে যে ডিএনএ থাকে তাকে ক্লোরোপ্লাষ্ট জেনোম বলে। সাধারনত মানুষের বৈশিষ্ট্য নির্ধারিত হয় নিউক্লিয়ার জেনোম দিয়ে। মাইটোকন্ড্রিয়াল জেনোম দিয়ে নয়।

৩।মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএঃ কোষের মাইটোকন্ড্রিয়াতে যে ডিএনএ থাকে তাকে মাইটোকন্ড্রিয়াল ডিএনএ বলে।এটা মায়ের ডিম্বানু থেকে পরবর্তি বংশে যায়। যদিও বাবার শুক্রানুতেও মাইটোকন্ড্রিয়া থাকে কিন্তু কিছু কিছু কারনে শুক্রানুর মাইটোকন্ড্রিয়া জাইগোটে যেতে পারে না। যেমন ডিম্ব কোষে মাইটোকন্ড্রিয়ার সংখ্যা শুক্র কোষের মাইটোকন্ড্র্যার সংখ্যার চেয়ে কয়েকগুন বেশী।তাই প্রতিযোগিতায় টিক্তে পারে না। আবার শুক্রানুতে মাইটোকন্ড্রিয়া লেজের দিকে থাকে বলে নিষিক্তকরনের সময় নতুন জাইগোটে যেতে পারে না (যেহেতু লেজ ডিম্বানুর সাথে যায় না তাই পুরুষের মাইটোকন্ড্রিয়া জাইগোটে যেতে পারে না)।কারন যাই হোক না কেন মাইটোকন্ড্রিয়া সব সময় মা থেকে সন্তানে যায়। যদিও নিউক্লিয়াস এবং মাইটোকন্ড্রিয়া উভয়ই কোষের মধ্যে থাকে তবুও সাধারন ভাবে নিউক্লিয়ার জেনোমের সাথে মাইটোকন্ড্রিয়াল জেনোমের কোন বিনিময় হয় না বা মিশ্রন ঘটে না।কিছু কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে এদের মাঝে ডিএনএ বিনিময় হলেও তা জীবের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্যে প্রকাশ পায় না কারন মাইটোকন্ড্রিয়াল জেনোমের বৈশিষ্ট্যগুলি রিসিপ্টিভ জোনে প্রকাশ পায় না।মাইটোকন্ড্রিয়াল জেনোম সাধারনত জীবের জীবন নির্ধারনকারী কিছু কাজ করে যেমন নির্দৃষ্ট কিছু এনজাইম উৎপাদন করে। তাই, মাইটোকন্ড্রিয়াল জেনোম, কখনই মানুষের সাধারন বৈশিষ্ট্যে যেমন স্বভাব, চেহারা ইত্যাদিতে অবদান রাখেনা।

৪।ওয়াই ক্রোমোজোম ডিএনএঃ মানুষসহ অধিকাংশ স্তন্যপায়ী প্রানীর প্রতিটি কোষে এক জোড়া লিঙ্গনির্ধারনী ক্রোমোজোম থাকে। ক্রোমোজোম দুইটার নাম হল এক্স এবং ওয়াই। পুরুষের একটা এক্স এবং একটা ওয়াই ক্রোমোজোম থাকে এবং নারীদের কোন ওয়াই ক্রোমোজোম থাকে না, থাকে দুইটাই এক্স ক্রোমোজোম। মানুষের ওয়াই ক্রমোজোম এক্স ক্রোমোজোমের সাথে এর রিকম্বিশন হয় খুবই কম (৫% এর বেশী নয়)। তাই ওয়াই ক্রোমোজোমের যে ডিএনএ থাকে তা প্রায় অপরিবর্তিত অবস্থায় পিতা থেকে ছেলে সন্তানে যায়, এবং এ ভাবে ওয়াই ক্রোমোজোমের ডিএনএ বিশ্লেষন করে পুরুষদের বংশের পুর্বপুরুষের পরিচয় খুঁজে বের করা যায়। এই জন্য পারিবারিক ইতিহাস বের করার জন্য ওয়াই ক্রোমজোমের ডিএনএ বিশ্লেষন করা হয়।