টাকা হারানোয় সান্ত্বনা
-মোকছেদ আলী*

[গত ২৯ মার্চ ভবঘুরের লেখা ‘আমার দশ টাকা গচ্চা গেল’ পাঠের পর আমার মনে পড়লো মোকছেদ আলীর লেখা ‘টাকা হারানোয় সান্ত্বনা’ নামক স্মৃতিকথাটি, তাই ভবঘুরে স্মরণে লেখাটি পোষ্ট করলাম]
——————-
….. টাকা আত্মসাৎ করেছে, আল্লাহর উপর বিশ্বাসী একজন মুসল্লী বান্দা। টাকা কোন অপবিত্র স্থানে খোয়া যায় নাই। খোয়া গেছে একেবারে আল্লাহর ঘর মসজিদেই।

আগের নেয়া চার হাজার টাকা পরিশোধ করে দিয়ে আবার আলুর আবাদের জন্য ১৫ হাজার টাকা কৃষি লোন নেব সোনালী ব্যাংক থেকে। কাগজপত্র সব সই স্বাক্ষর সারা। শুধু ব্যাংকে গিয়ে টাকাটা নগদ গ্রহণ করব। সকাল বেলায় গৃহকর্ত্রীকে একথা বলায় তিনি গরম পানি করে দিলেন। গরম পানিতে গোসল করে শরীরটা একটু আরাম লাগল। গত ৩/৪ দিন থেকে সর্দি কাশিতে শরীর খুব দূর্বল, সেই সঙ্গে মন মেজাজ তিরিক্ষি।
যাহোক ইস্ত্রি করা জামা-পায়জামা পরিধান করে রওনা হব, গৃহিনী গরম ভাত দিলেন চৌকির উপর। ভাত খেয়ে রওনা দিলাম ব্যাংকে। সাইকেল নিয়ে গেলেই ভাল হয়। একটা ব্যাগ নিলাম। টাকাগুলি সব পকেটে আনা যাবে না। যদি ব্যাগটা নিই, ভাল হবে। ব্যাগের মধ্যে একখানা বই নিলাম। যদি ব্যাংকে টাকার অপেক্ষায় বসে থাকতে হয় তখন বইখানা পড়ে সময় কাটানো যাবে।
সাইকেল না নিয়ে হেঁটে যাওয়াই সমীচীন মনে করলাম। শরীরটা তো খুব একটা যুৎসই না, এজন্য সাইকেলে চড়তে মন চাচ্ছিল না। পকেটে ২২০ টাকা। সবই বিশ টাকার নোট। ব্যাগ হাতে ঝুলিয়ে সদর রাস্তায় না গিয়ে সোজাপথে রঘুজীর মন্দিরের পাশ দিয়ে রওনা হলাম। ব্যাংক বেশি দূরে নয়। পা চালাক করে হাটলে ৬ মিনিট লাগবে সোনালী ব্যাংকে পৌছুতে। শরীরটা মন্দা দেখে ধীরে ধীরেই চলছিলাম। বাড়ি থেকে যখন বের হই তখন হাতের ঘড়িতে ১০ টা বাজে।
বড় রাস্তায় উঠে সোভান ডাক্তারের মসজিদের কাছে এসেছি। হঠাৎ কে একজন পিছন থেকে বলল, “চাচা আপনের জামায় এসব কী?” ছেলেটি নিজেই বলল- “পাখিতে হেগে দিছে, ঐ মসজিদে গিয়ে ধুয়ে আসুন।” জামা টান দিয়ে দেখি আলকাতরার মত কালো কিসের দাগ। পাখির গু-ই হবে। কারণ রঘুজীর মন্দির থেকে শুরু করে পাকা রোড পর্যন্ত মাথার উপর নানান গাছ-গাছালী। পথটাও বেশ নিরিবিলি।
