এক

ছোটবেলায় এক পাগলাটে শিক্ষক ছিলেন আমাদের স্কুলে। সারাক্ষণ বিড়বিড় করে কি বলতেন আপন মনে। উস্কোখুস্কো চুল, কোনদিন আঁচড়াতেন কিনা সন্দেহ, অনেকগুলো উকুন পরিবার সেখানে নিরাপদ বাসা করেছিল নিশ্চয়ই। বিয়েথা করেননি জীবনে, পোষাকআশাক এলোথেলো, ময়লা, এখানে ওখানে তালি দেওয়া। হেডমাস্টারসাহেব সুযোগ পেলেই তাঁকে ধমকাতেন, চাকরি খোয়াবার হুমকি দিতেন, অন্যান্য শিক্ষকরা তাঁর সংসর্গ এড়িয়ে চলতেন। কিন্তু ছাত্রদের কাছে এই শিক্ষকটিই ছিলেন সবচেয়ে প্রিয়। তিনি ক্লাসে এসে অন্যান্য শিক্ষকদের মত বই খুলে গড়গড় করে পড়ে যেতেন না, বা বোর্ডের ওপর লিখতে শুরু করতেন না। গল্প করতেন, দেশবিদেশের মজার মজার গল্প, নানা যুগের নানা দেশের উত্থান ও পতনের গল্প। কেমন করে মানুষ গড়ে নতুন জিনিস, আবার কেমন করে সেই একই মানুষ তা নিজের হাতে ভেঙ্গে ফেলে। এসব আশ্চর্য, অবিশ্বাস্য গল্প। আমরা চুপ করে শুনতাম, মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে।

তিনি আমাদের ইংরেজি ব্যাকরণ আর রচনা শেখাতেন।

একদিন ক্লাসে এসে গল্পসল্প না করে রচনা লিখতে বললেন আমাদের। রচনার বিষয়? একটা অর্থমূলক হাসি দিয়ে বল্লেনঃ “কিছু না”।

আমরা থ। বেকুব। পরস্পর চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম। কিছু না’র ওপর লেখার কি আছে? কিছু না তো কিছুই না–অস্তিত্বহীন। নাথিং, নট, ননএক্সিস্টেন্ট। শূন্য। আমাদের মধ্যে একজন সাহস করে জিজ্ঞেস করল, স্যার, যা নাই তার ওপর কি লিখব আমরা?

বললেনঃ তোমাদের কল্পনা কোথায় গেল? যা নেই তার মধ্যে “কিছু”কে সৃষ্টি করা, কল্পনা তো তাকেই বলে। অস্তিত্বহীনকে অস্তিত্ব দাও, সুন্দর করে তোল নিজের মনের মত করে, তখনই
বুঝবে কিছু না থাকার কী শক্তি।

আমরা খেই হারিয়ে অথৈ সাগরে ভাসছি তখন। মাথা চুলকাচ্ছি। কল্পনার ঘোড়ার পিঠে চাবুক মেরে ছোটাবার চেষ্টা করছি। আমাদের দুরবস্থা দেখে উনার একটু মায়া হল হয়ত। বললেনঃ অংকের ক্লাসে “শূন্য” শিখেছো নিশ্চয়ই। সেই শূন্য নিয়ে লেখ। শূন্যকে তোমরা কিভাবে দেখ তা নিয়ে লেখ।

এর চেয়ে পাগল আর কে হতে পারে বলুন।

বলা বাহুল্য সেদিন আমরা সবাই লাড্ডু মেরেছিলাম। আমি নিজে কি লিখেছিলাম মনে নেই। ওই বয়সের ওটুকু জ্ঞানে কিই বা লিখা যায়। কোনরকমে পৃষ্ঠা ভরামাত্র। ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি অবস্থা।

তার অনেক, অনেক কাল পর যখন আমি নিজেই শিক্ষাপেশাতে মোটামুটি সুপ্রতিষ্ঠিত, দুচারজন জ্ঞানীগুণি মানুষের সান্নিধ্যলাভের সৌভাগ্য হয়েছে, দুচারটে ভাল ভাল বই পড়বার সুযোগ পেয়েছি, পুরাকালের দুচারটে সভ্যতার উত্থানপতনের ইতিহাস জানবার অবকাশ হয়েছে, তখন হঠাত্‌ একদিন সেই পাগল শিক্ষকটার কথা মনে পড়ে গেল। লোকটা হয়ত এক গরিব স্কুলের ছোটখাটো শিক্ষক ছাড়া আর কিছু হতে পারেনি জীবনে, কিন্তু তাঁর ছাত্রদের মনের পর্দায় দূর দিগন্তের রঙ ছড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন, মহাকাশের বিপুল শূন্যতার বুকে কান পেতে তার নীরব বার্তা শুনতে শিখিয়েছিলেন, আমাদের অজান্তে তিনি প্রতিটি ছাত্রের অন্তরে জাগিয়ে দিয়েছিলেন অজানার পিপাসা, বাজিয়েছিলেন অচেনার বাদ্য। তাঁর জ্ঞান অবশ্যই বড় বড় পণ্ডিতদের সমতুল্য ছিল না, কিন্তু তাঁর অন্তর্দৃষ্টি ছিল ঋষিতুল্য। আজকে, এতদিন পরে আমি বুঝি, “শূন্য” মোটেও শুন্যগর্ভ নয়, তার একটা নিজস্ব সত্তা আছে। আছে দৃঢ় ব্যক্তিত্ব। আজকে আমি জানি শূন্যের মত শক্তিশালী জিনিস সংসারে বেশি নেই। শূন্য একটা সভ্যতাকে ধ্বংস করে দিতে পারে, তারপর সেই ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে পারে। ইতিহাসে তার নজিরও রয়েছে। শূন্য আর অসীম, এরা একে অন্যের যমজ। যেখানে শূন্য সেখানেই সীমাহীনতা। দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে ভাবলে যেখানে কিছু নেই সেখানেই সবকিছু। শূন্য দ্বারা বৃহত্‌কে পূরণ করুন, বৃহত্‌ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এই একই শূন্য দ্বারা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্রকে ভাগ করুন, ক্ষুদ্র অসীমের অঙ্গধারণ করবে। শূন্য সবকিছু শুষে নিয়ে অসীমের দরবারে পাঠিয়ে দেয়।
বিশ্বাস হচ্ছে না বুঝি। শুনুন তাহলে।

দুই

অঙ্ককে মানুষ ভয় পায়। অঙ্কের মাস্টার শুনলেই লোকে আমাকে এড়াতে চায়। ভাবে, একজন উজবক ব্যক্তি হবেন নিশ্চয়ই। আমরা যেমন ছোটবেলায় ব্যাকরণের টিকিওয়ালা পণ্ডিতমশাইকে দেখে ভয় পেতাম। যেন অঙ্ক আর ব্যাকরণ বাস্তব জীবনের জন্যে অত্যন্ত নিস্প্রোয়জন দুটি বস্তু।

অথচ ব্যাকরণ যেমন ভাষার বিশ্বস্ত প্রহরী, অঙ্কও তেমনি প্রকৃতির প্রাণসখা। আমি অঙ্ককে প্রকৃতির ব্যাকরণ বলেও প্রচার করেছি কোন কোন মহলে। আমরা ভাবি দৈনন্দিন জীবনে অঙ্কের স্থান নেই। ভুল। দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনেই অঙ্কের চেতনা জাগে মানুষের মনে। আজ থেকে কয়েক সহস্র বছর আগে মানুষ যখন হালচাষ করে খাদ্যসংগ্রহ করতে শেখে তখনই সে ‘সংখ্যা’র কথা ভাবতে শুরু করে। তার গোয়ালে কতগুলো গরু তার হিসাব রাখার প্রয়োজন উপলব্ধি করতে শুরু করে। কত মণ ধান হল ক্ষেতে, কত বিঘা জমির মালিক সে, কতগুলো সন্তান তার সংসারে, কতগুলো মরে গেল, তারও হিসেব রাখা দরকার। হাতের আঙ্গুল ক’টি, হাতেপায়ে মিলিয়ে ক’টা আঙ্গুল, তাও এক রহস্য। এভাবেই ধীরে ধীরে মানুষের চিন্তায় ‘সংখ্যা’র বোধ সৃষ্টি হয়। মানুষ তার আপন আপন ভাষায় ‘এক’, ‘দুই’, ‘তিন’ শব্দগুলো আবিষ্কার করতে শুরু করে, যদিও সেগুলো একসাথে মিলে একটা নিয়মমাফিক সংখ্যাপ্রণালীতে পরিণত হতে আরো কয়েক হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয় তাকে।

কিন্তু প্রাত্যহিক জীবনের ব্যবহারিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে যে-সংখ্যাটির কখনো প্রয়োজন বোধ করেনি কেউ(এবং সাধারণভাবে, এখনও হয়না), সেটা হল ‘শূন্য’। ক্ষেতের চাষীকে কখনো ‘শুন্য’ সংখ্যক বীজ বপন করতে হয়না, ‘শুন্য’ গরুর দুধ দোয়াতে হয়না, ‘শুন্য’ সন্তানের মৃত্যুতে কাতর হতে হয়না। এমনকি ১ এর ডানপাশে একটা শুন্য বসালে যে যে দস্তুরমত একটা পূর্ণসংখ্যা দাঁড়িয়ে যায় সে বোধটুকু উদয় হতে অনেক, অনেক যুগ অপেক্ষা করতে হয়েছিল মানুষকে।

প্রাচীন সভ্যতাগুলোর মধ্যে সাধারণত চীন এবং মিশরীয় সভ্যতার কথাই উল্লেখ করা হয় বেশি। ভারতীয় সভ্যতারও কম অবদান ছিল না মানব ইতিহাসে, তবে তার বয়স সম্ভবত তিন চার হাজার বছরের বেশি নয়, যেখানে চীন-মিশর, বিশেষ করে মিশর, জ্ঞানবিজ্ঞানের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রসরতা অর্জন করেছিল আজ থেকে ছয় হাজার বছর আগে। মিশরের বিজ্ঞানীদের বিশেষ ব্যুত্‌পত্তি ছিল জ্যোতির্বিজ্ঞান আর পঞ্জিকার ওপর। চন্দ্রগ্রহ আর পূর্নিমার হিসেব রেখে রেখেই মিশরীয়রা চান্দ্রবর্ষ আবিস্কার করে। এক অমাবস্যা থেকে আরেক অমাবস্যার পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত চন্দ্রগ্রহের যতটা সময় ততটাকেই তারা ‘একমাস’ বলে নামকরণ করে। পরে তারা বুঝতে পেরেছিল যে ‘চান্দ্রবর্ষের’ সমস্যা আছে, কারণ চাষবাসের ক্ষেত্রে ভীষণ তালগোল পাকিয়ে ফেলে, এবং কালক্রমে তারাই সূর্যভিত্তিক পঞ্জিকার সূচনা করে। তবে তাদের মূল পঞ্জিকাতে মাসের দৈর্ঘ্য ছিল ৩০ দিন, অনেকটা চান্দ্রমাসের মত, তারপর শেষ মাসটি পূর্ণ হলে তারা আরো ৫ দিন যোগ করে ৩৬৫ দিনের বছর পূরণ করে দিত। মিশরীয়দের সৌরবর্ষ পরবর্তীকালের গ্রীকরা গ্রহণ করে নেয়, এমনকি গ্রীকদের পরাজিত করে যখন রোমানদের রাজত্ব শুরু হ‌য তখন তারাও সেই মিশরী ক্যালেণ্ডারই ব্যবহার করতে থাকলেন, যদিও রোমানরা সেই ‘বাড়তি ৫ দিন যোগ’ করার নীতি বাদ দিয়ে লিপইয়ারের প্রথা সূচনা করেন।

সেকালের পরিপ্রেক্ষিতে এ এক দারুণ অগ্রগতি, সন্দেহ নেই। সেই সৌরবর্ষ আজো মোটামুটি অসংস্কৃত অবস্থায় অনুসৃত হচ্ছে অধিকাংশ দেশে। সৌদী আরব আর ইজরায়েলই বলতে গেলে একমাত্র ব্যতিক্রম যারা এখনও সেই প্রাচীন চান্দ্রবর্ষের আঁচল ধরে বসে আছে।

অথচ, এত উন্নতি, এত অগ্রসর চিন্তাভাবনা সত্ত্বেও ‘শুন্য’ কারো কল্পনার দুয়ারে করাঘাত করেনি। না করার আরেকটা কারণও ছিল। সেটা হল মিশরীদের জ্যামিতি আবিষ্কার। অনেকের ধারণা জ্যামিতির গুরু হলেন গ্রীক পণ্ডিতরা। কথাটা একেবারে মিথ্যা নয়। পৃথিবীর প্রতিটি দেশের প্রতিটি ছাত্রছাত্রী ইউক্লিডের জ্যামিতি পড়েই বড় হয়। ইউক্লিডের নাম শোনেনি এমন শিক্ষিত লোক একটিও খুঁজে পাবেন না সারা সংসারে। হ্যাঁ এটা মিথ্যা নয় যে গ্রীকরাই জ্যামিতি শিখিয়েছেন সারা পৃথিবীকে। কিন্তু গ্রীকরা শিখেছিলেন কোত্থেকে সেটা জানে ক’জন? তাঁরা শিখেছিলেন মিশরী গুরুদের কাছ থেকে। কথিত আছে যে পাইথাগরাস, থ্যালিস, এইসব জাঁদরেল গ্রীক পণ্ডিতরা মিশরে গিয়েই লেখাপড়া শিখেছিলেন।

মিশরীদের বাস্তবজীবনের প্রয়োজনেই জ্যামিতি আবিষ্কারের জরুরী তাগিদ সৃষ্টি হয়েছিল। এবং এই তাগিদের গোড়ায় ছিল একটা নদী—নীল। পৃথিবীর দীর্ঘতম নদী বলে খ্যাত নীলের যে অবস্থান মিশরজীবনে, বাংলার পদ্মাযমুনা আর মেঘনার গুরুত্ব সে-তুলনায় একেবারেই নগণ্য। নীল ছিল বলেই এতবড় একটা সভ্যতা গড়ে উঠতে পেরেছিল। নীল তাদের অন্নপূর্না, তাদের ধাত্রীমাতা। ওদিকে দারুণ রাগীও সে। আমাদের বাংলাদেশের রাগিনী বাঘিনী পদ্মার মতই তার মেজাজ। বর্ষায় তার বজ্র রুপ, যেদিকে যায় সেদিকেই সব ভেঙ্গেচূড়ে ধ্বংস করে দেয়, জমি জমা সব গিলে খায় সর্বগ্রাসী রাক্ষশের মত। কিন্তু ধ্বংসস্তুপের ওপরেই সে রেখে যায় কৃষকের সোনার ফসলের পলিমাটি। সেই ফসলের অধিকার ভোগের জন্যে গ্রামবাসীদের মধ্যে তখন লেগে যায় ঝগড়া, অন্তত সেকালে লাগত, যার কারণে সরকারকে বাধ্য হয়েই কার কত জমি সেটা জরিপ সরিপ করে একটা ফায়সালা বের করতে হত। সেই ‘জরিপ’এর প্রয়োজনেই জন্মায় পুরাকালের জ্যামিতি। কে কয় বিঘা জমি পাওয়ার যোগ্য, কার কতটা জমি নষ্ট হয়ে গেল নীলের স্রোতে, কাকে কতটা ক্ষতিপূরণ করতে হবে, তার হিসেব রাখার জন্যে সরকার থেকে পাঠানো হত জরিপদারদের। তাদের প্রাথমিক জ্ঞানের সূত্র ধরেই আস্তে আস্তে গণিতের একটা নতুন শাখা তৈরি হয়ে যায়—জ্যামিতি। কালে কালে এটা এমন বৃদ্ধি পেতে থাকে যে মিশরীরা একসময় ঘন বস্তুর ঘনত্বের মাপ করতেও শিখে যায়। এবং এভাবে তাদের মনে উদয় হয় পিরামিডের ধারণা। দেড় হাজার বছর লেগেছিল পিরামিড তৈরি করতে, কিন্তু তারা শুধু তৈরি করেই ক্ষান্ত হয়নি, অঙ্ক কষে তার ঘনত্ব বের করতেও শিখেছিল। এমনই উন্নতমানের জ্যামিতিজ্ঞানের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল প্রাচীন মিশরী সভ্যতা।

