প্রসঙ্গ: জাকির মিয়ার কোরানিক বিজ্ঞান

এ পর্বে আমি মূলত: জাকিরিয় কোরানিক বিজ্ঞানের ব্যপারে আলোকপাত করেছি কারন মনে হয়েছে অনেকেরই জানা দরকার তিনি কোরান থেকে কি কি বিজ্ঞানের তত্ত্ব আবিষ্কার করেছেন তার আবিষ্কারের মধ্যে অসারতা কোথায়। কারন অনেক নিরীহ প্রকৃতির লোক এই লোকটির ফাদে পড়ে ভয়ংকর রকম উগ্রবাদী ধার্মিক বা সন্ত্রাসী হয়ে উঠছে বলে আমার যথেষ্ট বিশ্বাস জন্মেছে।

তত্ত্ব-১। মহাবিশ্ব একটা বিগ ব্যাং এর মাধ্যমে সৃষ্টি হয়েছে।

জাকির নায়েকের অনুবাদ-
অবিশ্বাসীরা কি দেখে না আকাশ ও ভুমন্ডল একত্র ছিল, পরে আমরা উভয়কে পৃথক করলাম। ২১ঃ ৩০

জাকির নায়েকের দাবি উক্ত সূরা দ্বারা বিগ ব্যাং এর কথা বুঝানো হয়েছে। অর্থাৎ আগে সব কিছু একসাথে ছিল পরে তা বিস্ফোরিত হয়ে মহাবিশ্বের সৃষ্টি হয়েছে এটাই এ সুরাতে বলা হয়েছে বলে তার দাবি। এবারে পুরো সূরাটি দেখা যাক-

অবিশ্বাসীরা কি দেখে না আকাশ ও ভুমন্ডল একত্র ছিল, পরে আমরা উভয়কে পৃথক করলাম এবং পানির দ্বারা জিন্দা বস্তু পয়দা করিয়াছি। ২১ঃ ৩০

বাক্যটি পড়ে যা বোঝা যাচ্ছে যে- এক সময় জমীনের সাথে আকাশ সমূহ আটকে ছিল। কেমনে সেটা ? কোরান বলছে আকাশ হলো সাত টি । তার মানে সমতল জমিনের ওপর সাতটি আকাশ একের ওপর একটি সজ্জিত ছিল অনেকটা আমরা যেমন অনেকগুলো ঢেউ টিন মাটির ওপর একটির ওপর একটি সাজিয়ে রাখি। আর এ থেকে কিন্তু খুব পরিষ্কার হয়ে যায় যে এসব আসমানসমূহ ছিল কঠিন পদার্থের তৈরী। কঠিন পদার্থের তৈরী না হলে জমিনের সাথে আসমান একসাথে ছিল একথাটা অর্থহীন হয়ে যায়।এটাই হলো কোরানের আসল বক্তব্য। সর্বনিম্ন আসমান যে কঠিন একটা ছাদ হিসাবে আমাদের জমিনে বসবাসরত আদম সন্তানদেরকে রক্ষা করছে তা কিন্তু আগে ১ম পর্বে ভালমতো বোঝানো হয়েছে(৭৯ঃ২৭-৩০,২ঃ২২,১৩ঃ২)।এখন আল্লাহ দয়া করে জমিন থেকে সাতটি আকাশকে ঠেলে উপরে তুলে দিয়েছেন। আবার একটি আসমান থেকে অন্য আসমান পৃথক করে নির্দিষ্ট দুরত্বে একটির ওপর একটিকে বসিয়ে দিয়েছেন। এতে সর্বনিম্ন আসমান থেকে জমীন পর্যন্ত যা আমাদের কাছে দৃষ্ট হয় তাই হলো আমাদের জানা মহাবিশ্ব।সর্বনিম্ন আসমানের ওপর আর যে ছয়টা আসমান নির্দিষ্ট উচ্চতায় আল্লাহ স্থাপন করেছেন, প্রত্যেকটা আসমান হলো এক একটা বেহেস্ত এবং বলাবাহুল্য সর্বনিম্ন আসমানের কারনে আমরা তাদেরকে দেখতে পারি না। জমীনের ওপর আমরা আদম সন্তানরাসহ অনেক জীবিত প্রানি ( যাদেরকে পানি থেকে পয়দা করা হয়েছে) হাজির নাজির আছি, আর আছে পাহাড় পর্বত, মরুভূমি, বন-জঙ্গল, সাগর নদী ইত্যাদি। আর সর্বনিম্ন আসমানের নিচে ঝুলে আছে প্রদীপ স্বরূপ অসংখ্য নক্ষত্র। তার নিচে সূর্য ও চাদের চলাচলের জন্য কক্ষপথ আছে যে পথে তারা ঘুরে মরছে। এরি মধ্যে আবার ছুটন্ত তারা আছে যাদেরকে আল্লাহ শয়তানদেরকে শায়েস্তা করার জন্য ক্ষেপনাস্ত্র স্বরূপ মোতায়েত রেখেছেন।এটাই হলো কোরানে বর্নিত আল্লাহ কর্তৃক সৃষ্ট আসমান জমিন তথা মহাবিশ্ব। আল্লাহ বলছেন- আমি জমিন থেকে পৃথক করে আসমান সমূহকে উপরে স্থাপন করেছি।এজন্য অবিশ্বাসীরা জমিনে বাস করতে পারছে। এসব দেখেও কেন তারা আমাকে অবিশ্বাস করে?

তো যাই হোক, উপরোক্ত সূরা থেকে জাকির নায়েক বিগ ব্যাং আবিষ্কার করেছেন আর বলা বাহুল্য বিগ ব্যাং এর পরবর্তী অনুসঙ্গ সম্প্রসারনশীল মহাবিশ্বের ধারনা তাও কোরানে বর্নিত আছে বলে জাকির সাহেব দাবী করেছেন। এখন সম্প্রসারিত মহাবিশ্বকে স্বীকার করে নিলে যে সমস্যা হয় তা হলো- সম্প্রসারনের সাথে সাথে সর্বনিম্ন আকাশ সহ বাকী ছয়টি আকাশ ভেঙ্গে টুকরা টুকরা হয়ে যাবে তথা ধ্বংস হয়ে যাবে যা আমি আগের পর্বে বলেছি।সেক্ষেত্রে কোন আসমান তথা বেহেস্তই অবশিষ্ট থাকবে না ফলে মুসলমানরা(তাও শুধুমাত্র পুরুষরা) মরার পর কোন্ বেহেস্তে গিয়ে হুর দের সাথে মজা ফুর্তি করবে সেটা একটা বিশাল সমস্যা হয়ে দাড়ায়। জাকির নায়েক এখানে সত্যি সত্যি তার কোরানের মহাবিশ্ব তত্ত্ব নিয়ে আমাদের সাথে বিরাট একটা জোক করেছেন বলেই মনে হচ্ছে।