আমি জামার গু ধোয়ার জন্য মসজিদে গেলাম। অজুর স্থানে গিয়ে দেখি, দুইজন টুপিধারী মুসল্লী। মুখে দাড়ি ভর্তি। অর্থাৎ তারা যে পাকা মুসল্লী তাতে কোনই সন্দেহ নাই। একজন মগে পানি নিয়ে পেশাবখানায় গেল। আরেকজন দাঁড়িয়ে রইল। আমি জামার পকেট থেকে টাকাগুলি বের করে ব্যাগের মধ্যে রাখলাম। ব্যাগটা অজুর জন্য বসার সিমেন্টের আসনের উপর রেখে জামা খুললাম। তারপর ট্যাপ খুলে গু ধুতে লাগলাম। মেলা স্থানেই হয়েছে। দাঁড়ানো মুসল্লীটি বলল, “আপনার গেঞ্জিতেও হয়েছে আর পাজামাতেও হয়েছে।” তাকিয়ে দেখি বাস্তবিক গেঞ্জিতেও হয়েছে, পায়জামাতেও হয়েছে। আগে জামাটা ধুয়ে নিই। পেশাবখানা থেকে লোকটি এসে জিজ্ঞেস করল, “কি হয়েছে?” বললাম, “পাখিতে পায়খানা করে দিয়েছে তাই ধুইয়ে ফেলছি।” সে বলল, “ঐ ট্যাপে যান, এই ট্যাপের পানি ভালো না।” আসলে ট্যাপের টাংকিও দুটি। তার কথামত একটু সরে গিয়ে জামা ধৌত করলাম। তারপর পায়জামার দিকে তাকিয়ে পায়জামা ধৌত করতে লাগলাম।
দাঁড়িয়ে থাকা লোকটি আমাকে বলল, “ব্যাগটা কাছে রাখুন।” বলেই সে ব্যাগটা আমার কাছের টাংকির ঢাকনার উপর রেখে দিলো। আমি পায়জামা, গেঞ্জি ধুয়ে জামা গায়ে দিলাম। কড়া রৌদ্র। এমনিতেই শুকিয়ে যাবে। ব্যাগটা নিয়ে দেখি, ওর ভিতর টাকা নাই। শুধু বই, চশমা আর কলমটি রয়েছে। কাকে কি বলি, চেয়ে দেখি দুই মুসল্লীর কেহই নাই। তাদের তো চিনি না।
এই টাকাটা এভাবে খোয়া যাওয়ার কারণ কি? এর একটা ব্যাখ্যা আছে। তোমরা হয়তো বলবে- আপনি তো মোটামুটি একজন চালাক লোক। আপনার তো এরকম ঠকা ঠিক হয় নাই। কথাটা ঠিক। তবে চালাকেরাও মাঝে মাঝে বোকা বনে যায়।
এখন এর ব্যাখ্যা হলো- আমার মনে হয় সামনে আমার বেশী অংকের অর্থ খোয়া যাবার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আল্লাহপাক অনুগ্রহ করে তার এক মুসল্লী বান্দার দ্বারা আমার এই অল্প টাকাটা খোয়াইয়া দিলেন।
১) কোন দুষ্ট পকেটমার বা চিটারের হাতে আমার টাকা খোয়া যায় নাই।
২) টাকা আত্মসাৎ করেছে, আল্লাহর উপর বিশ্বাসী একজন মুসল্লী বান্দা।
৩) টাকা কোন অপবিত্র স্থানে খোয়া যায় নাই। খোয়া গেছে একেবারে আল্লাহর ঘর মসজিদেই।

সুতরাং আমার আফসোস করার কিছুই নাই। আমি যে একজন মুসল্লী ব্যক্তিকে অবিশ্বাস করি নাই, এটা আমার ইমানের পরিপক্কতা। অর্থাৎ রসুলের প্রতি আমার দৃঢ় মহব্বত। যদি আল্লাহর ঘরের মধ্যে ঐ মুসল্লীকে অবিশ্বাস করতাম, তাহলে আমার ইমানের দূর্বলতা প্রকাশ পেত। আমার টাকাটা এমন এক ব্যক্তি গ্রহণ করেছে, যে পরে অনুতপ্ত হবে এবং আমাকে ফেরত দেবার জন্য ছট ফট করবেই করবে। সেসময় হয়ত আমাকে আর পাবে না। তখন আল্লাহর দরবারে তার এই অপরাধের জন্য বার বার ক্ষমা চাবে। আমার ক্ষতিপূরণের জন্য বারবার মহিয়ান আল্লাহর দরবারে মোনাজাত করবে। বলবে- “আল্লাহ যদি জীবনে কখনও কোনদিন বিন্দু পরিমাণও তোমার সন্তুষ্টি অর্জন করে থাকি, তবে সেই সন্তুষ্টির বিনিময়ে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তির কল্যাণ করো।”