তথাপি, এত বুদ্ধিমান হওয়া সত্তেও মিশরীদের মাথায় শূন্যের বোধ জেগে ওঠেনি। বড়সড় কোন সংখ্যা নিয়ে একটু আধটু সমস্যা যে তাদের হতনা তা নয়, কিন্তু কোনরকম জোড়াতালি দিয়ে তারা কাজ চালিয়ে নিত। আজকে যেমন সংখ্যাসূচক চিহ্ন ব্যবহার করা হয় সেযুগে অবশ্য সেসব বের হয়নি। তার বদলে তারা কাঠি বা পশুর হাড়, গাছের বাঁকল, এসব ব্যবহার করত। কাজ চলে যেত সেসময়কার জীবনের জন্যে। তারপর যখন গ্রীকদের সাম্রাজ্য শুরু হয় খৃষ্টপূর্ব পাঁচ ছয় শতাব্দী থেকে তখন তারা মিশর থেকে শেখা জ্ঞানের ওপর আরো অনেক নতুন জিনিস যোজন করতে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। আরো অনেক এগিয়ে দেয় জ্যামিতির জ্ঞান। জ্যামিতির কিংবদন্তীয় পুরুষ ইউক্লিড ছিলেন প্রথম ব্যক্তি যিনি জ্যামিতিকে একটি প্রথম সারির গণিতশাখাতে পরিণত করেন। গুটিকয় স্বতঃসিদ্ধ তথ্যকে সম্বল করে পুরো একটা শাখা নির্মাণ করে ফেললেন তিনি–যাকে আজ আমরা ইউক্লিডিয়ান জিওমেট্রি বলে অভিহিত করি। তিনিই প্রথম ‘যুক্তিপ্রমাণ’ দিয়ে একটা উপপাদ্য প্রমাণ করার তরিকা শেখালেন। আড়াই হাজার বছর ধরে তাঁর শেখানো জ্যামিতি পড়েই ছেলেমেয়েরা স্কুলকলেজ পাস করেছে, প্রকৌশল বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা স্থাপত্যশিল্প শিখেছে, ভাস্কররা ভাস্কর্য শিখেছে, চিত্রশিল্পীরা আঁকতে শিখেছে। একজন সত্যিকার ক্ষণজন্মা পুরুষ ছিলেন তিনি।

কিন্তু তিনিও, এতবড় জ্ঞানীগুণী ব্যক্তি হয়েও, ‘শুন্য’কে তাঁর চিন্তায় স্থান দেননি। দেননি, কারণ সেকালের গ্রীক সংস্কৃতিতে শূন্য বলতে বোঝাত যা নেই, অর্থাত্‌ অস্তিত্বহীন। ’শূন্য’ ইঞ্চি সরলরেখা হয়না, ‘শূন্য’ আয়তনের বর্গক্ষেত্র হয়না। অনেকের ধারণা জ্যামিতিতে গ্রীকদের বিশেষ ব্যুত্‌পত্তিই গণিতের অন্যান্য শাখাতে তাদের অগ্রগতিকে খানিকটা প্রতিহত করার সহায়ক হয়েছিল। তাদের চিন্তার জগতে ত্রিভুজ, চতুর্ভুজ, বৃত্ত আর ঘনবস্তু ছাড়া কোন অদৃশ্য বস্তুর আশ্রয় চঘিল না। তারা ভাল করেই জানত যে পৃথিবীর অন্যান্য জায়গাতে ঠিক ‘শূন্য’ না হলেও শূন্য জাতীয় একটা কিছুর প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হতে শুরু করেছে। মিশরে নয়, কিন্তু বেবিলনে তো অবশ্যই। বেবিলনের সভ্যতা সেকালে গ্রীকদের প্রায় সমতুল্যই ছিল বলা যায়। অন্তত কোন কোন বিষয়ে তারা বরং গ্রীকদের চেয়েও অগ্রসর ছিল। যেমন গণিতের অন্যান্য শাখা। পাটিগণিত, বীজগণিত, এসবের কোন বোধ গ্রীকদের চিন্তায় ঢোকেনি, কিন্তু বেবিলনিয়ানদের চিন্তায় ঢুকেছিল। আরো একটি দিক ছিল যাতে গ্রীকচিন্তার চেয়ে স্বতন্ত্র ছিল তাদের চিন্তা। গ্রীক চিন্তায় গণিত আর দর্শনশাস্ত্র ছিল একে অন্যের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত—তাঁরা ভাবতেন যে জ্যামিতির ত্রিভুজ বহুভুজ বৃত্ত আর গোলক—এসবের মধ্যে প্রকৃতি অর্থাত্‌ সৃষ্টিরই কোন গূঢ় ইঙ্গিত রয়েছে। এর বাইরে যা কিছু তা সবই মানুষের কল্পনাপ্রসূত, সুতরাং তার অস্তিত্ব নেই এবং তা ধর্তব্য নয়। বেবিলনিয়ান চিন্তায় গণিত , বিজ্ঞান, আর দর্শন ছিল সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র বিষয়। একটির সঙ্গে আরেকটিকে সংযুক্ত করা ঠিক নয়। সে-কারণে তাদের গণিত অগ্রসর হয় তার নিজস্ব গতিতে, নিজেরই প্রয়োজনে। বেবিলনের গণনা পদ্ধতির ভিত্তি ছিল ৬০—গ্রীক আর মিশরীয়দের মত ১০ বা ২০ নয়। ৬০-এর ব্যবহার খুব বিজ্ঞানসম্মত নয়, তদোপরি সেকালে কোন দেশেই ১,২,৩,—এসব চিহ্ন দিয়ে সংখ্যা লেখার প্রথা চালু হয়নি।( উল্লেখযোগ্য যে পরবর্তীকালে গ্রীকরা বেবিলিয়ানদের কাছ থেকে শিক্ষালাভ করে ৬০ কে ভিত্তি করে সময় ভাগ করার রীতি চালু করেন—৬০ সেকেণ্ডে এক মিনিট, ৬০ মিনিটে এক ঘন্টা) বেবিলনিয়ানদের লেখার ধারা ছিল সংখ্যাকে ছোট ছোট মদের বোতলের-মত-দেখতে দাগ বসিয়ে। শূন্যের প্রয়োজনীয়তা দাঁড়িয়ে গেল সেখানেই। দুটো বোতল পাশাপাশি বসালে ৬১ হতে পারে, আবার ৩,৬০১ও হতে পারে। সেই ধাঁধাটা দূর করবার জন্যেই মাঝখানে একটা আধবাঁকা দাগ বসিয়ে সংখ্যাটির একটা একক মান দাঁড় করানো হত। এই বিশেষ ‘দাগ’ টাই পরবর্তীকালে ‘শূন্য’ হয়ে গেল। সেজন্যেই বলা হয় যে ‘শূন্যের’ আদি প্রবর্তক ছিলেন বেবিলনিয়ান গাণিতিকরা।

এ সবই জানা ছিল গ্রীকদের। কিন্তু তারা কিছুতেই শূন্যকে গ্রহণ করবেন না। শূন্য তাদের বিশ্বাসের পরিপন্থী। বিশ্বজগতের প্রকৃতি সম্বন্ধে তাদের যে ধ্যানধারণা তাকে নাকচ করে দেয় ‘শূন্য’। শূন্যকে গ্রহণ করা মানে বিপদ ডেকে আনা। শূন্য তাদের শত্রু–তাকে যে করেই হোক রুখতে হবে, এই মন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন সেকালের অনেক গ্রীক চিন্তাবিদ, যাদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশীল ছিলেন মহামতি পাইথাগরাস (খৃঃপূঃ ৫৬৯-৫০০)।পাইথাগরাসের উপপাদ্য শেখেনি এমন মানুষ কি আছে কোথাও পৃথিবীতে? কিন্তু তিনি যে একজন বড় দার্শনিকও ছিলেন সেটা হয়ত সবার জানার সুযোগ হয়নি। বিশ্বব্রম্মাণ্ড বিষয়ে তাঁর নিজস্ব কতগুলো ধ্যানধারনা ছিল যা তিনি অন্ধভাবে আঁকড়ে ছিলেন সারাজীবন। ব্যক্তিগত জীবনেও তাঁর কতগুলো অদ্ভূত আচরণ ছিল যা তাঁর মত এক বিশাল ব্যক্তির কাছ থেকে আশা করা যায় না। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন যে তাঁর জন্ম হয়েছে অন্য এক মৃত ব্যক্তির আত্মার ওপর। শুধু তাই নয়। তিনি নিশ্চিতভাবে জানতেন যে জীবজগতের প্রতিটি প্রানীই যখন মরে যায় তখন তার আত্মা অন্য কোন ব্যক্তি বা প্রানীর দেহে গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করে। সেকারণে তিনি সারাজীবন অত্যন্ত কড়াকড়িভাবে নিরামিষব্রত পালন করেছেন। তবে মটর, বুট এজাতীয় খাদ্য বর্জন করতেন এই বিশ্বাসে যে এগুলো খেলে পেট ফাঁপে! এবং তাঁর মতে সংসারের যাবতীয় রোগের আকর হল বদহজম!

তবে একটা জিনিস ছিল পাইথাগরিসের চরিত্রে যা মানুষকে চুম্বকের মত আকৃষ্ট করত তাঁর প্রতি— বর্তমান যুগে যাকে বলে ‘ক্যারিজমা’। দারুণ বাকপটু মানুষ ছিলেন তিনি। বক্তৃতায় দাঁড়ালে লোকজন মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনত তাঁর কথা। ফলে, কালে কালে তাঁর একটা অন্ধ অনুগত ভক্তগোষ্ঠী তৈরি হয়ে যায়। তিনি যা বলতেন বা যা চাইতেন তা তারা বিনাপ্রশ্নে, চোখ বুঁজে মানত এবং পালন করত। পুরাকালের ধর্মীয় নেতাদের মত। আসলে তাঁর ঘরানাটা ছিল অনেকটা ‘কাল্ট’এর মত। কারু কারু মতে, গুপ্ত এবং ভীতিকর কাল্ট। পাইথাগরাসের আইনে ক’টি নিষিদ্ধ শব্দ বা বিশ্বাস ছিল যা লঙ্ঘন করার অপরাধে দোষী ব্যক্তিকে মৃত্যুদণ্ড দিতেও ইতস্তত করেননি তিনি। সেসব নিষিদ্ধ সব্দের একটি ছিল ‘শূন্য’। আরেকটি ছিল ‘ইররেশনাল’ সংখ্যা,(যেমন ২ এর বর্গমূল) যাকে সসীম দশমিক ভগ্নাংশ দিয়ে প্রকাশ করা যায় না। কড়া নির্দেশ ছিল এগুলো যেন ভুলক্রমেও কেউ উচ্চারণ না করে তাঁর সামনে, বা কেউ করেছে এমন সংবাদ যেন তাঁর কানে না পৌঁছায়। দুঃখের বিষয় হিপসাস নামক এক হতভাগা সে আইন অমান্য করেছিলেন। সেজন্যে পাইথগরাস তার শাস্তি নির্ধারণ করেছিলেনঃ স্বেচ্ছায় পানিতে ডুবে মৃত্যুবরণ।( এ কাহিনীর সত্যমিথ্যা নিয়ে বিতর্ক আছে যদিও)

গ্রীক দর্শনে শূন্য আর অসীম, এ দুটিই ছিল পরম শত্রু। তাদের মতে অসীম বলতে একমাত্র ঈশ্বরকেই বোঝায়—আর সবই সীমার মাঝে গণ্ডীবদ্ধ। শূন্য হল শয়তানেরও অধম, কারণ শূন্য ঈশ্বরের অস্তিত্বকে অস্বীকার করে, তাকে ধ্বংস করে দেয়। এই বিশ্বাসের কারণেই ‘জ্জেনোর ধাঁধা’ (দৌড় প্রতিযোগিতায় খরগোশ জিতবে না কচ্ছপ জিতবে? জ্জেনোর হিসেব অনুযায়ী খরগোশ বহুগুণে বেশি বেগবান হওয়া সত্ত্বেও কখনোই কচ্ছপকে হারাতে পারবে না)বলে খ্যাত প্রহেলিকার সমাধান খুঁজে পাননি গ্রীক দার্শনিকরা। মজার ব্যাপার যে এ-ধাঁধার সমাধান পশ্চিম তথা গ্রীক চিন্তাধারাতে পুরোপুরি মীমাংসা পেতে আরো প্রায় দু’হাজার বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। সে আরেক লম্বা ইতিহাস।
সে ইতিহাস বলার আগে পাইথাগরাসের গণিত এবং দর্শন নিয়ে একটু বিস্তারিত আলোচনা করা যাক।

তিন

বর্তমান যুগের সামান্য লেখাপড়াজানা যেকোনও লোক অনায়াসে বলে দিতে পারবে ‘পাইথাগরাসের উপপাদ্য’ বলতে কি বোখায়। সমকোনী ত্রিভুজের বিপরীত বাহুটির দৈর্ঘ্যের বর্গ হল পাশের বাহুদু’টির যে দৈর্ঘ্য তাদের বর্গের যোগফল। মজার ব্যাপার হল উপপাদ্যটির ঐতিহাসিক প্রণেতা হিসেবে তাঁর নাম সর্বজনিত হলেও আসলে এটা এক হাজার বছর আগেও জানা ছিল আদিম গ্রীকদের কাছে। সম্ভবত মিশরীদেরও অজানা ছিল না। প্রাচীন্ গ্রীসে পাইথাগরাসের নাম ছড়ায় প্রধানতঃ গাণিতিক হিসেবে নয়, সঙ্গীতস্রষ্টা হিসেবে। অর্থাত্‌ সঙ্গীতই তাঁকে গণিতের পথে এগিয়ে দেয়।

