[মানব বিবর্তন বিষয়ক একটি বইয়ের ফসিল অংশটা লেখার পরিকল্পনা রয়েছে। এই লেখাটির মাধ্যমেই তার সূচনা ঘটছে। শুরুটা একটু গল্পের মত করা হয়েছে। তবে এর পর থেকে একেবারে অবজেক্টিভ জীবাশ্ম- প্রত্ন-নৃ বিজ্ঞান আলোচনা শুরু হবে হয়ত…]

অন্যদের মত অতো ভোরে ঘুম থেকে উঠতে পারে না শানিদার ৩। বয়স তো তার কম হয়নি। নিয়ানডার্থালদের জন্য ৪০ মানে শেষ বয়স।[১] বার্ধক্যের পাশাপাশি হাঁটুর সন্ধিতে তীব্র ব্যথা তাকে প্রায় কাবু করে ফেলেছে।[২] অথচ জীবনের প্রতিটা দিন এখনও তার কাছে প্রকৃতির উপহার মনে হয়। পরিবার-পরিজনের সেবা শুশ্রুষা আর আত্মীয়-স্বজনের উষ্ণ সহানুভূতি থাকতে তার পক্ষে জীবনকে ফাঁকি দেয়া সম্ভব না। তার উপর সম্প্রতি সে শানিদার গুহার প্রেমে পড়ে গেছে।

আজ ঘুম ভাঙার পর পায়ের ব্যথাটা একটু কম মনে হচ্ছে। এমনিতে লাঠিতে ভর না দিয়ে হাঁটতে তার কষ্ট হয়। কিন্তু আজ খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ভালই হাঁটতে পারছে। অনেকদিন পর তাই শানিদার ৩ তার পুরনো অভ্যাসে ফিরে যাওয়ার তাড়া অনুভব করে। একটা দাঁত-খিলান হাতে নিয়ে হেঁটে যায় জাব নদীর দিকে। আজ সে জাবের জলে পবিত্র হয়ে শানিদার গুহার সামনে যাবে, তারপর গুহামুখটির দিকে পেছন ফিরে দাঁড়িয়ে জাব অধ্যুষিত শানিদার উপত্যকাকে অবাক চোখে দেখবে।[৩] আশ্রয় ও নির্ভরতার প্রতীক হিসেবে এই গুহাকে উপত্যকার সব নিয়ানডার্থালই সম্মান করে। কিন্তু শানিদার ৩ এর সাথে গুহাটির সম্পর্ক যেন আরও গভীর।

তার মনে হতে থাকে যেন কতকাল পরে সকালের তুলতুলে আলোয় জাব নদীর ঠাণ্ডা হাওয়ার সংস্পর্শে এসেছে, শেষ কবে এসেছিল মনে পড়ে না। মুখ না ধুয়েই অপলক নেত্রে চেয়ে থাকে শানিদার গুহার কৃষ্ণ বিবরসম মুখটির দিকে। জাব তীরে তো সৌন্দর্য্যের কমতি নেই কোন, চারদিকে সারি সারি পাহাড়, সবগুলো চূড়া শুভ্র তুষারে ছাওয়া।[৪] অথচ এখান থেকে কেবল সেই কৃষ্ণ বিবরই তাকে টানছে। বরফ শীতল জলে মুখ ধোয়ার পর কোত্থেকে এক ঝাপ্টা শীতল বাতাস তার অন্তর জুড়িয়ে দিয়ে যায়। গুহামুখটির সান্নিধ্যলাভের আকাঙ্ক্ষা তার আরও বেড়ে যায়। জাব নদীর যে পারে তাদের বাস গুহাটিও সেই পারেই, তবে একেবারে কাছে নয়।[৫] সুবিধার জন্য একটা লাঠি হাতে হাঁটা শুরু করে শানিদার ৩। এতো দূর হেঁটে গিয়ে উঁচুতে উঠতে তার একটু কষ্ট হবে হয়তো, কিন্তু প্রাপ্তির তুলনায় সে নস্যি।

