এক নাস্তিক পুত্রের নিকট পিতার পত্র।
-মোকছেদ আলী*

(ধরুন, আপনার পিতাকে আপনি আপনার মুক্তবুদ্ধির চর্চার কথা জানিয়ে ধর্মীয় কর্মাদীর অসারতার বিষয় উল্লেখ করে একটি চিঠি দিয়েছেন। আপনার চিঠির জবাবে আপনার পিতা ধর্র্মীয় উপদেশমূলক নিম্নের চিঠিটি আপনার নিকট প্রেরণ করলেন। এখন আপনি পিতার চিঠির জবাব কিভাবে দিবেন? ভাবুন এবং যুক্তিবাদী উত্তর দেবার চিন্তা করুন)

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
দোয়াবরেষু,
আমার কলেজার টুকরা, স্নেহের পুত্তলী, নয়নের মনি, আমার বংশের উজ্জ্বল রত্ন, আত্মীয়-স্বজনের আদরের বাবা …., আমার দোয়া নিও। তোমার তারিখবিহীন পত্রখানা গত ১২-১১-৮৮ তারিখে পাইয়া যৎপরোনাস্তি খুশী হইয়াছি। তোমার সুন্দর হস্তলেখায়, তোমার মনের কথা অকপটে লিখিয়াছ, তাহা পড়িয়া খুব আনন্দিত হইয়াছি। দোয়া করি সর্বশক্তিমান, পরমদাতা ও দয়ালু আল্লাহপাক তোমাকে প্রকৃত জ্ঞান দান করুন। তোমাকে দীর্ঘজীবী করুন। আর্তের সেবায়, মানব কল্যাণের সুমহান ব্রতে ব্রতী করুন। তোমাকে হেদায়েত করুন। ন্যায় ও সত্যের পথে সাহসের সহিত বীরের মত চলিবার তৌফিক দান করুন।
তুমি লিখিয়াছ, “আব্বা আমি ধর্মান্ধ নই, এটার নিশ্চয়তা দিতে পারি।” পড়িয়া খুব প্রীতি লাভ করিলাম। আমার সন্তান যে ধর্মান্ধ হইতে পারে না, এটা আমি আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করি।
তুমি লিখিয়াছ, “আমার ছোটবেলা থেকে ইসলামের প্রতি ঝোঁক ছিল। নামাজ পড়েছি, কোরানের কিছু অংশ হেফজ করেছি, রোজাও নিয়মিত পালন করেছি, ঘন্টার পর ঘন্টা মসজিদে কাটিয়েছি, ‘তাজকেরাতুল আউলিয়া’ পড়ে তাঁদের মত হতে চেয়েছি, তাবলীগ জামাতও করেছি, এমন কি আবেগের বশবর্তী হয়ে ইসলাম সব কিছুর সমাধান দিতে পারে মনে করে শিবিরও করেছি, কিন্তু কিছুই লাভ হয়নি। আমি এসবের প্রকৃত অর্থ খুঁজে পাইনি।”
তোমার এইসব কর্মকান্ডের কথা আমি জানিতাম এবং তাহার জন্য আমি আনন্দিত হইতাম। তোমার এইসব ক্রিয়াকলাপ দেখিয়া আত্মগৌরব করিয়াছি। তোমার গর্ভধারিণী জননীও তোমার ক্রিয়াকলাপে খুব খুশী হইত। তাহার সব সন্তানের মধ্যে তুমি যে তাহার কত বেশী প্রিয়, সেই কথা সে কথায় কথায় বলিত। আমিও খুব খুশী হইতাম।
তুমি লিখিয়াছ, “ইসলামের এসব ক্রিয়াকলাপ পালনে আমার কোন লাভ হয়নি, এসবের অর্থ আমি খুঁজে পাইনি।”
না পাওয়ার কারণ কি? সেটা কি তুমি কখনও খুঁজিয়া দেখিয়াছ? দেখ নাই। দেখিলে অবশ্যই এর প্রকৃত অর্থ বা মর্ম অবগত হইতে পারিতে। তুমি তাজকেরাতুল আউলিয়া গ্রন্থ পড়িয়াছ, তাহাদের মত হইতে চাইয়াছ, কিন্ত হইতে পার নাই কেন? এহিয়া আল উলুমের মত দর্শন শাস্ত্রের প্রণেতা ইমাম গাজ্জালী, তাফহিমুল কোরানের রচয়িতা আল-কোরানের ভাষ্যকার মনীষী সাইদ আবুল আলা মওদুদী, শেখ সাদী, রুমী, ইকবাল, প্রভৃতি লক্ষ লক্ষ মুসলীম মনীষীগণ কি তোমার চেয়ে কম জ্ঞানী ছিলেন? নিশ্চয়ই ছিলেন না।
শোন, মানুষের এক প্রকার রোগ হয়, তাহার নাম ‘কামলা রোগ’। এই রোগে আক্রান্ত রুগীরা সবকিছুই হলুদ বর্ণ দেখে। এখন বলতো, দোষটা কি বস্তুগুলির যে দুনিয়ার সব রং রাতারাতি হলুদ হইয়া গিয়াছে? নাকি রোগাক্রান্ত ব্যক্তির দৃষ্টিভ্রম? কোনটা?
আচ্ছা দেখ, দুধ সাদা তরল বস্তু, যে কোনদিন দুধ লইয়া গবেষণা করে নাই, সে কী করিয়া বুঝিবে যে দুধের মধ্যে মুল্যবান ঘৃত, মাখন, পনির, ছানা, ননী, ক্রীম লুক্কায়িত আছে। যদি কেহ তাহাকে বলে যে, দুধের মধ্যে এইসব মুল্যবান বস্তু নিহিত আছে সে কি বিশ্বাস করিবে? করিবে না। যদি সে ঘোষের নিকট কিছুদিন থাকিয়া দুধকে মন্থন করিয়া এই মুল্যবান বস্তু প্রস্তুত প্রণালী শিক্ষা করে, তবে কি আর সে অবিশ্বাস করিবে? কখনই না।
আলকাতরার ভিতর যেসব রকম রং লুকাইয়া আছে, চিনি হইতে ৬০০ গুণ মিষ্টি স্যাকারিন রহিয়াছে, যে এর ভিতর হইতে এই সব পদার্থ প্রস্তুত প্রণালী আয়ত্ব করে নাই, সে তো বলিবেই- “আলকাতরা নাড়িলাম, দেখিলাম, কৈ এইসব তো পাইলাম না।” তাহার এই অযোগ্যতার দরুণ কি আলকাতরার এই গুণ রহিত থাকিবে?
আখের ভিতর যে চিনি, গুড়, মিছরী, লজেন্স, চিটা, আবার দেখ চিটার ভিতর মুল্যবান স্পিরিট, বিয়ার, ব্রান্ডি প্রভৃতি মুল্যবান ওয়াইন লুকানো আছে, তাহা কি যে ঐ গুলি আখের ভিতর হইতে বিচ্ছিন্ন করিবার প্রণালী অবগত নহে, সে কি বিশ্বাস করিবে? করিবে না।
আবার দেখ চক্ষু দিয়া দেখিলে দেখা হয় না, তাহার সহিত মনোসংযোগ থাকা চাই। তুমি একটি বস্তুর প্রতি দৃষ্টি দিয়াছ সত্য কিন্তু তোমার খেয়াল বা কল্পনা যদি বহুদূরের উপর যায় তবে চোখের সামনের বস্তুকে দেখা যায় না। দূরের বস্তু চোখের সামনে না থাকিলেও তাহা স্পষ্ট দেখা যায়। তুমি দুরে আছ, তুমি তোমার দৃষ্টি দিয়া খেয়ালে তোমার মায়ের শুকনা মুখখানার দিকে মনোসংযোগ করো, পরিস্কার দেখিবে তোমার জননীর মুখ। কিন্তু তোমার নিকটে হাত থাকিতেও তাহা দেখিবে না। আবার চিন্তা করো চোখ দিয়া সব কিছু দৃশ্যমান বস্তু দেখ, কিন্তু চোখ দিয়া চোখ দেখা যায় না। চোখের অতি নিকটে নাক, মুখমন্ডল দেখা যায় না। কিন্তু যদি আয়নার সামনে দাঁড়াও তবে সব দেখা যায়। এই আয়না জ্ঞানের দ্বারা প্রস্তুত করিতে হয়। সেই জ্ঞান অর্জন না করা পর্যন্ত চোখ, চোখকে দেখিতে পারিবে না।
তুমি ইসলামের মর্ম অবগত হইতে পারো নাই, কারণ তুমি গভীর মনোযোগ দিয়া মর্ম অবগত হইতে চেষ্টা করো নাই। নামাজ পড়িয়াছ সত্য, কিন্তু হুজুরীদেলে কি নামাজ আদায় করিয়াছ? করো নাই। করিলে ইহার মর্ম অবগত হইতে পারিতে, তোমার লাভ হইত। কবি বলিয়াছেন-
ও নামাজি, নামাজ পড় নামাজে কি রাখো ডর,
যে নামাজে পার হইবা সে নামাজ কোথায় তোমার?