প্রথম যৌবনে একদিন তিনি খেলা করছিলেন একটি একতারা জাতীয় বাদ্যযন্ত্র নিয়ে। একটি তার টান টান করে আটকানো দুই প্রান্তের দু’টি খুঁটিতে। কৌতূহলবশতঃ তারটির মাঝখানে টোকা দিয়ে দেখলেন একটা শব্দ বের হয়। এটি মৌলিক সুর—ফাণ্ডামেন্টাল নোট। তারপর এক বুদ্ধি এল তাঁর মাথায়। খালি হাতে টোকা না দিয়ে সেই তার বরাবর একটা ধাতব কিছু বসালে কেমন হয়। ছোট একটা রড জাতীয় জিনিস মাঝখানে বসিয়ে তিনি তারটির দুই পাশে টোকা দিলেন। ভিন্নরকম আওয়াজ বেরোল। এভাবে রড এবং টোকার জায়গা বদল করে করে তিনি ভিন্ন ভিন্ন সুরের আওয়াজ পেতে থাকলেন। কোনটা সুরেলা, অর্থাত্‌ শ্রুতিমধুর, আবার কোনটি একেবারেই বেসুরো। কোনটা ভারি, কোনটা মিহি। যে জিনিসটা সবচেয়ে চমকপ্রদ মনে হল তাঁর কাছে সেটা হল যে তারের যে-জায়গাটিতে টোকা দিলে ভাল শব্দ আসে, সেটা তার মধ্যিখানে নয়, এমন এক বিন্দুতে যাতে ছোট অংশটির সঙ্গে বড় অংশটির অনুপাত একটি সহজ ভগ্নাংশে দাঁড়ায়—-যেমন ৩/৫ বা ৮/১১, যাকে গণিতের ভাষায় বলা হয় রেশনাল নাম্বার—মূলদ সংখ্যা। আরো আশ্চর্য যে এই অনুপাতটি যখনই অমূলদ সংখ্যা হয়ে যায় তখনই বিশ্রি আওয়াজ বেরুতে থাকে তাঁর একতারা থেকে। পাইথাগরাসের তখন মনে হল যে এই সরল অনুপাতের মধ্যে নিশ্চয়ই কোন গভীর অর্থ আছে। প্রকৃতির যা কিছু সুন্দর, যা কিছু মধুর মনোহর ও সৌম্য কান্তিতে ভরা হয়ত তাতেই আছে এই অনুপাতের প্রকাশ। আস্তে আস্তে এই সহজ চিন্তাটি তাঁর মনে একটি গূঢ় দার্শনিক ধারণার রূপ ধারণ করল। তাইতো, এ শুধু গানে নয়, সুরে নয়, প্রকৃতির বিবিধ রূপ আর বর্ণশোভায় নয়, সারা বিশ্বব্রম্মাণ্ড জুড়েই সে ব্যাপৃত। যা কিছু দেখছি আমরা, যা কিছু আমাদের অনুভবের মধ্যে ধরা দিচ্ছে, যা কিছু আমাদের ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য, তার সবকিছুতেই লুকিয়ে আছে কোন-না-কোনও মূলদ সংখ্যা। অর্থাত্‌ সৃষ্টির সবকিছুরই মূল হল সংখ্যা। শুধু সংখ্যাই নয়,মূলদ সংখ্যা।

এই ধারণাটি এমনই গেঁথে গেল পাইথাগরাসের মনে যে গোটা বিশ্বসৃষ্টিরই একটা চিত্র দাঁড় করিয়ে ফেললেন তাঁর কল্পনায়। সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন যে সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থিত আর কিছু নয়, পৃথিবী(অর্থাত্‌ বিশ্বজগতের আর সবাকিছুকে ছাড়িয়ে আমাদের এই জল বায়ু মৃত্তিকা নির্মিত পৃথিবীটি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে), এবং অন্যান্য গ্রহনক্ষত্র তার চারপাশে আবর্তিত হচ্ছে তাদের নিজ নিজ গোলাকার কক্ষপথে। শুধু তাই নয়, এই গোলকগুলোর আকৃতির মধ্যে একটা সহজ আনুপাতিক সম্পর্ক বজায় রয়েছে। গোলকের ভেতরে আবদ্ধ থেকে গ্রহতারাগুলো আপন সুরে গান করে যাচ্ছে অবিরাম, ঠিক যেমন করে একতারার তারে আনুপাতিক নিয়মের টোকাতে সৃষ্টি হয় অনুপম বাদ্য। পাইথাগরাসের বিশ্বদর্শনে সঙ্গীত, সংখ্যা, জ্যামিতি ও সৃষ্টি সব একাকার হয়ে গেল। যে-কোন সংখ্যা হলে চলবে না, তাকে মূলদ হতে হবে। অমূলদ সংখ্যাকে তিনি একধরণের পাপাচার বলে মনে করতেন—পাপাচার এই কারণে যে অমূলদ অনুপাত্ সুরের ব্যাঘাত ঘটায়, সুন্দরকে অসুন্দর করে । স্রষ্টার সৃষ্টিতে অসুন্দরের স্থান নেই। এই ছিল তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস।

মুস্কিল এই যে বিশ্বাস শুধু বিশ্বাসের গণ্ডীতে সীমাবদ্ধ থাকেনি, পাইথাগরাসের কঠোর নির্দেশে সেটা উগ্র ধর্মবিশ্বাসের রূপধারন করে। উগ্র এবং হিংস্র। তাঁর মতবাদের বিপক্ষে কোন কথা তিনি সহ্য করতে পারতেন না। বিশেষ করে তাঁর ভক্তগোষ্ঠীর কাছ থেকে তিনি দাবি করতেন অন্ধ আনুগত্য। কোনরকম প্রশ্ন, সন্দেহ, দ্বিধাদ্বন্দ্ব তিনি প্রশ্রয় দিতেন না। ফলে তাঁর ঘরানাটি অচিরেই একটি গুপ্ত সংস্থার আকার ধারণ করে। সেখানে বাইরের কারো প্রবেশাধিকার ছিল না। ভক্তরা নিজেদের সংসারধর্ম ত্যাগ করে গুরুকে ঘিরে একই গৃহে বাসগ্রহণ করে এবং কঠোর জীবনধারাতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় যে তারা কোনক্রমেই ঘরানার কোন গোপন সংবাদ কারো কাছে ফাঁস করে দেবে না। দুঃখের বিষয় যে ফাঁস করার মত গোপন সংবাদ যে ছিল না সেই ঘরানার তা নয়। পাইথাগরাস এবং তাঁর শিষ্যরা একসময় আবিষ্কার করলেন যে সংসারের সবচেয়ে সুন্দর, সবচেয়ে মধুর যে সুর, সবচেয়ে সুদর্শন যে দৃশ্য, তার সঙ্গে যে অনুপাতটি জড়িত সেটা আসলে মূলদ সংখ্যা নয়, একটি অমূলদ সংখ্যা। এই অনুপাতটিকে তিনি নাম দিয়েছিলেন ‘গোল্ডেন রেশিও’—একটু আগে যাকে বললাম সুবর্ণ অনুপাত। এই অনুপাতের উপস্থিতি আসলেই প্রকৃতির সর্বত্র। শিল্পী যখন ছবি আঁকেন, ভাস্কর যখন সৃষ্টি করেন তাঁর প্রস্তরমূর্তি, স্থপতি যখন তাঁর স্বপ্নভবনের নক্সা তৈরি করেন তখন তাঁর নিজেরই অজান্তে, অজ্ঞাতসারে এই অনুপাতটি কাজ করে মনের ভেতরে। গ্রীসের পুরাকালীন কিংবদন্তীয় অট্টালিকা—পার্থেনন প্রাসাদ—তার শীর্ষচূড়া থেকে ছাদ পর্যন্ত যে মাপ তাকে ভাগ করুন ছাদ থেকে মেঝে অবধি যে দৈর্ঘ্য, তা দিয়ে। দেখা যাবে যে দুটি সংখ্যা হুবহু মিলে গেছে। এটাই হল ‘সুবর্ণ অনুপাত’। মজার ব্যাপার যে এই একই অনুপাত নিসর্গের আরো অনেককিছুতে দেখা যায়। যেমন আনারস, শামুক, গাছপালা তরুলতা।

পাইথাগরাসের সমস্যাটি ছিল এখানে যে তথ্যটি তিনি প্রকাশ্যে স্বীকার করতে পারছিলেন না। তাঁর দর্শনশাস্ত্রের ভিত্তিটাই ছিল মূলদ সংখ্যা। বিশ্বভুবনের গোটা ছবিটাই তিনি দাঁড় করিয়েছেন সেভাবে। সারা দেশের মানুষ সেটা মেনে নিয়েছে। এখন তিনি কিভাবে বলবেন যে আসল জিনিসিটা তা নয়–গোড়ার সংখ্যাটি একটি অমূলদ সংখ্যা। কিছুতেই তা হয়না। লোকে ভাববে পাইথাগরাস একটি ভণ্ড। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে কথাটা চেপে যেতে হবে—কেউ যেন ঘূণাক্ষরেও জানতে না পারে প্রকৃত তথ্যটি। সেই মর্মে আদেশ জারি হয়ে গেল ঘরানাতে যে অমূলদ সংখ্যার খবরটি চূড়ান্ত গোপন—টপ সিক্রেট। খবরদার, কেউ যেন মুখ না খোলে। খুললে তার সাজা আছে। এই সাজারই ভুক্তভোগী হয়েছিলেন হতভাগা হিপসাস।

পাইথাগরাসের গুপ্ত সঙ্ঘ ও তাঁর নিজের অন্তিম পরিণতি খুব সুখময় হয়নি। এবং তার জন্যে দায়ী ছিল প্রধানতঃ তাঁর অতিরিক্ত গোপনপ্রিয়তা ও উত্‌কেন্দ্রিক আচার আচরণ। তাঁর সময়কালে তিনি এবং তাঁর ভক্তগোষ্ঠী এতই প্রসিদ্ধিলাভ করেছিলেন যে সেই গোষ্ঠীতে প্রবেশাধিকার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেছিলেন অনেকেই। কিন্তু পাইথাগরাস তাদের ইচ্ছা পূরণ করেননি। তারা হতাশ হতে হতে একসময় তিক্ত দ্রোহিতার ভাব পোষণ করতে থাকে ভেতরে। সেই তিক্ততা ও বিদ্বেষ শেষ পর্যন্ত সহিংস রূপ ধারণ করে। এতটাই ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে বিরোধী দল যে তারা একদিন দল বেঁধে পাইথাগরাস গোষ্ঠীকে সশস্ত্র আক্রমন করতে উদ্যত হয়। প্রথমে ভক্তদের ধরে ধরে গণপিটুনি দিয়ে হত্যা করে একে একে, শেষে ধাওয়া করে স্বয়ং গুরুদেবকে। পাইথাগরাস পেছনের দরজা দিয়ে পালাবার চেষ্টা করেন। হয়ত পারতেনও পালাতে, কিন্তু বাধ সাধল একটি মটরের ক্ষেত! মটরের প্রতি তাঁর কি মনোভাব সেটা তো আগেই বললাম। এমনই কুসংস্কারাবদ্ধ লোক ছিলেন তিনি যে জীবন যাক, তবুও মটর ক্ষেত পার হবেন না। ফলে যা হবার তাই হল। শত্রুরা তাকে মটরক্ষেতের ভেতরেই কুপিয়ে হত্যা করে ফেলল। এই হল পাইথাগরাসের জীবনাবসানের প্রচলিত গল্প। সত্য কি মিথ্যা তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের বিতর্ক এখনও শেষ হয়নি।

চার

পাইথাগরাস ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের করুণ পরিণতি অবশ্য গ্রীক সমাজের ওপর তাঁর গণিত বা তাঁর মতবাদের প্রভাবকে মোটেও ক্ষুন্ন করতে পারেনি। বরং পরবর্তীকালের দুই দিকপাল—প্লেটো (খৃঃপূঃ ৪২৮-৩৪৮ আঃ) এবং এরিস্টটোল (খৃঃপূঃ ৩৮৪-৩২২)—এঁরাও দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন তাঁর দর্শন দ্বারা। প্লেটোর ধারণা, সংসারে যা কিছু নিখুঁত ও অনবদ্য তার ওপর সময়ের ছাপ পড়ে না— তা চিরন্তন ও অপরিবর্তনীয়। পরিবর্তন মানেই পতন, স্খলন, যা অস্থায়ী ও অবাস্তব। সেই কারণে তিনি কোন বস্তুর গতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। গতি মানে চক্রাকার গতি নয়, কারণ চক্রাকার পথে বস্তু তার যাত্রাবিন্দুতেই প্রত্যাবর্তন করে—যেমন পাইথাগরাসের গ্রহনক্ষত্র। কিন্তু সরল পথে তারা ফিরে আসে না, সুতরাং সরল রাস্তা প্রকৃতিবিরোধী। প্লেটোর মতবাদের পূর্ণ সমর্থক এবং অনুসারী ছিলেন তাঁর শিষ্য এরিস্টটোল। পাইথাগরাসের মত এরিস্টটোলও বিশ্বব্রম্মাণ্ডের একটি রূপনক্সা দাঁড় করালেন নিজের মনে। সকল সৃস্টির কেন্দ্রবিদু আমাদের এই স্থবির পৃথিবী, একথা তিনি অকপটে মেনে নিলেন। কিন্তু তার সঙ্গে যোগ করলেন নিজের কিছু চিন্তাভাবনা। বললেন যে আমাদের এই গ্রহটির অব্যবহিত পার্শ্ববর্তী যে গ্রহটি সে কিন্তু স্থবির নয়–সে তার কক্ষপথে অনন্ত ঘূর্ণ্যমান, একটি গোলাকার খোলশের ভেতরে চির আবদ্ধ থাকা অবস্থায়। সেই খোলশটি কেবল ওই গ্রহটিরই নিজস্ব বিচরণক্ষেত্র। এখানে অন্য কারুর প্রবেশাধিকার নেই। কথা হল এই যে অনন্তকাল ঘুরতে থাকা, তার জন্যে যে জ্বালানিশক্তি প্রয়োজন হয়, সেটা আসে কোত্থেকে? এরিস্টটোলের মতানুসারে সেটা স্থির-দাঁড়িয়ে-থাকা পৃথিবীর কাছ থেকে আসতে পারে না, সুতরাং আসতে হবে তার ওপাশে যে বৃহত্তর গ্রহ বা নক্ষত্রটি রয়েছে তার কাছ থেকে। কিন্তু এই দ্বিতীয় নক্ষত্রটি তার চলার শক্তি পেল কার কাছ থেকে? নিশ্চয়ই তার পার্শ্ববর্তী নক্ষত্র থেকে। এভাবে তিনি ছোট থেকে বড় এক সারি গ্রহনক্ষত্র দাঁড় করালেন বিশ্বব্রম্মাণ্ড জুড়ে। তখনকার দিনে আকাশের যত গ্রহতারার খবর জানা ছিল সবাই নিজ নিজ স্থান পেল এরিস্টটোলের মানচিত্রে। একটা বড় প্রশ্ন স্বভাবতঃই মাথা চাড়া দিয়ে উঠল তখন। এর পর কি? অর্থাত্‌ সবচেয়ে বাইরের যে সর্ববৃহত্‌ নক্ষত্রটি সেটি তার চলার শক্তি পেল কোথায়? ওটার পাশে যদি বৃহত্তর কোন প্রতিবেশী না থাকে তাহলে তাকে চালাবে কে? কঠিন প্রশ্ন। কিন্তু এরিস্টটোল তার সহজ সমাধান বের করে ফেললেন। বললেন, আহা, শোন বাছারা। এই যে সবার বাইরে থেকে সবকিছুকে চলবার শক্তি যুগিয়ে যাচ্ছে তারই নাম ঈশ্বর–সৃষ্টিকর্তা। এই যুক্তিটা এমনই পাকাপোক্তভাবে স্থান করে নিল তাঁর চিন্তায় যে তিনি দাবি করলেন যে ঈশ্বর বলতে যে সত্যি সত্যি কেউ আছেন এটাই তার প্রমাণ। মজার ব্যাপার যে এই যুক্তিটি আধুনিক চিন্তাবিদদের কাছে যতই অদ্ভূত মনে হোক না কেন, পাশ্চাত্য সভ্যতার মৌলিক বিশ্বাসমালা কিন্তু এই মতবাদের ওপরই ভিত্তিশীল। এই মতবাদই সম্ভবতঃ প্রভাবিত করেছিল সেকালের নানাবিধ ধর্মগ্রন্থসমূহকে। প্রভাবিত করেছিল পরবর্তী দু’হাজার বছরের পাশ্চাত্য দর্শন ও বিজ্ঞানকে।