জাকির সাহেব তার এ তত্ত্বকে সমর্থন করতে যেয়ে নিচের সূরা উল্লেখ করেছেন-

অতঃপর তিনি আকাশের দিকে মনযোগ দিলেন যা ছিল ধুম্র কুঞ্জ, অতঃপর তিনি তাকে ও পৃথিবীকে বললেন, তোমরা উভয়ে আস ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায়। তারা বলল আমরা স্বেচ্ছায় আসলাম।৪১ঃ১১

তো জাকির নায়েক বলছেন- এ দ্বারা আল্লাহ আদি অবস্থার বিবরন দিচ্ছেন যা ছিল ধুম্রময় তথা গ্যাসীয়।কথাটা কিন্তু একশ ভাগ খাটি। কিন্তু যে খাটি বিষয়টি তিনি কৌশলে এড়িয়ে যেতে চেয়েছেন তা হলো- সৃষ্টির শুরুতেই যে পৃথিবী সৃষ্টি হয়নি বরং সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ১০০০ কোটি বছর পর তা। মহাবিশ্বের বয়স আনুমানিক ১৫০০ কোটি বছর। এর পর প্রথম প্রজন্মের তারকারা সৃষ্টি হয়েছিল। সেসব তারকাদেরই একটি তার জীবনকাল শেষ করার পর তা থেকে নিসৃত ধুলি , গ্যাস বা পদার্থ থেকে সৃষ্টি হয়েছে দ্বিতীয় প্রজন্মের তারা। বিজ্ঞানীরা নিঃসন্দেহ হয়েছেন আমাদের সূর্য দ্বিতীয় বা তৃতীয় প্রজন্মের তারা। তার অর্থ সৃষ্টির আদিতে পৃথিবী তো দুরের কথা , আমাদের সূর্যই তখনও সৃষ্টি হয় নি। সৃষ্টি হয়েছে প্রায় ১০০০ কোটি বছর পরে। সুতরাং আল্লাহ কিভাবে সৃষ্টির শুরুতে জমিন ও ধুম্রময় আকাশকে এক সাথে আসতে আদেশ দিলেন তা একমাত্র আল্লাহ আর তার নবী ছাড়া আর কেউই জানে না। কেন ডাক দিলেন তাও বোঝা যাচ্ছে না। ডাক দিয়ে যদি একত্র হতে বলেন তার অর্থ তাহলে তো সম্প্রসারন হয় না। তখন তো তাকে বলতে হবে সংকোচন। সুতরাং পুরো ব্যপারটিই মহা গোলমেলে হয়ে উঠল আরও।কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না, কারন মহাবিজ্ঞানী জাকির নায়েক তা থেকে যা জানার জেনে গেছেন। শুধু তাই নয়, তার এ ডাক দেয়ার আগেই কিন্তু পৃথিবীতে পাহাড় পর্বত , জীবিত সব প্রানীই সৃষ্টি করে ফেলেছেন। দেখুন উপরোক্ত সূরার ঠিক পূর্বের সূরা-

তিনিই উহার উপরে পর্বতসমূহ স্থাপন করেছেন এবং তিনি উহাতে আধিক্য প্রদান করেছেন ও তিনি চারি দিবসে উহাতে উৎপন্ন সমূহের নির্ধারন করে দিয়েছেন। সকল প্রার্থীর জন্য সমতুল্য করে দিয়েছেন। ৪১ঃ১০

অর্থাৎ জমিনের ওপর সব কিছু সৃষ্টি করার পরই আল্লাহ নজর দিয়েছেন আকাশের দিকে। উপরোক্ত সূরা কিন্তু তাই বলে। তার মানে সব কিছুর আগে আল্লাহ পৃথিবী সৃষ্টি করেছেন যা বিজ্ঞানের দৃষ্টিতে এক মহা ফাজলামো ছাড়া আর কিছু না। যাহোক, জাকির নায়েক কৌশলে সূরার ১০ নম্বর আয়াত এড়িয়ে গিয়ে খালি ১১ নম্বরকে এক দল নিরীহ মানুষের সামনে হঠাৎ করে উপস্থাপন করেছেন তার স্বভাব সুলভ অভিনেতার কায়দায়। উপস্থিৎ পাবলিক তো কোরানের সব আয়াত মুখস্ত করে তার আলোচনা সভায় যায় নি তাই কেউ আর তাকে পাল্টা প্রশ্ন করেনি। বরং বলা যায়, শ্রোতারা বরং তাদের কোরানের এহেন অলৌকিকত্বের কারনে তাদের ইমানকে আরও মজবুত করেছেন, হতে পারে তার মধ্য থেকে দুই একজন আত্মঘাতী বোমাবাজও হয়ে গেছে।

তত্ত্ব -২ ঃ গোলাকার পৃথিবী।

জাকির নায়েকের অনুবাদ-

তুমি কি দেখ না আল্লাহ রাত্রিকে দিন আর দিনকে রাত্রিতে প্রবিষ্ট করান ? ৩১ঃ২৯
তিনি রাত্রিকে দিবস দ্বারা আচ্ছাদিত করেন আর দিবসকে রাত্রি দ্বারা আচ্ছাদিত করেন। ৩৯ঃ৫

পাঠক, বলুন তো এ সূরা দুটো দ্বারা কি বোঝায়? পারলেন না তো ? কিন্তু আপনি না পারলে কি হবে মহাবিজ্ঞানী জাকির কিন্তু এ বাক্য থেকে মহাজ্ঞান আবিষ্কার করেছেন আর তা হলো- এ সুরার অর্থ নাকি পৃথিবী গোলাকার। হাসব নাকি কাদব কিছুই বুঝতে পারছি না। আল্লাহ যদি পৃথিবীকে গোলাকারই বলবেন তাহলে এত ধানাই পানাই না করে সোজা এরকম একটা সূরা বলে দিলেই তো হতো , যেমন-

আমি পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছি কমলালেবুর মত করে, কিন্তু তোমরা তা দেখতে পাও না কারন তোমাদের দৃষ্টি অতদুর পৌছায় না।

তিনি পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন আপেলের মত করে অথচ তোমরা তাকে দেখ সমতল বিছানা, এতে জ্ঞানবানদের জন্য জ্ঞানের অনেক কিছু লুকানো আছে।

তিনি পৃথিবীকে সৃষ্টি করেছেন গোলাকার করে, কিন্তু অবিশ্বাসীরা তা দেখতে পায় না।তাদের দৃষ্টি অতদুর পৌছতে পারে না, কিন্তু আল্লাহ সব দেখেন ,জানেন আর শুনেন , তিনি মহাপরাক্রমশালী, মহাজ্ঞানী।

