কোল বালিশ ও গোল বালিশ
টিন বালিশ ও তূষ বালিশ
চুল বালিশ ও তেল বালিশ
আমার কোন নেই নালিশ।

গিন্নি বললো, দোয়া কর যেন আমি কালই মরে যাই। বললাম, তোমার তো কই মাছের জান, সহজে মরবে না তাই দোয়া করে আমার সময় নষ্ট করতে চাই না। নিজের আয়ূ সম্পর্কে এই আশ্বাস পেয়ে আরেকদিন বললো, দেখ ভবিষ্যতে কখন কি হয় বলাতো যায় না, দুর্দিনের জন্যে একটু মাথা রাখার ব্যাবস্থা করে রাখলে ভাল হয় না? তথাস্তু, বলে পরদিনই মোটামুটি দাম দিয়েই বিছানা ও বালিশ কিনে এনে বলেছিলাম, এটির আরাম, কাঠামো ও আয়ূর ব্যাপারে বিশ বছরের নিশ্চয়তা (ওয়ার্যাবন্টি) দেয়া আছে। তোমার সাথে ঘর করে (বা না করে) বিশ বছরের মধ্যেই আমার মত্যু হওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। এর পর যদি টেনেটুনে আরো বছর দশেক কাটিয়ে দিতে পার তবে শুধু মাথা রাখা নয়, বাকিটা জীবন ঘুমিয়ে আমার দোয়া ছাড়াই ইহলোক ত্যাগ করতে পারবে। সেই বিছানায় শুয়ে, বালিশে মাথা রেখে শুধু গিন্নিরই নয়, আমারো মনে হয়েছিল এর চেয়ে আরামের কিছু আর নেই। কিন্তু আজ ডাউনটাউন ডালাসের এই হায়াত রিজেন্সি হোটেলে উঠে আমার সে ধারণা বদলে গেল।

কাজ উপলক্ষে মাঝে মাঝে বাসার বাইরে থাকা হয়। সানফ্রান্সিস্কোর হিল্টন বলুন, বা থাইল্যান্ডের পাতায়ায় রয়াল ক্লিফ বীচ হোটেল বা ফিলাডেলফিয়ার ডাবলট্রি, বা অষ্ট্রেলিয়ার এডেলাইড হিলটন, বা সান্টিয়াগো’র গ্র্যান্ড হায়াত, বা ইটালীর বাভেনো’র গ্র্যান্ড ডিনো বলুন, আমি ছোট একটি মানুষের জন্য বরাদ্ধ পাই বিশাল এক ঘরে কিং সাইজের বিছানা। এগুলোর ম্যাট্রেস, লেপ, বালিশ, চাদর এতোই তুলতুলে ও আরামদায়ক, যে আমার মত খেটে খাওয়া শরীরে তা সহ্য না হয়ে সারা রাত না ঘুমিয়ে কাটাতে হয়। গত মাসে বাসা থেকে মাত্র বিশ মিনিট দূরে এক সপ্তাহ থাকতে হয়েছিল আলেকজান্ড্রিয়ার ওয়েষ্টিন হোটেলে। সুন্দর একটি বইতে লেখা ছিল, পছন্দ হলে খাট ও নিশ্চয়তা (ওয়ার্যা ন্টি) ছাড়াই বিছানাটি যতদূর মনে পড়ে মাত্র ছয় হাযার ডলারে কিনে নিতে পারি! আপনারাই বলুন, চাকুরি সুবাদে এ বিছানায় শোয়ার সৌভাগ্য হলেও চোখে কি তুলতুলে এই পরিবেশে সহজে ঘুম আসার কথা? কিন্তু আজকের হোটেলটি তার চেয়েও এক কাঠি ওপরে। বিছানায় সুন্দর, আলতো করে শোয়ানো একটি কোল বালিশ ও বাংলা ‘ণ’ অক্ষরের পুঁটুলিটির মত তার পাশে রাখা বলের মত একটি গোল বালিশ। বিদেশে এই প্রথম একটি কোল বালিশ দেখে আনন্দে আত্মহারা হয়ে পায়ের জুতো না খুলেই বিছানায় গড়াগড়ি দিতে লাগলাম। সাথে সাথে বাসায় ফোন করে গিন্নিকেও এর বর্ণনা দিলাম। আদিখ্যেতা হয়ে গেল ভাবছেন? একটু ধৈর্য ধরুন।

