তখন সত্যি মানুষ ছিলাম

 

এখন এ-সব স্বপ্নকথা

দূরের শোনা গল্প

তখন সত্যি মানুষ ছিলাম

এখন আছি অল্প।

 

 

মে, ১৯৭১। গাঙ্গেয় বদ্বীপ।

 

পাকিস্তানী আর্মির তুমুল বর্বরতায় নৃশংসভাবে ধর্ষিত হচ্ছে বাংলার মাটি। বারুদ আর রক্তের দাগ গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে কোমল পলিমাটির বুকে। সামরিক বুটের হিংস্র থাবার নিচে চাপা পড়ে সীমাহীন অপমানে নতমুখ বাংলাদেশ।

 

মাতৃভুমির এই করুণ অপমান দেখে তীব্র অনুশোচণায় দগ্ধ হচ্ছে মাত্র ষোল বছর বয়সী এক কিশোর। গভীর অনুতাপে তার ছোট্ট জীবনের সবচেয়ে বড় সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে সে। ঘরের নিশ্চিন্ত আশ্রয় ছেড়ে অনিশ্চিত অজানার পথে যাত্রা শুরু করতে হবে তাকে। কিশোরের মনে হয়েছে ঘরে বসে থেকে যে ক্ষমাহীন অপরাধ সে করেছে তার প্রায়শ্চিত্র হতে পারে একমাত্র দেশের জন্য অস্ত্র ধারণ করা। যুদ্ধের ময়দানে শত্রুর মোকাবেলা করা, প্রতিবাদে-বিক্ষোভে ফেটে পড়া। প্রবল ঘৃণা আর জিঘাংসায় স্বজন হারানোর প্রতিশোধ নেয়া। যে স্বপ্নকে পাশবিক নির্মমতায় ছিন্নভিন্ন করে দিচ্ছে নরঘাতকেরা সেই স্বপ্নকে ভালবাসার স্নিগ্ধ স্পর্শে বাঁচিয়ে তোলা।

 

বাবাকে একটা অসাধারণ চিঠি লিখে রেখে কোন এক আলোহীন রাতে আলোর ঠিকানা খুঁজে পেতে অতলান্ত অন্ধকারের পথে হারিয়ে যায় সেই কিশোর। আর ফিরে আসে না সে কখনো। চিরতরে হারিয়ে যাওয়া এই কিশোর মুক্তিযোদ্ধার নাম আমানউল্লাহ চৌধুরী ফারুকবেগমগঞ্জের অম্বরনগর মিয়াবাড়ির সন্তান তিনি। একাত্তরে সময় চট্টগ্রাম সিটি কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্র ছিলেন।

 

কিশোর বয়সেই সমাজ সচেতন এবং রাজনৈতিক চিন্তাধারার মানুষ ছিলেন আমানউল্লাহ ফারুক। অন্যায়ের প্রতিবাদে অকুতোভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তেন তিনি। প্রতিবাদমুখর দুরন্ত এই ছেলেকে সমঝে চলতো অনেক পরিণত বয়সের মানুষই। কিশোর বয়সেই যে তিনি প্রচন্ড রকমের রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় এক ঘটনায়। বঙ্গবন্ধুর সাতই মার্চের ভাষণ শোনার জন্য গোপনে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় চলে আসেন তিনি। তার বাবাও কোন এক কারণে ঢাকায় ছিলেন তখন। তিনিও হাজির হয়েছেন রেসকোর্সের ময়দানে ইতিহাসের স্বাক্ষী হতে। ভাগ্যের এমনই ফের। লক্ষ লক্ষ মানুষের জনসমুদ্রে দেখা হয়ে যায় পিতাপুত্রের। এমনতর গর্হিত আচরণেও কোন বকাঝকা জোটে না পুত্রের কপালে। কে জানে হয়তো গোপনে গোপনে পিতার বুক ফুলে উঠেছিল ঠিকই গর্ব এবং অহংকারে।

 

বাড়ী থেকে পালিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ফারুক। নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানার বামনী বাজারের দক্ষিণে বেড়িবাঁধের ওপর পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে ভয়াবহ এক যুদ্ধে শহীদ হনএই যুদ্ধে তার সাথে আরও চারজন মুক্তি যোদ্ধা শহীদ হন নদী পার হচ্ছিলেন তারা। নদী্র পানিতে থাকা অবস্থাতেই গুলিবিদ্ধ হন তিনি। নদীর স্রোতে ভাটির দিকে ভেসে যায় এই বীর কিশোরের লাশ। হারিয়ে যায় অজানা কোন দূর দেশে। কিংবা মাতৃভূমিই হয়তো প্রগাঢ় ভালবাসায় সকলের অগোচরে আশ্রয় দিয়েছিল এই দুরন্ত কিশোরকে তার কোমল বুকে। সে খবরতো কেউ জানে না আজো।

 