যেখানে কয়েক গন্ডা সূরাতে একের পর এক আল্লাহ বলে গেছেন- পৃথিবী হলো সমতল বিছানা, চাদোয়ার মত, বিস্তৃত(২ঃ২২,১৩ঃ৩,১৮ঃ৮৬-৯০, ৭৮ঃ৬-৭,৫১ঃ৪৮,১৮ঃ৪৭২০ঃ১০৫-১০৭)জাকির মিয়ার নজরে ওগুলো পড়ল না তাই তিনি -দিনের মধ্যে রাত আর রাতের মধ্যে দিন -এর মধ্যে পৃথিবী গোলাকার এ আবিষ্কার করে ফেললেন। কি আচানক কারবার! শুধু তাই নয়, জাকির মিয়া একটা সুরার অনুবাদ এভাবে করেছেন-

অতঃপর আমরা পৃথিবীকে ডিম্বাকৃতি করে সৃষ্টি করেছি।৭৯ঃ৩০

ওয়াও ডিম! কিসের ডিম ! উট পাখির ডিম। কারন জাকির নায়েক বলেছেন উক্ত সূরায় পৃথিবীকে বলা হয়েছে দাহাহা । দাহাহা আরবি শব্দ দুহিয়া থেকে নেয়া হয়েছে, দুহিয়া অর্থ উট পাখির ডিম। আমি আরবি জানি না , তাই বিষয়টি ঠিক কিনা জানি না। তবে অনেক অনুবাদকের কোরানের অনুবাদ দেখলাম যা তারা লিখেছে তা হলো-

পৃথিবীকে এর পরে বিস্তৃত করেছেন। (www.quraanshareef.org)

http://quranexplorer.com থেকে অনুবাদ

Dr. Mohsin : And after that He spread the earth;
Pickthal : And after that He spread the earth,
Yusuf Ali : And the earth, moreover; hath He extended (to a wide expanse)

পাঠক বর্গ কোথাও কি উট পাখির ডিম দেখেন নাকি ? পৃথিবী বিখ্যাত সব কোরান অনুবাদক কোরানে উট পাখির ডিম না দেখলেও জাকির মিয়া ঠিকই দেখতে পেয়েছেন। এ নিয়ে এই মুক্তমনাতেই একটা চমৎকার নিবন্ধ লিখেছিলেন একজন। তারপরও যুক্তির খাতিরে যদি ধরে নেই যে কোরানে পৃথিবীকে উট পাখির ডিম বলা হয়েছে তাহলে সরাসরি উট পাখির আরবী শব্দ ব্যবহার করা কেন হলো না কেন দুহিয়া থেকে দাহাহা শব্দ তৈরী করা হলো? এত ভয়ংকর রকম অস্পষ্টতা কোরানে? যেখানে বলা হচ্ছে কোরানে সব কিছু সহজ সরল ভাবে বলা হয়েছে আর সব নির্দেশ সুনির্দিষ্ট ভাবে দেয়া আছে সেখানে কোরানকে বুঝতে আমাদেরকে কেন জাকির নায়েক নামের এক মহাপন্ডিতের জন্য ১৪০০ বছর অপেক্ষা করতে হলো? সর্বোপরি, পৃথিবী তো উট পাখির ডিমের মত নয়, এটা দেখতে কমলালেবুর মত তা কি আল্লাহ জানতেন না ? বিশ্বাস না হয় গুগল সার্চ করে উট পাখির ডিমের আকৃতি দেখে নিতে পারেন।

তত্ত্ব-৩ঃ চাদের আলো নিজের নয়।

জাকির নায়েকের অনুবাদ-

কল্যানময় তিনি যিনি আসমানে নক্ষত্রপুঞ্জ সৃষ্টি করেছেন, তাতে স্থাপন করেছেন প্রদীপ(সূর্য) আর আহরিত আলোয় উদ্ভাসিত চন্দ্র।২৫ঃ৬১
তিনিই মহান সত্তা যিনি সূর্যকে বানিয়েছেন উজ্জল আলোকময় আর চন্দ্রকে বানিয়েছেন স্নিগ্ধ আলো প্রতিফলনকারীরূপে। ১০ঃ৫

তো জাকির মিয়া চাদকে আহরিত আলোয় উদ্ভাসিত বলে অনুবাদ করেছেন। এখন দেখা যাক অন্যান্যরা কি ভাবে অনুবাদ করেছে-
কল্যানময় তিনিই যিনি নভোমন্ডলে রাশি চক্র সৃষ্টি করেছেন, এবং তাতে রেখেছেন সূর্য ও দীপ্তিময় চন্দ্র। (www.quraanshareef.org)

Blessed is He who has placed in the sky great stars and placed therein a (burning) lamp and luminous moon. Shahee Intl Noble Quran
Blessed is He Who made constellations in the skies , and placed therein a Lamp and a Moon giving light. -Yusuf Ali

Blessed be He Who hath placed in the heaven mansions of the stars, and hath placed therein a great lamp and a moon giving light! –Pickthal
Blessed is He Who made the constellations in the heavens and made therein a lamp and a shining moon.- Shakir
Blessed be He Who has placed in the heaven big stars, and has placed therein a great lamp (sun), and a moon giving light.- M Khan & Hilali

Luminous Moon or A shining moon or a moon giving light – এর অর্থ কি আহরিত আলোয় উদ্ভাসিত চাদ ??? কিন্তু ধুরন্ধর জাকির মিয়া সেটাই অর্থ করেছেন। আর তা করে কোরান বিষয়ে বর্তমান দুনিয়ায় একমাত্র নিজেকেই শ্রেষ্ট ও অন্যরা ফালতু এটাই প্রমান করার তালে আছেন। এখন পাঠকবর্গ বুঝতে পারছেন- আস্কারা পেয়ে জাকির মিয়া এখন নিজেই কোরান রচনা করতে উদ্যত হয়েছেন যাতে মুসলমানরা কোন অপরাধ দেখছে না। উল্টো তাকে বাহবা দিয়ে যাচ্ছে আর সবাই ব্যাঙের মত লাফাচ্ছে। যাহোক , চাদের এ বিষয়টি নিয়ে জাকির মিয়ার ব্যাখ্যা- কোরানে সূর্য বলতে সর্বদা শামস্ শব্দটি ব্যবহার হয়েছে যার কয়েকটি প্রতিশব্দ হলো- সিরাজ, ওয়াহাজ বা দীয়া যাদের অর্থ জ্বলন্ত প্রদীপ বা গৌরবোজ্জল আভা। আর চন্দ্র এর আরবী শব্দ কামারের যার প্রতিশব্দ হলো মুনির বা আহরিত আলো , নুর বা প্রতিফলিত আলো। তার আরও বক্তব্য চন্দ্র বলতে কোথাও সিরাজ বা ওয়াহাজ বা দীয়া ব্যবহৃত হয়নি। জাকির নায়েক কিন্তু চেষ্টার ত্রুটি যে করেননি তা কিন্তু বোঝা যাচ্ছে। কথা হলো- সূর্য ও চাদ যে এক বস্তু না, তাদের গুনগত তফাৎ যে বিরাট তাতো যে কোন অসভ্য বা কাফিরও জানত সেই নবীর আমলের আরব দেশে। সূর্য প্রচন্ড কিরনশালী আর উত্তপ্ত বিশেষ করে আরব দেশে তো সেটা আরও বেশী অনুভব করা যায়, অন্য দিকে চন্দ্র হলো মৃদু কিরনশালী , স্নিগ্ধ ও মোটেও উত্তপ্ত নয়। তো সূর্য আর চাদকে বোঝাতে কি একই রকম প্রতিশব্দ ব্যবহৃত হবে নাকি ? এটা তো একটা সাধারন জ্ঞানের ব্যাপার অথচ সেটাই হয়ে উঠেছে অসাধারন এক আসমানী জ্ঞান জাকির মিয়ার কাছে। ধন্য জাকির মিয়া।