জায়নামাজে হইয়াছ খাড়া,
দৌড় দিল মনের ঘোড়া
আজাজিল হইয়াছে ছোয়ার,
যে নামাজে পার হইবা, সে নামাজ কোথায় তোমার।
তাহা হইলে বুঝিতে পারিতেছ দুধের মধ্যে অমুল্য রতন রহিয়াছে, সেটা বিশ্লেষণ করিবার চেষ্টা করো নাই, তাই দুধকে তরল বস্তুই দেখিয়াছ। তাই বলিয়া কি দুধ এই গুণ বর্জ্জিত? কখনই না। আলকাতরা বিশ্লেষণ করিতে শেখো দেখিবে কত অপুর্ব রং, স্যাকারিন রহিয়াছে। রোজা করিয়াছ, কিন্তু গভীর আত্ম-বিশ্বাসের সহিত রোজার প্রকৃত তাৎপর্য উপলব্ধি করিতে পারো নাই। ইহার যে অপূর্ব স্বাদ রহিয়াছে, তাহা আস্বাদন তোমার ভাগ্যে হয় নাই।
আখকে একটা লাঠিরুপে দেখিয়াছ, ইহার ভিতর যে কত বস্তু রহিয়াছে তাহা বিশ্বাস করিতে পারো নাই। কারণ বিশ্লেষণ করার যোগ্যতা অর্জন করিতে পারো নাই। যদি বিশ্লেষণ করিবার জ্ঞান অর্জন করিতে তবেই বুঝিতে পারিতে ইহার মর্ম। তাবলীগ জামাত করিয়াছ সত্য। কিন্তু হয়ত এমন সব লোকের সহিত যাপন করিয়াছ যাহাদের প্রকৃত জ্ঞান ছিল না। তাহারা তোমাকে প্রকৃত জ্ঞান দিতে পারে নাই। কিংবা তাহাদের জ্ঞান ধারণ করিবার মতো তোমার হৃদয় যোগ্য করিয়া তুলিতে পারো নাই। যদি পারিতে তবে তুমি এই কথা বলিতে না যে, কোন লাভ হয় নাই।
একটা উদাহরণ দেই- মিঃ ‘এ’-র নিকট ৫০০ টাকার দুই খানা নোট আছে। সে খুব আত্মতৃপ্তিতে ভাবিল, আমি হাজার টাকার মালিক। আর মিঃ ‘বি’-এর নিকট ৫০০ টাকার একটি নোট আছে। উভয়ে একসঙ্গে দোকানীর নিকট পণ্য খরিদ করিল। ‘এ’ করিল এক হাজার টাকার পণ্য খরিদ। সে জানে তাহার নিকট হাজার টাকাই আছে। মূল্য পরিশোধ করিবার সময় দেখা গেল ৫০০ টাকার নোট দুইখানা জাল, মেকি অচল। আর ‘বি’-এর নিকট ৫০০ টাকার নোটটি খাঁটি। এখন বলতো, পণ্য বিক্রেতা কাহাকে পণ্য দিবে? নিশ্চয়ই ৫০০ টাকাওয়ালাই পণ্য পাইবে। হাজার টাকাওয়ালা অন্ধের মত, যাচাই না করিয়া নোট গ্রহণ করিয়াছিল, কিন্তু কাজের বেলায়, প্রয়োজনে তাহা কোন কাজেই লাগিল না। অথচ ধরা পড়িবার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত সে খুব আত্মতৃপ্তি লাভ করিতেছিল। তোমার অবস্থাও আজ সেই পর্যায়ে পড়িয়াছে। তুমি মেকী জ্ঞান অর্জন করিয়া আত্মতৃপ্তি অনুভব করিতেছ। নিজের মনে ভাবিতেছ- মুসলীম মনীষীদের চেয়ে আমার জ্ঞান অগাধ। কিন্তু প্রয়োজনের বেলায় দেখা যাচ্ছে ঠন্ ঠন্, তাই না বাজান? দোয়া করি, সর্বজ্ঞানের স্রষ্টা তোমাকে প্রকৃত জ্ঞান দান করুন। আমিন।
তুমি লিখিয়াছ- ‘ইসলাম সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে ভেবে শিবির করেছি। কিন্তু সমাধান পাই নাই, লাভ হয় নাই।’ আসলে তুমি শিবিরকে বুঝিতে চেষ্টা করো নাই। অথবা শিবিরের যেসব যুবকেরা সাদা বকের মত পায়জামা পাঞ্জাবী টুপি পরিয়া মনে করে, ‘আমরাই প্রকৃত চিন্তাবিদ’; তুমি তাহাদের সঙ্গ পাইয়াছ। আসলে তাহারাও তোমার মতই মেকী জ্ঞানের অধিকারী। প্রকৃত জ্ঞানী আলেমের সোহবতে থাকিয়া যদি আসল ইসলামী জ্ঞান অর্জন করিতে, তবে স্পষ্ট দেখিতে পাইতে যে, সত্য সত্যই ইসলামী জ্ঞান সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে। অথবা নিজ স্বার্থান্বেষী কোন রাজনৈতিক ব্যক্তি নিজ স্বার্থকে হাসিল করিবার জন্য ইসলামের নামে তোমাদের মতো কোমলমতি ছেলেদের ইসলামী জ্ঞানের নামে মেকী জ্ঞান দান করিয়া তোমাদের ব্যবহার করিতেছে। প্রকৃত ইসলামী জ্ঞান সব হজম করিতে পারে, কিন্তু শিবির হজম না করিয়া নিজেরাই হজম হইতেছে কেন? এ বিষয়ে গভীরভাবে অনুসন্ধান করিয়া দেখ, কোথায় গলদ। গলদা চিংড়ীর মত শুধু লম্বা লম্বা দাঁড়ি রাখিয়া মাথায় চোখা করাৎ রাখিয়া ভয়ংকর রূপ ধারণ করিলেই তো আর ইসলামী জ্ঞান কায়েম হয় না। ইসলামের জন্য সাহস, ধৈর্য্য, সহনশীলতার প্রয়োজন।
দেখো, চমকপ্রদ বাক্য কহিয়া, স্বাস্থ্যবান শিশুর ছবি দিয়া, খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়া বিলাতী দুধ প্রস্তুতকারকেরা জনসাধারণকে ধোঁকা দেয়, আসলে ঐসব যবের আটা কি প্রকৃত মায়ের দুধের সমান শক্তিশালী হয়? মেকী দুধ খাওয়াইয়া কি প্রকৃত স্বাস্থ্যবান করা যায় শিশুকে? তোমার বড় ভাইকে কত কৌটা বিলাতী দুধ খাওয়াইয়াছি, আজো সেসব গ্ল্যাক্সো, অষ্টার মিল্ক, কারেক্স, ডানোর খালি কৌটা তোমার মায়ের ঘরে মজুত আছে। কিন্তু তোমার ভাইবোনদের মধ্যে বড়জনের স্বাস্থ্য সবার চেয়ে কৃশ। যখন আমার বোধোদয় হইল, তখন তোমার মেজ ভাইকে চমৎকার বিজ্ঞাপনের স্বাস্থ্যবান শিশুর ছবি পেপারে দেখিয়া বিভ্রান্ত না হইয়া তোমার মায়ের স্তনের খাঁটি দুধই খাওয়াইয়াছি। তোমাদের ভাইবোনদের স্বাস্থ্য বিলাতি দুধখোর তোমার বড় ভাইয়ের চেয়ে অনেক অনেক ভাল। আমার মনে হয়, তুমি যে-শিবিরের কথা বলিয়াছ তাহাদের নেতৃবৃন্দ চমৎকার বাক্য কহিয়া তোমাদের বিভ্রান্ত করিয়াছে, যাহার জন্য তুমি ইসলাম যে সব সমস্যার সমাধান দিতে পারে সেটা খুঁজিয়া পাও নাই। জানি না এর গুরুতত্ত্ব কোথায়? দেখো জ্ঞানের বিভিন্ন শাখা আছে। এর প্রত্যেক শাখায় বিচরণ করো, প্রকৃত জ্ঞান অর্জন হইবে। তখন আত্মার তৃপ্তি পাইবে।