পাইথাগরাস, প্লেটো, এরিস্টটোল, এঁরা সবাই গভীরভাবে বিশ্বাস করতেন যে বিশ্বভুবন একটি কঠিন পদার্থ, এর মধ্যে ফাঁকফোকর কিছু নেই। ফাঁক মানে শূন্যতা, যেখানে ঈশ্বর অস্তিত্বহীন, বাস্তবতা অনুপস্থিত। সেটা অসম্ভব, তাই খালি জায়গা বলে কিছু থাকতে পারেনা ইহজগতে। মরমানুষের চামড়ার চোখে যা খালি বলে মনে হয় তা আসলে খালি নয়, সেখানেও বস্তু আছে। ‘ভ্যাকুয়াম’ নামক কোন বাস্তব জিনিস নেই সংসারে, ওটা মানুষের কল্পনা মাত্র। একারণে তাঁরা খৃঃপূঃ চতুর্থ খৃষ্টাব্দের গ্রীক দার্শনিক ও চিন্তাবিদ এপিকিউরাসের(খৃঃপূঃ ৩৪২-২৭০) আনবিক তত্ত্ব নাকচ করে দিয়েছিলেন। তারও আগে একই মতবাদ প্রকাশ করে গিয়েছিলেন ডেমোকরিটিস(খৃঃপূঃ ৪৬০-৩৬০)নামক এক দার্শনিক। অনুতত্বের সবচেয়ে শক্তিশালী ও ওজস্বী প্রবক্তা ছিলেন লুক্রেসিয়াস (খৃঃপূঃ ৯৮-৫৪)। এই তত্ত্ব অনুযায়ী বস্তুর মৌলিক উপাদান অণুপরমাণু—সূক্ষাতিসূক্ষ, চোখে-দেখা-যায়না এমন সব কনা। তারা নিরন্তর ঘুরে বেড়ায় বিশ্বচরাচরে। ঘুরতে ঘুরতে পরস্পরের সঙ্গে ধাক্কা তাদের লাগে প্রতিনিয়তই, আবার দুই ধাক্কার ফাঁকে তাদের মুক্ত বিচরণের জন্যে খালি জায়গাও রয়ে যায়। এই ‘খালি’ জায়গা আর ’মুক্ত বিচরণের’ ব্যাপারটাই এরিস্টটোলের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিল না। ‘মুক্ত বিচরণ’ ঈশ্বরের ইচ্ছাবিরুদ্ধ।

শূন্যতা, এবং তার বিপরীতে সীমাহীনতা—এ দুটি ধারণার প্রতি গ্রীক দার্শনকিদের মজ্জাগত অনীহার কারণেই খৃঃপূঃ পঞ্চম শতাব্দীর প্রখ্যাত চিন্তাবিদ যেনোর উপরোল্লেখিত ধাঁধাটির কোন সমাধান পাওয়া যায়নি অনেক শতাব্দী ধরে। ধাঁধাটি এরকম। একটি দ্রুতপদী খরগোশ আর একটি শ্লথগতি কাছিম দৌড় প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যেহেতু কাছিম বেচারীর পায়ের জোর কম সেহেতু তাকে কয়েক কদম আগে থাকতে দেওয়া হল। ধরুন এক গজ আগে। মনে করুন খরগোশের গতি কাছিমের দ্বিগুণ—-তার মানে কাছিম যে সময় নেবে ১ গজ দৌড়ুতে সে সময়ে খরগোশ চলে যাবে ২ গজ। তাহলে দেখা যায় খরগোশ যখন কাছিমের যাত্রাবিন্দুতে পৌঁছালো ততক্ষণে কাছিম ১/২ গজ এগিয়ে গেছে। এই আধা গজ দূরত্ব যখন পার হয়ে যায় খরগোশ ততক্ষণে কাছিম আরো ১/৪ গজ এগিয়ে যায়। এর পর খরগোশ যায় ১/৪ গজ, কাছিম তার থেকে এগিয়ে থাকে আরো ১/৮ গজ। এভাবে তাদের দূরত্ব কমতে থাকে ধাপে ধাপে, কিন্তু একেবারে শূন্যতে পৌঁছায় না। ১, ১/২, ১/৪, ১/৮, ১/১৬,…, এরকম করে সীমাহীন ধাপে চলতে থাকে তাদের প্রতিযোগিতা, কিন্তু খরগোশ বেচারার কখনোই ভাগ্যে জোটে না কাছিমকে ছাড়িয়ে যাওয়া। অথচ প্রকৃতপক্ষে আমরা সবাই জানি যে খরগোশ অতি সহজেই কাছিমকে টপকে অনেক দূরে চলে যায়। তাহলে অঙ্কের অকাট্য যুক্তিতে সেটা পাচ্ছি না কেন আমরা? মহা সমস্যা, তাই না? এই সমস্যা শুধু সেযুগের গ্রীক দার্শনিকদেরই দারুণ মাথাব্যথা সৃষ্টি করেনি, বর্তমান যুগেও অনেক সময় মানুষকে চিন্তায় ফেলে।

মূল সমস্যা এখানে একটি নয়, দু’টি। এক, ওপরের ভগ্নাংশগুলো ক্রমেই ছোট হয়ে যাচ্ছে। এত ছোট যে প্রায় ‘শূন্য’তে পৌঁছার অবস্থা। তার অর্থ গ্রীকদের সেই চিরশত্রু ‘শূন্য’টি আলগোছে উঁকি মারছে পেছন থেকে। দুই, সংখ্যাগুলো তো শেষ হচ্ছে না—চলে যাচ্ছে একেবারে অসীমের দিকে। সুতরাং পাইথগরাস আর এরিস্টটোল যা একেবারেই বরদাস্ত করতে পারতেন না, ‘অসীম’ সংখ্যা, সেটাই দেখা দিচ্ছে এখানে। অথচ যেনোর যুক্তি খণ্ডাবেনই বা কেমন করে তাঁরা। শূন্য আর অসীম আসলে নেই, অথচ যেনোর ধাঁধাতে আছে, তার কি সুরাহা হবে? এরিস্টটোল অবশ্য দমে যাওয়ার পাত্র ছিলেন না তাতে। বললেন, ‘শুন্য’ আর ‘অসীম’, দুটোই সত্য, তবে বাস্তবে নয়, যেনোর উর্বর মস্কিষ্কের কল্পনাতে। এক কথাতে তিনি যেনোর ধাঁধাকে উড়িয়ে দিলেন, যেন এর কোন গুরুত্বই নেই।

পশ্চিম সভ্যতাকে অনেক অনেক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়েছিল যেনোর ধাঁধার পূর্ণ সমাধান পেতে। ঘটনাটি হল এই যে সংখ্যায় সীমাহীন হলেও ওপরের ক্রমহ্রস্বমান ভগ্নাংশগুলোর যোগফল কিন্তু অসীম নয়, একটি ছোটখাটো সংখ্যা–২। অর্থাৎ

১+১/২+১/৪+১/৮+….=২
কাছিম আর খরগোশের দৌড় প্রতিযোগিতাকে বিচার করতে হবে, সীমাহীন দূরত্ব দিয়ে নয়, সীমিত কালক্ষেপনের মাপে। এক গজ যেতে তার এক মিনিট লাগে দুই গজ যেতে লাগবে দুই মিনিট। দুই মিনিটে খরগোশ কতদূর যায়, আর কাছিম যায় কতদূর সেটা বের করলেই তো সমস্যা দূর হয়ে যায়। সুতরাং ধাঁধার গোড়ায় ছিল গ্রীক পণ্ডিতদের চিন্তার সীমাবদ্ধতা, ‘শূন্য’ আর ‘অসীম’এর দ্বন্দ্ব নয়।

পাঁচ

বৈষয়িক গণনাকর্মে শূন্যের প্রয়োজনীয়তা যে মিশরীয় আর গ্রীকরা উপলব্ধি করেননি তা নয়। বেবলিয়ানদের কাছ থেকে ব্যাপারটা বুঝে নেওয়ার পর তারাও মেনে নিয়েছিলেন যে দর্শনশাস্ত্রে যত অবাঞ্ছনীয়ই হোক শূন্যকে একেবারে অগ্রাহ্য করারও উপায় নেই। শূন্যের ব্যবহার কোন জাতি কার কাছ থেকে শেখে, কেইবা প্রথম তার সূচনা করে, তার সঠিক ইতিহাস হয়ত কখনোই পুরোপুরি জানা যাবে না। কারো কারো মতে দক্ষিন আমেরিকার মায়া সভ্যতাতেই শূন্যের বোধ জন্মায় প্রথম। কেউ বলেন চীন। কিন্তু একটা বিষয়ে সবাই একমত যে শূন্যকে তারা কেউই সংখ্যা হিসেবে গণ্য করেনি। শূন্য একটা চিহ্ন মাত্র—বড় রাস্তাতে যেমন থাকে দিকনির্দেশক ফলক, বা দূরত্বের ফলক। ১, ২, ৩,… এগুলোর সঙ্গে তুলনীয় কোন সংখ্যা নয়। শুন্য যে আসলেই একটি সংখ্যা, এবং অত্যন্ত গুরত্বপূর্ণ সংখ্যা সেই উপলব্ধিটা পশ্চিমে জন্মায়নি, মধ্যপ্রাচ্যেও নয়, জন্মেছিল দক্ষিনপ্রাচ্যে—ভারতবর্ষে।

সব গাছ সব মাটিতে হয় না, সব মাছ থাকে না সব নদীতে। উপযুক্ত পরিবেশ লাগে। জলবায়ু তাপ ইত্যাদি ঠিকমত হতে হয়। একটা জাতির চিন্তার জগতটিও অনেকটা সেরকম। ওটা কিভাবে বিকশিত হবে তা নির্ভর করে সেজাতির ধ্যানধারণা ও রীতিনীতির ওপর,‌ তার প্রাণশক্তির ওপর। অনুকূল পরিবেশ পেলেই একটা জাতির মেধা প্রস্ফূটিত হতে পারে শতমুখি সৃজনশীলতায়। ‘শূন্য’ আর ‘অসীম’—দু’টি আইডিয়াই দুহাজার বছর আগেকার ভারতবর্ষের মনমানসের সঙ্গে হুবহু খাপ খেয়ে যাবার মত ছিল।‘শূন্য’কে পশ্চিম দেখত ভীতির চোখে, ভারতে ‘শূন্য’ ছিল দেবীর আসনে। পরম পূজনীয় সত্ত্বা। শূন্য আর অসীম এই দুই সত্ত্বার মাঝে ভারতবাসীরা তাদের আত্মার আশ্রয় খুঁজতেন। হিন্দুধর্মে সব ভগবানের সেরা ভগবান হলেন ব্রম্মা। তিনিই স্রষ্টা, তিনিই সংহারক। তিনি আছেন সর্বত্র, আবার তিনি কোথাও নেই। তিনি একাধারে মহাশূন্যের চিরশূন্যতায় বিলীন, আবার সর্বব্যাপী তাঁর উপস্থিতি। এক অন্তহীন দ্বৈততার শরীরে তাঁর নিবাস। শিবের মূর্তির দিকে তাকিয়ে দেখেছেন কেউ? এক হাতে তাঁর সৃষ্টির দণ্ড, আরেক হাতে ধ্বংসের অগ্নিমশাল। তার অর্থ হিন্দুধর্মের মৌলিক বিশ্বাসের মধ্যেই নিহিত রয়েছে শূন্য আর অসীমের দ্বৈত অস্তিত্ব। এ-বিশ্বাস একান্তই ভারতীয় বিশ্বাস। এখানে শূন্য আর অসীম একে অন্যের স্বভাব দোসর, একে অন্যের পরিপূরক। ভারতীয় দর্শনে ‘শূন্য’ হল স্বাগত অতিথি—আত্মার পবিত্র মন্দির। তাই ভারতের মাটি ছিল ‘শূন্য’ আর ‘অসীমের’ আদর্শ জন্মভূমি।

কিন্তু ‘শূন্য’ যে দস্তুরমত একটি গাণিতিক সংখ্যার সম্মান পাবার যোগ্য সেই বোধটা জন্মালো কেমন করে ভারতীয় চেতনায়? গণিত আর দর্শন তো ঠিক অবিচ্ছিন্ন জিনিস নয় গ্রীকদের মত। সুতরাং ব্রম্মার দ্বৈতসত্ত্বার উপলব্ধি থেকে গণিতের সংখ্যামালাতে শূন্য তার নিজের স্থানটি স্বভাবিকভাবে দখল করে নেবে সেটা খুব বাস্তবসম্মত মনে হয়না। কোন দেশের কোন সভ্যতাতেই এমন উদাহরণ নেই যে একটা বড় আবিষ্কার আপনা আপনি জন্ম নিয়েছে কোনও ঐতিহাসিক, সামাজিক বা এধরণের কোনও কার্যকারণ সম্পর্ক ছাড়া। সাধারণত আইডিয়ার কোনও ভৌগোলিক সীমারেখা নেই। বর্তমান যুগে সেগুলো প্রচার হয় বইপুস্তকের মাধ্যমে, বা অন্যান্য শতপ্রকারের যোগাযোগসূত্রে। দুহাজার বছরে আগে সেভাবে কোনকিছু ছড়াবার উপায় ছিল না অবশ্য। ছিল যেটা সেটা হল রাজ্যজয় বা ব্যবসাবাণিজ্য। গণিতের শূন্য হয়ত ঐভাবেই প্রবেশ করেছিল ভারতবর্ষে। খৃঃপূঃ চতুর্থ শতকে সম্রাট আলেকজাণ্ডার ভারত আক্রমণ করেন। তিনি শুধু জাঁদরেল সেনানায়ক ছিলেন না, উঁচুমানের লেখাপড়া জানা ব্যক্তিও ছিলেন। স্বয়ং এরিস্টটোলের ছাত্র। ধারণা করা হয় যে তিনি এবং তাঁর গ্রীক সৈন্যসামন্তদের সংস্পর্শে এসে স্থানীয় ভারতবাসীরা খবর পায় যে বেবলিয়ানরা শূন্যের ব্যবহার বেশ আয়ত্ত করে ফেলেছেন, সংখ্যা হিসেবে না হলেও সংখ্যাফলক হিসেবে। এই ছোট্ট আইডিয়াটি ভারতের উর্বর পলিমাটিতে নতুন জীবন পেয়ে যায়। শুধু ফলক কেন হবে, সংখ্যা হতেই বা দোষ কোথায়। গ্রীকদের মত তাদের তো সেই ‘শূন্য মানে নিরীশ্বরবাদ’ জাতীয় মানসিক প্রতিবন্ধকতা ছিল না, বরং উলটোটাই। ভারতে শূণ্য মানেই ঈশ্বর। তাই অচিরেই শূন্য তার জায়গা করে নিল সংখ্যামালাতে। তবে তারা বেবিলনিয়ানদের মত ৬০-ভিত্তিক গণনা বর্জন করে নিজেদের ১০-ভিত্তিক সংখ্যার ব্যবহার বলবত্‌ রাখলেন। আজকে আমরা যাকে আরবি নিউমারেল বলে আখ্যায়িত করি ভারতীয়দের সেসময়কার লিখনপদ্ধতি বলতে গেলে প্রায় একই রকম ছিলঃ ১,২,…,৯,০। অনেকে মনে করেন আধুনিক সংখ্যার লিখনপদ্ধতি প্রবর্তনের কৃতিত্বটা আরবদের না দিয়ে বরং ভারতীয়দের দেওয়াই বোধ হয় উচিত ছিল, কারণ ঐতিহাসিকভাবে দেখতে গেলে আরবরা শেখে ভারতের কাছ থেকে, রাজ্য জয় করার পর। তারপর পশ্চিম শেখে আরবদের কাছে, ইসলামের যখন স্বর্ণযুগ। পরে পশ্চিমই এর নামকরণ করে আরবি সংখ্যা।

