[আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত, এই রক্ত কোনোদিন পরাভব মানে না।]

বিশিষ্ট সাংবাদিক, প্রজন্ম ‘৭১ এর সংগঠক নাদিম কাদিরের কাছে জানতে চেয়েছিলাম যুদ্ধদিনের কথা। তিনি বললেন, দেখুন তখন আমি নেহাতই বালক। আর যুদ্ধদিনের সব স্মৃতি আমার বাবা, শহীদ মুক্তিযোদ্ধা লেফটেনেন্ট কর্নেল আব্দুল কাদিরকে ঘিরে। …

তিনি দীর্ঘশ্বাস চেপে বলেন, দীর্ঘ ৩০ বছর অনুসন্ধান চালিয়ে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশে, যেখানে পাকিস্তানী সেনারা আমার বাবাসহ ১৮জন মুক্তিযোদ্ধাকে গুলি করে হত্যা করেছে, সেই বধ্যভূমিটি আবিস্কার করি। কিন্তু সরকারের কাছে বহু ধর্ণা দিয়েও গত দুবছরেও বধ্যভূমিটি খনন করে শহীদদের দেহাবশেষ উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। সেখানে চার তলা বাড়ি গড়ে ওঠায় বাড়ির মালিকের সদিচ্ছার অভাব ও সরকারের উদ্যোগহীনতায় সেখানে একটি নামফলক পর্যন্ত লাগানো যায়নি। …

আমাদের কথা হচ্ছিল সাউথ এশিয়ান টেলিভিশনের গুলশানের কার্যালয়ে নাদিম ভাইয়ের ছোট্ট অফিসে সম্প্রতি এক সকালে। নাদিম ভাই টিভি চ্যানেলটির বাংলাদেশ প্রতিনিধি।

আমি জানতে চাই, পাকিস্তান সেনা বাহিনীর সেই বিদ্রোহী মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল কাদিরের কথা।

.

নাদিম ভাই বলেন, আমি বড় হয়ে মা’র (হাসনা হেনা কাদীর, ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির অন্যতম সংগঠক, ১৯৯৯ সালে প্রয়াত) কাছেই বেশীর ভাগ কথা শুনেছি। আমার স্মৃতিতেও বাবার বেশ কিছু কথা রয়েছে। আর এখন তো সাংবাদিক, গবেষকরা নিজস্ব উদ্যোগে অনুসন্ধান করে জানাচ্ছেন, মুক্তিযুদ্ধে আমার বাবা কতোটা অবদান রেখেছিলেন।

তিনি বলে স্মৃতি হাতড়ে বলে চলেন, পাকিস্তান সেনা বাহিনীতে আমার বাবা বরাবরই বাঙালি সেনা কর্মকর্তা হিসেবে গর্বিত ছিলেন। তিনি অনেকটাই খোলামেলাভাবে পূর্ব পাকিস্তানের সায়ত্বশাসন তথা ছয় দফার পে কথা বলতেন। এ জন্য পাক-সেনারা তাকে ‘ভাষানী’ বলে ডাকতো। এমনও হয়েছে, তাকে একবার এক পাঞ্জাবি সেনা কর্মকর্তা ’এই বাঙালি, ইথারমে আও’ বলে ডেকেছে। আর বাবা গিয়ে তাকে একটা চড় মেরে বলেছেন, বাঙালি কি আমার নাম? এ জন্য তাকে কোর্ট মার্শালের মুখোমুখি পর্যন্ত হতে হয়। পরে সেখানে বাবা নির্দোষ প্রমানিত হন।…

নাদিম ভাই বলে চলেন, আমার মনে আছে, ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ যেদিন রেডিওতে প্রচার হয়, সেদিন বাবা খুশীতে খুবই উৎফুল্ল ছিলেন। বার বার বলছিলেন, যুদ্ধ শুরু হচ্ছে, বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছেন। এবার আমরা স্বাধীন হবো। …

এরপর একদিন বাবা আমাদের ছোট-ভাইবোনদের জন্য কিনে দেন স্বাধীন বাংলার একটি বড় পতাকা। সেটি বাঁশ পুঁতে চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের যে কোয়ার্টারে তখন আমরা থাকতাম, সেখানে লাগানো হয়। আর বাবা নিজের গাড়িতে লাগাতে শুরু করেছিলেন স্বাদীন বাংলার ছোট একটি পতাকা। তখন অনেকে তাকে বলেছেন, কর্নেল সাহেব, আপনি যে এসব করছেন, দেখবেন শিগগিরই হয়তো আপনার বিপদ হবে। কিন্তু তিনি এ সবের তোয়াক্কা করেননি।