আচ্ছা বলত, একটা স্বচ্ছ কাচের বোতলে মধু আছে। তুমি বেশ দেখিতে পাইতেছ মধু। কিন্তু ছিপি না খুলিয়া যদি বোতলের গাত্র লেহন করো তবে কি মধুর স্বাদ পাইবে? পাইবে না। মধুর প্রকৃত স্বাদ পাইতে হইলে আগে বোতলের ছিপি খোলার কৌশল আয়ত্ব করিতে হইবে। ছিপি খুলিয়া ঢালিলে মধু পাইবে, তারপর লেহন করিলে প্রকৃত স্বাদ আস্বাদন করিতে পারিবে। নচেৎ কোরানের মর্ম তোমার নিকট অনাস্বাদিত মধু যেমন, যুঁথি অনাঘ্রাতার মতই রহিয়া যাইবে।
তুমি লিখিয়াছ- ‘দুর্বোধ্য আরবী ভাষায় কোরান পড়িয়া লাভ কী?’ খুব দামী প্রশ্ন রাখিয়াছ। আচ্ছা দেখতো দুনিয়ার কোন্ ধর্মশাস্ত্র দুর্বোধ্য ভাষায় লেখা হয় নাই? হিন্দুদের বেদ কঠিন সংস্কৃত ভাষায়, বাইবেল কঠিন হিব্রু ভাষায়, ইঞ্জিল গ্রীক ভাষায়, বৌদ্ধদের ত্রিপিটক দুর্বোধ্য পালি ভাষায়, জেন্দাবেস্তা প্রাচীন কঠিন পারসী ভাষায় আর তাওরাত ল্যাটিন ভাষায়, তাই বলিয়া কি অন্য ভাষাভাষী লোকেরা ঐ ধর্মগ্রন্থকে প্রত্যাখান করিয়াছে? করে নাই। আর কোরান তো সহজ সরল আরবী ভাষায়। ভাষা বিজ্ঞানীগণ বলেন, আরবী একমাত্র ভাষা যা অল্প কথায় বেশী ভাব প্রকাশ করা যায়।
তোমার কাছে দুর্বোধ্য হইতে পারে, কারণ তোমার মেধা, তোমার প্রতিভা, তোমার স্মৃতিশক্তি যদি কম থাকে, তাহার জন্য তো ঐ আরবী ভাষা দায়ী নয়। তাই যদি হইত তবে ভাই গিরিশ চন্দ্র কোরানের বাংলা অর্থ প্রকাশ করিতে পারিতেন না। দয়ানন্দ স্বরস্বতী কোরানের হিন্দি অনুবাদ করিতে পারিতেন না। রডওয়েল, সেল, পামার প্রভৃতি ইংরেজী ভাষী মনীষীগণ কোরানের ভাষ্য লিখিতে ব্যর্থ হইতেন। তুমি তো বাংলা ভাষী। তুমি খুব রকমের একটা ভ্রম কথা লিখিয়াছ, ‘বাংলা ভাষায় কোরানের মানে লিখিতে মৌলভীরা ভয় পাই কেন?’ কোনদিন তাহারা ভয় পায় না। যদি পাইত, তবে নজিবর রহমান, মৌলানা আকরাম খাঁ, আব্দুল্লাহ হেল কাফী, আব্দুল হাকিম, আলী হাসান প্রভৃতি বাংলা ভাষী মৌলভীরা কোরানের বাংলা তর্জমা লিখিতেন না। আব্দুল হাকিম, আলী হাসানের কোরানের ভাষ্য পড়িয়া দেখিও, কী অনুপম লেখা! মাওলানা মহিউদ্দিন-এর কোরানের তাফসীর ও ভাষ্য পড়িয়া দেখিও। সাইদ আবুল আলা মৌদুদী উর্দুতে তাফহিমুল কোরান লিখিয়াছেন, উর্দু হইতে বাংলা তরজমা বহু পুর্বেই প্রকাশ হইয়াছে।
আবার দেখ- পন্ডিৎ ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মাইকেল মধুসুদন দত্ত, বঙ্কীমচন্দ্র প্রভৃতি লেখকেরা যে কত কঠিন ভাষায় লিখিয়াছেন, তাহা তো তুমি স্বয়ং বাংলা ভাষী লোক হইয়াও সহজে বুঝিতে পার না। পার কি এ সমস্ত লেখকদের লিখিত পদ্য ও গদ্য কাব্যগুলি? সহজে কি তাহাদের লেখা মানে করিয়া দিতে পারিবে? আচ্ছা মধুসুদন দত্তের মেঘনাদ বধ কাব্যের নিম্নলিখিত কয়েকটি পংক্তির সরল অর্থ করতো শুনি-

“উদিলা আদিত্য তবে উদয় অচলে,
পদ্মপর্নে শুপ্তদেব পদ্মযোনি যেন,
বিকিরণ করে যথা, তেজময় ভানুসিংহ,
আনায় মাঝারে আনি বধে ভিরুচিৎ।
ব্যাধ বীরেন্দ্র কেশরী, কিন্তু সে যবে বধে,
বীর বিক্রমে ধাবি, আপন বিক্রমে।”

অথবা কবি ঈশ্বর চন্দ্রের চন্ডিমঙ্গলের নিম্নলিখিত পংক্তিগুলি-
‘কে বলে ঈশ্বরগুপ্ত ব্যাপ্ত চরাচর, যাহার প্রভায় প্রভা পায় প্রভাকর।’

অথবা, ‘কুকথায় পঞ্চমুখ কন্ঠ ভরা বিষ, কেবল আমার মনে দ্বন্দ অহর্নিশ’।

কিংবা, ‘হরির উপরে হরি হরি বসে তায়, হরিকে দেখিয়া হরি, হরিতে লুকায়’,

কিংবা কবি নজরুলের বিদ্রোহী কবিতার দুইটি চরণের অর্থ কর- ‘আমি ভৃগু, বিশ্ব করিব ছিন্নভিন্ন, আমি ভগবান বুকে একে দেই পদচিহ্ন।’
আমার পন্ডিত আব্বাজান এগুলি তো অতি সহজেই তোমার বোধগম্য হইয়াছে। আমাকে একটু অর্থ করিয়া সহজ সরলভাবে বুঝাইয়া দাওতো তো। ক্যা বাজান, এহুন কোতো ক্যা? খুব পান্ডিত্য অর্জন করেছো বোলে? তাহলে ঐ সব লেখকেরা, তোমার ভাষায় অযৌক্তিক কাব্য রচনা করিয়াছেন। বাজানরে, আগে নাচা শেহ তারপর কইও উঠানডো ব্যাহা।
তুমি চমৎকার যুক্তি দিয়া লিখিয়াছ, “যে আরবী ভাষায় কোরান শরীফ লিখিত হয়েছে, সেই আরবী ভাষা বুঝতে না পারলেও তা পূনঃপৌনিক তেলায়াত করে যাওয়া পূণ্যের ব্যাপার, এই বিশ্বাসও আমার দৃষ্টিতে অযৌক্তিক।” সুন্দর কথা লিখিয়াছ বাজান।
আমার মহামান্য ওয়ালেদ সাহেব মরহুম —— কে দেখিবার সৌভাগ্য তোমার হয় নাই। কোন বাক্য কেহ না বুঝিলে কেহ যদি বলিত, “দাদা তোমার কথা বুঝিতে পারি না, এটা বলা অযৌক্তিক।” তখন তোমার মরহুম পিতামহ জিন্নাত আলী কি বলিতেন তবে শোন-
বলিতেন, কুত্তার প্যাটে কি ঘিও হজম হয়রে, আগে প্যাটটাকে ঠিক কর, তারপর ঘিও খাইস।
আচ্ছা বাজান, এখন কওতো কুত্তা যে ঘি খাইয়া হজম করিতে পারে না, সব পশম উঠিয়া কচ্ছপের পিঠের মতন তেলতেলে হইয়া যায়; এটা কি ঘিয়ের দোষ, নাকি কুকুরের হজম শক্তির দোষ?