যাই হোক শূন্যের নবার্জিত সম্মান গণিতের জগতে এক নবযুগের সূচনা করে, বিশেষ করে ভারতবর্ষে। (সম্ভবত চীনদেশেও প্রায় একই সময়ে বিজ্ঞজনেরা শূন্যের বহুবিধ ব্যবহারের কথা ভাবতে শুরু করেছিলেন।) তাদের কল্পনা নতুন নতুন উদ্ভাবনার দিকে এগিয়ে চলে। যেমন ঋণাত্বক সংখ্যা। আগে কেউ -১ বা -৭ বলতে কি বোঝায় কল্পনা করতে পারত না। ভারতীয় গাণিতিকরা শেখালেন যে ঋণাত্নক সংখ্যাকে অনেকটা ঋণের মতই দেখা যেতে পারে। কারো কাছ থেকে ধার করলে সেটা ঋণ, নিজে কামাই করলে সেটা ধন, অর্থাত্‌ ধনাত্নক। আন্দাজ করা হয় যে বাংলা ভাষায় ‘ধনাত্নক’ আর ‘ঋণাত্নক’ শব্দদুটির উত্‌পত্তিই সেখানে। সপ্তম শতাব্দীর বিশিষ্ট ভারতীয় গাণিতিক ব্রম্মগুপ্ত শিখিয়েছিলেন কেমন করে ধনাত্নক এবং ঋনাত্নক উভয়প্রকার সংখ্যা দিয়ে যোগ বিয়োগ পূরণ ভাগ করতে হয়। তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি ঘোষণা করলেন যে “ ধনাত্নক সংখ্যাকে ঋণাত্নক সংখ্যা দিয়ে ভাগ করলে ফলাফল দাঁড়াবে ঋণাত্নক, এবং ঋণাত্নক সংখ্যাকে আরেকটি ঋণাত্নক সংখ্যা দিয়ে ভাগ বা পূরণ করলে দাঁড়াবে ধনাত্নক”। বর্তমান যুগের সাত বছরের ছেলেমেয়েরাও তা জানে, কিন্তু সপ্তম শতাব্দীতে সেটা ছিল এক বিস্ময়কর আবিষ্কার।
ব্রম্মগুপ্ত এ’ও জানতেন যে শূন্য দিয়ে যে কোন সংখ্যাকে পূরণ করলে সেটা শূন্য হয়ে যাবে। সে অর্থে শূন্য সবকিছুকে শুষে নেয়। তবে তিনি সমস্যায় পড়েছিলেন শূন্য দিয়ে ভাগ করার চেষ্টা করতে গিয়ে। ০/০ বা ৫/০ কততে দাঁড়ায়? খুব ভাবনাচিন্তা না করেই বলে বসলেন এগুলোও শূন্য—যা অবশ্য ঠিক নয়। তখনকার চিন্তাধারাটাই ছিল ওরকম—শূন্য হল এমন জিনিস যার সংস্পর্শে এসে সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়।

এই ভ্রান্ত ধারণাটি তত্‌ক্ষনাত্‌ শুধরানো হয়ে ওঠেনি। আরো কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করতে হয়েছিল। দ্বাদশ শতাব্দীর আরেক প্রখ্যাত ভারতীয় গাণিতিক, ভাস্কর, তিনি এই সমস্যার সঠিক মীমাংসা দিতে সক্ষম হন। তিনি বললেন, ১/০ শূন্য নয়, অসীম। আর ০/০—এর মানে কি? এর কোন মানেই নেই। আজকে আমরা জানি যে এরও একটা অর্থ আছে। একে বলা হয় ‘ইনডিটারমিনেট নাম্বার’ বা অনির্দিষ্ট সংখ্যা। এর মান যেকোন সংখ্যা হতে পারে। তবে এর গণিতসম্মত অর্থ প্রথম দিয়েছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীর ফরাসী গাণিতিক ‘লোপিতাল’। সেটা বুঝার জন্যে মধ্যযুগের ইউরোপিয়ান গণিতের ইতিহাস জানা দরকার। সেসব কথায় পরে আসা যাবে।

ছয়

এক হিসেবে সপ্তম শতাব্দী ছিল ভারতবর্ষের স্বর্ণযুগ, অন্তত গণিতচর্চায়। শুন্যকে সংখ্যার সারিতে স্থান দেওয়া এবং ঋণাত্নক সংখ্যার আবিষ্কার, দুটোই ছিল সেসময়কার পরিপ্রেক্ষিতে যুগান্তকারি ঘটনা। ওদিকে পশ্চিমের সূর্য তখন প্রায় অস্তমিত। দীর্ঘ সাত শ’ বছর রাজত্ব করবার পর পরাক্রান্ত রোমান সাম্রাজ্য তখন ধ্বংসের মুখে। ৪৭৬ খৃষ্টাব্দের ৪ই সেপ্টেম্বর রোমান সম্রাট রমুলাস অগাস্টাস যখন শত্রুপক্ষের হাতে চূড়ান্তভাবে পরাস্ত হলেন, তখনই সত্যিকার অর্থে ইউরোপের মাটি থেকে রোমের আধিপত্য মুছে যায়। এতদিনের একটা বিশাল সভ্যতা একটি পরাজয়ের ঘটনাতে একেবারে লোপ পেয়ে যাবে কোনও এক বিশেষ দিবসে সেটা অবশ্য কখনোই বিশ্বাসযোগ্য নয়। একটা সভ্যতা আপনা আপনি গড়ে ওঠে না, আপনা আপনি পড়েও যায় না। ওঠার যেমন একটা প্রক্রিয়া আছে নামারও আছে। অনুমান করা হয় যে রোমান সাম্রাজ্য ৩২০ বছর ধরে আস্তে আস্তে ক্ষয় হতে হতে শেষে সামান্য খোঁচাতেই একেবারে বিলীন হয়ে যায়। তখন আর পশ্চিমের কিছু থাকল না পৃথিবীকে দেওয়ার। সাম্রাজ্য নয়, সমৃদ্ধি নয়, নতুন কোন জ্ঞান নয়, কোন যুগান্তকারি আইডিয়া নয়। পশ্চিমের ভাণ্ডার তখন শুন্য হয়ে গেছে।

ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণে মধ্যপ্রাচ্যে উদয় হতে থাকে এক নতুন সূর্য—ইসলামের চাঁদতারা মার্কা সূর্য। ৬৩২ খৃষ্টাব্দে হজরত মোহাম্মদ (দঃ) এন্তেকাল করার দশ বছরের মধ্যেই দুর্ধর্ষ আরব বাহিনী তাদের দিগ্বিজয়ের সীমানা মিশর, সিরিয়া, মেসোপটেমিয়া আর পারস্য পর্যন্ত বিস্তার করে ফেলে। ইহুদী আর খৃষ্টান অধ্যুষিত জেরুজালেম তাদের করায়ত্ত হয়ে যায়। ৭০০ খৃষ্টাব্দের মধ্যে তারা পশ্চিমে আলজিরিয়া আর পূর্বে সিন্ধু নদ পর্যন্ত দখল করে ফেলে। ৭১১ খৃষ্টাব্দে তারা স্পেনের পতন ঘটায়। ৭৫১ খৃষ্টাব্দে তাদের জয়যাত্রা চীন সাম্রাজ্যের ভিত্তি কাঁপিয়ে তোলে।
সেকালের মুসলমানরা অবশ্য সাম্রাজ্যবিস্তার আর ধর্মপ্রচার করেই ক্ষান্ত হননি, যেখানে গেছেন সেখান থেকেই সাগ্রহে আহরণ করে এনেছেন বিজিত জাতির ধনভাণ্ডার শুধু নয়, জ্ঞানভাণ্ডারও। জ্ঞানবিজ্ঞানের প্রতি একটা বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ পায় বাগদাদের আব্বাসী আমলে। বিশেষ করে খলিফা হারুন-অর-রশিদের ছেলে আল-মামুনের (৭৮৬-৮৩৩) শাসনকালে। আল-মামুন অসম্ভব জ্ঞানপিপাসু মানুষ ছিলেন। অত্যন্ত উঁচুমানের প্রগতিশীল চিন্তার নৃপতি। তিনিই ছিলেন মুসলিম জগতের প্রথম সাংস্কৃতিক রেনেসাঁর হোতা ও অভিভাবক—অনেকের মতে ওটাই ছিল ইসলামের একমাত্র উল্লেখযোগ্য রেনেসাঁ। সারা মুসলিম জাহানে তিনি নিয়ে এসেছিলেন মুক্তবুদ্ধি ও মুক্তচিন্তার এক দুর্বার কল্লোল। ধর্মীয় গোঁড়ামি পিছুটান নিতে বাধ্য হয়, মোল্লা সম্প্রদায় পশ্চাতপদ। আধুনিক যুক্তিবাদী ও প্রশ্নমুখি চিন্তাধারা প্রবেশ করে মুসলিম মননে। আল-মামুনের সময়ই মোতাজিলা মতবাদ মাথা চাড়া দেয়। এই মতবাদ অনুসারে সংসারের কোনকিছুই প্রশ্নের অতীত নয়, এমনকি ধর্মও। বিশেষ করে ধর্ম। মোতাজিলারা বিশ্বাস করতেন যে কোরান পবিত্র গ্রন্থ ঠিকই, কিন্তু দৈবগ্রন্থ নয়, মনুষ্যপ্রনীত। সুতরাং যুগবিশেষে এর রদবদল সম্ভব ও সঙ্গত। মোতাজিলারা অমুসলমান ছিলেন তা নয়, নামাজ রোজা তাঁরা করতেন ঠিকই, কিন্তু সাথে সাথে এ’ও বিশ্বাস করতেন যে ধর্মকে যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, উল্টোটা নয়। বলা বাহুল্য যে এই মতবাদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিরোধিতা সৃষ্টি হয়েছিল সেসময়—শুধু সনাতন মোল্লাসমাজের কাছ থেকে নয়, সাধারণ জনসাধারণের কাছ থেকেও। খলিফা মামুন সেই বিরোধিতাকে প্রশ্রয় দেননি। বরং পূর্ণ উদ্যমে এগিয়ে গেছেন তাঁর আধুনিকতার সংগ্রামে। রাজ্যের জ্ঞানীগুণি পণ্ডিতদের একসাথে জড় করে নির্দেশ দিলেন নিশ্চিন্তমনে জ্ঞানচর্চার সাধনায় আত্মনিমগ্ন হতে। আল-মামুন প্রচণ্ডভাবে আকৃষ্ট ছিলেন গ্রীক দর্শন, জ্যোতির্বিজ্ঞান আর গণিতের প্রতি। ইহুদী ও খৃস্টান সম্প্রদায়ের জ্ঞানসাধনার সংস্কৃতিকেও তিনি সম্মান করতেন। তাঁর পণ্ডিতকূলের প্রতি তাঁর প্রথম নির্দেশ ছিল তাঁরা যেন উঠে পড়ে লেগে যান গ্রীক, ইহুদী আর খৃস্টানপ্রনীত বইপত্র যা যেখানে পাওয়া যায় তা যেন সংগ্রহ করে নিয়ে আসেন বাগদাদে। তারপর সেগুলো ভাল করে পাঠ করে অনুবাদ করেন আরবি ভাষায়। শেষে নিজেরাই যেন একনিবিষ্টভাবে গবেষণার কাজে লিপ্ত হয়ে যান। এমনই দূরদর্শীসম্পন্ন খলিফা ছিলেন তিনি যে নিজ প্রাসাদের বিলাসজীবন উপেক্ষা করে মত্ত হয়ে গেলেন জ্ঞানচর্চার জন্যে একটি বিশেষ ভবন তৈরি করাতে। এ ছিল তাঁর বড়ই শখের স্বপ্ন—এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করা যেখানে জ্ঞানীরা শুধু জ্ঞানার্জন করবেন এবং নতুন জ্ঞান সৃষ্টি করবেন, নির্বাধ ও নিঃশঙ্ক স্বাধীনতার সঙ্গে। ৮৩৩ খৃষ্টাব্দে তাঁর এই স্বপ্ন কার্যকরি হয় শেষ পর্যন্ত। বিশ্বের সর্বপ্রথম গবেষণাগৃহ, জ্ঞানমন্দির (House of Wisdom), বায়তুল-হাকমা, তার নির্মানপর্ব সমাপ্ত হয় বাগদাদে। আজকে পশ্চিম জগতের সর্বত্র, প্রাচ্যেরও অনেক দেশে গবেষণাগারের ছড়াছড়ি। কিন্তু এর সূচনা হয়েছিল ইসলামের সেই গৌরবযুগে, সে তথ্য হয়ত সবার জানা নয়। আল-মামুনের উত্‌সাহ, প্রেরণা ও পৃষ্ঠপোষকতায় ইসলামী মেধা শতবর্ণে পল্লবিত হয়ে ওঠে। এই প্রস্ফূটিত জ্ঞানবৃক্ষের অন্যতম প্রধান শাখা ছিলেন আবু মুসা আল-খোয়ারিজমি নামক এক গণিতপ্রেমিক জ্ঞানসাধক। ইতিহাস তাঁকে জানে অঙ্কের অন্যতম প্রধান শাখা, বীজগণিত, তার স্রষ্টা হিসেবে। তাঁর প্রনীত গ্রন্থ ‘হিসাব-আল-জবর-ওয়াল-মোকাবেলা’। সেই আলজবর থেকেই ইংরেজি নাম ‘এলজেব্রা’। আরবি আলজবরের আক্ষরিক অর্থ কিন্তু গণিতের সঙ্গে সম্পৃক্ত মোটেও নয়—বরং চিকিত্‌শাস্ত্রেই বেশি প্রযোজ্য। এর মানে ‘সারানো’, কোনকিছু ‘মেরামত’ করা, যেমন ভাঙ্গা হাড়। তিনি বললেন, অস্ত্রোপচার করে যেমন ভাঙ্গা হাড় জোড়া লাগানো যায়, তেমনি সমীকরণ সমাধান করে উদ্ধার করা যায় অজানা সংখ্যার মান। উদাহরণঃ x+3=5 । x এর মান কত? সোজা উত্তরঃ 2. কিন্তু যদি এমন হয় যেঃ ax^2+ bx+c=0, তাহলে x এর মান বের করব কি করে। আজকে যে-কোন স্কুলের বারো তেরো বছরের যে কোন ছাত্র/ছাত্রী মুখস্ত বলে দিতে পারবে তার উত্তরঃ (-b +(b^2-4ac)^(1/2))/2a. কিন্তু নবম শতাব্দীতে এই সহজ সমাধানটি কারুরই জানা ছিল না। পৃথিবীতে বোধ হয় এমন কোন স্কুল নেই যেখানে শিক্ষার্থীরা শেখে না এই সূত্রটি। কিন্তু ক’জন ছাত্র ছাত্রী, বা ক’জন শিক্ষক জানে যে এই সূত্রের আবিষ্কারক ছিলেন সেই আরব গাণিতিকটি। আলখোয়ারিজমি ছিলেন সত্যিকার সাধক পুরুষ–দিনরাত গণিত নিয়েই পড়ে থাকতেন। তিনি বলতেন যে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে গণিত মাথা তুলে দাঁড়ায়। তাঁর আরো একটি বড় আবিষ্কার ছিল। অনেকটা ধারাপাতের মত—যোগবিয়োগ পূরণ ভাগের ধারাপাত, ইংরেজিতে যাকে বলি ‘আলগরিদম’। তাঁর নামানুসারেই বর্তমান যুগের সর্বজনপরিচিত শাখাঃ আলগরিদম।