কোল বালিশঃ বিদেশে আমি প্রথম যাই জাপানে। ভাষাটা যখন কিছু বুঝতে শিখেছি, টিভিতে নৈশকালীন টক শো’র সঞ্চালককে দেখলাম একটা কোল বালিশ উঁচু করে ধরে দর্শকদের জিজ্ঞেস করছেন, এ-ই-টা কী-ঈঈঈ…? অনেকে অনেক কথা বললেন, সঠিক উত্তরের ধারেকাছেও না। সঞ্চালক তখন সাহায্য করতে গিয়ে বললেন, ভারত ও বাংলাদেশে এর ব্যাবহার আছে। তারপর আরো বললেন, দুই পায়ের মধ্যিখানে কী-ঈঈঈ… থা-আ-কে-এএএএ…? দর্শকদের ক্ষনিকের ফিসফিসানির পর হাসির কি হুল্লোড়! ভাষার জ্ঞ্যানের স্বল্পতা, তার ওপর গরীব দেশের নাগরিক-সুলভ হীনমন্যতা নিয়ে এজাতীয় বর্ণনা শুনে ও ওদের অট্টহাসি দেখে মনে হচ্ছিল এরা আমাদের ব্যাবহারের জিনিসকে মস্করা করে আমাকেই ব্যাঙ্গ করছে। এই পঞ্ছাশ বছর আগেও এক টুকরো কাঠকে জাপানীরা মাথার বালিশ হিসেবে ব্যাবহার করতো। সেসময়ে বাংগালির বালিশ কেমন ছিল জানি না তবে জ্ঞ্যান হওয়া থেকে ব্যাবহার করে, আর গল্প-উপন্যাস-সিনেমায় ব্যাবহার দেখে কোল বালিশকে বিছানার একটি অত্যাবশ্যকীয় অংগ বলেই জেনে এসেছি। পাশে বসে থাকা জাপানী ও বিদেশী বন্ধুদের একটু রাগান্বিত ভাবেই বলেছিলাম নতুন পয়সা হয়েছে তো, কোল বালিশের মাহাত্ম্য বুঝতে তোমাদের আরো সময় লাগবে। ছেলের জন্মের পর স্ত্রী দেশ থেকে ছোট একটা কোল বালিশ আনিয়েছিলেন। আমেরিকায় এসে নিজেদের জন্যে বৃথাই খোঁজ করে করে কোল বালিশ ছাড়া ঘুমানোতেই অভ্যস্ত হয়ে গেছি।

তা আজ এই হোটেল কি মনে করে বিছানায় কোল বালিশটি দিল? অন্যান্য জিনিসের তুলানায় একটির দাম আর কতই হবে যে এতোদিন তারা দিতে পারে নাই নাই? কোন বৈজ্ঞানিক গবেষণালব্ধ জ্ঞ্যান থেকে কি? ইন্টারনেটে পাবমেড ও ন্যাশনাল লাইব্রেরী অব মেডিসিন এর নথীকৃত কোন গবেষণা সাময়িকীর প্রবন্ধ বলতে কিছু পেলাম না। শেষমেশ বিছানা বানানোর ব্যাবসায়ীক দুয়েকটি সাইটে পেয়ে গেলাম ছবি সহ কোল বালিশের মাহাত্ম্যের বর্ণনা। এরা মাথার ব্যাবহারের বাইরে অন্যান্য কয়েক ধরণের বালিশকে একত্রে বলছে ‘অর্থোপেডিক পিলো’, আর কোল বালিশকে বলছে ‘বডি পিলো’। লিখেছে আগে যেখানে বালিশের ব্যাবহার শুধু মাথার নিচেই সীমাবদ্ধ ছিল, অতি সম্প্রতি কোল বালিশের আরো অনেক গুণাগুনের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। তাদের দাবী, এক রেজিষ্টার্ড নার্স এটির আবিষ্কারক(!), যার মতে বালিশটি শরীরের কোমল যায়গাগুলোয় আদরের সাথে লেপ্টে থেকে পুরো শরীরের হাড়-মাংশের (মাস্কিউলো-স্কেলেটাল) অবলম্বন (সাপোর্ট) হিসাবে কাজ করে। ফলে হাযার হাযার শরীর-ব্যাথার রুগীকে এই বালিশ চিকিৎসীয় আরাম (থেরাপিউটিক কমফোর্ট) এনে দিচ্ছে। ওরা আরো দাবি করছে যে বাতের ও পিঠের সহ সব ধরণের পুরাতন ব্যাথা, স্থায়ী দূর্বলতা-অবসন্নতা (ক্রণিক ফ্যাটিগ সিন্ড্রোম), অনিদ্রা, এমনকি হৃদয় ও ফুসফুসের (হাঁফানি) বিভিন্ন রোগেও কোল বালিশ রুগীকে আরামে ঘুম পাড়িয়ে আবার সতেজ হয়ে জেগে উঠতে সাহায্য করছে। একেবারে ধ্বন্নন্তরি তাবিজের মত ব্যাপার আর কি! হোটেলটি হয়তো এধরণের উপকারীতার কথা শুনেই আরামের ঘুম নিশ্চিত করতে এ বালিশের প্রচলন করা শুরু করেছে। বহু বছর আগে জাপানে কোল বালিশ নিয়ে হাসি-তামাসার যে অপমানবোধ বয়ে বেড়াচ্ছিলাম এতোদিন, আজ তার কিছুটা উপশম হোল!