আল্লাহর তো ধনের অভাব নাই। হয়ত তিনি অন্যদিক থেকে আমার এই আর্থিক ক্ষতিপূরণ করে দেবেন। সেই ক্ষমতার প্রতি যে আমাকে আস্থা এবং বিশ্বাস রাখতেই হয়। কাজেই আফসোস না-করে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করলাম, “হে মাবুদ, তোমার যে বান্দা আমার অর্থ নিয়েছে, তাকে সুবুদ্ধি দান করো। তার ইমান মজবুত করে দাও।”
আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করি যে, ব্যাগে তো আরো মূল্যবান কলম ও চশমা ছিল; তা তো সে নেয় নাই। যদি কলম ও চশমা নিত তাহলে এই কাহিনীটাও এত সহজে লিখতে পারতাম না। যাক যা হবার হয়েছে। এটা আমার নসীবেই ছিল। তা না হলে আমি ঐ রাস্তায়ইবা গেলাম কেন? পাখিইবা কেন আমার জামায় পায়খানা করে দিল?
জামা ভিজা। সুতরাং ভিজা জামা নিয়ে আর ব্যাংকে গেলাম না। ঘড়িতে ১০\. টা বাজে। সময় আছে মেলা। বাড়ি ফিরে এলাম। আব্দুল্লাহর দোকানে গিয়ে সংক্ষেপে বলে তার কাছে ১০ টাকা পকেট খরচের জন্য চেলাম। কোন বাক্য ব্যয় না করে পকেট থেকে ১০ টাকা বের করে আমার হাতে দিল।
জামা-কাপড় বদলিয়ে সাইকেল নিয়ে আবার ব্যাংকে গেলাম। কাগজপত্র সব সই স্বাক্ষর করা আছে। ১৫ হাজার টাকা আমার ডিমান্ড, কিন্তু ম্যানেজার সাহেব সাত হাজার টাকা বরাদ্দ দিলেন। তার বেশি আর দিলেন না। আমার এক ছেলে ঐ ব্যাংকেই চাকরী করে। সেজন্য আমি আর পীড়াপীড়ি করলাম না।
মহসেন মিয়া ব্যাংকের কেরানী। বললো- চাচা, আপনাকে আর সারের ভাউচার দিলাম না। ৭ হাজার নগদ দিলাম। আমি আল্লাহর শুকরিয়া আদায় করলাম। সারের ভাউচার দিলে তিন হাজার টাকার ভাউচার দিত। আর আমার তো আপাতত টাকারই প্রয়োজন, সারের প্রয়োজন নাই। সারের ডিলারের কাছে নগদ টাকা চাইলে অবশ্যই দুশো টাকা কেটে রেখে দিত।
সুতরাং চিন্তা করে বুঝলে সহজেই বোধগম্য হলো যে, টাকাটা আসলে আমার খোয়া যায় নাই। খোয়া গেল সারের ডিলারের। তোমরা একথা শুনে অবশ্যই হাস্য করবে। হাস্য করার কথাই বটে। তবে এর ভিতর যে অতি সূক্ষ্ণ তত্ত্ব আছে, তাতো সকলেরই বোধগম্য হবে না। আল্লাহ নিজের উদ্দেশ্যমত যাদের ডেকেছেন তাদের ভালোর জন্য সবকিছুই একসঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে। অর্থাৎ, ইমানদারের জীবনে যাকিছু ঘটে তা মঙ্গলের জন্যই ঘটে।
এই দুনিয়াতে কত রকম যে ঘটনা ঘটে, তার হিসাব কে রাখে? আমার অতীত জীবনে কত ঘটনা ঘটেছে কিন্তু তার বিশ্লেষণ কখনও এভাবে করে দেখি নাই।
রচনাকাল: ১২ নভেম্বর ১৯৮৯।
===========
অনুলিখন: মাহফুজ।
*মোকছেদ আলী (১৯২২-২০০৯)। স্বশিক্ষিত।