আমার লেখক হওয়া হলো না
-মোকছেদ আলী।*
….. আগামীকাল পবিত্র শুক্রবার, জুম্মাবার, বড়ই ফজিলতের দিন। কাল-ই মূর্তির জন্য অর্ডার দিব।

দুনিয়ার বুকে যত সম্মানিত শ্রদ্ধেয়, জ্ঞানী ও গুণী ব্যক্তি আছেন বা ছিলেন সবাই কিন্তু লেখক। লেখক যদি জ্ঞানীর জ্ঞান কাগজের পৃষ্ঠায় লিপিবদ্ধ করে না রাখতেন তবে সেই জ্ঞান, জ্ঞানী ব্যক্তির মৃত্যুর সাথে সাথে চির বিদায় নিয়ে চলে যেত। সেই জ্ঞান দ্বারা পরবর্তী বংশধরদের কোনই উপকার বা লাভ হতো না।
যেমনটি হয়েছে মিসরের ফেরাউন বাদশাহর আমলে। তখনকার বিজ্ঞানীগণ আজ থেকে হাজার হাজার বৎসর পূর্বে মিসরের ফেরাউন বাদশাহর আমলে, বাদশাহগণের মৃত্যু হলে তাদের মৃতদেহকে এক প্রকার আরক দ্বারা ভিজিয়ে পচনরোধ করতেন। তারপর তাকে সমাহিত করা হতো। আজও মিসরের ফেরাউন বাদশাহর মৃতদেহ অবিকৃত অবস্থায় আছে।
আজ থেকে হাজার বছর পূর্বে ঐ লাশ সমাহিত করা হয়েছে কিন্তু চুলমাত্র বিকৃত হয় নাই। দেখলে মনে হয়, এই মাত্র মৃতদেহটি কবরে দেওয়া হলো। আর মনে হবে এই ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছে মাত্র ঘন্টা দুই পূর্বে। অথচ পন্ডিতেরা হিসাব করে দেখেছেন আজ থেকে কয়েক হাজার বছর পূর্বের লাশ। ভবিষ্যতে আরো এরকম কত হাজার বছর যে অবিকৃত অবস্থায় থাকবে, কোন বিজ্ঞানী তা বলতে পারেন নাই। তবে কোন এক রসায়নবিদ বলেছেন যে কেয়ামতের পূর্ব মূহুর্ত পর্যন্ত এরুপ তরতাজা অবস্থায় থাকবে।
এখন চিন্তা করে দেখুন? যদি সেই সময়কার রসায়নবিদ ঐ বিদ্যাটাকে কোন কিছুতে লিপিবদ্ধ করে রাখতেন তবে আজকের বাজারেও সেই বিদ্যা দ্বারা কত উপকার পাওয়া যেত। যদিও বর্তমান যুগের রসায়নবিদগণ কিছু আরক তৈরি করেছেন কিন্তু পূর্ব জমানার রসায়নবিদগণের আরকের ন্যায় অত দীর্ঘস্থায়ী করতে পারেন নাই। সুতরাং লেখক না থাকায় ঐ মূল্যবান বিদ্যাটা দুনিয়ার বুক হতে চিরতরে বিদায় নিয়েছেন।
আবার দেখুন, ফেরাউন বাদশাহদের অবিকৃত লাশের সমাধীর উপর দুনিয়ার অত্যাশ্চর্য পিরামিড সৌধ নির্মান করেছে, তারও নির্মাণ কৌশল পদ্ধতি স্থাপত্য শিল্পী লিপিবদ্ধ করে রাখেন নাই। এখনকার পন্ডিতেরা পিরামিড়ের নির্মাণ কৌশল নিয়ে কত চিন্তা ভাবনা গবেষণা করেছেন কিন্তু আসল তথ্য বের করতে পারছেন না। কোন একজন হয় নির্মাণ পদ্ধতির একটা ব্যাখ্যা প্রদান করলেন, পরক্ষণেই অপর পন্ডিত ভুল প্রমাণিত করে ব্যাখ্যা করলেন। ফলে আসল তথ্য আর উদ্ঘাটিত হচ্ছে না।
আবার দেখুন- সক্রেটিস, এরিস্টোটল, হোমার প্রমুখ বিদ্বান, দার্শনিক, কবি যে সমস্ত দর্শন বিদ্যা লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন আজ কয়েক হাজার বছর গত হয়েছে, এখনও তাদের সেই বিদ্যা দ্বারা মানব সমাজ উপকার লাভ করছে। ফলে তাদের নাম জনগণের মনে উজ্জ্বলভাবে অমর হয়ে আছে। হোমারের ইলিয়াড পড়ে সব লোক জ্ঞান আহরণ করছে ও অপার আনন্দ লাভ করছে।
তাওরাত, ইঞ্জিল, ত্রিপিটক, বেদ, মনুসংহিতা প্রভৃতি গ্রন্থের প্রণেতাগণ তা লিপিবদ্ধ করায় মুসা, ঈসা, দাউদ, বেদের পন্ডিতগণ অমর হয়ে আছেন। বর্তমান বিজ্ঞানের যুগ বিজ্ঞানের বহু সূত্র গ্রন্থের মধ্যে লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। তাই তো নিউটন, আইনষ্টাইন, ফ্যারাডে, এডিসন প্রভৃতি বিজ্ঞানীগণ অমর হয়ে আছেন।
কাজেই অনেক চিন্তা ভাবনা করে স্থির সিদ্ধান্তে পৌছুলাম, আমি লেখক হব। এবং আমিও দুনিয়ার বুকে চির অমর হব। আহ্ কি সুখ! আমি মরে যাব অথচ আমার কীর্তিগাঁথা জগতের বুকে, মানুষের হৃদয়ে, কিতাবের পৃষ্ঠাভরে প্রভাতী তারার মত জ্বল জ্বল করে জ্বলবে। চিন্তা করেও সুখ! পরম সুখ!!