কিন্তু গোল বালিশটি কেন? সকালে নাশতার টেবিলে পরিচিত জনদের জিজ্ঞেস করে জানলাম তাঁদের কাছে কোল ও গোল দুই বালিশই নতুন। অভ্যর্থনা টেবিলে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। আমার প্রশ্নে মেয়েটি প্রথমে লজ্জা পেলো, পরে খুব করে হাসলো। রিং বাজাতে ‘এক্সকিউজ মি’ বলে সে ফোনটি হাতে তুলে নিল। আমি ভাবতে থাকলাম জীবনে কত বালিশ নিয়েই ঘুমিয়েছি, সোফার ওপরে চারকোনা বালিশও বাসায় আছে প্রচুর, কিন্তু এরকম গোল বালিশ তো কখনো দেখি নাই। মনে পড়ে গেল তেল বালিশের কথা, টিন বালিশের কথা, তূষ বালিশের কথা, চুল বালিশের কথা।

তূষ বালিশ, টিন বালিশ ও চুল বালিশঃ একাত্তরে ঢাকা থেকে প্রাণ হাতে নিয়ে পালানোর পথে নরসিংদিতে আটকে পড়া আপাদের ও আরেকটি পরিবারকে ব্রাহ্মনবাড়ীয়া নিয়ে যেতে এসেছি। মাঝ নদীতে জলদস্যুর হাতে সর্বস্ব হারিয়ে এপ্রিলের দুই বা তিন তারিখ সন্ধ্যায় নবীনগর বাজার ঘাটে পৌঁছালাম সূর্যাস্তের আগে। স্থানীয় চেয়ারম্যান ও স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সমবেদনা জানিয়ে সের দুয়েক চিড়া-গুড় দিয়ে আমাদের আপ্যায়ন করলেন। বাজারের মাঝেই সবচেয়ে বড় যে গুদামঘরটি ছিল তাতে একটি হারিকেন দিয়ে থাকার ব্যাবস্থা করলেন। কোথা থেকে একটা বড় ও ভারী চট এনে মেঝেতে বিছিয়েও দিলেন। দুই কাতারে সতের জন প্রাণী ঘুমাতে গেলাম যেন সবারই পা উলটো দিকের দেয়ালে তাকিয়ে থাকে, অর্থাৎ উল্টো করে শোওয়া প্রতি দুজনের মাথা কাছাকাছি থাকে। কিছুক্ষনের মধ্যেই আগের রাতে হয়ে যাওয়া বৃষ্টির পানি মেঝে থেকে সতরঞ্ছি চুঁইয়ে চুঁইয়ে শরীরে শীত ধরিয়ে দিল। আমি আরাম খুঁজতে গিয়ে ঘরের এক কোনায় স্তুপ করে রাখা ধানের তুষে (খোসা) শরীরের উপযোগী একটি গর্ত ও বালিশ বানিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। হঠাৎ ধপ্ করে এক শব্দে ঘুম ভেঙ্গে গেল। তখনি একটি উষ্ণ কম্বলের ছোঁয়া পেয়ে সেটি গায়ের ওপর টানতে গিয়ে মনে হোল এটির লোম খুব মোটা, বাড়ীর পরিচিত কোন কম্বল নয়। পরক্ষণেই অল্প আলোয় দেখতে পেলাম কম্বলটি নিজেই নড়ে উঠলো, চার পায়ে উঠে দাঁড়িয়ে নিঃশব্দে হেঁটে হেঁটে ঘরের আরেক কোনে ভাঙ্গা বেড়ার একটি ফোকোর দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। বুঝলাম, আমি যেখানে শুয়েছি, সেটি ছিল এই কুকুরটির প্রতিদিনের ঘুমের বিছানা। আমিই আজ অনাহুত ভাবে ওর যায়গা দখল করে রেখেছিলাম। নবীনগরের আর সবার মত সেও বুঝতে পেরেছিল দেশের দূরবস্থার কথা, অতিথি বৎসল হয়ে সে তাই ঘুমিয়ে যাওয়ার পর আমাকে না জাগিয়ে পাশে এসে একটু শুয়েছিল মাত্র। লজ্জা ও কৃতজ্ঞতায় আমার দেহমন ভরে গেল।