আচ্ছা বাজান, কওতো- বোখার হইলে বৈদ্যরা সুস্বাদু পোলাও, কোর্মার ব্যবস্থা না দিয়া তিক্ত ‘পাচন’ কিম্বা ‘কুইনাইন’ বড়ি গিলিতে দেয় কেন? ঐগুলি তো খাদ্য নয়। তবুও পুনঃপৌনিক গিলিতে নির্দেশ দেয় কেন? এর যৌক্তিকতা কোথায়? অবশ্যই আছে, মানবদেহের কষ্টকর বোখার নিরাময়ের প্রয়োজনে তিক্ত দাওয়া গলধঃকরণ করিতে হয়। তদ্রুপ মানব হৃদয়ের অজ্ঞানতারূপ বোখার দূর করিবার জন্য পুনঃপৌনিক কোরানের আয়াত তেলাওয়াত প্রয়োজন।
আমি তোমার পিতা, আমি তোমাকে আদেশ দিতেছি তুমি প্রতিদিন বিশ্বাসের সহিত পবিত্র কোরানের এই কালামটি ১০০০ বার পড়িবে। ১০ দিনের মধ্যে ইহার মূল্য উপলব্ধি করিতে পারিবে। “রাব্বি জেদনী এলমা”।
পিতার আদেশ অমান্য করিবার নির্দেশ পৃথিবীর কোন ধর্মগ্রন্থে নাই, কোন শাস্ত্রেও নাই। হিন্দু মাইথোলজিতে আছে- পরশুরাম তাহার পিতার আদেশে তাহার মাতাকে কুঠারাঘাতে হত্যা করিয়াছিল, সে সময় পরশুরাম কি কথা বলিয়াছিল? বলিয়াছিল- “পিতাহি স্বর্গ, পিতাহি ধর্ম, পিতাহি প্রপদান্তে সর্ব্বদেবতা”
হিস্টরী অব ইউরোপ পড়িয়া দেখিও, বালক ক্যাসাবিয়াংকা, পিতার আদেশ অমান্য হইতে পারে ভাবিয়া জ্বলন্ত আগুনে পুড়িয়া বিশ্বের ইতিহাসে অমর হইয়া রহিল। তাহার স্মৃতির স্মরণে ইউরোপের ক্যাসাবিয়াংকা পোর্ট, বৃহত্তম সামুদ্রিক বন্দর। পিতার আদেশ লঙ্ঘন করা মানেই পিতাকে অস্বীকার করা। হযরত সোলায়মান (আ) বলেন-
“যার কথায় পিতা কিম্বা মায়ের প্রতি অশ্রদ্ধা থাকে, ভীষণ অন্ধকারে তার জীবন্ত বাতি নিভে যায়।
বিবেচনাহীন ছেলে তার পিতার সর্বনাশের কারণ হয়।
জ্ঞানী ছেলে পিতার শাসন মানে, কিন্তু ঠাট্টাবিদ্রুপকারী সংশোধনে কান দেয় না।
অসাড় বিবেক লোক তার পিতার শাসনকে তুচ্ছ করে, কিন্তু সতর্কলোক সংশোধনের কথায় কান দেয়।
ছেলে আমার, তুমি তোমার পিতার উপদেশে কান দাও; তোমার মায়ের দেওয়া শিক্ষা ত্যাগ কোরো না।”
আমার একমাত্র চাচা, আমার আব্বার ছোট ভাই। তাহার একটি মাত্র মেয়ে, নাম সুরতন্নেছা। তাহার পুত্র সন্তান ১৪ টা। মোট ১৫ জন ছেলে মেয়ে। আল্লাহর মহানুগ্রহে তাহারা সবাই জীবিত আছেন। ….. শহর হইতে প্রায় ৩৬ মাইল উত্তর-পশ্চিম কোণে, …… নামক প্রসিদ্ধ বাণিজ্য কেন্দ্র, বৃহত্তম হাটের ২ মাইল উত্তরে ….. গ্রামে তাহারা অবস্থান করিতেছেন।
আমার চাচা তৎকালীন সময়ের মাইনর পাশ। তিনি একদিন একটা চমৎকার কাহিনী বলিয়াছিলেন। কাহিনীটা এইরূপ- কোন এক গ্রামের সাইট্যাল গৃহস্থ, সমাজের প্রধান, মানে পরামানিক। পরামানিক আশে-পাশের কয়েক গ্রামে এলান করিয়া দিলেন, “আমাকে যে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজের যৌক্তিকতা (তোমার লিখিত ভাষায় ছকবাঁধা আনুষ্ঠানিকতা) যে বুঝাতে পারবে আমি তাকে খোদার কসম, পালের রোস্তম নামক বড় ষাড়টা দিয়ে দিব”। ষাড় প্রাপ্তির লোভে বহু মোল্লা-মৌলভী, হাজী, গাজী, পরামানিকের দহলিজে হাজির হইল। লোকজনের ভিড় দেখিয়া তাহার স্ত্রী ও সন্তানেরা ডুকরে কান্দিতে লাগিল। তাহাদের কাঁদিতে দেখিয়া পরামানিক কহিল, “আরে, তোরা সব হুদা হুদা কাঁদোছ ক্যা?” পরামানিকের স্ত্রী বাঁ হাত দিয়া নাকের কফমিশ্রিত পানি (পোটা) ফেলিয়া ধরা গলায় কহিল, “ওগো ঐযে সব লোকজন তোমাকে নামাজ বুঝাইতে আসিয়াছে, এখনি তোমাকে বুঝাইয়া আমাদের আদরের রোস্তমকে লইয়া যাবিনি।” পরামানিক প্রচন্ড এক ধমক দিয়া কহিল, “আরে বেহুদারা হুদা হুদা কান্দিশ না। আমি যদি না বুঝি তয় বুঝায় ক্যাডা?” এবার স্ত্রী, পুত্রেরা হো হো করিয়া হাসিতে লাগিল। বাজান তুমি যদি না বোঝো তয় তোমারে বুঝাইব ক্যাডা?