সে সময় পূর্ব পাকিস্তান তৈল-গ্যাস উন্নয়ন সংস্থার প্রধান নিয়ন্ত্রক (অপারেশন) পদে থাকার সময় আমার বাবা শহীদ জাতীয় নেতা কামরুজ্জামানকে একটি চিঠি লিখেছিলেন (পরে এই চিঠিটির ফটোকপি আমি সংগ্রহ করি), যেখানে পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তান কীভাবে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে অসহযোগিতা করছে, তা তিনি বিস্তারিত জানিয়েছিলেন। আর তেল-গ্যাস ক্ষেত্র অনুসন্ধানের জন্য যে সব বিস্ফোরক ব্যবহৃত হয়, বাবা সে সময় প্রচুর পরিমানে এ সব বিস্ফোরক গোপনে সরবরাহ করেছিলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। তারা শোভাপুর ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছিলেন এই বিস্ফোরক ব্যবহার করে। …

এদিকে ২৭ মার্চ পুরো চট্টগ্রামের দখল নেয় পাকিস্তানী সেনা বাহিনী। সে দিন রাতে আমরা পাঁচলাইশের বাসায় পর্দা টেনে ভয়াবহ আতংকের রাত কাটাই। সারারাত ভয়াবহ গোলাগুলির শব্দ শুনি। ৭-৮ এপ্রিলের দিকে বাবা বাসা থেকে হঠাৎ উধাও হয়ে যান। পরে ১৪ এপ্রিল বাসায় ফিরে তিনি মাকে বলছিলেন, নাহ, বের হয়ে যেতে পারলাম না। সব রাস্তায় ওরা পাহারা বসিয়েছে। আমি কোনো রকমে প্রাণে বেঁচে ফিরেছি। …

পরে জেনেছি, বাঙালি সেনা কর্মকর্তা মেজর রফিক, এমআর সিদ্দিকীসহ আরো কয়েকজনের সঙ্গে বাবা পরিকল্পনা নিয়েছিলেন, প্রত্যেকের বাড়িতে দুটি করে গাড়ি পাঠানো হবে। একটিতে করে বাবাসহ বিদ্রোহী অন্য বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা সরে পরে কোনো একটি গোপন স্থানে জড়ো হবেন, মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করবেন। আর অন্যটি করে আমরা পরিবারের সদস্যরা নিরাপদ স্থানে সরে পড়বো। একই ভাবে সব বিদ্রোহী সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারকেও নিরাপদ কোনো স্থানে সরিয়ে নেওয়া হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্য কোনো কারণে এই গাড়িগুলো আর আসেনি।

.

আমার এখনো মনে আছে, ১৭ এপ্রিল সকালে পাঁচলাইশের দোতলা বাসায় বাবা নাস্তা সেরে নিজের শোবার ঘরে বসে আছেন। আমি মা, আর আমার ছোট বোন নাস্তা খাচ্ছি। এমন সময় বাসার দরজায় জোরে জোরে ধুম-ধাম ঘা পড়তে লাগলো। আমাদের দুজন স্টাফ জানালা দিয়ে উঁকি মাকে জানালো, আর্মি এসেছে। আমি গিয়ে বাবাকে বললাম, আমি কি দরজা খুলে দেবো? বাবা বললেন, হ্যাঁ, খুলে দাও। …

দরজা খুলে দিতেই একজন পাক ক্যাপ্টেন ও কয়েকজন সোলজার বন্দুক উঁচিয়ে ঘরে ঘরে ঢুকে পড়লো। তারা সরাসরি শোবার ঘরে ঢুকে বললো, ইউ আর আন্ডার এরেস্ট! বাবা তার প্রিয় শার্ট-প্যান্ট পড়ে তৈরি হয়ে নিলেন। ঘড়িটি হাতে নিলেন, মানি ব্যাগ পকেটে পুরলেন। চলে যাওয়ার সময় মাকে বললেন, নিজের দিকে খেয়াল রেখো, বাচ্চাদের দিকে ল্য রেখো। আমার ছোট ভাইটি তখন মার পেটে। …

গলায় আটকে আসা কান্না চেপে নাদিম কাদির বলে চলেন, পাক সেনারা যখন বাবাকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে, তখন আমি পিছু পিছু সিঁড়ি পর্যন্ত ছুটে যাই। সিঁড়ি বারান্দার জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি, বাবাকে বন্দুকের মুখে সেনা বাহিনীর জিপে তোলা হচ্ছে। গাড়িতে ওঠার আগে বাবা একবার মাথা উঁচিয়ে তাকালেন, আমাদের বাসার দিকে। তিনি আমাকে দেখলেনও। আমি তাকে দেখে হাত নাড়লাম। জবাবে তিনিও একবার হাত নাড়লেন। সেটাই আমার বাবাকে শেষ দেখা।…

সাংবাদিক নাদিম কাদিরের কাছে আমি জানতে চাই, এর পর আপনার বাবা শহীদ কর্নেল কাদিরের কোনো সন্ধান পাওয়া গেলো?