গুহার সামনে এসে অবশ্য তার আশাভঙ্গ হয়। এতোক্ষণ সে পৃথিবী থেকে অনেক দূরের কোন জগতে বিচরণ করছিল, গুহার সামনের জটলাটা দেখে পৃথিবীতে ফিরে আসতে এক মুহূর্তও দেরি হয় না। কি নিয়ে মত বিনিময় করছে তারা সেটাও বুঝতে বাকি থাকে না। একটি সুন্দর সকালের করুণ সমাপ্তি ঘটে অদ্ভুত দশর্ন কিছু মানুষের কথা ভেবে। এই মানুষেরা তাদেরই আশেপাশে থাকে, গড়নে তাদের চেয়ে খানিকটা লম্বা ও চিকন-চাকন। প্রতিযোগিতার দুনিয়ায় এই অদ্ভুত দশর্ন মানুষের থেকে পিছিয়ে পড়ছে নিয়ানডার্থাল মানুষেরা। কারণ সংখ্যায় তারা অনেক বেশি, শক্তিতে সামনা সামনি কোন নিয়ানডার্থালের সাথে হয়তো তারা পেরে উঠবে না, কিন্তু কৌশলে এগিয়ে গেছে।[৬] প্রকৃতির সাথেও কি সুন্দর মানিয়ে নিয়েছে সেই মানুষেরা, শানিদার ৩ ব্যাপারটাকে প্রকৃতির পক্ষপাতিত্ব ভেবে ক্ষুণ্ণ হয়।

প্রকৃতির হাতছানি ভুলে সহ-নিয়ানডার্থালদের সাথে মত বিনিময়ে বসে শানিদার ৩ ও। আলোচনার মূল বিষয় থাকে খাদ্যের যোগান। ফলমূল খেয়ে কারও পক্ষেই টিকে থাকা সম্ভব না। শানিদার ৩ অনেক আগেই বুঝতে পেরেছিল যে বিরুদ্ধ দলের মানুষেদের একটা বড় সুবিধা হচ্ছে এই যে, ফলমূলেও তাদের খুব একটা অরুচি নেই। কিন্তু নিরামিষ খেয়ে দেখেছে সে, একেবারে অখাদ্য।[৭] শিকারের অভাবে এই বুড়ো বয়সে তাকে মাঝেমধ্যে ফলমূল খেয়ে ক্ষুধা নিবারণ করতে হয় ঠিকই, কিন্তু জীবন তখন সত্যিকার অর্থেই বিস্বাদ ঠেকে। আজকের শলাপরামর্শের ফলাফল- আরেকটি শিকার অভিযান। ছেলেদের খানিকটা আপত্তি সত্ত্বেও শানিদার ৩ এবার শিকারী দলে নিজের জায়গা করে নেয়। খুব বেশি আপত্তি করে না কেউ, কারণ সংখ্যায় তারা এতোই কম যে আর একজন মানুষকেও বড় অবলম্বন হিসেবে দেখতে বাধ্য হয়, যদিও সে ঠিকমতো হাঁটতেই পারে না।

শানিদার ৩ আবারও জীবন সংগ্রামে টিকে যাওয়ার আশায় বুক বাঁধে। নিজের বেঁচে যাওয়াটা মুখ্য নয় তার কাছে, তাদের এই ছোট্ট শিকারী-সংগ্রাহক দলটা অনেকদিন টিকে থাকুক- এটাই তার প্রত্যাশা। কেন জানি মনে হয় সে নিজে নিঃশেষ হয়ে গেলেও এই ছোট্ট দলটির মাঝে তার জীবনের সবটুকু মায়া টিকে থাকবে, এই চিরন্তন মায়ার মূল্য দিতে শিখেছে সে- কিছুটা হলেও। ভবিষ্যৎ নিয়ানডার্থালরা যে পূর্বপুরুষদের স্মরণ করে শিকার অভিযানে যাবে সেই পূর্বপুরুষদের মাঝে সেও থাকবে। তবে তার এই ইতিবাচকতায় খানিকটা বিষাদের আভা ছড়িয়ে দিয়ে যায় ঐ আকাশ শাসনকারী শকুনগুলো।[৮] নিশ্চল ডানায় ভর করে আকাশে চরে বেড়ানো শকুনের চেয়ে ভীতিকর যেন আর কিছু নেই। তাদের মত শকুনও যে হন্যে হয়ে শিকার খুঁজে বেড়ায় এই বোধ আসেনি শানিদার ৩ এর। আর যাই হোক সে ঐ মূর্তিমান পিশাচের খাদ্য হতে চায় না।