তত্ত্ব-৪ঃ সূর্যের আহ্নিক গতি।

জাকির নায়েকের অনুবাদ-
তিনিই সৃষ্টি করেছেন রাত্রি ও সূর্য এবং চন্দ্র ও সূর্য। সবাই আপন আপন কক্ষপথে বিচরন করে।২১ঃ৩৩

এ থেকে জাকির মিয়া সূর্যের আহ্নিক গতি সম্পর্কে যাবতীয় তথ্য বের করে ফেলেছেন। কোন পাঠক কি তা বের করতে পারবেন? পারবেন না , মনে হয় দুনিয়ার সবচাইতে বড় জ্যোতির্বিজ্ঞানীও তা পারবেন না। কিন্তু জাকির মিয়া পেরেছেন। সত্যি অসাধারন ব্যাক্তি উনি। সূর্যেরও আহ্নিক গতি আছে আমাদের পৃথিবী বা চন্দ্রের মত। পৃথিবী যে ২৪ ঘন্টায় একবার নিজের অক্ষের ওপর পাক খায় সেটাই তার আহ্নিক গতি। তেমনি সূর্য ২৫ দিনে একবার নিজ অক্ষের ওপর পাক খায় যা তার আহ্নিক গতি।কিন্তু সেই আহ্নিক গতির বহিঃপ্রকাশ কৈ উপরোক্ত সূরাতে? বরং এটা বলছে সূর্য ও চাদ পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘোরে সে কথা। ধরুন এক ব্যাক্তি জানে না যে, পৃথিবী সূর্যের চারপাশে ঘুরছে, সে ব্যক্তি উক্ত সূরা পড়ে কি বুঝবে? সেই ১৪০০ বছর আগে কেউ তো জানত না যে পৃথিবী সূর্যের চারপাশ দিয়ে ঘুরছে, তাহলে তারা উক্ত সূরা দিয়ে কি বুঝবে? পাঠক আপনারাই বিচার করুন। যাহোক আগের পর্বে খুব ভাল ভাবে বিশ্লেষণ করা হয়েছিল সূর্য ও চন্দ্র যে তার কক্ষপথে বিচরন করে বলে কোরানে বলা আছে এটা স্রেফ মোহাম্মদ সাদা চোখে যা দেখেছিলেন, তার আগেও মানুষ যা দেখত, এমনকি আমরাও এখন দৈনিক যা দেখি সে বর্ননাই করেছেন- তার চাইতে বেশী কিছু না। দ্বিরুক্তি হবে বিধায় এখানে তা আবার বিবৃত করলাম না।আগ্রহী ব্যাক্তিবর্গ এখানে দেখতে পারেন- https://blog.mukto-mona.com/?p=6037

তত্ত্ব-৫ঃ পরমানু মতবাদ।

জাকির নায়েকের অনুবাদ-
নভোমন্ডলে ও ভূমন্ডলে তার অগোচরে নয় অনু (জাররা) পরিমান কিছূ, না তদপেক্ষা বৃহৎ বা ক্ষুদ্র, সমস্তই আছে সুস্পষ্ট কিতাবে।৩৪ঃ৩

তো এটা নায়েকের মতে কোরান বর্নিত পরমানু মতবাদ। যদিও মোহাম্মদেরও অন্ততঃ ১০০০ বছর আগে গ্রীক দার্শনিক ডেমোক্রিটাস তার পরমানু মতবাদ প্রকাশ করেন ও প্রায় একই সময়ে প্রাচীন হিন্দু গ্রন্থেও এ ধরনের পরমানু মতবাদ পাওয়া যায়। যাহোক তারপরেও একটা সাধারন প্রচলিত কথাকে জাকির মিয়া পরমানুবাদের পরাকাষ্ঠা বলে প্রমানের আপ্রান চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। সেই প্রচলিত কথাটা কি? আমরা সাধারনত কথায় কথায় বলে ফেলি-পাত্রে বিন্দু পরিমান পানিও অবশিষ্ট নেই, এক বিন্দু তেলও নেই ট্যাঙ্কে ইত্যাদি। তো কোরানে মোহাম্মদের উল্লেখিত সাধারন প্রচলিত কথা যদি পরমানুবাদ হয় তাহলে আমাদের প্রচলিত এসব সাধারন কথাও কিন্তু পরমানুবাদ একথা বলতেই হবে। মোহাম্মদ বলছে- সমস্তই আছে সুস্পষ্ট কিতাবে, কিছুই কিন্তু স্পষ্ট বোঝা গেল না কিভাবে এ সূরা পরমানুবাদ তত্ত্ব প্রকাশ করছে। তবে জাকির মিয়ার কাছে যে সুস্পষ্ট তা নিশ্চিত।

তত্ত্ব-৬ঃ উদ্ভিদের লিঙ্গভেদ।

জাকির নায়েকের অনুবাদ-
আল্লাহই আকাশ থেকে পানি বর্ষন করেন যা দ্বারা বৈচিত্রময় বিভিন্ন প্রজাতির উদ্ভিদ জোড়ায় জোড়ায় উৎপন্ন করেন।২০ঃ৫৩

এটা নাকি বলছে যে আল্লাহ উদ্ভিদ স্ত্রী ও পুরুষ লিঙ্গ ভেদে সৃষ্টি করেন। জোড়ায় জোড়ায় বলতে তিনি স্ত্রী আর পুরুষ বোঝাচ্ছেন । এবার দেখা যাক প্রসিদ্ধ কোরান অনুবাদকরা কিরকম অনুবাদ করেছেন সূরাটির-

He Who has, made for you the earth like a carpet spread out; has enabled you to go about therein by roads (and channels); and has sent down water from the sky.” With it have We produced diverse pairs of plants each separate from the others.- Yusuf Ali