আমি বাপ, তোমার সুবুদ্ধির জন্য দোয়া করি, মহান মহাজ্ঞানী আল্লাহ বুঝশক্তি দান করুন। তোমাকে হেদায়েত করুন। আমিন। তুমি আরো লিখিয়াছ যে, কঠিন দুর্বোধ্য ভাষায় কুরআন পাঠ করলে বেহেশত যাবার পথ সহজ হবে, এটা তুমি মানিতে পারো নাই। তাহলে, পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই যাহাদের ভাষা ইংরেজী নহে, তাহারা জটিল চিকিৎসা বিদ্যা, ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যা, রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য রাজনৈতিক বিদ্যা ইংরেজী ভাষায় লিখিত মূল্যবান গ্রন্থ সকল পাঠ করিয়া, সেই বিদ্যা কেন তাহারা আয়ত্ব করে? তোমার যুক্তি অনুসারে এসব বিদ্যা যখন ইংরেজী ভাষায় লিখিত. তবে আর ঐ বিদ্যা নিজ মাতৃভাষায় শিক্ষা না করিয়া ইংরেজীতে লেখা গ্রন্থ অধ্যয়ন করা একেবারে অযৌক্তিক। এটা তোমার মারাত্মক ভ্রম। কারণ তুমি অচল নোটের মতই মেকী জ্ঞান অর্জন করিয়াছ। সেইজন্য তুমি এরূপ মারাত্মক ভ্রমের মধ্যে আবদ্ধ রহিয়াছ।
তোমার যুক্তি দিয়াই তোমাকে বলি- ইংরেজ, জার্মান, ফরাসী, রাশিয়ানগণ এক কথায় সমস্ত ইউরোপিয়ান জাতি জ্ঞানে বিজ্ঞানে ও চেহারায় এশিয়া ও আফ্রিকার জাতিসমূহ হইতে অনেক উন্নত। তাই বলিয়া কি আফ্রিকার ও এশিয়ার কৃষ্ণকায় জাতি নিজ ঐতিহ্য ফেলিয়া দিয়া কাকের ময়ূর পুচ্ছের লাগানোর মত হইবে। হইলেও সে যখন ধরা পড়িবে, তখন তাহার স্থান না ময়ুরের দলে, না স্বজাতির দলে। সে তখন নির্বুদ্ধিতার দরুন দুই কূলই হারাইবে। অতএব আপন ঐতিহ্য বজায় রাখিয়া প্রকৃত জ্ঞান অর্জন করো। মনে রাখিও, তোমার ধমনীতে ইসলামের পবিত্র রক্ত প্রবাহিত। সুতরাং সেই রক্তের মর্যাদা রক্ষা করিও প্রকৃত শান্তি পাইবে।
আবার লিখিয়াছ, “আর্ত্তমানবের সেবার জন্য যে সময় দরকার, তা না করে অযথা নামাজ পড়তে গিয়ে সময় নষ্ট করা উচিৎ নয়।” আসলে তুমি ইসলামের প্রকৃত মর্ম বুঝিতে চেষ্টা করো নাই। তাই ভ্রমে পতিত হইয়াছ। ইসলাম তো বাধ্যতামুলক আর্তের সেবার জন্য নির্দেশ দেয়। যাকাত, ফেৎরা, ওশর, সাদকা, দান এসব তো আর্তের, দুস্থের, দুঃখী মানুষের জন্য। সবার জন্য, কল্যাণের জন্য। তোমার আব্বা তো দরিদ্র, কুৎসিত কালো, তাই বলিয়া কি তুমি তাহাকে অস্বীকার করিয়া ধনী, সুন্দর কোনো লোককে পিতা বলিবে? এরূপ সন্তান কি পৃথিবীর ইতিহাসে পাওয়া যায়? যায় না। যদি এরূপ থাকিত তবে দরিদ্র কুৎসিত পিতারা পিতা ডাক শুনিতে পাইত না।
হিন্দু শাস্ত্রে আছে, “স্বধর্মে নিধনং শ্রেয়, পরধর্ম বিষবৎ ত্যাজ্যঃ।” -কথাটা খুবই প্রাণিধানযোগ্য। ইসলাম মানুষের কল্যাণের জন্য যেসব বিধি-বিধান অর্থাৎ শরিয়ত দান করিয়াছে, তাহার মধ্যে চুল পরিমাণ ভ্রান্তি নাই। মানুষের সংসার জীবন, রাষ্ট্রীয়-জীবন, পররাষ্ট্রনীতি, খাদ্য-খাওয়া, পোষাক-পরা, সর্ব বিষয়ের ব্যবসানীতি, শ্রমিকের-মর্যাদা, সবকিছুর সমাধান দিতে পারে। দুধকে মন্থন করো ঘি পাইবে। মরীচীকার পিছনে ধাবিত হইও না। ধাবিত হইলে পানি পাইবে না; তৃষ্ণায় মারা পড়িবে।
তুমি আরো একটা প্রশ্ন রাখিয়াছ, “ভোর চারটার সময় উঠিয়া ঠান্ডা পানি দিয়া অজু করিয়া নামাজ পড়ার স্বার্থকতা কোথায়?” মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য তাহাকে প্রকৃত মনুষ্যত্ব অর্জন করিবার জন্য ভোর ৪ টায় বিছানা ত্যাগ করা যে কত প্রয়োজন, সেটা তোমাকে বিশ্বের বড় বড় মনীষীদের জীবনালেখ্য থেকে কিছু বলিব। আশা করি, তুমি আমার কলেজার টুকরা, গভীর মনোযোগ দিয়া বিচার বিশ্লেষণ করিবে, তবেই বুঝিবে ইসলামের প্রকৃত মাহাত্ম্য।
তাহলে এবার শোন। বিশ্ববিখ্যাত দার্শনিক বিজ্ঞানী লর্ড লিটন বলিয়াছেন-
I was an early riser. Happy the man who is! Early morning day comes to him with virgin love, full of bloom and freshness. I doubt if any man can be called old so long as he is an early riser and early walker.
আল্লাহর দুনিয়ায় যতলোক দীর্ঘজীবী ও চিরস্মরণীয় হইয়াছেন, তাহাদের সকলেই অতি ভোরে বিছানা ত্যাগের জন্য প্রসিদ্ধ ছিলেন। ভোর বেলায় বিছানা ত্যাগ না করিলে সকালবেলার সব কাজ অসম্পন্ন থাকে। আমেরিকার বিখ্যাত দার্শনিক ও রাজনীতিবিদ বেঞ্জামিন ফ্রাংক্লিন বলিয়াছেন, “যে ব্যক্তি আলস্য করিয়া বেলা উঠিলে বিছানা ত্যাগ করে, সে সারাদিন ব্যস্ততার সাথে কাজ করিয়াও তাহা রাত্রেও শেষ করিতে পারে না।” অতি খাঁটি কথা।
দিক বিজয়ী মহাবীর আলেকজান্ডারের শিক্ষাগুরু, গ্রীসদেশীয় দার্শনিক ও বিজ্ঞানবিদ এ্যরিষ্টটল বলিয়াছেন- Early to bed and early to rise, he will be healthy, wealthy and wise. এশার পরে যে শো’য় ও সুবহে সাদিকের সময় ওঠে সে ব্যক্তি স্বাস্থ্যবান, ধনাঢ্য ও জ্ঞানী হয়। অতি চমৎকার কথা।
প্রুশিয়ার (বর্তমান জার্মানী) বিখ্যাত সম্রাট যার উপাধী ছিল ফ্রেডারিক দি গ্রেট, তিনি প্রত্যহ ভোর চারটার সময় উঠিয়া রাজকার্য সকল সম্পাদন করিতেন এবং রাত দশটায় শুইয়া পড়িতেন। তিনি বৃদ্ধ বয়সেও চাকরদিগকে আদেশ দিয়া রাখিয়াছিলেন যে, তাহাকে যেন ভোর চারটায়/পাঁচটায় তুলিয়া দেওয়া হয়।
রুশিয়ার প্রজাবৎসল, দেশহিতৈষী ও বিদ্যুৎসাহী বিখ্যাত সম্রাট পিটার দি গ্রেট হল্যান্ডে জাহাজ নির্মাণ শিল্প শিক্ষা করিবার সময় ভোর চারটার সময় বিছানা ত্যাগ করিতেন। আবার রাজ্য শাসনের সময়ও ভোর চারটার সময় শয্যাত্যাগ করিতেন। জার্মানীর বিখ্যাত চিত্রকর ও রাজনীতিবিদ পিটার পল রুবেল ভোর চারটার সময় উঠিয়া আল্লাহকে ধন্যবাদ দিয়া কিছু সময় প্রাতঃসমীরন সেবন করিয়া তাহার বিখ্যাত চিত্রগুলি অংকন করিতেন, তিনি চিত্রবিদ্যায়, সাহিত্যে ও রাজনীতিতে প্রভুত জ্ঞান অর্জন করিয়াছিলেন, ইউরোপের ইতিহাসে তাঁহার নাম সোনার হরফে লেখা আছে। তিনি বলিয়াছেন, “যে ব্যক্তি সকালে অর্থাৎ সোবহে সাদেকে বিছানায় আলস্য কাটায় সে দিবসের মধ্যে একটি ছিদ্র করিয়া দেয়, যার মধ্য দিয়া দ্রুতগামী ঘন্টাসমুহ পালাইয়া যায়।” মহামূল্যবান কথা।
বিশ্ব বিখ্যাত অমর উপন্যাস ‘ওয়েভালীর’ লেখক স্কটদেশীয় মহাপন্ডিত স্যার ওয়াল্টার স্কট রাত চারটার সময় উঠিয়া নিজ হাতে বাতি জ্বালাইতেন এবং সাহিত্য কর্ম সমাধা করিতেন। ভোজনের নির্দিষ্ট সময় বেলা দশটা পর্যন্ত কার্য করিতেন। এরূপ ভোরে না উঠিলে কি তিনি বিশ্ব সাহিত্য ভান্ডারে এত গ্রন্থ দান করিতে পারিতেন।
