জ্ঞান বিজ্ঞান, অর্থনীতি, সামরিক শক্তি বা মানসিকভাবে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্টীর কিছু সাধারন বৈশিষ্ট্য থাকে। সোনালী অতীতের স্বপ্নে বিভোর থাকা তার মধ্যে একটি। আরেকটি বৈশিষ্ট্য হল নিজদের অক্ষমতা বা দুরবস্থার জন্য অন্যদের দায়ী করা। অনেক রকমের কনস্পিরেসি থিওরী আবিস্কার করা এবং মিথ্যা কাল্পনিক ঘটনায় শান্তি খোজা। নিজেদের দুরবস্থার জন্য যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে মানুষ নিজেই দায়ী তা তারা স্বীকার করতে চায়না।
কিছু উদাহরন দেই। আমাদের দেশে অনেকেই এখনো বলেন যে পাকিস্তান আমলই ভাল ছিল। অনেকে আবার এরকম ও বলেন যে, শায়েস্তা খার আমল ই ভাল কারন টাকায় ৮ মণ চাল পাওয়া যেত। আমরা প্রায় ই বলি, যায় দিন ভাল, আসে দিন খারাপ। প্রায়ই আমরা দেখি যে কেউ একজন স্বপ্নে দেখেছেন যে নবীজী এসে তাকে কিছু একটা নির্দেশ দিয়েছেন। সে যাতে এই নির্দেশ এর ৪০ টা কপি করে বিলাতে থাকে। এর সাথে থাকে আবার সাবধান বানী। অবিশ্বাস করলে শাস্তি আর বিলালে অশেষ পুরস্কার। আগে এসব ফটোকপি হয়ে আসত এখন আসে মেইল এ। মুসলমানরা জ্ঞান বিজ্ঞান এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়ার ফলে বিভিন্ন রকমের এরকম আজগুবি তথ্য ও ইতিহাস বিলিয়ে তারা আত্মার শান্তি খোজে। এক হাজার বছর আগে কিছু মুসলিম বিজ্ঞানীর অবদান নিয়ে এখনো বড়াই করে (সেই বিজ্ঞানীরাও কতটা মুসলিম ছিলেন বা মুসলিম শাসক রা তাদের কি দৃষ্টিতে দেখত সে বিতর্কে নাই বা গেলাম)। কিংবা ধরুন নীল আর্মস্ট্রং এর মুসলমানিত্বের খবর ইত্যাদি। এ নিয়ে হাস্যকর ভিডিও ও আছে দেখলাম ইউটিউব এ।

এরকম আরেকটি কন্সপেরিসি থিওরী হল এপ্রিল ফুল ডে তে কিভাবে স্প্যানিশরা মুসলমানদের বোকা বানিয়েছিল তার গল্প। এই কন্সিপেসি থিওরীর ও আবার দু তিনটা ভাষ্য আছে। এই প্রবন্ধে আমরা দেখার চেষ্টা করব কন্সপিরেসি থিওরী গুলো কি। এপ্রিল ফুল এর আসল ইতিহাস কি এবং স্প্যানিশ ইসলামের ইতিহাস আসলে কি।

ইসলামিক কন্সপিরেসি থিওরীর জনপ্রিয় সংস্করণটি এরকম-
শান্তিপ্রিয় মুসলিম শাসকরা গ্রেনাডায় শান্তিপূর্ণ ভাবে রাজত্ব করে আসছিল। অত্যাচারী রাজা ফার্দিনান্দ ও শয়তান ইসাবেলের বাহিনী গ্রেনাডা আক্রমণ করে। তার গ্রাম ঘর জ্বালিয়ে ছারখার করে রাজধানীতে উপস্থিত হয়। তখন তারা ঘোষণা করে যে মুসলমানরা যদি মসজিদে আশ্রয় নেয় তাহলে তাদের মারা হবে না। কিন্তু মোনাফেক ইহুদী নাসারারা মসজিদে আগুন ধরিয়ে হত্যা করে নিরপরাধ মুসলিমদের। সেদিন ছিল এপ্রিলের ১ তারিখ। মুসলিমদের এই বোকা বানানোর গল্প থেকেই নাকি এপ্রিল ফুল পালিত হয়। তবে এর স্বপক্ষে নিরপেক্ষ ঐতিহাসিক প্রামাণ পাওয়া দুস্কর।

আরেকটি থিওরী হল, মুসলমানদের পরাজিত করার জন্য ইহুদী খ্রিষ্টান রা মদ ও সিগারেট পাঠানো শুরু করল। মুসলমানরা সেগুলো সেবন করে তাদের তাকওয়া থেকে দূরে সরে যায় এবং পরাজিত হয়।
সমস্যা হল বরাবরের মত এসব ইসলামি কন্সপিরেসি থিওরীর কোন তথ্যসুত্র বা রেফারেন্স নেই। তারা কোন ঐতিহাসিক সূত্রের রেফারেন্স দিয়ে এসব তথ্যের সত্যতা যাচাই করেন না। ঘটনার বিপরীত সূত্র দিলে বলেন যে এগুলো ইহুদী নাসারাদের দেয়া তথ্য, বিশ্বাস করতে নেই।