Who hath appointed the earth as a bed and hath threaded roads for you therein and hath sent down water from the sky and thereby We have brought forth divers kinds of vegetation,- Pickthal

Who made the earth for you an expanse and made for you therein paths and sent down water from the cloud; then thereby We have brought forth many species of various herbs.-Shakir

Who has made earth for you like a bed (spread out); and has opened roads (ways and paths etc.) for you therein; and has sent down water (rain) from the sky. And We have brought forth with it various kinds of vegetation.- M Khan & Alhilali

একমাত্র ইউসুফ আলী ছাড়া আর কেউ জোড়া শব্দ ব্যবহার করেননি। কিন্তু তাও আবার যে স্ত্রী পুরুষ বোঝাতে তা কিন্তু না। অন্যরা তো সেখানে শুধুমাত্র বহুরকম উদ্ভিদ এর কথা অনুবাদ করেছেন। কিন্তু জাকির মিয়া বলছেন জোড়া জোড়া মানে স্ত্রী ও পুরুষ গাছ , আর যেহেতু তার অনুবাদে শুধুমাত্র জোড়া জোড়া কথাগুলো আছে , তার মানে কোরান বলছে প্রত্যেক গাছেরই স্ত্রী ও পুরুষ গাছ আছে। এটা ঠিক উদ্ভিদ জগতে অনেকেরই স্ত্রী ও পুরুষ লিঙ্গ আছে, কিন্তু তা সব উদ্ভিদের বেলাতে সত্য না। উন্নত জাতের উদ্ভিদের বেলাতে এ লিঙ্গ ভেদ আছে কিন্তু নিম্ন প্রজাতির উদ্ভিদ যেমন- ফার্ন, মাসরুম ইত্যাদির কোন লিঙ্গভেদ নেই। তাই জাকির মিয়ার কথা ঠিক না। কোরান বলছে সমস্তই আছে সুস্পষ্ট কিতাবে সেখানে দেখা যাচ্ছে এখানে মোটেও সব কিছু সুস্পষ্ট না। তাছাড়া জোড়া জোড়া বলতে স্ত্রী ও পুং লিঙ্গ কেন বুঝব তাও সুস্পষ্ট নয়, আল্লাহ খুব সোজাভাবেই কোরানে বলতে পারত-

আমি আকাশ হতে বৃষ্টি বর্ষন করি, আর সৃষ্টি করেছি নানা প্রজাতির উদ্ভিদ পুং ও নারী জাতিতে।

তাহলে তা হতো সুস্পষ্ট। তাছাড়া কোরানের বানী যদি এতই সুস্পষ্ট, অনুবাদকেরা এত বেশী ভিন্ন ভিন্ন অনুবাদ করেন কেন? কোরান হলো একটা গাইড লাইন মূলক কিতাব, সেখানকার যাবতীয় বক্তব্য হবে সহজ, সরল, সুস্পষ্ট, প্রাঞ্জল, ও সহজবোধ্য। কিন্তু আমরা দেখি কোরানের সূরায় সুরায় অস্পষ্টতা, দুর্বোধ্যতা ও সামঞ্জস্যহীনতা। নীচে আমি নিজেই কিছু খুব সহজ সরল ও সুনির্দিষ্ট বাক্য রচনা করলাম পাঠক/পাঠিকাদের বোঝার স্বার্থে-

সদা সত্য কথা বলিবে, কখনও চুরি করিও না।

আমি দুনিয়ায় মানুষকে সৃষ্টি করিয়াছি স্ত্রী, পুরুষ ও নপুংসক রূপে, আমি পৃথিবীকে সৃষ্টি করিয়াছি কমলালেবুর আকৃতিতে।

পৃথিবী সূর্যের চারদিকে তার কক্ষপথে বিরতিহীনভাবে ঘুরে চলেছে, কিন্তু তোমরা তা দেখতে পাও না ।

চাদের নিজের কোন আলো নেই সে সূর্যের আলোয় আলোকিত হয়ে রাতে স্নিগ্ধ আলো দেয়।

আমি মহাবিশ্বকে সৃষ্টি করেছি একটা বিন্দু থেকে মহাবিস্ফোরনের মাধ্যমে, অতঃপর তা প্রসারিত হয়ে চলেছে অবিরাম।-ইত্যাদি।

উপরোক্ত কথাগুলো হলো তথ্যমূলক যা সুস্পষ্ট যদিও আমি নিজেই তা তৈরী করেছি আল্লাহর কোন ওহি ছাড়াই। এখন উপরোক্ত বাক্যগুলো পৃথিবীর যে কোন ভাষাতেই যে কোন ভাল ভাষাবিদ অনুবাদ করলে অর্থের সামান্যতম হের ফের হবে না বলেই ধরা যেতে পারে। কেন হের ফের হবে না ? কারন বাক্যগুলো সরল , সহজ , প্রাঞ্জল, সুস্পষ্ট- তাই অনুবাদে অর্থের কোনই হের ফের হবে না। পক্ষান্তরে কোরানে আল্লাহ বার বার এর বক্তব্যকে সহজ , সরল, সুস্পষ্ট ঘোষনা দেয়ার পরেও তার অনুবাদে ব্যপক ভাবে অর্থের পার্থক্য ঘটে। এধরনের অর্থের পার্থক্য হতে পারে শুধুমাত্র কবিতা বা সাহিত্য পুস্তকের অনুবাদের সময়।কারন তা মোটেও সরল ও সুস্পষ্ট নয়। কোরান তো কোন কবিতা বা সাহিত্যের বই না। আর মোহাম্মদ কোন কবিতা বা ছড়া লেখেন নি , তাহলে? বক্তব্য সুস্পষ্ট হলে- জাকির নায়েককে আর উট বা ঘোড়ার ডিম বের করে অথবা দিনকে রাতের মধ্যে ও রাতকে দিনের মধ্যে প্রবেশ করানোর মত অর্থহীন বক্তব্য থেকে প্রমান করতে হতো না যে পৃথিবী গোলাকার। সোজাসুজি বলে দিলেই হতো যে- পৃথিবী গোলাকার বা পৃথিবী সূর্যের চারদিকে ঘোরে, বা মহাবিশ্ব একটা বিন্দুর বিস্ফোরন থেকেই সৃষ্টি হয়েছে।।আল্লাহ সর্বজ্ঞানী, সবজান্তা তার এত ধানাই পানাই কথা বলার তো কোন মানে ছিল না।মোহাম্মদের কথা তো সাহাবীরা এক সময় প্রশ্নাতীতভাবেই বিশ্বাস করত। যেমন বিনা দ্বিধায় বিশ্বাস করেছিল তার নারীমুখো ঘোড়ার পিঠে চড়ে সাত আসমান পেরিয়ে আল্লাহর আরশে বেড়াতে যাওয়ার ও আল্লাহর সাথে খোশ গল্পের কথা।