আধুনিক ইংরেজ গ্রন্থকার, অতিশয় পরিশ্রমী, সদাশয় এন্টনী ট্র্যালোপ পোষ্ট অফিসে চাকুরী করিতেন। ভোর চারটার সময় উঠিয়া গ্রন্থ লিখিতে শুরু করিতেন। অফিসের সময় না হওয়া পর্যন্ত দ্রুত লেখনি চালাইতেন। ইউরোপের লোক মাত্রই জানেন ইংরেজী সাহিত্য ভান্ডারে তিনি কত অমূল্য গ্রন্থ যোগ করিয়াছেন। বস্তুতঃ মহাত্মাদিগের জীবনী পাঠ করিলে জানা যায় যে, তাহারা সকলেই ভোর চারটার সময় উঠিতেন।
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শিলাইদহে তাহার কুঠিবাড়িতে অবস্থান করিবার কালে ভোর চারটায় উঠিয়া তাহার অমর কবিতাগুলি লিখিতেন। বেলা নয়টার সময় হইতে মধ্যাহ্ন পর্যন্ত জমিদারীর কার্য পরিচালনা করিতেন। যে গ্রন্থ লিখিয়া তিনি বিশ্বের শ্রেষ্ঠ সম্মান নোবেল প্রাইজ প্রাপ্ত হইয়াছিলেন, সেই অমর কাব্য “গীতাঞ্জলি” প্রতিদিন ভোর ৪টায় লিখিতেন।
প্রাতঃকালের নির্মল বায়ু স্বাস্থ্যের জন্য যে কত উপকারী, বর্তমান বিজ্ঞানের যুগের চিকিৎসকগণ এক বাক্যে স্বীকার করিয়াছেন।
কবি বন্দে আলীর নাম নিশ্চয়ই শুনিয়াছ, এমন কি বিদ্যালয়ের পাঠ্যপুস্তকে তাহার অনেক কবিতা পড়িয়াছ, ১৯৬০ সনে তাহাকে একদিন জিজ্ঞাসা করিলাম, “আপনি আপনার উচ্চভাবপূর্ণ কাব্যগুলি কোন্ সময় রচনা করেন?” তিনি সহজ সরল কন্ঠে জবাব দিলেন, “শেষ রাত্রি”।
বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানী হাজারো যন্ত্রের উদ্ভাবক, বিদ্যুৎ লইয়া গবেষণা করিয়া আজকের ইলেকট্রিক বাতি, গ্রামোফোন রেকর্ড প্রস্তুতকারী, মনুষ্যের কল্যাণকর অসংখ্য যন্ত্রের নির্মাতা, টমাস আলভা এডিসন। যিনি আমেরিকার মহাগৌরব, তিনি ভোর চারটার সময় উঠিয়া গবেষণা কার্য্য করিতেন। তাহার প্রত্যূষের গবেষণাগুলি সাফল্যমন্ডিত হইয়াছে।
বিশ্বের একজন শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ৭০ কোটি ভারতবাসীর ‘বাপুজী’ করমচাঁদ মোহনচাঁদ গান্ধি, তাহার অমুল্য জীবনীগ্রন্থ ভোর চারটার সময় উঠিয়া লিখিতেন। বিশ্বের খ্যাতনামা লেক্সিকোগ্রাফার জন ওয়েবষ্টার, মিনি ইংরেজী অভিধান ‘ওয়েবষ্টার ইন্টারন্যাশনাল’ ডিকশনারীর প্রণেতা ভোর চারটায় গাত্রোত্থান করিয়া কার্য্য আরম্ভ করিতেন।
চীনাদের মাঝে একটা প্রবাদ আছে- ‘সুর্যদেব উঁকি দেবার পূর্বে যে মনুষ্য আকাশে উঁকি দেন তাহার মৃত্যু নাই।’ একথার তাৎপর্য কী? একথার মর্ম, ভোরে উত্থান করিলে শরীর সুস্থ থাকে। সুস্থ শরীর সকল জ্ঞান আহরণ করিতে পারে। তাই আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে আছে ‘শরীর মাদ্যং খলূ ধর্ম সাধনং।’ অর্থাৎ ধর্ম কর্ম সাধনা করিতে হইলে শরীর সুস্থ থাকা প্রয়োজন। প্রত্যুষে শয্যা ত্যাগ না করিলে শরীর সুস্থ রাখা যায় না।
আফ্রিকার ও নাইজেরীয়ার বলিষ্ঠকায় দীর্ঘজীবী নিগ্রো জাতির সামাজিক একটা রীতি চালু আছে। কোন যুবক বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হইতে চাহিলে, তাহাকে সমাজের প্রধান ব্যক্তিকে তিন পুর্ণিমা সময় অর্থাৎ ৪৫ দিন মোরগ ডাক দিবার পূর্বে জাগরিত করিবে। তবেই সেই বিবাহ করার অধিকার পাইবে।
সুস্বাস্থ্য লাভের চমৎকার বিধান আছে এশিয়ার জাপানী জাতির, যারা চির স্বাধীন বলিয়া গৌরব করে। বর্তমান বিশ্বে জাপানীরা কঠোর পরিশ্রমী, অর্থনীতিতে আজো জাপান বিশ্বের শীর্ষস্থানে অবস্থান করিতেছে। তাহারা তাহাদের মাতৃভূমিকে আদর করিয়া নিপ্পন বলে, জাপানী ভাষায় নিপ্পন মানে সূর্যোদয়ের দেশ। জাপানে ভোর চারটার পরে বিছানায় শুয়ে থাকা শিন্টো ধর্মমতে অপরাধ। শিন্টোদের দেখাদেখি বৌদ্ধ ও খ্রীষ্টানগণও ভোর চারটায় গাত্রোত্থান করে। জাপান যে আজ শিল্প বিদ্যায়, কৃষিবিদ্যায় সবার উর্ধ্বে, তাহার মূলে আছে ভোর চারটায় শয্যাত্যাগ।
ইসলামী ইতিহাসে ইমাম গাজ্জালী একজন মহাজ্ঞানী তাপস। তিনি কয়েক শত বই লিখিয়াছেন, তন্মধ্যে আরবী ভাষায় লেখা ‘এহিয়াউলউলুম’ বিশাল ভলিউমের গ্রন্থ। তাহার সংক্ষিপ্ত সার পারস্য ভাষায় লিখিত ‘কিমিয়ায়ে সাদাত’ বা ‘সৌভাগ্য স্পর্শমনি’। মিসরের এক মহা পন্ডিত ‘এহিয়াউলউলুম’ সম্বন্ধে এরূপ মন্তব্য করিয়াছেন- “জগতের সমস্ত জ্ঞান নির্বাপিত করিয়া দিলে আমি এই গ্রন্থের সাহায্যে সমস্ত জ্ঞান উদ্ধার করিতে পারিব।” সেই জ্ঞানী তাপস প্রতিদিন ভোর চারটার সময় শয্যাত্যাগ করিতেন।
আল কোরানের তাফসীর ও ভাষ্যকার তাফহিমুল কোরানের প্রণেতা আল্লামা মওদুদীকে আমি পাবনা টাউন হলে বক্তৃতা দিতে দেখিয়াছি। স্বাস্থ্যবান খাটোখোটা শশ্রুমন্ডিত লোক, তিনি তাহার বক্তৃতার এক পর্যায়ে সমস্ত ছাত্রদের উদ্দেশ্য করিয়া বলিলেন, “সোবহে ছাদেকের সময় উঠিয়া পাঠাভ্যাস করিও, কামিয়াব হইবে।” তিনি নিজেও ৪০ বৎসর যাবৎ সোবহে সাদেকে বিছানা ত্যাগ করিতেন। পশ্চিম পাকিস্তানে সুন্নি মুসলমান ও কাদিয়ানীদের দাঙ্গায় তাহাকে অপরাধী সাবাস্ত্য করিয়া পাকিস্তান সরকারের বিচার বিভাগ তাহাকে ফাঁসি কাষ্ঠে মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন। আদেশ শোনামাত্র সমগ্র বিশ্ব হইতে ঐদিন পাকিস্তান সরকারের কাছে ৩০ হাজারেরও অধিক ফাঁসি মওকুফের জন্য টেলিগ্রাম আসে। জেলখানায় তাহার আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, ভক্তবৃন্দ কাঁন্দিতে থাকে। তিনি তাহাদেরকে দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ের সহিত বলিলেন, “তোমরা ক্রন্দন করিও না। মৃত্যুর ফয়সালা জমিনে হয় না। মৃত্যুর ফয়সালা হয় আসমানে।” কি আশ্চর্য, পরদিনই তিনি বেকসুর খালাশ পান। তারপর তিনি দীর্ঘ ৩৬ বছর বেঁচেছিলেন।
মুসলীম মনীষীদের অন্যতম দার্শনিক, কবি ‘আছরারে-খুদী’র মত মহাকাব্যের রচয়িতা জার্মান বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক ডক্টরেট উপাধীপ্রাপ্ত স্যার ইকবাল ভোর ৪টায় উঠিয়া অধ্যাপনা করিতেন। ভু-পর্যটক ইবনে বতুতা, ফাহিয়েন হিউয়েন সাং, কলম্বাস, ড্রেক, ম্যাগিলান, লিভিংষ্টোন প্রভৃতি দুঃসাহসী নাবিক ও আবিষ্কারকদের জীবনী পড়িয়া দেখিও, তাহারা ভোর ৪ টায় বিছানা ত্যাগ করিতেন।
প্রাতঃকাল দিবসের অত্যুৎকৃষ্ট সময়। এই সময় মৃদু মন্দ নির্মল বায়ু (অবশ্য বৎসরের কতিপয় বৃষ্টি বাদলার দিন ছাড়া) প্রবাহিত হয়। এই নির্মল বায়ু সেবনে দেহাভ্যন্তরে রোগ জীবানু নাশ হয়। স্বাস্থ্যের উন্নতি হয়। পাখি যে মিষ্টি মধুর কুজন করে, তাহাতে সুধা কর্ণে বর্ষণ করে। প্রষ্ফুটিত পুষ্পের সুঘ্রান মনপ্রাণ মোহিত করে। ভোরে না উঠিলে, আত্মার তৃপ্তিদায়ক সুর লহরী কি প্রাপ্ত হওয়া যায়?
