আমি জানি ছেলেবেলা থেকেই যে খুব একটা সুন্দরী ছিলাম না, তবু কেনো জানি আয়নায় ঘুরে ফিরে নিজকে দেখতাম। এক দিন ভর দুপুরে, তখন আমি ক্লাস এইটে হবে যদ্দুর মনে হয়। আমার ভাইয়ের বন্ধু গেইটে শব্দ করলো। আমি বের হবার পরে আমার হাতে একটা বই দিয়ে বলল
– তোমার ভাইকে দিও – চলে গেলো।

আমি বইএর পোকা। উৎসাহিত হয়ে বই নাড়াচাড়া করতে লাগলাম। হঠাৎ টুক করে মাটীতে পড়লো। কি ভেবে কাগজটা খুলতেই চক্ষু চড়কগাছ !
আরে এ যে আমাকেই চিঠি দিয়েছে। খুলে পড়লাম , চিঠির সুন্দর ভাষা ! আমার চুল, চোখ, হাসি সব নাকি তার বুক তোলপাড় করে। ভাগ্যিস চিঠিটা মেজ ভাইয়ের হাতে পড়েনি। দুরুদুরু বুক। কাকে কি বলবো। চিঠিটা কোথায় লুকাব, বুঝতে না পেরে ছিঁড়ে ফেললাম। কুটিকুটি করে হাওয়ায় উড়িয়ে দিলাম। এর পর থেকে কতজনের চিঠি যে পেলাম হিসেব পাইনা। এক-এক জনের এক এক ভাষা – কাজল টানা চোখ, হরিণের মতো চোখ। আসলে আমি কেমন নিজেও বুঝতে পারিনা।
সব চিঠিই হাওয়ায় উড়িয়ে দিতাম। এমন প্রেম, এমন ভালবাসা আমাকে টানতোনা। হয়ত নিজেই তার জন্য দায়ী — মনটা কিন্তু উদাস হয়ে যেত। কোথায় যেন পড়েছিলাম”পৃথিবীতে যোগ্য স্থান ও আছে যোগ্য মানুষও আছে, কিন্তু যোগ্য মানুষের সাথে যোগ্য স্থানে দেখা হয় কদাচিৎ” আমার বেলায় ও হয়তো তাই হয়েছিল।
সবাইকে কেমন নির্বোধ আর বোকা লাগত। আর নির্বোধ মানুষ আমার একদম ভাললাগে না। আসলে নিজেই বেকুব ছিলাম আর নির্বোধ ছিলাম।

আজ সে সব স্মৃতি হয়ে গেছে। তবু স্মৃতি গুলো মুছে ফেলতে পারিনি। মনুষ্য চরিত্র বড়ই অদ্ভুত। মা বলত ‘কুলের বিচি খেলে যেনো পেটে না যায় গাছ হবে ‘ – সারাদিন ভয়ে ভয়ে থাকতাম , যদি গাছ হয় পেটে।

স্নান ঘরে ঢুকলে কতো কথায়ই না মনে পড়ে। এক বিচিত্র ব্যাপার! অবাক হয়ে যাই। কবিতার লাইন মনে আসে ,গল্প লেখার উপাদান খুঁজে পাই।
মাঝে মধ্যে ইচ্ছে করে কাগজ কলম নিয়ে স্নান ঘরে ঢুকি। যখন মনে হবে , টুক করে লিখে ফেলবো, নাহলে হয়ত নাহলে সব ভুলে যাবো।

–ভুলে যাওয়া আর এক পুরনো অসুখ আমার । মানুষ চিনতে না পারা আমার বিরাট দোষ ।

একদিন নিউমার্কেটে একজন হাতছানি দিয়ে আমায় ইশারা করলো। আমি দাঁড়িয়ে ভ্রু কুঁচকালাম। বুঝতে পারছিলাম এ ছাড়া সে মানুষটার উপায় ছিল না। অনেক ভিড়ে সে অনেক দূরে ছিল। কাছে এলো হাঁপাতে হাঁপাতে ।
–তুমি এ ভাবে তাকিয়ে কেনো ?
আমার ভ্রু তখনো কুঁচকানো ছিল, অনিচ্ছায় হাসলাম।
–আমি মুনির –এক গাল হেঁসে বললো
–আমি চিনতে পারলাম নাতো ?
মনেই পড়ছেনা – তবু হাসলাম ( চিনতে পারিনি তখনো )
–ওহ! বুঝেছি আমি অনেক মোটা হয়ে গেছি তাই না ? এই বলে চশমাটা খুলে ফেললো –।
–ওঃ তাই কেমন আছো ? পেছনের সীটে বসতো মুনির, কথাও খুব কম হয়েছে।
মনে পড়ার মতো তেমন কিছু ই ছিলো না।

বিয়ে মানুষের জীবনকে কতো বদলে দেয়। আগে মনে হত বিয়ে মানেই মুক্তি ।
বিয়ে মানেই স্বাধীন কবুতরের মত উড়ে বেড়ানো , ওখানে কেউ বাধা দেবে না। কেউ রাত করে এলে চোখ রাঙ্গাবেনা।
অথচ বিয়ে আমার আমিত্ব কে বদলিয়ে দিতে শুরু করল। নতুন নতুন বিধিনিষেধ আমার জীবনকে যেনো বিবর্ণ করে দিলো। সেই সব রঙ্গীন স্বপ্ন , সেই সংসদ ভবনের লেকের পাড়ে বসে পা ডোবানো । সব স্বপ্ন আস্তে আস্তে মলিন হতে শুরু করল।
প্রথম দিকটা ভালই কেটেছিল আমার। কোল জুড়ে বাচ্চাটা আসার পরে বদলে গেল দৃশ্যপট। স্বামী থাকেন কাজে সারাদিন বাইরে ।
দু/তিন বছর শ্বশুর বাড়ি ছিলাম দু’জনা। শ্বশুরের ইচ্ছেতেই ঢাকায় বাড়ি নিলাম।
নতুন সংসার নতুন হাড়ি পাতিল , সোফা আলমিরা।
সংসারিক কাজে আনাড়ি আমি সারাজীবন। মা বড় বোন একজন দক্ষ রাঁধুনী দিয়েছিল। বাচ্চাটা সহ বলতে গেলে একঘেয়ে জীবনটা কাটাতে লাগলাম।

মাঝে মাঝে দুপুরে ঝিমুনি আসে। কাজের মহিলার নাম আয়েশা। ওকে বুয়া বলে ডাকি। ডাকতে ডাকতে একদিন ওর নামটাই ভুলে গেলাম। ঢাকা শহরে সবাই কাজের মানুষদের বুয়া বলে ডাকে। আমিই বা তার ব্যতিক্রম হব কেনো। নির্জণ দুপুরে বুয়াকে বলি ,
–তোমার জীবনের কথা বল –
ও কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলতে শুরু করে, অনেক ঘটনা।
স্বামী পরকীয়া প্রেম অতঃপর এক বিছানায় দেখে। সে স্বামীর ঘর ছেড়ে দেয় চিরদিনের জন্য ।
[ চলবে ]