কিন্তু ধপ করে কিসের শব্দ হয়েছিল? উফ্ বলে আপার গলা শুনেছিলাম। জিজ্ঞেস করলাম, আপা কি হয়েছে? ঘুম জড়িত কন্ঠে বললেন, কে যেন আমার চুল ধরে টান দিল। ঘরটি যে অরক্ষিত সেতো কুকুরের চলে যাওয়া থেকেই বুঝতে পারলাম। সাথে সাথে আপার উলটো দিকে শোয়া হেলাল ভাই উঠে বসলো। ২৫শে মার্চ রাতে গোলাগুলি শুরু হয়ে যাওয়ায় সে মোহাম্মদপুরে আপার বাসায় থেকে যায়। গত দুদিনের নারকীয় ধ্বংশ-যজ্ঞে এতোটাই ঘাবড়ে যায় যে ২৭শে মার্চে দু’ঘন্টার সান্ধ্য আইন বিরতিতে একা একা দু’মাইল দূরে লালমাটিয়ায় নিজের মা-বাবার কাছে না গিয়ে আপাদের সাথে নরসিংদি চলে এলো। দেখতে পেলাম ও এক হাতে চোখ রগড়াতে রগড়াতে আরেক হাত নিজের মাথায় এমন ভাবে বুলাচ্ছিল যেন ব্যাথা পেয়েছে। নন্নাহ্, কেউ আপার চুল ধরে টান দিল আর হেলাল ভাই মাথায় ব্যাথা পেল – এ অঙ্ক তো কিছুতেই মিলছে না। একটু শার্লোক হোমস গিরি করতেই ঘটণার জট খুলে গেল। আজ রাতে আমাদের কারোরই কাঁথা বা বালিশ ছিল না। যার যা বাড়তি কাপড় ছিল সেগুলো পুঁটুলি করে বালিশের কাজ চালানো হয়েছিল। আপার কাপড়গুলো দুলাভাই, শ্বাশুড়ি ও তিন মেয়েকে দেয়ার পর তাঁর নিজের জন্য কিছুই রইলো না। শিশু কন্যার জন্য ড্যানো মার্কা গুড়া দুধের একটি গোল টিনকে ঘাড়ের নীচে রেখে বালিশের কাজ চালাচ্ছিলেন। হেলাল বালিশ ছাড়া ঘুমানোর নিস্ফল চেষ্টা করে দেখতে পেল ওর মাথার কাছে হৃষ্টপুষ্ট ও লম্বা এক জোড়া চুলের বেণী অযত্নে পড়ে আছে। পূরকৌশলের এর তৃতীয় বর্ষের ছাত্র এতোদিনে তার অর্জিত বিদ্যার এক উৎকৃষ্ট প্রয়োগের সূযোগটা কাজে লাগালো। পেঁচিয়ে একটা বেণীকে আরেকটির ওপর রেখে চমৎকার এক বালিশ বানিয়ে তার ওপর মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়লো। মুশকিল শুধু একটাই ছিল, বালিশ বানানোর ডিজাইন করতে গিয়ে জড় পদার্থ হিসেবে চুলের স্থিতি ধর্মকে (ষ্ট্যাটিক প্রোপার্টি) বিবেচনায় আনলেও নড়ন-চড়ন ধর্মের (ডায়নামিক প্রোপার্টি) সাথে এর সমন্বয় করতে পারে নাই। ঘুমের মাঝে আপা এপাশ থেকে ওপাশ করার সময় তাঁর চুলের বেণীতে টান পড়ে, আর তখনি হেলালের মাথা ধপ্ করে মেঝেতে পড়ে যায়। ঘুম ভাংগায় যারা বিরক্ত হয়েছিল, এই ঘটণা শুনে হাসতে লাগলো। মুক্তিযুদ্ধে জল্লাদ ইয়াহিয়ার নৃশংসতা আপামর জনগনকে যে অবর্ণনীয় কষ্টের মাঝে ঠেলে দিয়েছিল, ছোটখাট এসব ঘটণা ক্ষনিকের জন্য হলেও সেসব দুঃখ ভুলে যেতে সাহায্য করেছিল।