তত্ত্ব-৭ঃ পরিযায়ী পাখিদের দুরপাল্লার নিখুত উড্ডয়ন।

জাকির নায়েকের অনুবাদ-

তারা কি উড়ন্ত পাখীকে দেখে না? এ গুলো অন্তরীক্ষে আজ্ঞাধীন রয়েছে।আল্লাহ ছাড়া কেউ এগুলোকে আগলে রাখে না। নিশ্চয়ই এতে বিশ্বাসীদের জন্য নিদর্শন রয়েছে।১৬ঃ৭৯

এ সূরার মাধ্যমে নাকি- শীতকালে দুরপাল্লার পরিযায়ী পাখিরা যারা হাজার হাজার কিলোমিটার পথ আকাশে উড়ে ঠিক নির্দিষ্ট যায়গায় যায় আবার গরম কালে তাদের আগের আবাস স্থলে নিরাপদে নিখুত ভাবে ফিরে যায়- সে কথা বলা হয়েছে। বলা বাহুল্য, যে প্রযুক্তি (স্নায়তন্ত্রের মাইগ্রেটরী প্রোগ্রাম) ব্যবহার করে তারা এ আপাতঃ কঠিন কাজটি করে সেটাই নাকি নির্দেশ করছে সূরাটি। এ ধরনের আবিষ্কার কি আর কেউ করতে পারবে? এবার দেখা যাক অন্যান্য অনুবাদ-

Do they not look at the birds, held poised in the midst of (the air and) the sky? Nothing holds them up but (the power of) Allah. Verily in this are signs for those who believe. -Yusuf Ali

Have they not seen the birds obedient in mid-air? None holdeth them save Allah. Lo! herein, verily, are portents for a people who believe.- Pickthal

Do they not see the birds, constrained in the middle of the sky? None withholds them but Allah; most surely there are signs in this for a people who believe.- Shakir

Do they not see the birds held (flying) in the midst of the sky? None holds them but Allah (none gave them the ability to fly but Allah). Verily, in this are clear proofs and signs for people who believe (in the Oneness of Allah).- M Khan & Alhilali

দেখা যাচ্ছে সবাই প্রায় একই রকম অনুবাদ করেছে। কিন্তু তাতে পাখির সেই স্নায়ুতন্ত্রের মাইগ্রেটরী প্রোগ্রামের সংকেত কোথায়? বরং এটাই বলা হচ্ছে যে- পাখীরা যে আকাশে উড়তে পারে তা মূলতঃ আল্লাহর আজ্ঞাতে বা নির্দেশে। কারন পৃথিবীর মাধ্যকর্ষন শক্তির কারনে কোন জড় বস্তুই আকাশে বেশীক্ষন থাকতে পারে না। অথচ পাখীরা তা পারে। আর সেটা পারে কেবলমাত্র আল্লাহর আজ্ঞাতে ও শক্তিতে। সেই জিনিসটিই এখানে খুব সুস্পষ্ট ভাবে বলা হচ্ছে। এখানে বিশ্বাসীদের জন্য যে নিদর্শন রয়েছে বলা হচ্ছে তা হলো- আল্লাহর এ ক্ষমতা দৃষ্টে তাদের ইমান আরও পাকাপোক্ত হবে। যদি এ সূরাতে স্নায়ুতন্ত্রের মাইগ্রেটরী প্রোগ্রামের কথা বলা হতো তাহলে সূরাটি হতে হতো এরকম-

তারা কি দুর পাল্লার উড়ন্ত পাখীকে দেখে না? । তারা তাদের গন্তব্যে নিখুতভাবে যায় তাদের শরীরের মধ্যে আল্লার ঢুকিয়ে দেয়া একটা কৌশলের দ্বারা। নিশ্চয়ই এতে বিশ্বাসীদের জন্য জানার কিছু রয়েছে।

তাহলে বক্তব্য হতো পরিস্কার আর আমরাও বুঝতাম সুরাটিতে অধূনা আবিস্কৃত সেই মাইগ্রেটরী প্রোগ্রামের কথাই বলা হয়েছিল যা আমরা এতদিন বুঝি নি। আর এ বুঝা থেকে আমরা আমাদের মন থেকে আল্লাহ ও তার নবী মোহাম্মদের প্রতি অবিশ্বাস দুরে ঠেলে দিয়ে তার উম্মত হয়ে যেতাম সাথে সাথে।

তত্ত্ব-৮ঃ মধূর ভেষজ গুন।

তার (মধুমক্ষিকা) পেট থেকে নানা রকম পানীয় নির্গত হয়।তাতে মানুষের জন্য রয়েছে নানা রোগের প্রতিকার। নিশ্চয়ই এতে চিন্তাশীল লোকদের জন্য রয়েছে নিদর্শন।১৬ঃ৬৮-৬৯

এটা কি মোহাম্মদ নতুন আবিষ্কার করেছিল নাকি? জাকির নায়েক দেখি নিজেরে ছাড়া আর সবাইকে বোকা পাঠা মনে করে। আমরা জানি- মোহাম্মদের এ ধরাধামে আসার হাজার হাজার বছর আগেই মানুষ মধূকে নানা ব্যাধিতে ভেষজ উপাদান হিসাবে ব্যবহার করত। মিশরের পিরামিডের ভিতর যে মমি পাওয়া গেছে যার বয়স তিন হাজার বছরেরও বেশী তার সাথে পাথরের কৌটাতে মধূ পাওয়া গেছে, কারন তা ফারাও এর রোগ ব্যধিতে কাজে লাগবে মৃত্যুর পরেও। প্রাচীন ভারত বর্ষে সেই তিন/চার হাজার বছর আগ থেকেই মধুকে একটা অন্যতম প্রধান ভেষজ উপাদান হিসাবে গন্য করা হয়ে আসছে। তো মধূর যদি কোন ভেষজ গুন না থাকতো তাহলে কি তারা এটা করত নাকি ?