সন্তানহারা মা দীর্ঘদিন বিশ্বাস করেনি যে তার সন্তান মারা গিয়েছে। সজল চোখে আশায় আশায় তিনি পথ চেয়ে থাকতেন তার ফারুকের জন্য। ভাবতেন ছেলে কোন দূরদেশে চলে গিয়েছে অভিমানে। একদিন ঠিকই মস্ত জোয়ান হয়ে ফিরে আসবে তার বুকে। সেই একদিন আর আসেনি কখনো। বৃদ্ধ মা হয়তো আর আশায় পথ চেয়ে থাকেন না। শুষ্ক চোখে এখন শূন্য দৃষ্টিতে চেয়ে থাকেন অসীমের দিকে। কে জানে কি ভাবেন তিনি।

 

স্বাধীনতার পরে বাবাকে লেখা ফারুকের সেই অসাধারণ চিঠিটা ছাপা হয়েছিল চট্টগ্রামের আজাদী পত্রিকায়। কীভাবে কীভাবে যেন সেই চিঠি চোখে পড়ে গিয়েছিল প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবের। চট্টগ্রামে এক সফরের সময় হুট করে তিনি হাজির হয়ে যান ফারুকের বাবার কর্মস্থলে। তার বিশাল বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে তিনি সান্তনা দেন সন্তানহারা পিতাকে। জানতে চান তার দাবী দাওয়া চাহিদার কথা। ফারুকের বাবা শুধু সন্তানকে ফেরত পাওয়া ছাড়া আর কোন কিছুই চান না প্রধানমন্ত্রীর কাছে। এমন সোনার টুকরো ছেলের বিনিময়ে কী-ইবা চাওয়ার আছে তার। পৃথিবীর আর সব কিছুইতো তুচ্ছ তার কাছে।

 

আমাদের মত অকৃতজ্ঞ জাতি পৃথিবীতে খুবই বিরল। একদিন যারা আমাদের স্বর্ণময় ভবিষ্যতের কথা ভেবে, আমাদের পথের কণ্টককে বিদূরিত করার জন্য, তাদের জীবন দিয়ে গিয়েছেন নিঃস্বার্থভাবে, আমরা তাদের ভুলে গিয়েছি চরম নিষ্ঠুরতায়। বিস্মৃতি, অবহেলা আর অপমানে জর্জরিত করেছি তাদের। ফারুকের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। যে কিশোর তার জীবন শুরু করার আগেই জীবন দিয়ে গিয়েছে দেশের জন্য, কোথায় তাকে আমরা স্মরণ করবো গভীর শ্রদ্ধাভরে। তা না তাকে বিসর্জন দিতেই ব্যস্ত আমরা। তার স্মরণে নোয়াখালীতে একটি স্কুলের নামকরণ করা হয়েছিল শহীদ আমানউল্লাহ স্কুল নামে। গত বিএনপি সরকারের সময় সেই নাম পরিবর্তন করে ফেলা হয়। সামরিক সমর্থনপুষ্ট ফকরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় এসে সাবেক সেনাপ্রধান জেনারেল মইন ইউ আহমদের ব্যক্তিগত উদ্যোগে সেই নাম আবার পুনরুদ্ধার করা হয়। কি কারণে জেনারেল মইন নাম পুনরুদ্ধার করেছিলেন জানেন? শহীদ আমানউল্লাহ ফারুক জেনারেল মইনের আপন চাচাতো ভাই ছিলেন। তা না হলে শহীদ ফারুকের কবলে এটুকুও জুটতো না। এই হচ্ছি আমরা।

 

খুব বেশিদিন আগের কথা নয়। একদিন আমাদের পূর্বপুরুষেরা ঠিকই মানুষ ছিলেন, ছিলেন পরিপূর্ণ মানুষ। আমরা তা নই। পরিপূর্ণতার বদলে দিন দিন স্বল্প থেকে স্বল্পতর হচ্ছি আমরা। মানুষ থেকে ঊনমানুষে রূপান্তরিত হচ্ছি আমরা দিনকে দিন।

 

বাবাকে লেখা ফারুকের চিঠিটি ‘একাত্তরের চিঠি’গ্রন্থে ঠাই পেয়েছে। সেখান থেকেই চিঠিটা তুলে দিলাম। পড়ে দেখুন। অবাক হয়ে যাবেন একজন কিশোরের উপলব্ধির গভীরতা দেখে, তার মানসিক পরিপক্কতা দেখে, সামাজিক এবং রাজনৈতিক সচেতনতা দেখে। দেশের প্রতি তার প্রগাঢ় ভালবাসা দেখে বিস্মিত হবেন। তার মানবিক চেতনা দেখে কিছুটা হলেও লজ্জিত হবো আমরা আমাদের অধোমুখিতা দেখে এটাও সুনিশ্চিত।

 

 

 

তাং: ২৩-০৫-১৯৭১

 

জনাব আব্বাজান,

 