কিন্তু? কিন্তু আবার কি? কি বিষয়ের উপর লিখব? লিখতে হলে যে লেখাপড়া জানতে হয় তাতো আমার নাই। আমি তো সাড়ে ষোল আনা ব-কলম।
তবুও আমি লিখব। কারণ আমি তো লিখব না, লিখবে আমার কলম। পুরাকালে কালিদাস তো লেখাপড়া জানতেন না। রাজকুমারী স্ত্রীর হাতে ঝাটার বাড়ি খেয়ে বিদ্যাদায়িনী দেবী স্বরস্বতীর আরাধনা করতে থাকেন। কালিদাসের নিষ্ঠাবান আরাধনায় দেবী স্বরস্বতী যৎপরোনাস্তি সন্তুষ্ট হয়ে কালিদাসকে কৃপা করেন। দেবী স্বরস্বতীর কৃপায় কালিদাস পাঠশালায় পাঠ না নিয়ে মস্তবড় কবি হন এবং শকুন্তলা, মেঘদূত, কুমারসম্ভার প্রভৃতি অমর কাব্য রচনা করেন। মহাকবি উপাধী পেয়ে কালিদাস ইতিহাসের পাতায় অমর হলেন। তার নাম সোনার অক্ষর দিয়ে লেখা হল। তিনি বাদশাহ্ বিক্রমাদিত্যের রাজসভায় রাজ কবিরূপে স্থান লাভ করেন।
স্কুল কলেজে পড়ার পরিশ্রম নাই, কাগজ কলম কেনার প্রয়োজন নাই। রাত জেগে পরীক্ষার পড়া নাই। পরীক্ষার হলে গিয়ে প্রশ্নপত্র হাতে নিয়ে বুকের মধ্যে টিপটিপানি নাই। ফেলের কোন আশংকা নাই। উপরন্তু পিতার কষ্টার্জিত অর্থের অপচয় নাই। অতএব আজ হতে আমি দেবী স্বরস্বতীর আরাধনা করব। সেজন্য মূর্তি তৈরি করাবো কুমারকে দিয়ে। রাজহংস ও পদ্মফুলের উপর দেবী মূর্তি বানিয়ে আমার শোবার ঘরে রেখে আরাধনা করতে থাকবো।
গঙ্গা হতে এক কলসী পবিত্র ঘোলা জল এনে রাখবো। আর একটি ধূপদানি মাটির তৈরি কম দামের ধূপদানিতে ধূপ পুড়িয়ে সুগন্ধ ধোয়া দিব। আর বেলের পাতা? সে তো আমাদের দুই দুইটা বড় বড় গাছ আছে, পাতা অভাব হবে না। ছোট ভাগ্নেটাকে গাছে তুলে দিয়ে এক বোঝা পেড়ে নিব। বেশ মাসখানেক ঐ পাতাতেই চলবে। আরাধনার নিমিত্ত কাইশে দিয়ে ছোট একটা আসন বানিয়ে নিব। বাস!
