মুহাম্মদ (শিক্ষানবিস) ইট হ্যাপেন ওয়ান নাইট লেখার অনেক আগেই আমাকে জানান দিয়েছিলো তার জ্যোতির্বিদ হবার স্বপ্নের কথা। আইইউটির বোরিং বোরিং রাতগুলোর একটিতে আমি আর ও ল্যাম্পপোস্টের হলুদ আলোর নীচে বসে জীবন নিয়ে চিন্তা করছিলাম- ঠিক তখনই। প্রকৌশলী থেকে কেউ পদার্থবিজ্ঞানী হতে চাইবে এটা আমার মতো প্রকৌশলীর ভাবনার অতীত কিন্তু মুহাম্মদ ভেবেছিল এবং আমরা সবাই জানতাম একবার যখন ভেবে ফেলেছে তখন ব্যাটা হয়েই যাবে।

ফোর্থ ইয়ারে আমরা প্রজেক্ট নিলাম জ্যোতিপদার্থবিজ্ঞানের উপর। আমার কাছে বিষয়টা কতোগুলো ইকুয়েশন আর কঠিন কঠিন ম্যাথ ছাড়া আর কিছুই না, কিন্তু মুহাম্মদের কাছে অপরীসীম আনন্দের ব্যপার। বের হয়ে আসার আগে আমরা যেদিন প্রেজেণ্টেশন দিলাম, তখন মুহাম্মদের কষ্ঠের অসংখ্য সিমুলেশন, গ্রাফ, ডাটা দেখে অলটাইম কোপ মারার জন্য রেডি থাকা একস্যার পর্যন্ত উঠে দাঁড়িয়ে হাত তালি দিলেন। আর সবগ্রুপ তার মুখ তালিইই পেয়েছিলো শুধু।

কানাডায় যাবার জন্য ভার্সিটি প্রফেসরদের মেইল করতে হয়, তিনি কোনও ছাত্র নিবেন কীনা জানার উদ্দেশ্য। মুহাম্মদ মেইল করা শুরু করেছিল অন্য সবার সাথেই। এবং একদিন সকালে হঠাৎ আমাদের ব্লকে চিৎকার শুরু হয়ে গেলো, মুহাম্মদকে এলবার্টার এক প্রফেসর খুব ভালো রিপ্লাই দিয়েছেন। আমরা ধরেই নিলাম ওর হয়ে গেছে। নেটে একভাইয়া মুহাম্মদের জন্য সমবেদনা জানালেন, কারণ এলবার্টায় নাকি প্রচুর শীত। তাদের এক স্যার মাস্টার্স করেই শীতের চোটে দেশে চলে এসেছিলেন, পিএইচডি প্রোগ্রামে ভর্তি না হয়ে।

তারপর নিকুঞ্জে থাকা শুরু হলো। মুহাম্মদ আইএলটিএস দিলো। কী মনে করে আমিও দিলাম। এলবার্টায় কাগজ পাঠানো হলো। প্রফেসরের সাথে ওর তখনও যোগাযোগ চলছে। এলবার্টায় যেহেতু হয়েই যাবে তাই মুহাম্মদ আর তেমন কোথাও এপ্লাই না করে উঁচু এবং বিশাল ফাটাফাটি একটা স্কলারশীপে নামমাত্র এপ্লাই করলো- হবে না তাও করি, এইটাইপ আর কী।

এবং একদিন দুপুরে হঠাৎ এলবার্টা থেকে মেইল আসলো ওরা প্রিলিমিনারী সিলেকশনেই মুহাম্মদকে অযোগ্য ঘোষণা করেছে। খুব সম্ভবত বিএসসি লাইফে ওর পদার্থবিজ্ঞানের ক্রেডিট কম বলে। মুহাম্মদের প্রফেসর সমবেদনামূলক মেইল করলো। এবং ধূম করে মুহাম্মদের সব স্বপ্ন ধোঁয়াটে হয়ে গেলো।

এমনই একসময় আমরা ওর বাসার পাশের চায়ের দোকানের গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা ল্যাম্পপোস্টের কাছে প্রার্থনা শুরু করলাম। প্রার্থনার বিষয়বস্তু, মুহাম্মদ যেন তার আরেক অপসন ইরাসমাস মুন্ডুস স্কলারশীপটা পায়। এই স্কলারশীপ প্রোগ্রামের নাম এস্ট্রোমুণ্ডুস। মুহাম্মদ জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপর দুইবছরের মাস্টার্স করবে ইউরোপের চারটা দেশে- অস্ট্রিয়া, ইতালী, জার্মানী আর সার্বিয়া।

ল্যাম্পপোস্ট বেচারা আজীবন মানুষের সর্দি ছাড়া আর কিছু পায়নি, আমাদের প্রার্থনা পেয়ে সে আবেগে ইমোশোনাল হয়ে গেলো। সে প্রার্থনা কবুল করে ফেললো। কিন্তু নবিস হলে যা হয়, ইরাসমাস থেকে মেইল আসলো মুহাম্মদের পাশের বেডের তাওসীফের কাছে, সে ইরাসমাস মুণ্ডুস পেয়েছে। মিস ফায়ার।

তারপর আমরা ল্যাম্পপোস্টের কাছে যেয়ে বললাম সে ভুল করেছে। ব্যাপারটা যেনো আরেকবার দেখে। এরই মাঝে মুহাম্মদের কাছে মেইল আসলো, এস্ট্রোমুণ্ডুস স্কলারশীপ এবার ননইয়রোপীয়ান সবগুলো দেশ থেকে মাত্র দশজনকে দেওয়া হবে। ওরা পঞ্চাশজনের একটা লিস্ট সিলেক্ট করেছে, মুহাম্মদ সেই লিস্টে থাকলেও দশজনের মধ্যে নেই। তবে ও চাইলে নিজের টাকা দিয়ে প্রোগ্রামে অংশগ্রহণ করতে পারে।

বিশাল বিশাল টাকার ব্যপার। একবার আমরা ভাবলাম সাহায্য চাই পোস্টার তৈরী করে সারাদেশে ক্যাম্পেইন করবো কীনা, কিন্তু তারপরই মনে পড়লো ল্যাম্পপোস্টের কথা। দেখা যাক, সে কদ্দুর কী করতে পারে।

এবং তারও অনেক অনেকদিন পর আজকে দুপুরে হঠাৎ একটি মেইল আসলো মুহাম্মদের কাছে। সে ওয়েটিং লিস্টের এক নম্বরে ছিল। নির্বাচিত দশজনের মধ্যে একজন কোনও কারণে ভর্তি হবেনা, তাই সে স্কলারশীপের জন্য মনোনীত হয়েছে।

সাবাস মুহাম্মদ। আমরা জানতাম তুই পারবি এবং পারলিই। তবে ভুলে যাইস না, সকল প্রশংসা কিন্তু ল্যাম্পপোস্টের 😉