আজ আমি চলে যাচ্ছিজানি না কোথায় যাচ্ছিশুধু এইটুকু জানি, বাংলাদেশের একজন তেজোদৃপ্ত বীর স্বাধীনতাকামী সন্তান হিসেবে যেখানে যাওয়া দরকার আমি সেখানেই যাচ্ছিবাংলার বুকে বর্গী নেমেছেবাংলার নিরীহ জনতার উপর নরপিশাচ রক্তপিপাসু পাক-সৈন্যরা যে অকথ্য বর্বর অত্যাচার আর পৈশাচিক হত্যালীলা চালাচ্ছে, তা জানা সত্ত্বেও আমি বিগত এক মাস পঁচিশ দিন যাবৎ ঘরের মধ্যে বিলাস-ব্যসনে মত্ত থেকে যে ক্ষমাহীন অপরাধ করেছি, আজ সেই অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য যাত্রা শুরু করলামসমগ্র বাঙ্গালী যেন আমাকে ক্ষমা করতে পারেনআপনি হয়ত দুঃখ পাবেনদুঃখ পাওয়ারই কথাযে সন্তানকে দীর্ঘ ষোল বছর ধরে তিল তিল করে হাতে কলমে মানুষ করেছেন, যে ছেলে আপনার বুকে বারবার শনি কৃপাণের আঘাত হেনেছে, যে ছেলে আপনাকে এতটুকু শান্তি দিতে পারেনি, অথচ আপনি আপনার সেই অবাধ্য দামাল ছেলেকে বারংবার ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেছেন, যার সমস্ত অপরাধ আপনি সীমাহীন মহানুভবতার সঙ্গে ক্ষমা করেছেনআপনি আমাকে ক্ষমা করেছেন সম্ভবত একটি মাত্র কারণে যে, আপনার বুকে পুত্রবাৎসল্যের রয়েছে প্রবল আকর্ষণ

 

আজ যদি আপনার সেই জেষ্ঠ্য সন্তান ফারুক স্বেচ্ছায় যুদ্ধের ময়দানে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের পক্ষে যুদ্ধে মৃত্যকে আলিঙ্গন করে, তাহলে আপনি কি দুঃখ পাবেন, বাবা? আপনার দুঃখিত হওয়া সাজে না, কারণ হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যদি নিহত হই, আপনি হবেন শহীদের পিতাআর যদি গাজী হিসেবে আপনাদের স্নেহছায়াতলে আবার ফিরে আসতে পারি, তাহলে আপনি হবেন গাজীর পিতাগাজী হলে আপনার গর্বের ধন হব আমিশহীদ হলেও আপনার অগৌরবের কিছু হবে নাআপনি হবেন বীর শহীদের বীর জনককোনটার চেয়ে কোনটা কম নয়ছেলে হিসেবে আমার আবদার রয়েছে আপনার উপরআজ সেই আবদারের উপর ভিত্তি করে আমি জানিয়ে যাচ্ছি বাবা, আমি তো প্রবেশিকা পরীক্ষার্থীআমার মনে কত আশা, কত স্বপ্নআমি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করে কলেজে যাবআবার কলেজ ডিঙিয়ে যাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনেমানুষের মতো মানুষ হব আমি

 

 

আশা শুধু আমি করিনি, আশা আপনিও করেছিলেনস্বপ্ন আপনিও দেখেছেনকিন্তু সব আশা, সব স্বপ্ন আজ এক ফুৎকারে নিভে গেলবলতে পারেন এর জন্য দায়ী কে? দায়ী যারা সেই নরঘাতকের কথা আপনিও জানেনবাংলাদেশের প্রটিটি মানুষ ওদের কথা জানেইংরেজিতে একটি কথা আছে–Mother and Motherland are superior to heaven. স্বর্গের চেয়েও উত্তম মা এবং মাতৃভূমিআমি তো যাচ্ছি আমার স্বর্গাদপী গরীয়সী সেই মাতৃভূমিকে শত্রুর কবল থেকে উদ্ধার করতেআমি যাচ্ছি শত্রুকে নির্মূল করে আমাদের দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতেবাবা, শেষবারের মতো আপনাকে একটা অনুরোধ করবোসর্ব শক্তিমান আল্লাহর নিকট সবসময় দোয়া করবেন, আমি যেন গাজী হয়ে ফিরতে পারিআপনি যদি বদদোয়া বা অভিশাপ দেন, তাহলে আমার ভবিষ্যৎ অন্ধকার

 

 

জীবনে বহু অপরাধ করেছিকিন্তু আপনি আমায় ক্ষমা করেছেনএবারও আপনি আমায় ক্ষমা করবেন, এই আশাই আমি করিআপনি আমার শতকোটি সালাম নেবেনআম্মাজানকে আমার কদমবুসি দেবেন এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করতে বলবেনফুফু আম্মাকেও দোয়া করতে বলবেনফয়সাল, আফতাব, আরজু, এ্যানি ছোটদের আমার স্নেহাশীষ দেবেনআমার জন্য দোয়া করবেন আর সবসময় হুঁশিয়ার থাকবেন

 

 

ইতি,

আপনার স্নেহের ফারুক­­­

 

­­­­­_______________________________________________

 

শহীদ আমানউল্লাহ চৌধুরী ফারুক আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু সাঈদ হাসান সাজ্জাদের মামা। তার মুখ থেকেই এই গল্প শোনা আমার।

 

প্রবন্ধের শিরোনামটি নেয়া হয়েছে কবি আসাদ চৌধুরীর একটি কবিতার শিরোনাম থেকে। সে কারণে কৃতজ্ঞতা রইলো কবির প্রতি।