তাহলে শোন বাজান, পূর্বগগনের রক্তিম প্রভা প্রকৃতিকে কিরূপ মনোহররূপে সজ্জিত করে, স্বচক্ষে দর্শন না করিলে তো তাহা উপলব্ধি করা যায় না। এইরূপ রমনীয় সময়ে যে-ব্যক্তি গৃহাভ্যন্তরে বিছানায় শয়ন করিয়া থাকে, তাহার মত দূর্ভাগা কেহ কি আর আছে? জ্ঞানী মনীষীগণ বলেন, প্রাতঃকালীন সুশীতল সমীরণের মধ্যে এমন কতকগুলি মূল্যবান পদার্থ আছে যাহা মানব দেহের জন্য মূল শক্তি রক্তের চাকচিক্য বৃদ্ধি করে, হৃদয় প্রশান্ত করে, দৈহিক তেজস্বিতা বৃদ্ধি করে, অধোরোষ্ট রক্তানু রঞ্জিত করে, আত্মার সাহস অকল্পনীয়রূপে বৃদ্ধি করে, শরীর সর্বাংশে সুঠাম করে, মনোবল বৃদ্ধি করে।
অতএব বাজান, যদি দীর্ঘজীবী হইয়া জগতের কল্যাণ করিতে চাও, আর্তমানবের সেবায় সুখ পাইতে চাও, তবে আলস্য ত্যাগ করিয়া প্রাতঃকালে শয্যা ত্যাগ করিয়া তোমার সৃষ্টিকর্তার উদ্দেশ্যে সেজদা করো। তৎপর প্রাতঃভ্রমণে বহির্গত হও।
বাজান, এখন চিন্তা করিয়া দেখ, ইসলাম যে তাহার অনুসারীদিগকে ঘুম হইতে উপাসনা, আল্লাহর আরাধনা করিবার জন্য মোয়াজ্জেন সুললিত কন্ঠে আহ্বান করে, তাহার মধ্যে মানবের কত বড় কল্যাণ নিহিত আছে। আর এই আহ্বানে সাড়া দিয়া গাত্রোত্থান করিয়া উপাসনায় উদ্বুদ্ধ হওয়া, এটা তো বাধ্যতামূলক। একমাত্র ইসলাম ধর্মই মানবের মহাকল্যাণের জন্য বাধ্যতামূলক বিধান দিয়াছে। তাহলে দেখ, এ ব্যাপারে ইসলাম সকল ধর্মের উপর শ্রেষ্ঠ কি-না?
আর এই শ্রেষ্ঠ ধর্মের জন্মগতভাবে অনুসারী হইয়া, যে না-বুঝিয়া সেই ধর্মকে অবহেলা করে প্রত্যাখান করে, তাহার মত নির্বোধ আর কেহ আছে কি? নাই।
বাজানরে, তুমি একটা বিষয়ে ভুল ধারণা পোষণ করিতেছ। উহা এই যে, ‘ইসলামে কোন সমাধান নাই।’ গভীরভাবে ইসলামের বিধানগুলি পর্যালোচনা করো, আর জন্মগতভাবে তুমি যখন ইসলামের অনুসারী, এটা তোমারও পবিত্র দায়িত্ব যে, পর্যালোচনা করিয়া তোমার সমাজের নির্বোধদিগকে এর গুরুত্ব সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান দান করা। তুমি তাহা না করিয়া অভিমানে বা ভাবাবেগে এমন একটি বাতিল, মেকী জ্ঞানের পশ্চাতে ধাওয়া করিয়াছ- যেই জ্ঞান তোমাকে অনন্ত জীবনের পথে লইয়া যাইতে পারিবে না।
অতএব বাজান, তোমার মেকী জ্ঞানকে অপনোদন করা, আমি পিতা, আমার পবিত্র দায়িত্ব। আমি তোমাকে আদেশ দিচ্ছি- তুমি ইসলামের ইতিহাস, ইসলামী সাহিত্য, মুসলীম মনীষীদের উপদেশ পাঠ করো। দেখিবে- তুমি যে মহাভুলের মধ্যে পতিত হইয়াছ, তাহা মর্মে মর্মে উপলব্ধি করিতে সক্ষম হইবে। মহান আল্লাহপাক তোমাকে হেদায়েত করুন।
তুমি যে আর্তের সেবায় আত্মনিয়োগ করিয়াছ তাহা উত্তম। কিন্তু তুমি যে সমাজে জন্মগতভাবে সদস্য, সেই সমাজের কি করিতেছ? তোমার পিতামাতা ভাইবোনদের কতখানি সেবা করিতেছ? বিশ্বের কোন্ ধর্মে আছে যে, আপন আত্মীয় স্বজনকে পশ্চাতে ফেলিয়া অন্যের সেবা উত্তম? না, আগে আপন আত্মীয় স্বজনগণের সেবা করো। তাহাদের কল্যাণ করো, তাহাদের সব রকমের মঙ্গলের চিন্তা করো। “যে লোক নিজের আত্মীয় স্বজন-স্বজনদের, বিশেষ করে নিজের পরিবারের দেখাশোনা করে না, সে তো তার ঈমানকেই অস্বীকার করেছে; সে কাফেরের চেয়েও নিকৃষ্ট।” তুমি মেকী জ্ঞানের চিন্তা করিও না, চিন্তাবিদ হইও না। আগে নিজেকে চিনো, নিজেকে জানো, তবেই তোমার স্রষ্টাকে জানিতে, বুঝিতে ও চিনিতে পারিবে। আপন ঐতিহ্য রক্ষা করো।
বাজান, তোমাকে অনেক কথা বলিবার আছে। ইনশাল্লাহ্ সাক্ষাতে সব বলিব। বাজানরে, এখন আমি বৃদ্ধ হইয়াছি, চোখে কম দেখি গায়ে বল পাই না। রুজী রোজগার করিতে পারি না। চলৎশক্তি রহিত হইয়া যাইতেছে। কবে চোখ বুজিব। তোমাদের সব ভাইবোনদের যদি সুখী দেখিয়া মরিতে পারি তবে হয়ত আমার আত্মার শান্তি হইবে। তোমার মায়ের অবস্থা আমার চেয়ে আরও খারাপ। তাহার চেহারার দিকে তাকাইলে, চোখের পানি ধরিয়া রাখিতে পারি না। তুমি কি কখনও তোমার পিতামাতার দুরাবস্থার কথা চিন্তা কর? যদি করো তবে ভাল। আর যদি না করো তবে তুমি নাদান, অকৃতজ্ঞ। তবে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার প্রাণাধিক প্রিয় পুত্র কখনই পিতামাতা ভাইবোনদের প্রতি অকৃতজ্ঞ হইতে পারে না। তোমার জন্য সর্বদা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করি, হে মহিয়ান গরিয়ান প্রভু, আমার পুত্রকে হেদায়েত করো। তাহার দেহে বল দাও। হৃদয়ে সাহস দাও। অন্তরে প্রেম ভালবাসা দাও। প্রকৃত মানুষ করো।
বাজান, ইউরোপের বিকৃত খ্রীষ্টধর্মের গির্জা কেন্দ্রিক শোষণ নির্যাতনের ভাগারে বর্তমান সমাজতন্ত্রের চিন্তাভাবনার জন্ম। অমানবিক সামন্তবাদী শোষণ নির্যাতনের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিল তথাকথিত পাদ্রিরা বা গির্জাধীপতি ধর্মনেতারা। ফলে সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব গির্জা আশ্রিত ধর্ম ব্যবসার প্রতি তীব্র বিদ্বেষ লইয়া আত্মপ্রকাশ করে। ধর্মব্যবসায়ীদের জুলুমের কবল হইতে জনগণকে মুক্ত করার লক্ষ্যেই ধর্মবিশ্বাসের বিরুদ্ধে মারমুখী হইয়া উঠিতে বাধ্য হয়। জার্মানীর চিন্তাবিদ দার্শনিক সাহিত্যিক কালমার্কস ধর্মের বিরুদ্ধে লেখনি ধারণ করিয়া লিখেন, “ধর্ম আফিমের মত, গড বলিয়া কোন সত্বা নাই, ইহা শোষণকারী ধর্মব্যবসায়ীদের মনগড়া সৃষ্টি।”