কিছুক্ষনের মধ্যেই অস্ত্র হাতে প্রস্তুত হয়ে যায় জনা দশেক নিয়ানডার্থালের ছোট্ট শিকারী-সংগ্রাহক দলটি। নিজের ছেলের হাত থেকে ভারী বর্ষাটি তুলে নেয় শানিদার ৩। এই অস্ত্র হাতে শক্তপোক্ত নিয়ানডার্থালদের সর্বশক্তিমান মনে হয়। এই শীতের মাঝেও ক্ষীপ্র হয়ে উঠতে পারে তারা, বর্ষা হাতে শিকারের কয়েক হাতের মধ্যে একবার যেতে পারলেই হল। বর্ষার আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত শিকারের আর্তনাদ নিয়ানডার্থাল মানবের অহংকারের প্রতীক হয়ে ওঠে, আর মৃতদেহটি হয়ে ওঠে তার বিজয়মাল্য।[৯]

ভারী অস্ত্র হাতে সবাই রওনা হয়, গন্তব্য খানিকটা ঘন অরণ্য। আজ তাদের হাতে শিকার হতে পারে কোন বুনো ঘোড়া বা বুনো শূকর (বরাহ)।[১০] লোকালয় ছেড়ে তারা এমন এক জায়গায় পৌঁছায় যেখান থেকে শানিদার গুহা দেখা যায় না, তবে আকাশে এখনও শকুন আর ঈগলের দেখা মেলে। একটা উঁচু টিলা থেকে দূরে উঁকি দিয়ে এক পাল বরাহ দেখতে পায় তারা। শানিদার ৩ এর মাথায় তখনই চিন্তাটা খেলে যায়, তাদের যদি এমন কোন অস্ত্র থাকতো যা অনেক দূরে নিক্ষেপ করা যায়! তাদের চেয়ে খানিকটা লম্বা আর চিকন-চাকন মানুষগুলোর এমন অস্ত্র আছে, দেখতে বর্ষার মত হলেও সে অস্ত্র অনেক হালকা যা সহজেই নিক্ষেপ করা যায়, যা দিয়ে দূর থেকেও বধ করে ফেলা যায় ছোটখাট শিকার।[১১] তারপরও নিরাশার কিছু নেই, কারণ ঝোপ বুঝে কোপ মারার মত শিকার পদ্ধতিতে নিয়ানডার্থালরা খুব অভ্যস্ত। তাছাড়া কয়েক হাত দূর থেকে বর্ষা দিয়ে আঘাতের মাধ্যমে বিশালকায় জন্তুকেও কুপোকাত করা যায়, সাথে নিজের বীরত্বটাও ঝালিয়ে নেয়া যায়।

বরাহকূলের গতিপ্রকৃতি আন্দাজ করে গাছগাছালি ও ঝোপঝাড়ের আড়ালে অবস্থান নেয় নিয়ানডার্থাল শিকারীরা। শিকারের জন্য বেশিক্ষণ অপেক্ষাও করতে হয় না, আশেপাশে কোন প্রতিদ্বন্দ্বী শিকারীরও দেখা মেলে না। শানিদার ৩ প্রকৃতির সুবিচার দেখে মনে মনে খুশি হয়ে ওঠে। নিজের পা খানিকটা ভাল হওয়া থেকে শুরু করে এখনকার এই অনুকূলতা- সবকিছু ভেবে প্রকৃতিকে ক্ষমা করে দেয়ার চিন্তা করতে থাকে সে। এরই মধ্যে শিকারের চূড়ান্ত মুহূর্ত এসে যায়। বুনো ঘোড়ার চেয়ে বরাহ শিকার অনেক সোজা হওয়ার কথা, কিন্তু পাল বেঁধে ছুটতে থাকলে সহজে বধ করা যায় না এদের। এবার তাদের ছোটার বেগও খুব বেশি ছিল না। খুব সহজেই চারটে বরাহ ধরা পড়ে তাদের হাতে। চার গ্রুপে ভাগ হয়ে আক্রমণ করেছিল তারা, একটা গ্রুপে শানিদার ৩ ও ছিল। বিশাল বর্ষাটি যখন বরাহের দেহ ভেদ করে যাচ্ছিল তখন যৌবনের সেই তেজ আরেকবার অনুভব করেছিল সে। আজকের দিনটা তার জন্য সত্যিই বড় অদ্ভুত। বহুদিন পর একটি মাত্র দিনে এতো অনুভূতির ভার সহ্য করতে পারাটাই আজব লাগে তার কাছে।