আলখোয়ারিজমির উপরোক্ত সূত্র অনুযায়ী x^(2)=1, এর সমাধান কত? কোন সূত্র প্রয়োগ না করেই বলা যায় ১। এটুকু তিনি জানতেন—বাগদাদের জ্ঞানভবনের সকলেরই জানা ছিল। যেটা জানা ছিল না তাঁদের, এমনকি আলখোয়ারিজমি সাহেব নিজেও টের পাননি প্রথম প্রথম সেটা হল এই সমীকরনটির দ্বিতীয় সমাধানঃ -১। সেযুগের মানুষের মন এতই আচ্ছন্ন ছিল অখণ্ড সংখ্যা (natural numbers) দ্বারা যে ‘ঋণাত্নক’ সংখ্যা নামক কোন বস্তুর অস্তিত্বই তাদের মাথায় ঢোকেনি। ওই জ্ঞানটুক্কু তাঁরা আহরণ করেন ভারতীয় পণ্ডিতদের সংস্পর্শে আসার পর। বেবলিয়ানদের শিক্ষা থেকে তাঁরা জানতেন যে ‘শূন্য’ একটা দরকারি জিনিস, কিন্তু ভারতীয়দের কাছে তাঁরা শিখলেন যে শূন্য শুধু সাময়িক প্রয়োজন মেটায় না, দস্তুরমত একটা সংখ্যাও, ১,২,৩,… এর মতই। বড় কথা তাঁরা বুঝলেন যে x+3=1 জাতীয় সমীকরণেরও একটা সমাধান আছে, -২, যেটা হাতে গোনার মত অখণ্ড সংখ্যা না হলেও অত্যন্ত মূল্যবান সংখ্যা। তাঁরা এ’ও বুঝলেন যে দ্বিঘাতী সমীকরণের (quadratic equation) সমাধান একটি নয়, দুটি, যদিনা সমীকরণটি এরকম হয় যেঃ (x-1)^2=0, যার একটাই উত্তর, ১। এই যুক্তিতে আলখোয়ারিজমির ঐতিহাসিক সূত্রটিতে -b এর ডানপাশে শুধু যোগচিহ্ন নয়, তার নীচে একটা বিয়োগচিহ্নও বসাতে হবে। এই ফর্মূলাটিই পৃথিবীর প্রতিটি ছাত্রছাত্রী আজীবন মুখস্ত রাখে।

‘শূন্য’কে সংখ্যার আসরে বসাবার পর পুরো একটা ‘সংখ্যারেখা’র ধারণা মানুষের মনে জেগে উঠবার সুযোগ পায়। ‘শূন্য’ হয়ে গেল ধনাত্নক আর ঋণাত্নক সংখ্যামালার মাঝখানে একটা সেতুর মত। অন্যভাবে ভাবতে গেলে শূন্য যেন একটি কাচের আর্শি যেখানে দাঁড়িয়ে ধনাত্নক রাশি দেখতে পারে তার প্রতিচ্ছবি ঋণাত্নক রাশিকে। ধনাত্নক আর ঋণাত্নক সংখ্যা একে অন্যের সখা হয়ে গেল, তাদের মাঝে সৃষ্টি হল এক অবিচ্ছেদ্য প্রতিসাম্য। এযেন সৃষ্টিরই দ্বৈতরূপ—একদিকে ধন, আরেকদিকে ঋণ, একদিকে জন্ম, আরেকদিকে মৃত্যু—দু’টি একই বাস্তবতার বন্ধনে নিবিড়ভাবে আবদ্ধ।

‘শূন্য’ সভ্যতাকে আরো খানিকটা এগিয়ে দেয় মধ্যযুগের আরবপ্রভাবিত পৃথিবীতে।

‘শূন্য’ শব্দটি ইংরেজিতে ‘zero’ হল কেমন করে তারও একটা ইতিহাস আছে। শুরুতে ভারতে এর নাম ছিল ‘শূনিয়া’– যার অর্থ খালি, নেই, অবিদ্যমান, যা থেকে বাংলা নাম শূন্য। আরবরা সে ‘শূনিয়া’কে তাদের নিজেদের ভাষায় ‘সিফর’এ পরিণত করেন। পশ্চিম বিজ্ঞজনদের হাতে এসে আরব ‘সিফর’ ল্যাটিন গন্ধযুক্ত ‘সিফাইরাস’এ দাঁড়ায়, যা যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে একসময় জিরোতে রূপান্তরিত হয়।

বুদ্ধিজীবিমহলে শূন্যের একটা সম্মানজনক স্থান হওয়া সত্বেও এর দার্শনিক ব্যঞ্জনার্থের সঙ্গে চিন্তাবিদরা খুব স্বচ্ছন্দ বোধ করতেন গোড়া থেকেই তা কিন্তু নয়। কারণ তাঁদের মন থেকে তখনো এরিস্টটোলের ঘোর পুরোপুরি কাটেনি। শূন্যের সঙ্গে নিরীশ্বরবাদিতার একটা সম্পর্ক আছে এই অস্বস্তিটুকু কিছুতেই দূর হচ্ছিলনা তাঁদের চিন্তা থেকে। কিন্তু গণিতের অগ্রগতির কল্যানে তাঁদের এই ভ্রান্ত বিশ্বাসের ভিত্তি আস্তে আস্তে দুর্বল হতে থাকে। তাঁরা মেনে নিতে থাকেন ধীরে ধীরে যে ‘শূন্য’ একটা সংখ্যা মাত্র, তার বেশি নয়, কমও নয়। শূন্যের পৃথিবী গণিতে, দর্শনশাস্ত্রে নয়। শূন্যের সঙ্গে ঈশ্বর আছে কি নেই সে প্রশ্নের কোন সম্পর্ক নেই এবং থাকতে পারেনা, এই বিজ্ঞানসম্মত যুক্তিটি তাঁদের কাছেও গ্রহনযোগ্য মনে হয়।

সেই জ্ঞানমন্দিরের এক পরবর্তীকালীন সদস্য ছিলেন কিংবদন্তীয় পারসি কবি ওমর খৈয়াম। গোটা বিশ্বে বোধ হয় এমন কোন শিক্ষিত মানুষ নেই যে ওমর খৈয়ামের নাম শোনেনি। তাঁর ছয় শতাধিক ছড়াকাব্যসম্বলিত গ্রন্থ ‘রুবাইয়াত’ সম্ভবত পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থসমূহের অন্যতম—সর্বশ্রেষ্ঠ না হলেও সর্বাধিক পঠিত, আলোচিত ও সর্বনন্দিত তো অবশ্যই। মজার ব্যাপার যে যেযুগে তাঁর জন্ম, একাদশ শতাব্দী, সেযুগে তাঁর অধিকতর পরিচয় ছিল বিশিষ্ট গাণিতিক, জোতির্বিজ্ঞানী ও সঙ্গীতবিশারদ হিসেবে। তিনি ছিলেন সেকালের সর্বজ্ঞপুরুষ। ইস্ফাহান শহরে তিনি একটি আন্তর্জাতিক মানের মানমন্দির (observatory) তৈরি করেছিলেন, যার সাহায্যে তিনি বত্‌সরের দৈর্ঘ আশ্চর্য খুঁতশূন্যভাবে নির্ণয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন। এতটাই সুনাম ছিল তাঁর নভোদর্শী বিজ্ঞানী হিসেবে যে সেসময়কার সুলতান, জালালুদ্দিন, তাঁর ওপর দায়িত্ব দিয়েছিলেন একটা আধুনিক সৌরভিত্তিক পঞ্জিকা প্রস্তুত করতে। সেই দায়িত্ব তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে পালন করেছিলেন। তিনি তাঁর সহকর্মীদের নিয়ে যে পঞ্জিকাটি তৈরি করেছিলেন তার নাম দেয়া হয় ‘জালালিয়ান ক্যালেণ্ডার’। নির্ভুলতার বিচারে সে ক্যালেণ্ডার আধুনিক গ্রেগরিয়ান ক্যালেণ্ডেরারের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়, বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন অনেক পশ্চিমা বিশেষজ্ঞ।

গণিতে ওমর খৈয়ামের পাণ্ডিত্য কোনও সংকীর্ণ এলাকাতে সীমাবদ্ধ ছিল না। জ্যামিতির আদ্যোপান্ত সব তথ্যই ছিল তাঁর নখদর্পনে। গ্রীকদের মত তাঁর চিন্তাও ছিল জ্যামিতিক—অর্থাত জ্যামিতিক আকারাদির রীতিনীতি দিয়ে প্রভাবিত। আলখোয়ারিজির নতুন গণিত, বীজগণিত, তার প্রতিও আকৃষ্ট হয়ে উঠলেন এক সময়। তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করলেন নিজের কাছেঃ দ্বিঘাতী সমীকরণের সমাধান দিয়ে গেলেন আলখোয়ারিজমি, কিন্তু ত্রিঘাতী সমীকরণের (cubic equation) সমাধান তো দেইনি কেউ। সেই কাজটি তিনি নিজে করবেন বলে সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সিদ্ধান্তের পেছনেও কিন্তু তাঁর জ্যামিতিক চিন্তাধারণার প্রভাব ছিল। তাঁর যুক্তি ছিলঃ দ্বিঘাতী সমীকরণের সঙ্গে সম্পর্ক আছে দ্বিমাত্রিক সমতল ক্ষেত্রের, সুতরাং ত্রিমাত্রিক ঘন বস্তুর সঙ্গে নিশ্চয়ই সম্পর্ক আছে ত্রিঘাতী সমীকরণের। অনেক পড়াশুনা আর গবেষণার পর একটা নতুন এবং অত্যন্ত মূল্যবান তথ্য তিনি আবিষ্কার করলেন—ত্রিঘাতী সমীকরণ প্রধানত ১৪ প্রকারের। সমীকরণের পুরো সমাধান হয়ত তিনি দিতে পারেননি সেসময়, কিন্তু এই যে সমীকরণের একটা শ্রেনী আবিষ্কার করতে পারা, এটা বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিতে, সমীকরণ সমাধানের চাইতেও বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পরবর্তীকালে যাঁরা ত্রিঘাতী সমীকরণের ওপর কাজ করেছেন তাদের জন্যে এই তথ্যটির মূল্য ছিল অপরিসীম। ওমর খৈয়াম যে একেবারেই কোন সমাধান দিতে পারেননি তা নয়, তবে আংশিকভাবে, গুটিকয়েক বিশেষ বিশেষ সমীকরণের সমাধান তিনি অবশ্যই দিতে পেরেছিলেন। কিন্তু পুরোটা দেওয়া হয়ে ওঠেনি। তার কারণ তাঁর বৌদ্ধিক সীমাবদ্ধতা তা নয়, দ্বাদশ শতাব্দীর জ্ঞান দিয়ে সেটা বের করা মোটেও সম্ভব ছিল না। তাঁর অর্ধসমাপ্ত কাজটি শেষ হতে আরো চারশ’ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছিল গণিতজগতের—গুটিকয়েক ইতালিয়ান গণিতজ্ঞ সেকাজটি সমাপ্ত করেন।

সমীকরণকে শ্রেনীবদ্ধ করার কাজটির ভেতরে সুপ্ত ছিল ভবিষ্যতের এক বিশাল সম্ভাবনার বীজ। দ্বাদশ শতাব্দীতে দলতত্ত্ব( group theory) নামক কোন বস্তুর অস্তিত্ব কারো জানা ছিল না। এই বিষয়টি বর্তমান যুগের গণিতশাস্ত্রের অন্যতম বড় শাখা যার প্রভাব শুধু গণিতেই নয়, পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞান, প্রানীবিজ্ঞান, এমনকি সমাজবিজ্ঞান পর্যন্ত বিস্তৃত। ওমর খৈয়ামের শ্রেনীকরণের মধ্যে লুকিয়ে ছিল সেই দলতত্বের আইডিয়া।

পাঠক হয়ত ভাবছেন ওঁর গবেষনায় শূন্য কোখায়? সঙ্গত প্রশ্ন। না, প্রত্যক্ষভাবে হয়ত নেই, কিন্তু পরোক্ষে সেটা সর্বত্র। সমীকরণ মানেই তো বিসমিল্লাতেই ‘শূন্য’। শূন্যের বোধ ছিল বলেই তো মানুষ বুঝতে পারল যে একটা দ্বিঘাতী সমীকরণের দু’টি সমাধান। একই কারণে ওমর খৈয়াম সাহেবও জানতেন, একটি ত্রিঘাতী সমীকরণের সমাধান একটি নয়, তিনটি, সাধারণতঃ। ধনাত্নক, ঋণাত্নক তো আছেই, হয়ত, আরোকিছু। এই ‘আরোকিছু’ (যেটা পরে complex নাম্বার বা জটিল সংখ্যা নামে আত্মপ্রকাশ করে), তার জন্যেও অপেক্ষা করতে হয়েছিল বেশ কয়েক শতাব্দী। সেকখায় পরে আসব।

সাত

পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের সূচনা থেকে সমসাময়িক কাল পর্যন্ত পরিচিত ধারাটি হল, এশিয়া-আফ্রিকা আর ল্যাটিন আমেরিকার দেশগুলো থেকে মেধাবী ছেলেমেয়েরা নিজ দেশের ‘সর্বোচ্চ ডিগ্রি’ আর্জন করার পর ‘উচ্চতর’ শিক্ষার জন্যে আসে পশ্চিমে। অবিশ্বাস্য মনে হলেও মধ্যযুগের প্রাক্কালে কিন্তু স্রোতটা ছিল ঠিক বিপরীত। বরং পশ্চিম থেকেই উচ্চাকাংখী প্রতিভাধর ছেলেদের (সেকালে মেয়েদের স্কুলে যাওয়াটাই ছিল অশ্রুতপূর্ব) স্বপ্ন ছিল প্রাচ্যের বড় বড় শিক্ষানিকেতনগুলোর কোথাও গিয়ে উচ্চশিক্ষা লাভ করা। দ্বাদশ ও ত্রয়োদশ শতাব্দীতে সে শিক্ষাগারের পীঠস্থান ছিল আরব। তখনকার দিনে উন্নততর জ্ঞানকেন্দ্র ছিল মিশর, ইরাক, সিরিয়া, ইরান, এইসব মুসলিম দেশ।