ঠিক আছে, আগামীকাল পবিত্র শুক্রবার, জুম্মাবার, বড়ই ফজিলতের দিন। কাল-ই মূর্তির জন্য অর্ডার দিব। তারপর মূর্তি গড়াতে আর কয়দিন সময় লাগবে? ১০/১৫ দিনের মধ্যেই মূর্তি হবে। অহো! বিদ্যাদায়িনী মাতা দেবী স্বরস্বতীর মূর্তি দেখতে কত সুন্দরই না হবে! হলুদ রঙের ঠোঁট বিশিষ্ট সাদা রাজ হাঁসের পিঠের উপর মা দেবী স্বরস্বতী বসে থাকবেন। আর দেবীর হাতে থাকবে বীনা নামজ বাদ্যযন্ত্র। দেবীর পরিধানে সাদা শাড়ীর সোনালী পাড়যুক্ত, শাড়ী দিয়ে দেহ আবৃত থাকবে। কিন্তু মাথায় ঘোমটা থাকবে না। দেবীর বাহন হাঁসটা প্রকান্ড একটা পদ্মফুলের উপর স্থাপিত হবে। দেবীর মুখখানা পাতলা, বড় সুন্দরী। দেখলেই মা মা করে চিৎকার দিয়ে ডাকতে প্রাণ আনচান করবে।
দেবীর আরাধনা কায়মনোবাক্যে করতে থাকবো। তারপরে জ্ঞানদায়িনী দেবী স্বরস্বতী মহা সন্তুষ্ট হয়ে কালিদাসের ন্যায় আমাকেও বরপুত্র করবেন। দেবীর কৃপায় আমিও মহাকবি কালিদাসের ন্যায় শকুন্তলা লিখব।
না, না, শকুন্তলা লিখলে তো কালিদাসের আত্মীয়েরা সর্বসত্ব সংরক্ষিত আইনের ধারায় আমার নামের উপরে জেলার আদালতে কেস ঠুকে দিবেন। উকিল বাবুরা, মোক্তার বাবুরা পেশকারের সঙ্গে পরামর্শ করে খালি তারিখের পর তারিখ ফেলাবে। হাকিম সাহেব একটা মামলার শুনানীতেই তার হাজিরা হালাল করবে।
মামলার দিন বাড়ি ফিরে পকেটে হাত দিয়ে দেখবো যে, যা নিয়ে গিয়েছিলাম আল্লাহর রহমতে সবই খরচ করে এসেছি। একটা পাঁচ পয়সাও পকেটে নাই। সুতরাং আমার গিন্নী হাড় কিপটে কৃপণ বলে ভর্ৎসনা করতে পারবে না। কি দরকার, এত সব হাঙ্গামার চেয়ে বৃদ্ধিমানের মত শকুন্তলার পরিবর্তে চিলতলা কাব্য লিখব। লিখে অমর হব। ফেরাউনের লাশের মতন অমর না হই, ইতিহাসের পাতায় তো অমর হব।
ঠিক ঠিক শকুন্তলা হতে চিলতলা কাব্যই বর্তমান আধুনিক যুগের সঙ্গে, আধুনিক সমাজের সঙ্গে, আধুনিক রাজনীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। অতএব কাব্যের কাটতি বেশী হবে। প্রকাশকের অধিক মুনাফা অর্জিত হবে। প্রকাশকের মুনাফা অধিক হলে আমারও সিকিটা আধুলিটা বরাতে জুটবে। আবার আমার প্রকাশক মহাশয়গণ সদাশয় বা দেশ সরকারের কাছে কপি রাইট স্বত্ব রেজিস্টারী করবে। মুজতবা সাহেব বেঁচে থাকলে, বর্তমান বই পুস্তকের কাটতি দেখে বই কেনা নিবন্ধের দরুন লজ্জায় লাল ডগ ডগ হতেন। বইয়ের কাটতি খুব বেশি বেশি হতে দেখেই কাগজ ছয়ের স্থলে দশ টাকা দিস্তা হয়েছে। দুই পয়সার ধারাপাত ৫ টাকা হয়েছে। মুজতবা সাহেবের নিবন্ধ পাঠ করেই তো বাঙালির বোধোদয় হয়েছে। লাইনে দাঁড়িয়ে বই কিনতে শিক্ষা লাভ করেছে। মওকা বুঝে লাইব্রেবী-ওয়ালারা চট করে সাইন বোর্ড ঝুলিয়ে দিচ্ছে-out of print
আগেকার দিনে মানে আদিম আমলে বোকা মানুষেরা তো কারো জিনিস কেড়ে নিত না। শকুনের মত মিলে মিশে দলবদ্ধ হয়ে খেত। তাদের আচার আচরণ ছিল শকুনের মতই ধীর স্থির। খাবার নাই তো চেঁচামেচি নাই। চুপ করে মগডালে বসা শকুনের মতই নীরবে ঝিমাত। বাদশাহ বিক্রমাদিত্যের আমলে রাজনৈতিক দলাদলি ছিল না, এত মিছিল হরতালও ছিল না। বুড়ো শকুনের মত সবাই শান্ত নিরীহ ছিল। কালিদাস বাবু সমাজের ও রাজ্যের ঐ সব শান্ত প্রকৃতির রূপ দেখে তার অমর কাব্যের নাম রাখলেন শকুন্তলা।
আমিও আমার সমাজের সঙ্গে দেশের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে আমার অমর কাব্যের নাম রাখব চিলতলা। হরতাল, হাইজ্যাক, লুণ্ঠন, ভাঙ্চুর, আইন অমান্য, চুরি, ডাকাতি, রাহাজানির সঙ্গে চিল চরিত্রের বড়ই মিল, বড়ই সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। সুতরাং আমার অমর অমর কাব্যের নাম রাখব চিলতলা।
আমার অমর কাব্য চিলতলা অবলম্বনে কত নাট্যকার নাটক রচনা করে মঞ্চস্থ করবে। আবার সবাক চিত্র ব্যবসায়ীরা সবাকচিত্রে রূপান্তরিত করে চিল চরিত্রের জনগণকে অবাক করে দিবে।
সুতরাং স্বরস্বতী মা-য়ি কি জয়!