চারটের মধ্যে তিনটি বরাহকে শেষ পর্যন্ত বধ করতে সক্ষম হয় তারা। কিছুক্ষণ চলে বিজয়োল্লাস, তাদের উল্লাসের তোড়ে অদূরে মিলিয়ে যেতে থাকা বরাহ পালের গর্জন বড় অস্ফূট ঠেকে! উল্লাস শেষে আবার ধাতস্থ হয় সবাই। গুরুত্বপূর্ণ কাজটাই এখনও বাকি আছে- এই বরাহ তিনটা নিয়ে নিরাপদে বাড়ি ফিরে যেতে হবে। শুরু হয় তাদের ফিরতি যাত্রা। এবার শকুনগুলোর দিকে তাকিয়ে করুণার হাসি হাসে শানিদার ৩। শিকারে আসার আগে যে নির্লিপ্ত বিষাদ ছিল তার মাঝে সেটা কোথায় যেন মিলিয়ে গেছে, পূর্বপুরুষদেরও বোধহয় ভুলে গেছে এই মুহূর্তে। তার এই জীবনমুখী অনুভূতিগুলো জানতেও পারল না যে তাদেরই অপেক্ষায় সামনের কোন এক বা একগুচ্ছ ঝোপের আড়ালে ওৎ পেতে আছে তৎকালীন আধুনিক মানুষ তথা আমাদের পূর্বপুরুষদের একটি দল।

ওৎ পেতে থাকার কোন পূর্ব পরিকল্পনা দৈহিকভাবে আধুনিক মানুষদের ছিল না। আসল ঘটনা হচ্ছে, নিয়ানডার্থালদের তাড়া খেয়ে হন্যে হয়ে ছুটে চলা বরাহের পালে সুবিধা মতো হামলে পড়তে পারেনি আমাদের পূর্বপুরুষেরা। এ নিয়ে তারা যথেষ্ট ক্ষুব্ধ, কারণ এতো জন মিলে প্রক্ষেপণযোগ্য বর্ষা দিয়েও ৬ টার বেশি বরাহ শিকার করতে না পারাটা তাদের জন্য খুব দুঃখের বিষয়। এ নিয়ে তারা হাপিত্যেশ করছিল। যাদের জন্য তাদের স্বাভাবিক শিকার অভিযানে ছন্দপতন ঘটল তাদেরকে শায়েস্তা করার চিন্তা হয়ত কারো কারো মনে উঁকি দিচ্ছিল, তবে তাদেরকে খুঁজে বের করার কষ্টটা কেউই করতে চাচ্ছিল না। সে কষ্ট আর তাদের করতেও হবে না অবশ্য, শানিদার ৩ এর দল একটু পরে এই পথ দিয়েই যাবে, আনন্দের আতিশয্যে সদা-সতর্ক থাকার বিষয়টা মনেই থাকবে না তাদের, প্রকৃতির ভুলেই মুখোমুখি হয়ে যাবে মানুষের দুটো প্রজাতি- নিয়ানডার্থাল এবং হোমো স্যাপিয়েন্স।

এভাবেই আশ্চর্য রকম সূক্ষ্ণ অনুভূতি সম্পন্ন আমাদের এই নিয়ানডার্থাল চরিত্রের জীবন প্রদীপ নিভে আসার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। শানিদার ৩ ছাড়া তার দলের আর কাওকেই মৃত্যুর মত শূন্যতা এসে গ্রাস করে না। ভয়ানক আহত হওয়ার পর শানিদার ৩ এর জন্য বেঁচে থাকতে চাওয়াটাই কষ্টকর হয়ে দাঁড়ায়। হোমো স্যাপিয়েন্স প্রজাতির কোন এক অখ্যাত সদস্যের হাত থেকে ছুটে আসা তীক্ষ্ণ বর্ষাটি তার বাম পাঁজরে বিঁধেছিল।[১২] বর্ষা সে টান দিয়ে বের করে এনেছে ঠিকই, কিন্তু ভেতরটা তার চুরমার হয়ে গেছে। শরীরের ভার বয়ে বেড়ানো আক্ষরিক অর্থেই অসম্ভব হয়ে গেছে, সতীর্থদের কাঁধে ভর করে সে ফিরে এসেছে তার প্রিয় ঘরটিতে।