এমনি এক উচ্চাভিলাষী শিক্ষার্থী ছিলেন লিওনার্ডো ফিবুনাচি (১১৮০-১২৫০)। ইতালীর পিসা শহরে তাঁর জন্ম। ব্যবসায়ী পিতার আর্থিক সহায়তায় তিনি উত্তর আফ্রিকায় গিয়েছিলেন উচ্চশিক্ষার জন্যে। সেখানে তিনি অঙ্ক শেখেন মুসলিম গণিতজ্ঞদের কাছে। কালক্রমে তিনি নিজেই একজন বিশিষ্ট গাণিতিক হয়ে ওঠেন। আফ্রিকার গণিতচর্চা শেষ করে তিনি ফিরে আসেন মাতৃভূমিতে। ইউরোপে তখন প্রাচ্যের গণিত, বিশেষ করে আরবসূচিত সংখ্যালিখনপ্রণালী সবে পরিচিত হয়ে উঠছে। ‘শূন্য’ তখনও ঠিক তাদের সচেতন মনে ঠাঁই করে উঠতে পারেনি। গণিতের ঐতিহাসিকদের কারো কারো ধারণা, ফিবুনাচিই ছিলেন প্রথম ইউরোপিয়ান যাঁর হাতে করে আরবি গণিত এবং আরবি শূন্য সগৌরবে আবির্ভূত হয় ইউরোপের মাটিতে, এবং স্থায়ীভাবে আসন করে নেয় ইউরোপের মনমানসে।

১২০২ সালে Liber Abaci (গণনাগ্রন্থ)নামক একটি পুস্তক প্রকাশ করেন ফিবুনাচি। তাতে অত্যন্ত হালকা মেজাজে একটা আপাততুচ্ছ সমস্যা দাঁড় করালেন তিনি। সমস্যাটি এরকম।
ধরুন এক কৃষক একজোড়া বাচ্চা খরগোশ কিনে এনেছে বাজার থেকে। ধরা যাক, খরগোশ প্রজাতির প্রজননপ্রকৃতির ধারাটাই এরকম যে বাচ্চা থেকে সন্তানপ্রসব পর্যন্ত পুরো দুমাস সময় লাগে তাদের প্রসবযোগ্য বয়স হতে। এই দুমাস কেটে যাবার পর প্রতিমাসের প্রথম দিনটিতে তাদের একজোড়া সন্তান জন্মায়। এই সন্তানজোড়াও দুমাস অপেক্ষা করার পর ঠিক একই নিয়মে প্রতিমাসে একজোড়া সন্তানের জন্ম দেয়। সমস্যাটি হল এইঃ একটা নির্দিষ্টসংখ্যক মাস, ধরুন,n, অতিক্রম করবার পর, n+1 তম মাসের প্রথমে তাহলে সর্বমোট কতগুলো খরগোশের মালিক হলেন সেই কৃষক?

একটা ছেলেমানুষী মডেল, মানছি, কিন্তু এর একটা বিস্ময়কর পরিসমাপ্তি আছে।

গোণার কাজটি কিন্তু খুবই সহজ। প্রথম মাসে সংখ্যা ১। দ্বিতীয় মাসেও তাই, কারণ উত্‌পাদন তো শুরু হয় দ্বিতীয় মাস শেষ হবার পর। তৃতীয় মাসের ১ তারিখে সংখ্যা দাঁড়ায় ২। তার পরের মাসে সন্তানেরা সাবালক হয়ে ওঠেনি বলে শুধু তাদেরই একজোড়া বাচ্চা হয়, সুতরাং মোট সংখ্যা দাঁড়ায় ৩। তার পরের মাসে কিন্তু বাবামা এবং তাদের প্রথম সন্তানদ্বয়, দুয়েরই একজ়োড়া সন্তান জন্ম নেয়। তাহলে এবার সংখ্যা দাঁড়ালো ৫। এভাবে হিসেব করে যে সংখ্যামালাটি অনায়াসেই উদ্ধার করে ফেলি আমরা সেটা হলঃ
১,১,২,৩,৫,৮,১৩,২১,৩৪,৫৫,….

এই ধারাবাহিক সংখ্যাগুলোর দিকে একটু মনোযোগ দিয়ে তাকালে একটা সুশৃংখল প্যাটার্ণ ধরা দেবে যে-কোনো আনাড়ি চোখেও—তৃতীয় সংখ্যা থেকে শুরু করে ডানদিকের প্রতিটি সংখ্যা তার পূর্ববর্তী সংখ্যাদুটির যোগফল। এই অবলোকনটি থেকে একটা গাণিতিক সূত্র লিখে ফেলা যায়, কি বলেন? x_(n) যদি হয় n-তম মাসের খরগোশজোড়ার সংখ্যা, তাহলে সেই সূত্রটি নিশ্চয়ই এরকমঃ

x_(n+1)=x_(n) +x_(n-1).

এখানে n কে শুরু করতে হবে ১ থেকে, এবং ধরে নিতে হবে যে x_(0)=0, x_(1)=1.সুতরাং x_(2)=1, x_(3)=2, x_(4)=3, x_(5)=5,…
এই যে sequence টি, বা অনুবর্তী রাশিমালা, এটি গণিতজগতে বিশেষভাবে পরিচিত ফিবুনাচি সিকুয়েন্স নামে। আটশ বছর পর এখনো গণিতবিশারদদের অনেকে এর ওপর কাজ করছেন, পেপার লিখছেন। এ এক আশ্চর্য রহস্যময় সংখ্যামালা। এত সহজ, এত নিরীহ, অথচ এত গভীর তার তাত্‌পর্য। এই তাত্‌পর্যখানি ঠিক কোন জায়গাতে সেটা বুঝতে হলে আসুন আরেকটু মনোযোগ দিয়ে তাকাই আনুবর্তিক সংখ্যাগুলোর দিকে। বাঁ থেকে ডানদিকে এগিয়ে চলুন। প্রতিটি সংখ্যাকে তার পূর্ববর্তী সংখ্যা দিয়ে ভাগ করুন। যেমন ৩/২=১.৫, ৮/৫=১.৬, ১৩/৮=১.৬২৫, ২১/১৩=১.৬১৫৩৮….। পরিচিত মনে হচ্ছে কি? এই অনুপাতটি যতই এগুবে ডানদিকে, একেবারে অন্তহীন মাত্রায়, ততই এটি একটা বিশেষ সংখ্যায় গিয়ে পৌঁছুবে। সেই সংখ্যাটি হল পূর্ববর্ণিত সেই যাদুকরি সংখ্যাটিঃ ১.৬১৫…, পাইথাগরাসের সেই সুবর্ণ সংখ্যা যাকে ফাঁস করে দেয়ার জন্যে হতভাগ্য হিপসাসকে প্রাণ দিতে হয়েছিল।

আশ্চর্য, তাই না? শুধু তাই নয়্‌, পণ্ডিতরা খূঁজে বের করেছেন যে অনেক প্রানী আর উদ্ভিদের জীবনেও এই ফিবুনাচি রাশির প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এ যেন এক দৈব ডিজাইন। যারা দৈবতায় বিশ্বাস করেন না (যাদের মধ্যে আমিও একজন), তাদের কাছেও এ এক বিস্ময়কর রহস্য প্রকৃতির—যেন প্রজন্মবৃদ্ধির এই সরল সহজ নিয়মটির সারল্যের মধ্য দিয়ে প্রকৃতি তার নিজেরই সারল্যপ্রীতি প্রকাশ করেছে।

প্রকৃতির আইনকানুনের সঙ্গে যারা মোটামুটি পরিচিত (অর্থাত্‌ সফল গবেষণাকর্মে লিপ্ত ছিলেন) তারা অবশ্য অনেক আপাতরহস্যেরই ব্যাখ্যা খুঁজে পেয়েছেন, এবং অহরহ খুঁজে চলেছেন (এই অন্তহীন কৌতূহলই বিজ্ঞানীদের চালিকাশক্তির উত্‌স)। যেমন আইজ্যাক নিউটনের (১৬৪২-১৭২৭)অভিকর্ষ বা মধ্যাকর্ষণ তত্ব। অভিকর্ষের ফর্মূলাটি 1/d^(2)র ২ কেন ৩ হল না, বা ২.১৭ বা অন্য কোনও সংখ্যা, সেটা ভাববার বিষয় বইকি(উক্ত ফর্মূলাটিতে d হল দুটি বস্তুর দূরত্ব—যেমন সূর্য এবং পৃথিবী।) মজার ব্যাপার যে এই একই ফর্মূলা প্রকৃতির আরো কয়েক জায়গায় কাজ করে, যেমন চৌম্বিক-বৈদ্যুতিক ক্ষেত্র। ফর্মূলার ২ সংখ্যাটি অন্য কোন সংখ্যা হলে তার কি পরিণতি হত সেটা নিয়েও অনেক গবেষণা হয়েছে, গাণিতিক, বৈজ্ঞানিক, দার্শনিক, সব প্রকারেরই। তাতে দেখা গেছে যে ২ এর অন্যথায় আমাদের বিশ্বপ্রকৃতির চেহারা একবারে ভিন্নরকমের হয়ে যেত, সম্ভবত এর স্থায়িত্ব নিয়েই নানারকম সমস্যা দেখা দিত। তার অর্থ, এই যে সহজ সরল নীতিমালা অনুসরণ করে চলেছে প্রকৃতি তার একটুখানি উনিশবিশ হলে আমাদের অস্তিত্ব আর স্থিতি দু’টিই বিপন্ন হয়ে পড়ত।
ফিবুনাচির উপরোক্ত সূত্র বা সমীকরণটির সমাধান বের করা কিন্তু এমন কোন শক্ত কাজ নয়। ধরুন সমাধানটি এরকমঃ x_(n)=t^(n), t কোনও সংখ্যা, মূলদ অমূলদ কিছু আসে যায় না। এই ধারণাকৃত সমাধানটি আসলেই উক্ত সমীকরণের শর্ত পালন করে কিনা তা যাচাই করতে হলে দেখতে হবে ওটাতে স্থাপন করার পর t ভিত্তিক কি সমীকরণটি বের হয়ে আসে। এটা অতি সহজেই প্রমান করা যায় যে সমীকরণটি হচ্ছেঃ

t^(2)-t-1=0.
এর সমাধান কি করে বের করতে হয় সেটা তো আমাদের আগেই শেখা হয়ে গেছে আলখোয়ারিজমি সাহেবের আবিষ্কার থেকে। এই সমাধান থেকেই চলে আসবে সেই বিপুল রহস্যে ভরা সংখ্যাটিঃ
(5^(1/2)+1)/2=1.615….

বিচিত্র এই বিশ্ব, তাই না?

আমার নিবন্ধের মূল প্রসঙ্গটি হল ‘শূন্য’ ও তার ঘনিষ্ঠ সহচর ‘অসীম’। ফিবুনাচি সূত্রে শূন্য হয়ত আমরা স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিনা যদিও প্রচ্ছন্নভাবে সেটা আছেও, কিন্তু অসীম তো একেবারে নাকের ডগায়। এই যে বলা হল সংখ্যাগুলো (অর্থাত্‌ কৃষকের খরগোশ সংখ্যা) বেড়ে বেড়ে চলে যাচ্ছে অসীমের দিকে সেখানেই তো ছিল গ্রীক চিন্তাবিদদের জুজুর ভয়। ফিবুনাচির রাশিতে অসীম (এবং পরোক্ষে শূন্য)দেখা দিতে পেরেছে বলেই পাইথাগরাসের সযত্নে লুক্কায়িত জুজু, সুবর্ণ অনুপাত, আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হয়েছে।

Liber Abaci ফিবুনাচির একমাত্র গ্রন্থ নয়। তাঁর আরেকটি গ্রন্থে ওমর খৈয়ামের প্রিয় প্রশ্ন, ত্রিঘাতী সমীকরণের ওপর অনেক মূল্যবান গবেষণা লিপিবদ্ধ করে গেছেন। যেমনঃ
x^(3)+2*x^(2)+10*x=20.

এটির কোন মূলদ সমাধান থাকা যে সম্ভব নয়, এবং a+b^(1/2) জাতীয় কোন মূল, এধরণের আধুনিক গোছের মন্তব্যও তিনি রেখে গিয়েছিলেন (উল্লেখ্য যে এখানে a এবং b উভয়কেই মূলদ সংখ্যা হতে হবে।)

আট

ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ইউরোপের অন্ধকার ভাল করে কেটে ওঠেনি। উন্নততর আরব এবং ভারতবর্ষসহ দূরপ্রাচ্যের নানা দেশ থেকে নতুন নতুন আইডিয়ার বাতাস ভেসে এলেও প্রাচীন এরিস্টটোলিয়ান চিন্তাধারা তাদের বিজ্ঞান আর গণিতের অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করে রেখেছিল। ফিবুনাচির যুগান্তকারি আবিষ্কার আর আরব সংখ্যামালার প্রভাব তখনও প্রবেশ করেনি ইউরোপের গণমানসে, এমনকি বুদ্ধিজীবি মহলেও।