কিন্তু সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের ঢেউ যখন মধ্য এশিয়ার মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলিতে আসিয়া আছড়াইয়া পড়িল, তখনও ধর্ম সম্পর্কিত সেই ইউরোপীয় ধ্যানধারণা তাহারা আঁকড়াইয়া ধরিয়া রাখে এবং মধ্য এশিয়ার মুসলীমদের উপরও সমানতালে জুলুম অত্যাচার চালাইতে থাকে। একই কাঠি দ্বারা সব হাঁকানোর এই স্থুলবুদ্ধি প্রস্তুত কর্মপন্থার কারণেই দুনিয়ার তাবৎ ধর্মবিশ্বাসীদের মনে সমাজতান্ত্রিক ধ্যান ধারণা সম্পর্কে একটা আতঙ্কজনক মনোভাব সৃষ্টি হইয়া গিয়াছে।
খ্রীষ্ট ধর্মে কোন রাষ্ট্রনীতি নাই। ইসলামে রাষ্ট্রপরিচালনার পরিপূর্ণ নীতিমালা রহিয়াছে এবং তা বহুবার বহুভাবে পরীক্ষিতও হইয়াছে।
বাজান, বিশ্ব ইতিহাস পাঠ করিয়া দেখিও, আমার কথার সত্যতা কতদুর সত্য। কালমার্কসের সমাজতন্ত্র যাহা চায়, ইসলামের রাষ্ট্রীয় নীতিমালা তাহার চাইতে অনেক বেশী গণমুখী। মুসলমানগণ বিগত তিনশত বৎসরের মধ্যে ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদীর লাল-নীল শক্তিগুলোর দ্বারা সম্পুর্ণরূপে পর্যুদস্ত রহিয়াছে। বর্তমান শতাব্দীর মাঝামাঝি সময় হইতে এশিয়া ও আফ্রিকার মুসলমানরা নামমাত্র স্বাধীনতা লাভ করিয়াছে। প্রকৃতপক্ষে এরা সমাজতন্ত্র ও ধনতন্ত্র এই দুই মণ্ডলের কারো না কারো পক্ষপুটে আশ্রয় গ্রহণ করিয়া তাহাদের অস্তিত্ব টিকিয়া রাখার চেষ্টায় গলদঘর্ম। ফলে এসব শাসকের শাসনে জনগণ শুধু শোষিতই নয়, প্রতিনিয়ত প্রতারিতও হইতেছে। এসব দিশেহারা জনমানুষের কেউ সমাজতন্ত্র কেউবা গণবাধনতন্ত্রের তাবিজ লইয়া সংকট মুক্ত হইতে চাহিতেছে। আসলে কিন্তু এ দুটির একটিরও সাথে ইসলামের সামান্যতমও কোন সামঞ্জস্য নাই। সুতরাং কুফুরী ফতোয়া শুধু সমাজতন্ত্রের প্রতি বর্ষণ না করিয়া ধনতন্ত্রের প্রতি বর্ষণ করাও উচিৎ বা অপরিহার্য।
বাজান, খুব মনোযোগ দিয়া ইসলামের বিধানগুলি পড়িয়া এবং খাঁটিজ্ঞানে (তোমার মেকি জ্ঞানে নয়) বিচার করিয়া দেখিও, ইসলামে অর্থনৈতিক সাম্যের উৎকৃষ্ট বিধান রহিয়াছে। প্রতিটি মানুষের আহার, বাসস্থান, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি প্রতিটি মৌলিক চাহিদার বা অধিকারের নিশ্চয়তা রহিয়াছে। শোষণমূলক পন্থার মাধ্যমে যাহারা ধনসম্পদ সঞ্চয় করে, উহারা ইসলামের দৃষ্টিতে কারুন, ফেরাউনের সমগোত্রীয়রূপে স্বীকৃত। এইসব বিষয়কে যদি কেউ সমাজতন্ত্রের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ মনে করিয়া ইসলামী সমাজতন্ত্র বলিয়া অভিহিত করে তবে তাহাতে দোষ কি? তবে মনে রাখিতে হইবে যে, যেহেতু বর্তমান প্রচলিত সমাজতান্ত্রিক শ্লোগানের ধ্যানধারণার প্রথম শ্লোগানই সর্বপ্রকার ধর্ম বিশ্বাসের প্রতি অনাস্থার উপর নির্ভরশীল, সে কারণে কোন খাঁটি ঈমানদার লোকের পক্ষেই পাশ্চাত্য থেকে আমদানী করা সমাজতান্ত্রিক ধ্যানধারণার সহিত একাত্ম হওয়ার অবকাশ নাইরে বাজান।
দোয়া করি, মহান আল্লাহপাক তোমাকে, আমার লিখিত চিঠির মর্ম অবগত হইবার তৌফিক দান করুন এবং সত্যিকার মনুষ্যত্ব লইয়া প্রকৃত মনুষ্য নামে গৌরবান্বিত করুন। আমিন।
বাজান, গত ২/৩ মাস হইল আমার চক্ষুর জ্যোতি খুব হ্রাস পাইয়াছে, নান্টু ৩০০ টাকা দিয়া ডাক্তার দ্বারা পরীক্ষা করাইয়া চশমা দিয়াছে। বর্তমানে সেই চশমাও আর কাজে লাগিতেছে না। অর্থনৈতিক অভাবে ভাল প্রোটিনযুক্ত ভিটামিন সমৃদ্ধ কোন খাদ্যই খাইতে পাই না, কি করিব? গত প্রায় একমাসের বেশী হইল বা হাতের কাঁধ হইতে কনুই পর্যন্ত খুব বেদনা হইয়াছে, ভয় হইতেছে সম্পুর্ণ অবশ হইবে কিনা? পায়খানায় পানি খরচ করিতেও খুব কষ্ট হয়, কিছু বাতের বড়ি খাইলাম কোনই ফল হইল না। একজন এ্যালোপ্যাথিক নাম করা ডাক্তার দেখাইয়াছি, প্রতি ইনজেকশনের দাম পড়িবে ৫০ টাকা। অনেকগুলি ইনজেকশন দিতে হইবে। এত টাকা কোথায় পাইব? আমার বয়স বর্তমান ৬৬ বৎসর। বলো আর কতদিন দুনিয়ায় অবস্থান করিব? বর্তমানে আমি একটা স্কুল স্থাপন কার্যে ব্যস্ত। খুব চিন্তা করিয়া দেখিলাম আমার বেটা বেটি কাহারো দ্বারাই আমার কোনো স্মৃতি জগতে থাকিবে না। তাই এমন একটা স্মৃতি রাখিব যাহা দীর্ঘদিন মানুষের কল্যাণ করিবে। অর্থহীন অবস্থায় এই স্মৃতি গঠন করা একটু সহজ।
মেয়েদের ঘর সংসারের গতি না করা পর্যন্ত আত্মার শান্তি পাইব না। কখনও চিন্তা করি, বাড়ি বিক্রি করিয়া মেয়েদের গতি করিয়া দেই। এ সম্পর্কে তোমার অভিমত কি? ইতি-

তোমার আব্বা
২০-১১-৮৮ ইং

অনুলেখক: মাহফুজ।
*মোকছেদ আলী।