এবার দেখি স্প্যানিস ইসলামের আসল ইতিহাস। এ ইতিহাসে অনেক ঘটনা আছে। ৮০০ বছরের মুসলিম শাসনের অনেক উত্থান পতন আছে। আমি খুব সংক্ষেপে বলার চেষ্টা করছি। ইউরোপে মুসলমান আগ্রাসন শুরু হয় ৭১১ সাল থেকে। বিষেশ করে আইবেরিয়ান পেনিনসুলা (আজকের স্পেন এবং পর্তুগাল) এরিয়ায় তারা দখল করতে থাকে। ৭১১ সালের ৩০ এপ্রিল মুসলিম যোদ্ধা তারিক বিন জায়ীদ প্রথম জিব্রাল্টার প্রনালীতে উপস্থিত হন। সে যুগের ইউরোপ ছিল অসংখ্য ছোট স্টেট- এ টুকরা টুকরা হওয়া। তেমন কোন বড় রাজ্যের অস্তিত্ব এই পেনিন্সুলায় ছিলনা। তারা ছিল নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে ব্যস্ত। গ্রীক ও রোমান সাম্রাজ্যের ধ্বংশের পর ইউরোপে একধরনের অন্ধকার অবস্থা বিরাজ করছিল। অন্যদিকে সামরিক শক্তিতে আরবদের উত্থানের যুগ। এই অবস্থায় মুসলিমরা আক্রমণ করে আইবেরিয়ান পেনিনসুলায়। এই অঞ্চলকে তারা বলত আল আন্দালুস। তারা দখল করে নেই আইবেরিয়ার একাংশ। এসময়ে তারা চার্চ ও সিনাগগ নির্মানের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। অমুসলিমদের উপর আরোপ করে জিজিয়া কর। তাদের অনেক রকমের যুদ্ধ বিগ্রহের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। ইউরোপের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলোর ক্রমাগত আক্রমণের মোকাবেলা করতে হয়েছে। এ অবস্থা চলতে থাকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত। তখন ইউরোপ আবার জেগে উঠতে শুরু করেছে। ইউরোপের রেনেসাঁর যুগ। একত্র হওয়া শুরু করেছে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যগুলো। ইউরোপ তখন আবিস্কার আর দেশ জয়ের নেশায় বিভোর। আর অন্যদিকে শুরু হয়েছে মুসলিমদের পতনের যুগ। উমাইয়া আমলের শেষ থেকে মুসলমানেরা নৈতিক, সামরিক সব দিক থেকে পর্যুদস্ত। মোল্লা তন্ত্র, প্রতিক্রিয়াশীলতা, বিভিন্ন মতবাদে বিভক্তি হয়ে নিজেদের মধ্যে মারামারি ইত্যাদি তখন চরমে। সেই চরম অবস্থা থেকে তারা আজো বের হতে পারেনি। কাজেই ইতিহাসের একটা ঘটনা সেই সময়ের পারিপার্শ্বিক অবস্থা, অর্থনৈতিক পরিস্থিতি এসবের সমন্বয়ে বিচার করতে হবে। কে মুসলিম আর কে খ্রিষ্টান সেটা দিয়ে করলে আসল সত্য বেরোবে না।

ইতিহাসে একটা মজার ব্যাপার লক্ষ্য করা যায়। সাধারনত গড়ে একেকটি সভ্যতা তিনশ বছর করে থাকে। কম বেশি হতে পারে। চীনের মিং বংশ থেকে শুরু করে গ্রিক, রোমান, মেসেপটেমিয়ান, এমনকি মোঘল সাম্রাজ্য। ইসলামের ও অনেকটা তাই। সাফল্যের শিখরে থাকতে থাকতে তার মধ্যে বোধহয় একধরনের স্থুলতার জন্ম নেয়। শুরু হয় পতনের পালা।