কিন্তু রক্ষনশীল সমাজের নানারকম বিধিনিষেধ সত্বেও সত্যিকার কোনও আকর্ষণীয় আইডিয়া যখন অঙ্কুরিত হয় কোন দেশে তখন সেটা ধীরে ধীরে চারিদিকে ছড়িয়ে পড়বেই কোন-না-কোনভাবে, চুম্বকের মত আকৃষ্ট করতে থাকবে চিন্তাশীল মানুষদের। এটাই সব বড় আইডিয়ার সহজাত ধর্ম। ‘শূন্য’ তেমনি এক বড় আইডিয়া। একে আর বেশিদিন চেপে রাখা সম্ভব হয়নি ইউরোপে। ধর্মযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে আস্তে আস্তে উঠে আসবার পর ‘শূন্যের’ আইডিয়াটি যে-সম্প্রদায়কে সবার আগে টেনে আনতে সক্ষম হয় সেটা ছিল যারা ছবি আঁকতেন—পেশাবি না হলেও শখের শিল্পী, যাদের বেশির ভাগই ছিলেন চার্চের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট (সেকালে শিক্ষিত সম্ভ্রান্ত ব্যক্তি বলতে সাধারণত তাই বোঝাত, ল্যাটিন ভাষাজ্ঞান থাকা পাদ্রী বা সাধু বা ভিক্ষু বা ঐ জাতীয় কোনও উপাধিযুক্ত পুরুষ)। ফিলিপো ব্রুনেলিসি ছিলেন তেমনি এক উন্নতমনের ইতালিয়ান বুদ্ধিজীবি যিনি পেশাতে ছিলেন স্থপতি, নেশাতে শিল্পী, চিন্তায় গাণিতিক। এক বিরল ব্যতিক্রম সেকালের, যাঁর সঙ্গে চার্চের কোনও সরাসরি সম্পর্ক ছিল না, তবে চার্চের জন্যে ছবি এঁকেছিলেন। ১৪২৫ সালে তাঁর আঁকা ছবি, যা পরবর্তীকালে মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ছবি হিসেবে খ্যাতি অর্জন করে, সেটা এখনও ফ্লোরেন্সের সবচেয়ে নামকরা চার্চের দেয়ালে সগৌরবে বোদ্ধা দর্শকদের চিত্তরঞ্জন করে চলেছে। ছবিটির বৈশিষ্ট্য হল অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে শূন্যের বাস্তবতাকে প্রত্যক্ষতার পটভূমিতে তুলে নিয়ে আসা। তাঁর আগে ইউরোপের অঙ্কনশিল্পের কোনও জীবন ছিল না—একেবারে নিষ্প্রাণ সমতল ভূমিতে শবদেহের মত ছিল তাঁদের ছবি। ব্রুনেলিসি শূন্যের সাহায্যে তাতে একটা তৃতীয় মাত্রা যোগ করলেন। শিল্প জীবন্ত হয়ে উঠল। জন্ম নিল ‘ পার্সপেক্টিভ’ নামক এক নতুন আইডিয়া। দ্বিমাত্রিক পটে তিনি প্রবেশ করালেন ত্রিমাত্রিক বাস্তবতাকে। শূন্য আর আসীম তাতে হাত মিলিয়ে দর্শকের চোখ ধাঁধিয়ে দিল, মনকে তুলে নিল লোক থেকে লোকান্তরে। সে-ছবি ইউরোপের রেনেসাঁ যুগের প্রত্যুষকালের এক যুগান্তকারি সৃষ্টি। ব্রুনেলিসির উত্তরসূরি ছিলেন আরেক বিশিষ্ট ইতালিয়ান, রেনেসাঁর অন্যতম প্রধান কর্ণধার, লিওনার্ডো দ্য ভিঞ্চি (১৪৫২-১৫০৯)। ভিঞ্চি ব্রুনেলিসির কাজ দ্বারা খুব অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন কৈশোর আর যৌবনে। রীতিমত একটা বই লিখে ফেলেছিলেন ‘পার্সপেক্টিভ’ বিষয়টির ওপর। লিওনার্ডো ভিঞ্চির নাম শোনেনি এমন কোনও শিক্ষিত লোক পৃথিবীর কোথাও আছে কিনা জানি না। জ্ঞানবিজ্ঞানের সাধনাতে অনুপ্রেরণার প্রয়োজন হলে আর কোথাও যেতে হবে না, ভিঞ্চির দুয়েকটা কাজের কথা শুনলেই যথেষ্ট। তাঁর মত শতমুখি প্রতিভার মানুষ ইতিহাসে কখনও জন্মেছে কিনা সন্দেহ। তাঁকে বলা হয় সব জিনিয়াসের সেরা জিনিয়াস। কিংবদন্তীয় শুধু নয়, অবিশ্বাস্য, অপার্থিব, অসামান্য প্রতিভা। সাধারণ লোক তাঁর নাম শুনেছে ‘ মোনালিসা’র শিল্পী হিসেবে। কিন্তু তাঁর কর্মক্ষেত্র যে শিল্পের বাইরে কত অসংখ্য পথে বিস্তৃত ছিল, গণিত, পদার্থবিদ্যা, প্রকৌশল, বিমাননির্মান, শরীরবিজ্ঞান, বিশেষ করে মানবদেহের আভ্যন্তরীন জগতের যাবতীয় রহস্য যা বর্তমান যুগের মেডিক্যাল ছাত্র/ছাত্রীরা হিউমান এনাটমি বলে জানে (সেখবর হয়ত সবার জানা নয়)। আমার বিশেষ অনুনয় বাঙ্গালি পাঠকদের কাছে, তাঁরা যেন আগ্রহ করে এই লোকটার জীবনী পড়ার চেষ্টা করেন।

যাই হোক, আজকের প্রসঙ্গে যা বলতে চাচ্ছি তা হল ভিঞ্চি কি ধারণা পোষণ করতেন অঙ্ক আর শিল্পের সম্পর্ক নিয়ে। তিনি লিখেছিলেন এক জায়গায়ঃ “ আমার কাজ যদি ভাল করে বুঝতে চায় কেউ তাহলে সে যেন অঙ্কের জ্ঞান না নিয়ে বুঝতে চেষ্টা না করে”। ইউরোপের মধ্যযুগে গণিত আর অঙ্কনশিল্প ছিল একই জিনিসের এপিঠ ওপিঠ। অনেকটা প্রাচীন গ্রীকদের মত, যারা বিশ্বাস করতেন যে গণিত আর দর্শন প্রায় সমার্থক্ শব্দ।

যেহেতু ব্রুনেলিসির ছবিতে শূন্যের উপস্থিতি ছিল প্রায় আক্ষরিক অর্থেই, এবং সেই শূন্যই প্রকারান্তরে দিকনির্দেশনা দিচ্ছিল অনন্ত অসীমতার, প্রধানত সেই কারণেই, এবং আনুষঙ্গিক আরো কিছু কারণে চার্চের মন আস্তে আস্তে নরম হতে লাগল এদু’টি এরিস্টটোল-বিরোধী আইডিয়ার প্রতি। ফলে চার্চসংশ্লিষ্ট আরো কিছু গুণিজন সাহস করে এগিয়ে এলেন তাঁদের নিজ নিজ মতবাদ নিয়ে। ব্রুনেলিসির সমসাময়িক এক চার্চনেতা, কুসা শহরের জনৈক নিকোলাস, আকাশের নক্ষত্রমালার গতিপ্রকৃতি অত্যন্ত মনোযোগ দিয়ে লক্ষ্য করবার পর দৃঢ় সিদ্ধান্তে পৌঁছুলেন যে “পৃথিবী মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু নয়”। এবং সেমর্মে প্রকাশ্য ঘোষণাও দিয়ে ফেললেন । সেসময়কার মেজাজ অনুযায়ি অন্ত্যন্ত সাহসী, বিপ্লবী ও বিপজ্জনক ঘোষণা। কিন্তু এতবড় দুঃসাহসী ঘোষণা দেবার পরও চার্চের কোনও তাত্‌ক্ষনিক বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়নি। ব্রুনেলিসির ছবি হয়ত চার্চকে ঘুম পাড়িয়ে রেখেছিল কিছুদিন। এরপর টেম্পিয়ার নামক আরেক ব্যক্তি বলে বসলেনঃ “ ঈশ্বর তো সর্বশক্তিমান, যা ইচ্ছে তাই করতে পারেন। সুতরাং তিনি যদি চান তাহলে শূন্যতা থেকেই সবকিছু সৃষ্টি করতে পারেন (এটিই হল ইহুদী-খ্রীষ্টান-ইসলাম এই তিন আব্রাহামিক ধর্মেরই মূল বিশ্বাসের ভিত্তি), চাইলে এরিস্টটোলকেও ভুল প্রমানিত করতে পারেন”। ভীষণ উদ্ধত উক্তি সন্দেহ নেই, কিছুদিন আগে বা কিছুদিন পরে হলেও অমার্জনীয় অপরাধ বলে ধরা হত, চার্চ সেটা অগ্রাহ্য করে গেল। বিভোর ঘুম, নিঃসন্দেহে।

কুসার নিকোলাস কেবল ভূকেন্দ্রিক মতবাদের বিরোধিতা করেই ক্ষান্ত হলেন না, তিনি এ’ও বললেন যে, মহাবিশ্বে শুধু একটি নক্ষত্রমণ্ডল থাকবে কেন, কোটি কোটি, এমনকি অসংখ্য মণ্ডল থাকতেও বা বাধা কোথায়। আমরা যেমন পৃথিবীতে বসে আকাশের তারাদের উজ্জ্বলতা দেখে মুগ্ধ হচ্ছি, তেমনি অন্যান্য নক্ষত্রের অধিবাসীরাও হয়ত পৃথিবীর উজ্জ্বলতা দেখে একইভাবে মুগ্ধ হচ্ছে। তাহলে পৃথিবী কেন সবার থেকে আলাদা আসন পাবে সৃষ্টির মাঝে? পৃথিবী কেন হবে মহাবিশ্বের কেন্দ্রবিন্দু?

অসম্ভব বিপ্লবী কথাবার্তা। পঞ্চাশ বছর পরে জন্মগ্রহণ করলে লোকটাকে নির্ঘাত্‌ শূলে চড়ানো হত। কিন্তু প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম তার গতানুগতিক ক্ষমতার মোহাবিষ্টতায় এমনই বিভোর যে ক্ষুদ্র মানুষেরা তাদের ক্ষুদ্র চিন্তায় কোখায় কি আবোলতাবোল বকে যাচ্ছে সেসব নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন বোধ করেনি কেউ।

কুসার নিকোলাসের বলিষ্ঠ ঘোষণা বিস্মৃতির গহ্বরে মিলিয়ে যেতে না যেতেই আরেক নিকোলাস উদয় হলেন ইউরোপের সদ্যজাগ্রত বিজ্ঞানজগতে— নিকোলাস কপার্নিকাস (১৪৭৩-১৫৪৩)নামক এক পোলিশ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ও গাণিতিক। তখনকার ইউরোপে শিক্ষাদীক্ষার ক্ষেত্রে নেতৃস্থানীয় আসন ছিল পোলাণ্ডের। গণিত ও বিজ্ঞানের স্নায়ুকেন্দ্র ছিল পোলাণ্ডের বিখ্যাত ক্র্যাকো বিশ্ববিদ্যালয়। কপার্নিকাস তাঁর গণিত ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক যাবতীয় জ্ঞানলাভ করেন প্রধানত সেখানেই। তাঁর পাণ্ডিত্য কেবল গণিত আর জ্যোতির্বজ্ঞানেই ছিল তা নয়, আইন, চিকিত্‌সাশাস্ত্র—এসব বিষয়েও তাঁর বিশেষ বুত্‌পত্তি ছিল। তিনি কুসার নিকোলাসপ্রবর্তিত ভূকেন্দ্রিক তত্বকে আরো এক ধাপ এগিয়ে দিলেন তাঁর নিজস্ব তত্বতে—আমাদের সৌরমণ্ডলে সূর্যই একমাত্র নক্ষত্র যা তার নিজের অবস্থানে স্থির দাঁড়িয়ে আছে, এবং পৃথিবীসহ অন্যান্য গ্রহ তার চারপাশে নিজ নিজ বৃত্তপথে প্রদক্ষিণ করে একটি নির্দিষ্ট নিয়ম ও শৃংখলার সঙ্গে। তাঁর এই দুঃসাহসী তত্বটি এককথায় সম্পূর্ণ উত্‌খাত্‌ করে দেয় টলেমি, পাইথাগরাস আর এরিস্টটোলের বহুদিনের সযত্নে লালিত ভূকেন্দ্রিক তত্বকে। যে বছর তাঁর যুগান্তকারি তত্বসম্বলিত গ্রন্থ (১৫৪৩)প্রকাশলাভ করে ঠিক সেবছরই তিনি ইহলোক ত্যাগ করেন। ভাগ্যবান লোক। নইলে কপালে অনেক দুঃখ ছিল।

প্রায় একই সময় আরো দুচারটে অলক্ষুনে ঘটনা ঘটে ইউরোপে যাতে রোমের ধর্মীয় সিংহাসন একটু কেঁপে উঠতে শুরু করে। প্রথম বড় ধাক্কাটা আসে তাদের নিজেদেরই এক পাদ্রীর কাছ থেকে—মার্টিন লুথার (১৪৮৩-১৫৪৬) নামক এক ‘কুলাঙ্গার’। জার্মানির আইলবোনে তাঁর জন্ম, ১৫০৭ সালে অগাস্টানিয়ান মনাস্টারি থেকে তাঁর সন্ন্যাসত্ব প্রাপ্তি, এবং তার বছর পাঁচেক পর উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বোচ্চ ডিগ্রিলাভের ফলে বাইবেলবিষয়ক শাস্ত্রাদিতে অধ্যাপনার পদে নিযুক্তি।

অধ্যাপনা জীবনের প্রথম চারবছর তাঁর কেটেছিল বহু অন্তর্দ্বন্দ আর প্রশ্নজিজ্ঞাসার মধ্য দিয়ে, চরম মানসিক বিবর্তন ও মৌলিক সংশয়চিন্তায়। তাঁর মন বুঝতে চেষ্টা করে বিশ্বজগতে ঈশ্বরের যথার্থ প্রকৃতি কি, কি’ইবা চার্চের ভূমিকা, কেন মানুষের জীবন এমন আষ্ঠেপৃষ্ঠে বাঁধা চার্চের সীমাহীন বিধিনিষেধের বেড়াজালে, সেসব প্রশ্নও। ঈশ্বর সম্পর্কে তাঁর নিজের চিন্তাভাবনা আর ক্যাথলিক চার্চের গতানুগতিক দৃষ্টিভঙ্গির যোজন যোজন দূরত্ব সৃষ্টি হয়ে যাচ্ছিল ক্রমেই। সাথে সাথে আরো একটি যন্ত্রণার মধ্যে আজীবন বন্দী ছিলেন তিনি—কোষ্ঠকাঠিন্য। হাসি পাবে জানি, কিন্তু সমস্যাটি এতই গুরুতর ছিল তাঁর বেলায় যে মার্টিন লুথারকে নিয়ে যত বইপুস্তক প্রকাশ হয়েছে এযাবত তার প্রায় প্রত্যেকটিতেই এই সমস্যাটির উল্লেখ আছে। এমনও দাবি করেন কোন কোন লেখক যে লুথারের বড় বড় আইডিয়াগুলো শৌচাগারের নির্জনতায় ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থাকার কালেই তাঁর মাথায় উদয় হয়। যাই হোক, তিনি তাঁর সংশয়ী মনের নানা প্রশ্নকে কিছুতেই নিজের মধ্যে চেপে রাখতে পারলেন না। ১৫১৭ সালে উইটেনবার্গের চার্চে একদিন প্রকাশ্যে রোমের বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযোগগুলো একে একে লিপিবদ্ধ করে ঘোষণা করে দিলেন। অর্থাত্‌ চার্চের কৃষ্ণ বেড়াল তখন থলের অন্ধকার থেকে মুক্তি লাভ করে বহিরাঙ্গনে আবির্ভূত। সে ধাক্কার জের সামলাতে না সামলাতেই ইংল্যাণ্ডে লেগে গেল আরেক ফ্যাকরা—বিয়েপাগল রাজা অষ্টম হেনরি ১৫৩০ সালে পোপের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে নিজেই একটি আলাদা ধর্ম সৃষ্টি করে ফেললেন, এবং সেধর্মের প্রধান নিযুক্ত করলেন নিজেকেই। এর নাম হল চার্চ অব ইংল্যাণ্ড। পরপর দু’টি বড় বড় ‘ধর্মবিরোধী’ ঘটনা ঘটে যাওয়াতে চার্চকে এবার নড়েচড়ে বসতে হল। আর চুপ করে থাকা যায়না।

বলতে গেলে চার্চের শক্তহস্ত দমননীতি শুরু হয়ে গেল ১৫৪৩ এর অব্যবহিত পরই। কপার্নিকাস মরে গিয়ে বেঁচে গেলেন। বাঁচেননি বেচারা ব্রুনো নিয়ার্ডিনো।