তেলবালিশঃ মুক্তিযুদ্ধের মে বা জুন মাসে গ্রাম থেকে আমাকে একদিন ১৪ মাইল হেঁটে ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় একরাতের জন্য আসতে হয়েছিল। দেখলাম পুরু চায়ের দাগ লেগে থাকা খালি কাপটি তেমনি পড়ে আছে আম্মার পালঙ্কের পাশে। মাস দেড়েক আগে আরেক বার খালি বাড়িতে এসে বিছানায় অপরিচিত এক ভদ্রমহিলাকে দেখে অবাক হয়েছিলাম। জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম তিনি সংসদ সদস্য বেগম সাজেদা চৌধুরী (বর্তমানের সংসদে সরকার দলীয় উপনেতা)। এক রাত্রি এবাড়ীতে কাটিয়েছিলেন ভারত যাওয়ার পথে, সকালে আমি চা বানিয়ে দিয়েছিলাম। আজ কোথাও কোন সাড়াশব্দ নেই, বড় একা লাগলো। পরদিন সকালে পাকসেনাদের চোখের আঁড়ালে আবার গ্রামে ফিরে চললাম। কোমরে লুঙ্গি, গালে দাড়ি, হাতে স্যান্ডেল, মাথায় কিস্তি টুপি ও ছাতা নিয়ে হেঁটে চলেছি তিতাস নদীর পাড়ে উঁচুনীচু পথ বেয়ে। সীমানা পেরিয়ে গেলেই একটি কোলাহল কানে বাজতে থাকে, যা শহরের ভেতরে থাকতে কখনো শুনতে পাইনি। দূরত্ব বাড়ার সাথে সাথে একসময় তা মিলিয়ে যায়। পাকসেনার বদলে তখন একাকীত্বের ভয় এসে ভর করে। তা বুঝতে পেরে সূর্য আমাকে পাহাড়া দিতে এগিয়ে আসে চারিদিকে প্রখর দৃষ্টি রেখে, বাংলার শৈশব-কৈশোর-যৌবন-বার্ধক্য তাদের অপরূপ সৌন্দর্য আমার সামনে মেলে ধরে, আর শো শো শব্দে বাতাস আমার কানে অনবরত সাহসের বানী শুনিয়ে যেতে থাকে। ভালবাসার ঋণ শুধু বেড়েই চলে। এমনি ভাবে মাইল পাঁচেক যাওয়ার পর নদীর পাড়ে অলস ভাবে কাউকে বসে থাকতে দখলাম। চোখে সন্দেহের দৃষ্টি নিয়ে অনেক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাছে আসতেই বললো, আশরাফ না? আমিও চিনতে পারলাম, মজিদ (আসল নাম নয়), স্কুলে একসাথে পড়েছি। পাঁচ বছর আগে ক্লাশ টেনের পর আজ প্রথম দেখা। মজিদ তার গরুকে নদীর পাড়ে ঘাস খাওয়াচ্ছিল। সামাজিক দূরত্বের কারণে কখনো বন্ধুত্ব হয়ে ওঠেনি, কিন্তু একা চলার ক্লান্তিতে আজ মনে হোল সে আমার কত যুগ যুগান্তরের বন্ধু! ধপাস করে পাশে বসে পড়লাম। বললো, নদীপথে নাপাক বাহিনী অভ্যস্ত নেই বলেই হয়তো ওদের গ্রামটি এখনো অক্ষত আছে। সড়ক পথে এসে তাদের আরো উজানে সাহবাজপুর গ্রামের বাজারটি হানাদাররা বেশ আগেই পুড়িয়ে দিয়েছে।