উহু, অসুবিধা আছে। আমি যে টিকিবিহীন নেড়া মুসলমান। আমি শোবার ঘরে দেবী স্বরস্বতীর মূর্তি গড়িয়ে দিন রাত পূজা করছি। তখন আমার সমাজের লোকেরা জানতে পারলে দলবদ্ধ হয়ে লাঠি সোটা, ইটপাটকেল, এমন কি আধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র নিয়ে আমার ঘর ঘেরাও করে আক্রমণ করবে। শুধু তাই নয়, তারা আমার আত্মীয়-স্বজনদেরকেও আক্রমণ করতে পারে। কেননা আমি তাদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয় হয়ে, শোবার ঘরে বসে এমন একটি দুষ্কর্ম করছি তারা জেনে শুনে এমন একটা কুফুরী কার্যকে বাধা দেয়নি বরং সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে। এই সমস্ত কুফর ধ্বংস করলে অশেষ সওয়াব পাওয়া যাবে। যদি তাদের অর্থাৎ ঐ কাফেরদের হাতে তারা নিহত হয়, তবুও তারা শহীদ হবে। শহীদের দরজা বা মর্তবা সবার উপরে। সে বিনা হিসাব নিকাশে সরাসরি বেহেস্তে প্রবেশ করবে। বেহেস্তে যাওয়ার এমন মহা সুযোগ তারা হেলায় হারাবে না।
অতএব মাতা দেবী স্বরস্বতীর আরাধনা করা বা অর্চনা করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। আর সেই উন্মত্ত জনতা শুধুই কি আমাকে নিহত করে ক্ষান্ত হবে? না, তা হবে না। তারা দেবী স্বরস্বতীকে পর্যন্ত হত্যা করবে। রাজহংসটিকে পর্যন্ত আঘাতের পর আঘাত হেনে চূর্ণ বিচূর্ণ করে দেবে। দেবীর হাতে রক্ষিত বাদ্যযন্ত্রটি পর্যন্ত রক্ষা পাবে না।
সেদিন কিরূপ হবে? ভীষণ ভয়াবহ দৃশ্য হবে। মনোচক্ষে একবার দেখে নিই।
আমি পালাবার পথ পাচ্ছি না। যেদিক দিয়েই দৌড় দেই সেই দিকেই উন্মত্ত জনতার উদ্যত লাঠি আমার মাথা চূর্ণ করার জন্য দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমিও বাঁচাও বাঁচাও করে আকাশ বাতাস কম্পিত করে মরণ চিৎকার করছি কিন্তু কেউই আমাকে বাঁচাবার চেষ্টা করছে না। বরং মারমুখী জনতা আমার আর্তচিৎকার শুনে খুশিতে, মহানন্দে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ছে। আবার জনতার মধ্য হতে একজন চিৎকার দিয়ে ব্যঙ্গ করে বলছেÑ তোকে বাঁচাবার জন্যই তো আমরা এসেছি। তোকে বাঁচাবো। এমন বাঁচান বাঁচাবো যে, আর জীবনে মৃত্যু হবে না।
কিম্বা আমার সাধু সংকল্পের কথা অনেক পরে জানাজানি হয়ে গেল। আমি তখন সব লেখকদের উপরে উঠেছি। আমার চিলতলা নোবেল পুরস্কার পেয়ে আমার খ্যাতি বিশ্বময় ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু মানুষ তো আর চিরকাল বেঁচে থাকে না, একদিন নিয়মের রাজত্বে তাকে মৃত্যুর কোলে আশ্রয় নিতে হবে।