তত্ত্ব-৯ঃ মানুষের জন্ম বৃত্তান্ত।

জাকির নায়েকের অনুবাদ-
অতএব মানুষের দেখা উচিৎ কি বস্তু থেকে তারা সৃজিত হয়েছে। সে সৃজিত হয়েছে সবেগে স্খলিত পানি থেকে। এটা নির্গত হয় মেরুদন্ড ও বক্ষপাজরের মধ্য হতে।৮৬ঃ ৫-৭

প্রথম কথা- স্খলিত পানি আর শুক্রবীর্য বা ডিম্ব কি এক জিনিস ? পানির ঘনত্ব আর শুক্রবীর্যের ঘনত্বের মধ্যে যে বিপুল তফাৎ তা তো সবাই দেখতে পায়। সুতরাং এটা আবারও এক ভীষণ অস্পষ্ট বক্তব্য। আর তা ছাড়া এটা তো কোন নতুন তত্ত্বও নয়। সেই প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে মানুষ লক্ষ্য করেছে নারী পুরুষ যখন মিলিত হয় তখন পুরুষের জননাঙ্গ থেকে তরল ও থকথকে জাতিয় একটা পদার্থ সবেগে নির্গত হয়, নারীর জননাঙ্গের ভেতরেও তরল জাতিয় একটা পদার্থ নির্গত হয়। তারপর ই দেখা যায় নারীটি গর্ভবতী হয়ে পড়ে। তো এর পর এটা একটা সাধারন জ্ঞানের ব্যাপার যে, শিশু জন্ম নেয়ার জন্য সেই পদার্থগুলোর ভুমিকা আছে। এ তো মানুষ কোরান তৈরীরও হাজার বছর আগ থেকেই জানত। মানুষ তখন হয়ত জানত না পুরুষ ও নারী কর্তৃক নির্গত তরল জাতিয় পদার্থের মধ্যে কি আছে।কোরান ও কিন্তু সে সম্পর্কে কিছুই নির্দিষ্ট করে বলে নি।সেই সাধারন জানা জিনিসটাই মোহাম্মদ কোরানে বলে গেছেন। কিন্তু কোরান যদি বলত-সে সৃজিত হয়েছে সবেগে স্খলিত বীর্য ও ডিম্ব থেকে। একমাত্র তাহলেই তার একটা বিশেষত্ব থাকত ও তা বৈজ্ঞানিক ভাবে স্বীকার্য হতো। কিন্তু তাতে জাকির মিয়ার কিছুই যায় আসে না, তার দরকার কোরান থেকে বিজ্ঞান বের করার আর সেটাই তিনি করেছেন তা ঠিক হোক বা না হোক, কারন তার সামনে আছে কতকগুলো অন্ধবিশ্বাসী লোক, যা তাদের বলা হোক না কেন কোরানের নামে তা তারা গোগ্রাসে গিলবেই। এর পর আরও অদ্ভুত বক্তব্য দিয়েছে কোরান- বীর্য নাকি মেরুদন্ড ও বক্ষপাজর থেকে নির্গত হয়, হায় সেলুকাস, কি বিচিত্র জিনিস এই কোরান আর কি বিচিত্র চিজ এই জাকির নায়েক! প্রাপ্ত বয়স্ক পাঠক মাত্রেই জানেন যে বীর্য নির্গত হয় শুক্রাশয় থেকে আর তা মেরুদন্ড বা বক্ষপিঞ্জরের মধ্যে থাকে না।জাকির মিয়া বলছেন ভ্রুনীয় দশায় শুক্রাশয় ও ডিম্বাশয় বক্ষপিঞ্জর ও মেরুদন্ডের মাঝখানে থাকে। কিন্তু সূরাতে কি ভ্রুনীয় দশার কথা বলছে নাকি ? যখন পুরুষের পুরুষাঙ্গ থেকে বীর্য সবেগে নির্গত হয় তখন সে ভ্রুনীয় দশায় থাকে নাকি? সূরাতে তো ভ্রুনীয় দশার কোন কথা বলে নি। তাহলে ? এর কারন একমাত্র ভ্রুনীয় দশার কথা বিবেচনায় নিলেই জাকির মিয়ার যৎসামান্য সুবিধা হয়।

পাঠ কর তোমার প্রভুর নামে যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন জোকসদৃশ জমাট রক্ত থেকে।৯৬ঃ১-২

মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টি করেছেন জমাট রক্ত থেকে ? ওয়াও কি সাংঘাতিক কথা। আমরা জানি জীবের দেহের রক্ত যদি জমাট বেধে যায় তাহলে তা আর সারা দেহে চলাচল করতে পারে না, তাই কোষ অক্সিজেন গ্রহন করতে পারে না, তার ফলে সে মারা যায়। এখন কোরান বলছে সেই জমাট রক্ত থেকে নাকি মানুষ পয়দা হয়েছে। নারীর জরায়ুতে যখন শুক্রানু ও ডিম্বানু মিলিত হয়ে একটি ভ্রুন তৈরী করে প্রথম অবস্থায় তা একটি মাত্র কোষে সীমাবদ্ধ থাকে। সেই কোষ বিভাজনের মাধ্যমে খুব দ্রুত সংখ্যায় বৃদ্ধি পেতে থাকে ও ভ্রুনের আকার বাড়ে। তো কোরান বলছে তা নাকি জমাট রক্ত। জমাট রক্তবিন্দু কি সংখ্যায় বাড়ে নাকি? জাকির মিয়া কতটা মরিয়া বিষয়টাকে বিজ্ঞানে পরিনত করতে এটা তার একটা জ্বলন্ত নিদর্শন। লোকটা নিজে একটা ডিগ্রীধারী চিকিৎসক, আর কেউ না জানুক নিজে খুব ভাল করেই জানেন যে ভ্রুন কোন জমাট রক্ত কি না। কিন্তু ধর্মীয় অন্ধত্ব কোন পর্যায়ে পৌছলে মানুষ এভাবে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের যাবতীয় তত্ত্ব ও তথ্যকে জলাঞ্জলী দিতে পারে অবলীলায়। এখন যদি এ নিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করা হয় তো বলবে- ভ্রুনের প্রাথমিক অবস্থা দেখতে তো জমাট রক্তের মত দেখায়। কিন্তু একটা জিনিসকে -জমাট রক্তের মত দেখায়- এ বক্তব্য কি -তা জমাট রক্ত- এর সমার্থক ? বিশেষ করে আপনি যখন এধরনের বর্ননাতে বিজ্ঞানকে টেনে আনবেন তখন তো এ ধরনের অস্পষ্ট বর্ননা দিতেই পারবেন না।

তত্ত্ব-১০ঃ কোরানে জেনেটিক্স।

তিনিই সৃষ্টি করেন যুগল পুরুষ ও নারী এক বিন্দু বীর্য থেকে যখন তা স্খলিত হয়।৫৩ঃ৪৫-৪৬