দশম শতাব্দী থকেই স্পেনে শুরু হয় মুসলিম দখলদারিত্ব থেকে তাদের মাতৃভুমি রক্ষার সংগ্রাম। একে বলা হয় রিকনকোয়েস্ট। স্পেনের দুটি ক্ষুদ্র রাজ্যের প্রধান রানী ইসাবেল অফ ক্যাস্টেল এবং ফার্দিনান্দ III অব এরাগন এক হয়ে শুরু করে মুসলমানদের বিরুদ্ধে সম্মিলিত আক্রমণ। টানা দশ বছর এই আক্রমন চলে। শেষে বো আবদেল ( যিনি নিজেকে ষোড়শ মোহাম্মদ ঘোষণা করেছিলেন) এর সময়ে ১৪৯২ এর ২ জানুয়ারি তাদের পতন হয়। বো আবদেল তার দলবলসহ আত্মসমর্পন করেন। তার পরেও প্রায় ১৬শ শতক পর্যন্ত মুসলমানদের অবস্থান ছিল গ্রেনাডায়। মুসলমান দখলদারিত্ব মুক্তির এই দিনটি সেখানে প্রতিবছর এখনো পালিত হয়।

কাজেই দেখা যাচ্ছে যে এপ্রিল ফুল এর সাথে ইসলামি কন্সপেরিসি থিওরীর আসলে কোন যোগাযোগ নেই।

এবার দেখা যাক এপ্রিল ফুল এর ইতিহাস নিয়ে গল্পগুলো কিরকম।
এপ্রিল ফুল এর কোন প্রামান্য ইতিহাস পাওয়া যায়না। কেন শুরু হয়েছিল, কবে থেকে,কোথায় এসব নিয়ে বিভিন্ন গল্প প্রচলিত আছে। বহুল প্রচলিত গল্পটি ফ্রান্সের। ১৫৫৬ সালে রাজা গ্রেগরি, জুলিয়ান ক্যালেন্ডার থেকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের প্রচলন করেন। জুলিয়ান ক্যালেন্ডার অনুযায়ী মার্চের ২৫ থেকে এপ্রিলের ১ তারিখ পর্যন্ত নতুন বছরের উৎসব পালন করা হত। কিন্তু গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারে পরিবর্তনের সাথে সাথে নতুন বছর হয়ে যায় ১ জানুয়ারি। সে যুগে তথ্য আজকের মত এত দ্রুত পৌঁছানো যেতনা। ফলে দুরবর্তি অনেক এলাকার মানুষ নতুন তারিখ সম্পর্কে জানত না। অনেকেই এর ফলে বিড়ম্বনার শিকার হত, এবং রাজধানীর মানুষের হাস্যরসের উপাদান হত। এই ঘটনা থেকেই আস্তে আস্তে এপ্রিল ফুল পালনের রেওয়াজ ঘটে।

অনেকে বলেন যে, এপ্রিল ফুল পালনের ঘটনা আরো আগের। ইংরেজ কবি চসারের ক্যান্টারবেরি টেইলস এর একটি ছত্রে এর উল্লেখ আছে। কেউ কেউ আবার রোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন ঘটনায় এর উৎস সন্ধান করেন।

ফ্রান্সে পয়সন দ্য আভ্রিল পালিত হয় এবং এর সাথে সম্পর্ক আছে মাছের। এপ্রিলের শুরুর দিকে ডিম ফুটে মাছের বাচ্চা বের হয়। এই শিশু মাছগুলোকে সহজে বোকা বানিয়ে ধরা যায়। সেজন্য তারা ১ এপ্রিল পালন করে পয়সন দ্য এভ্রিল অর্থাৎ এপ্রিলের মাছ। সে দিন বাচ্চারা অন্য বাচ্চাদের পিঠে কাগজের মাছ ঝুলিয়ে দেয় তাদের অজান্তে। যখন অন্যরা দেখে তখন বলে ওঠে পয়সন দ্য আভ্রিল বলে চিৎকার করে।
এরকম আরো বিভিন্ন মজার গল্প বা উপকথা আছে এপ্রিল ফুল নিয়ে।

যে কারনেই উদ্ভুত হোক না কেন, এপ্রিল ফুল নির্মল বিনোদনের উৎস হয়ে আছে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে। একদিন তারা সিরিয়াসনেস ভুলে দুষ্টুমিতে মেতে ওঠে। অনেক বোকা বানানোর গল্প বিখ্যাত হয়ে আছে।

ইসলামে হাস্যরসের স্থান খুবই কম। তারা সব কিছুতেই সিরিয়াস। পরকালে দোজখের চিন্তা আর আল্লার গোলামীর চেষ্টায় হাস্যরস একধরনের সাইডলাইনের জিনিস ইসলামে। তার একটি বড় প্রমান আমাদের দেশে কার্টুনিস্ট আরিফের কার্টুন। কাজেই, ধর্মকারী সাইটের একটি বহুল ব্যবহৃত উক্তি — দেয়ার ইজ নো হিউমার ইন রিলিজিয়ন।

তথ্যসুত্রঃ
museumofhoaxes.com
Wikipedia
Anseringislam.com
Spanish Islam by Reinhart Dozy
আধুনিক ইউরোপের ইতিহাস- মোহাম্মদ হাসান।