আমার মৃত্যু হলে আমার সমাজের লোকেরা কিম্বা আমার জ্ঞাতি ভ্রাতারা কেউই আমার সৎকার করতে আসবে না। তারা আমাকে কাফের ঘোষণা করে আমার লাশের জানাজা দিবে না। কাফন দাফন করবে না। আমাকে স্পর্শ করবে না। আমি আমার ঘরে চৌকির উপরিভাগে সটান পড়ে থাকবো। আমার দেহে প্রাণ থাকবে না। প্রাণহীন দেহ তো বেশিক্ষণ থাকে না। লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি জীবানু এসে আমার দেহখানার মধ্যে বসতবাড়ি গড়ে তুলবে। তখনই আমার মাংস পঁচে যাবে। আর পচা মাংসের দুর্গন্ধ চারিদিক ছড়িয়ে পড়বে। জীবিত মনুষ্যগুলির তখন কিরূপ ভীষণ অসুবিধা হবে? পাড়ায় টিকতে পারবে না। গন্ধে অনেক পাড়া ত্যাগ করে নিরাপদ স্থানে চলে যাবে। পথচারী পথিকগণ নাকে কাপড় দিয়ে দৌড়ে আমার পাড়া ত্যাগ করবে। আমার দেহ পচার দূর্গন্ধে গ্রামের বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠবে।
অতএব দেবী স্বরস্বতীর আরাধনা করে তার বরপুত্র কালিদাসের দোষর হওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হবে না।
তাহলে উপায়?
উপায় আছে- ইচ্ছা থাকলে উপায় হয়, where there is will there is way । আমাকে লেখাপড়া শিখতে হবে। এটাই উৎকৃষ্ট উপায়। লেখাপড়া শিক্ষা শেষে লেখক হবার চেষ্টা করতে লাগলাম।
কিন্তু লেখক হতে গিয়ে খক খক করে কাশতে লাগলাম। কি বিষয়ের উপর লিখব? কবি কালিদাসের মত কাব্য লিখে অমর হবে? সে গুড়ে বালু। হোমার, দান্তে, সেক্সপিয়ার, সাদী, ইকবাল সব শেষে রবি ঠাকুর, নজরুল কিছু কি বাদ রেখেছেন? সব বিষয়ের উপর তারা লিখে অমর হয়ে আছেন। সুতরাং কাব্য লিখে আমার অমর হবার সব পথ বন্ধ করে দিয়েছেন। সাগরদাড়ির মাইকেল মধুসূদন মেঘনাধ বধ কাব্য লিখে আমার কবি হওয়ার ইচ্ছাটাও বধ করে দিয়েছেন। গদ্য কবিতা লিখব, তাতো শামছুর রহমানের কারণে হয়ে উঠবে না। যেটুকু খোলা ছিল, সেটুকু বন্দে আলী মিয়া এসে বন্ধ করে দিয়েছেন। আমার জন্য একটুকুও ফাঁক রাখেন নাই। অতএব ঐপথে পা বাড়ানো যাবে না। অনর্থক পণ্ডশ্রম হবে। তাহলে?
তাহলে গল্প লিখব। মজাদার গল্প লিখব। উহু ও পথ তো আলেফ-লাইলার লেখক বন্ধ করে দিয়েছেন। ইউসুফ, আলেকজান্ডার দুমা কেউ কি আমার জন্য একটু পথ খোলা রেখেছেন? সব তারা বন্ধ করে দিয়েছেন।
তাহলে ইতিহাস লিখব!
না তাও হল না, এদিকে সবচেয়ে বড় শত্রুতা করেছেন এনসাইক্লোপেডিয়া অব ব্রিটানিকার লেখকগণ।
বিজ্ঞানের সূত্রগুলি লিখে অমর হব? নিউটন, আইনস্টাইন, জগদিশ, এডিসন, ফ্যারাডে এরা সবাই আমার সঙ্গে শত্রুতা করে আমার অমর হবার পথ বন্ধ করে দিয়েছেন।
সুতরাং আমার লেখক হবার সৌভাগ্য আর হলো না।
—-
অনুলেখক- মাহফুজ।
*মোকছেদ আলী(১৯২২-২০০৯)। সিরাজগঞ্জ জেলার বেলতা গ্রামে জন্ম। গ্রামটি নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। স্বশিক্ষিত (পাঠশালায় তৃতীয় শ্রেণী পর্যন্ত অধ্যয়ন)।