মজিদ আমার দুদিনের হাঁটার কাহিনী শুনে সমমর্মিতা দেখিয়ে ভাত খেয়ে যেতে আমন্ত্রণ জানালো। নদীপাড় থেকে প্রায় পোয়া মাইল দূরে পাটখড়ির একটি ছোট ঘরে বসতে বলে খাবার আনতে চলে গেল। আসবাব বলতে ঘরের একপাশে মাটিতে প্রেথিত বাঁশের চৌকি। খানিক্ষণ পর চারকোনা একটি জিনিস আমার হাতে দিয়ে বললো ‘রান্না হতে হতে তুমি শুয়ে একটু বিশ্রাম নিয়ে নাও’। বলে সে উধাও হয়ে গেল। কালো রঙের যে বস্তুটি আমাকে দিল, আয়তনের তুলনায় সেটি অনেক ভারী। ঘরের একটি মাত্র জানালার আলোতে এপিঠ ওপিঠ ঘুরিয়ে বস্তুটি কি তা বোঝার চেষ্টা করলাম। হাতের স্পর্শে বেশ শক্ত কিন্তু কাঠের মত না হয়ে ক্ষৌরকারের ক্ষুর ধারানোর চামড়ার এক মসৃণ ও নমনীয় অনুভুতি পেলাম। আমি কল্পনায় দেখতে পেলাম, কোনকালে এবাড়ীর পিতামহী বা প্রপিতামহী হয়তো তাঁর বিয়ের সময় একটি বালিশ উপহার পেয়েছিলেন। বহু বছর ধরে কয়েক পুরুষের ব্যাবহারে প্রতি রাতে সেই বালিশটি শায়িত ব্যাক্তির মাথার তেল শুষে শুষে এমন এক পদার্থে পরিণত হয়েছে, সেটি যে কখনো কাপড় বা তুলা দিয়ে তৈরী হয়েছিল সে নিজেই এখন তা ভূলে গেছে। এর স্তরে স্তরে যদি শত বছরের পুরনো মুখের লালা, মাথার ঘাম, তেল, চামড়া, খুস্কি, থেকে থাকে, অথবা উকুন, উকুনের ডিম বা তেমন আরো কিছু নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে বা খেলা করতে থাকে তাতে বিস্মিত হবার কিছু নেই। মাত্র কদিন আগেই ধানের তুষের ওপর একরাত ঘুমিয়েছি কুকুরের সাথে। তার ওপর গত দুদিনের এতোটা পথ হাঁটার পর উকুন বা খুস্কিকে খারাপ লাগার মত মনের অবস্থা ছিল না। বরঞ্চ মজিদ আমার বিশ্রামের জন্যে যে একটি বালিশের প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছে, ওর প্রতি মনে মনে কৃতজ্ঞতা জানালাম। পরম যত্নের সাথে বালিশটি মাথার নীচে দিয়ে, ঢেউ খেলানো বাঁশের চৌকিতে শুয়ে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লাম বুঝতেই পারিনি।

গোল বালিশঃ ডেস্কের মেয়েটি ফোনটি রেখে ‘আই এ্যাম সরি’ বলে বললো এগুলো আসলেই কী, আমি তা জানি না, তবে একটু অপেক্ষা করলে খোঁজ নিয়ে আপনাকে বলতে পারি। আমার মিটিং এর সময় হয়ে যাচ্ছে, অপেক্ষা করতে পারবো না। তখন সে বললো, বলের মত গোল বালিশটি আমার ধারণায় কোন ব্যাবহারের প্রয়োজনে নয়, এটি শুধু সৌন্দর্য বাড়ানোর জন্যে। আমার মনে হোল, দারিদ্র্য ও প্রাচুর্য্যের সাথে একটি বড় পার্থক্য হোল আমরা যেখানে বস্তুর ব্যাবহার নিয়েই বেশি ব্যাস্ত থাকি, ওরা তার মাঝে সৌন্দর্যও খুঁজতে চায়। তাই আমার হোটেল রুমে অপ্রয়োজনীয় গোল বালিশটি প্রয়োজনীয় কোল বালিশ এর পাশে এমোন ভাবে সুন্দর, আলতো করে শোয়ানো আছে যেন একজন আরেকজনের দিকে স্নেহ ভরা চোখে তাকিয়ে আছে।

১৬ই নভেম্বর, ২০০৯
ডালাস, টেক্সাস