তাকে কেন্দ্র করে জড়ো হয়ে গেছে অনেকে। কিন্তু সেদিকে তার খেয়াল নেই। আকাশের দিকে তাকিয়ে সবকিছু কেমন অন্যরকম লাগছে- নীল নয়, সবকিছু যেন শূন্য, চারিদিকে কেবল শূন্যতা, যেখানে শূন্যতা নেই সেখানে শকুন। এই মানসিক শূন্যতা আর কোন নিয়ানডার্থাল মৃত্যুর সময় টের পেয়েছিল কিনা আমরা জানি না। অনেক নিয়ানডার্থাল হয়তো মৃত্যুর আগে তার পুরো জীবনটাকে স্মরণ করে যেতো, কিন্তু শানিদার ৩ কেবল আজকের দিনটাকে স্মরণ করতে চাচ্ছে। আজ ছিল তার অনুভূতির দিন, জীবনের সব তীব্র অনুভূতিগুলোকেই সে ছুঁয়ে গেছে আজ, মৃত্যুই যেহেতু সবচেয়ে তীব্র অনুভূতি সেহেতু সেটাও আজকের দিনে ঘটলে খারাপ হতো না।

এমন চিন্তা থেকেই সে আবার শানিদার গুহায় ফিরে যাওয়ার তীব্র তাড়া অনুভব করে। শ্বেত-শূন্যতায় কালো ছোপ হিসেবে জেগে থাকা শকুনগুলো তাকে ভয় পাইয়ে দিয়েছে মনে হয়। সতীর্থরাই তাকে বয়ে নিয়ে যায় শানিদার গুহায়। জীবনের শেষ কয়েকটা দিন সে এখানেই কাটায়। তাদের শিকার করা বরাহ তিনটির মধ্যে দুটো তারা ঘরে আনতে পেরেছিল, সে দুটোও এক সময় শেষ হয়ে আসে। জীবনের সবচেয়ে কষ্টের দিনগুলোতে শানিদার ৩ এর খাদ্য হয় সেই নিরামিষ- ফলমূল আর লতাপাতা। সুখের কথা হচ্ছে এবার সেটা তার কাছে খুব বেশি বিস্বাদ লাগে না।

জীবনের শেষ দিনে কাকতাল বা পূর্বানুমান যেভাবেই হোক শানিদার ৩ একবার গুহার বাইরে এসেছিল, অন্যদের সহায়তায়। তার শরীরের সকল জৈবিক ক্রিয়া বন্ধ হয়েছিল মুক্ত বাতাসেই। পূর্ণাঙ্গ একটি জীবন শূন্যতায় মিশে গিয়েছিল জাব নদীর দিকে তাকিয়েই। সতীর্থরা শানিদার ৩ কে সম্মানের সাথে শানিদার গুহার ভেতরেই সমাধিস্থ করেছিল। এমন শেষকৃত্য কজন নিয়ানডার্থালের ভাগ্যেই বা জোটে।[১৩] শকুনের খাদ্য হতে হয় নি তাকে, শকুনেরা এই প্যালিওলিথিক ট্র্যাজেডি কেবল দেখেই গেছে, তাতে ভাগ বসাতে পারেনি।

এখানেই আমাদের গল্পের পরিসমাপ্তি। গল্পের কাহিনীটা আজ থেকে ৫০,০০০ বছর আগের।[১৪] সে সময় সুদূর ইরাকের শানিদার গুহায় ঘটে যাওয়া ট্র্যাজেডি চিত্রায়নের জন্য অবিশ্বস্ত বর্ণনাকারীর দ্বারস্থ হওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তবে এবার আমরা সেই বর্ণনাকারীর হাত থেকে মুক্তি পাব। ফিরে আসব আজকের পৃথিবীতে। এই পৃথিবীতে টাইম মেশিন নেই, আর থাকলেও তাতে চড়ে অতীতে যাওয়ার সম্ভাবনা শূন্যের কোঠায়। কিন্তু অতীত আবিষ্কারের একটি উপায় আমাদের আছে যা টাইম মেশিনের চেয়ে কোন অংশেই কম নয়। এর নাম ফসিল, বাংলায় যাকে অনেক সময় জীবাশ্ম বলা হয়।