এটা নাকি কোরানে জেনেটিক্স বিদ্যার নমুনা জাকির মিয়ার মতে। ব্যাখ্যা হিসাবে তিনি বলছেন- শিশু সন্তান পুরুষ নাকি স্ত্রী হবে তা নির্ভর করে ২৩তম ক্রোমোজোমের জোড়ার ওপর। এখন পাঠক/পাঠিকা বৃন্দ আপনারা দেখেন তো উক্ত সূরার মধ্যে কোন জেনেটিক্স দেখতে পান কি না। সন্তান উৎপাদনের জন্য যে বীর্য লাগে এটা তো মানুষ সেই মোহাম্মদেরও হাজার হাজার বছর আগেই জানত, আর সে সন্তান হয় হবে পুরুষ নয় স্ত্রী সেটাও তারা জানত। তবে কোরান কোন নপুংসক মানুষের কথা বলেনি। তার মানে তারা কিভাবে সৃষ্টি হয় তা কোরান জানে না। তার চেয়ে বড় যে ত্র“টি সূরাতে দেখা যাচ্ছে- শুধুমাত্র বীর্য থেকে যে সন্তান জন্মে না, দরকার একটা ডিম্বানুরও সে বিষয়টা এখানে নেই। অর্থাৎ কোরানের ধারনা মতে- সন্তান জন্মের জন্য দরকার শুধুমাত্র পুরুষের একবিন্দু বীর্য, আর যেহেতু সন্তান জন্ম দেয়ার মত উপযুক্ত অঙ্গ পুরুষের নেই শুধুমাত্র সেকারনেই নারীটির দরকার, ভ্রুনটিকে নারীর গর্ভে ধারন, লালন পালন ও পরে জন্মদান করতে। কোরানের জনন সম্পর্কিত কোন সূরাতেই নারীর ডিম্বানুর কথা বলা নেই। তা নেই কারন মোহাম্মদ জানতেন না যে নারীর জনন যন্ত্রের অভ্যন্তরে ডিম্বানু তৈরী হয় যার সাথে পুরুষের বীর্যের শুক্রানু মিলিত হয়েই অবশেষে একটি সন্তানের জন্ম হয়। তা ছাড়া তখন তো কেউই জানত না সেই ডিম্বানুর কথা, কারন তা তো খালি চোখে দেখা যায় না। পুরুষের বীর্য যেমন সবেগে প্রকাশ্য, নারীর ডিম্বানু দারুনভাবে অপ্রকাশ্য কারন তা উৎপন্ন হয় তার জননেন্দ্রিয়ের গভীরে এমনকি নারিটিও তা দেখতে পারে না।তাই অন্য সবার মত মোহাম্মদেরও ধারনা ছিল শুধুমাত্র পুরুষের একবিন্দু বীর্য নারীর গর্ভে পতিত হওয়ার পর তা বৃদ্ধি পেয়ে শিশুর জন্ম হয়। সে কথাটাই তিনি সহজ সরল ভাষায় কোরানে বলে গেছেন। এখন সেই অতি সাধারন একটা বাক্যের সাথে ক্রোমোসোম, জেনেটিক্স ইত্যাদির মত গাল ভরা বৈজ্ঞানিক শব্দ গুলো জুড়ে দিয়ে জাকির মিয়া একটা ধোয়াশা সৃষ্টি করতে চাইছেন।

যাহোক, জাকির মিয়ার এত সব কোরানিক বিজ্ঞানের ব্যাখ্যা করতে যেয়ে মাঝে মাঝে ধৈর্য্য রাখা বেশ কঠিন হয়ে যাচ্ছিল কারন এত সব ফালতু প্রলাপ আর গোজামিল জিনিসের অবতারনা তিনি করেছেন যে তার প্রতিউত্তর দেয়াটাকে আমি স্রেফ সময়ের অপচয় মনে করেছি ও মনে করেছি যে সব পাঠক সেসব পাঠ করবেন তারাই জাকিরিয় কোরানিক বিজ্ঞানের অসারত্ব ধরতে পারবেন।

জাকির মিয়ার এটা একটা অপকৌশল। তা হলো- অপ্রাসঙ্গিক ভাবে তিনি বিজ্ঞানের নানা জটিল বিষয়ের অবতারনা করে তার পর তা কোন একটা সূরার সাথে মিলাতে চেষ্টা করেন। যদি দেখেন যে তা সম্ভব হচ্ছে না তখন তিনি সূরাটিকে নিজের মত করে অনুবাদ করে নেন। তারপর তা তিনি উপস্থাপন করেন একদল মটিভেটেড শ্রোতার কাছে যারা আগেই জাকিরের ভক্ত। তখন তিনি একটি সূরার নানা রকম ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করেন, সূরার আরবী শব্দকে নানারকম ভাবে নিজের মত করে ব্যাখ্যা দেয়া শুরু করেন। শ্রোতারা তখন তার এসব ব্যাখ্যা শুনে পুলকিত বোধ করে, কারন তারা তো অত শত আরবী শব্দের অর্থ জানে না । কিন্তু নিজের মত করে সুরার অর্থ তৈরী করে নেয়া, ইচ্ছেমত সুরার ব্যাখ্যা দেয়া, অপ্রাসঙ্গিক ভাবে বিজ্ঞানের নান তত্ত্বকে কোরানের অস্পষ্ট সব সূরার সাথে গোজামিল দিয়ে মিলানোর চেষ্টা করা, মনে হয় এতে করে জাকির মিয়া ইসলাম ও কোরানের অনেক ক্ষতি করছেন যা আপাতঃ মুসলমানরা বুঝতে পারছে না। মুসলমানরা বর্তমানে জাকিরের ব্যাখ্যা শুনে দারুন পুলকিত বোধ করতে পারে কিন্তু তারা বুঝতে পারছে না শুধুমাত্র এসব কারনেই এক শ্রেনীর জ্ঞানী গুনি পন্ডিত ব্যাক্তিবর্গ কোরান নিয়ে ব্যাপক গবেষণা শুরু করে দিয়েছেন ও তারা আসল জারি জুরি প্রকাশ করে দিচ্ছেন যা আগে তারা করতেন না, করার দরকারও ছিল না। সুতরাং আশা করি, তাদের এ প্রচেষ্টা মুসলমানদেরকে আলোকিত হওয়ার ক্ষেত্রে একটা বিরাট ভুমিকা রাখবে।

পরিশেষে আমি লালন ফকিরের একটা গানের কলি বিশ্লেষণ করে প্রবন্ধটির ইতি টানব। তা হলো-

বাড়ীর কাছে আরশী নগর , সেথায় পড়শী বসত করে, আমি একদিন ও না, চিনিলাম তারে।
আরশী নগর মানে কাচের নগর অর্থাৎ প্রতি নগর। সেখানে মানুষ জন বাস করে কিন্তু আমরা তা দেখতে পাই না। তার মানে সেটা একটা প্যারালাল ইউনিভার্স বা সমান্তরাল বিশ্ব বা প্রতি বিশ্ব। যা বিজ্ঞানীরা তাদের নানারকম তত্ত্বে বলার চেষ্টা করছেন। তা কিনা লালন ফকির অনেক আগেই জেনে গেছেন? কোরানে যদি এ ধরনের একটা বাক্য থাকত জাকির মিয়া নিশ্চয়ই তাকে এভাবেই ব্যাখ্যা করতেন , কি মনে হয় পাঠক/পাঠিকা বৃন্দ?