শানিদার ৩ এর মৃত্যুর পর ৫০,০০০ বছর গত হয়েছে। তার কোন স্বপ্নই পূরণ হয়নি- নিয়ানডার্থালরা টিকে থাকতে পারেনি, শানিদার গুহার শকুনেরা বিলুপ্ত হয়নি, দৈহিকভাবে আধুনিক মানুষের প্রতি প্রকৃতির পক্ষপাতিত্ব কমেনি বরং দিনকে দিন বেড়েছে। কিন্তু যে স্বপ্ন সে কোন দিন দেখেনি সেটাই বাস্তব করে ছেড়েছে প্রকৃতি, ফসিল হিসেবে তাকে ধরে রেখেছে এই দীর্ঘ সময় ধরে, আগলে রেখেছে নিজের বুকে। অবশেষে ১৯৬০ সালে তার সম্ভাব্য হত্যাকারীদের এক উত্তরসূরীই তাকে, আরও ঠিক করে বললে তার ফসিলকে, ধরার বুক থেকে উঠিয়ে এনেছে। রালফ সোলেকি-র নেতৃত্বে প্রত্নবিজ্ঞানীরা শানিদার গুহা থেকে উদ্ধার করেছেন ১০ জন নিয়ানডার্থালের ফসিল যাদের একজন আমাদের শানিদার ৩। শানিদার-রোয়ান্দুজ প্রত্নতাত্ত্বিক অভিযানের সময়ই সবগুলো ফসিল আবিষ্কৃত হয়েছে।[১৫] যে অভিযান সফল না হলে আমাদের এতো সাধের আধা-সত্য আধা-কাল্পনিক গল্পটি ফাঁদা হতো না সেই অভিযানের কথাই বলব এবার।

তথ্যসূত্র:

১। DD Thompson and Erik Trinkaus, “Age determination of the Shanidar 3 Neanderthal”, Science 1 May 1981:
Vol. 212. no. 4494, pp. 575 – 577
২। Erik Trinkaus, “The Shanidar 3 Neandertal”, American Journal of Physical Anthropology, Volume 57, Issue 1, pp. 37 – 60
৩। Ralph S. Solecki, Rose L. Solecki, Anagnostis P. Agelarakis, “The Proto-Neolithic Cemetery in Shanidar Cave”, 2004
৪। দ্রষ্টব্য ৩
৫। Ralph S. Solecki, “Shanidar: The First Flower People”, Knopf, New York (1971)
৬। Kate Wong, “The Twilighting Neandertals”, August 2009, Scientific American
৭। “Shanidar III – A Neandertal who ate his veggies… Or at least chewed them”, 28 April, 2008, Anthropology.net
৮। Steven Mithen, “After the ice: a global human history, 20,000-5000 BC”, Chapter 44 – “Vultures of the Zagros”, 2003
৯। Ralph S. Solecki, Rose L. Solecki, “The Pointed Tools from the Mousterian Occupations of Shanidar Cave, Northern Iraq”, Chapter 4 of the book “The Paleolithic prehistory of the Zagros-Taurus” by Deborah Olszewski, Harold Lewis Dibble, 1993
১০।
১১। Steven E. Churchill, Robert G. Franciscusc, Hilary A. McKean-Perazaa, Julie A. Daniela, and Brittany R. Warrena, “Shanidar 3 Neandertal rib puncture wound and paleolithic weaponry”, May 2009
১২। E. Trinkaus, “Hard Times Among the Neanderthals”, Natural History, vol. 87, December 1978, p. 143
১৩। দ্রষ্টব্য ৩
১৪। Jane Bosveld, “Did We Mate With Neanderthals, or Did We Murder Them?”, November 2009, Discover Magazine
১৫। দ্রষ্টব্য ৩

[চলবে…]