তিনি ছোট্ট একটি শ্বাস চেপে বললেন, নাহ। কেউ তাঁর কোনো সন্ধান দিতে পারেনি। এমন কী দীর্ঘ ৩৪ বছর আমরা জানতেও পারিনি, কী নির্মমভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছিলো! …

তিনি স্মৃতি চারণ করে বলেন, ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল সকালে আমাদের চট্টগ্রামের পাঁচলাইশের বাসা থেকে পাকিস্তানী সেনারা ধরে নিয়ে যাওয়ার আমরা সেনা নিবাসে তাঁর খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু তাঁর কোনো খবরই পাওয়া যাচ্ছিলো না।

কয়েকদিন পর পাক সেনার এক ক্যাপ্টেন কয়েকজন সোলজারসহ বন্দুক উঁচিয়ে আমাদের বাসায় আসে। তারা মা’র (হাসনা হেনা কাদির) কাছে জানতে চায়, আমার বাবার বন্দুকটি কোথায়? তিনি তাকে বন্দুকটি এনে দেন। এর পর সেই ক্যাপ্টেন বার বার মাকে বলেন, কর্নেল সাহেবের পিস্তল কোথায়? সেটি আপনি কোথায় লুকিয়ে রেখেছেন? মা বরাবরই অস্বীকার করেন, বাবার কোনো সার্ভিস-পিস্তল ছিলো না। কিন্তু ক্যাপ্টেন এ কথা বিশ্বাস করে না। সে মাকে বলে, জিজ্ঞাসাবাদে বাবা নাকি তাদের জানিয়েছে, তার একটি পিস্তলও আছে।

বাদানুবাদের এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেনের আদেশে মা, আমার চেয়ে সামান্য বড় বোন ও আমাকে লাইন-আপ করা হলো। সোলজাররা আমাদের দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়ালো। ক্যাপ্টেনটি হুমকি দিয়ে মাকে বললো, জলদি বলুন, পিস্তল কোথায়? নইলে সবাইকে গুলি করে মেরে ফেলবো। আমার মা তাদের বলেন, মারতে হয় আমাকে মারো। কিন্তু খবরদার! বাচ্চাদের গায়ে কেউ হাত দেবে না!

ক্যাপ্টেনটি বলে, নাহ। আপনাকে খুন করা ঠিক হবে না। কারণ আপনি গর্ভবতি ( সে সময় আমার ছোট ভাই মার পেটে)।

পরে সে সোলজারদের নিয়ে মার শোবার ঘরে ঢোকে। মাকে স্টিলের আলমারি খুলে গহনা-গাঁটি, টাকা-পয়সা — যা কিছু ছিলো, সব দিয়ে দিতে বলে। মা আলমারী খুলে সব তাদের দিয়ে দেন।

তারা যখন চলে যাচ্ছিলো, তখন আমি ক্যাপ্টেনের কাছে জানতে চাইলাম, আঙ্কেল, আমার বাবা কবে বাসায় আসবেন?

ক্যাপ্টেন অনেকণ চুপ করে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো। তারপর বললো, আ জায়গা। ফিবরে মাত করো।…

এদিকে বাবার অফিসের গার্ড এসে মাকে বলেন, আমি খবর নিয়ে জেনেছি, স্যারকে মেরে ফেলা হয়েছে। কিন্তু মা তাঁর কথা বিশ্বাস করেননি।

.

আমার মনে আছে, একদিন আমি জানালা দিয়ে উঁকি মেরে দেখি, আমাদের বাসার পাশেই পাহাড়ের ওপর হিন্দুদের ‘প্রবর্তন সংঘে’ পাক-সেনারা ঢুকে পাহাড়ের কিনারে লাইন করে দাঁড় করিয়ে পাখির মতো গুলি করে মারছে। আর মানুষগুলো গুলি খেয়ে একে একে গড়িয়ে পড়ছে খাদের ভেতর। আমি ভয় পেয়ে চিৎকার করে উঠি, এসব কি হচ্ছে! এ সব কি হচ্ছে! আমার মা এসে চোখ চেপে ধরে আমাকে জানালা থেকে সরিয়ে দেন।

সাংবাদিক নাদিম কাদির যুদ্ধদিনের কথা বলে চলেন, এমননি পরিস্থিতিতে আমার মা বুঝতে পারছিলেন, ওই বাসায় থাকলে হয়তো একদিন আমরাও সবাই মারা পড়বো। তিনি বাসা থেকে পালানোর একটা উপায় খুঁজছিলেন। প্রতিবেশীর একটি গাড়ি পেয়ে তিনি আমাদের নিয়ে বাবার পরিচিত একজনের বাসায় আশ্রয় নেন। কিন্তু তিনি পাক-সেনাদের টেলিফোন করে জানিয়ে দেন যে, কর্নেল কাদিরের স্ত্রী ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে তার বাসায় উঠেছে। এমন অবস্থায় আমার মা কাঁদতে শুরু করেন।

এদিকে কারফিউ শিথিল হলে এক দূর সম্পর্কের চাচা রহুল আমিন বাবার গ্রেফতারের খবর পেয়ে আমাদের খোঁজ করতে এসে জানতে পারেন, আমরা কোথায় আছি। তখনই তিনি একটি গাড়ি জোগাড় করে সেখানে এসে চট করে আমাদের নিয়ে সরে পড়েন। পরে আমরা বহুদিন তার বাসায় লুকিয়ে থেকেছি। তারই সহায়তায় ছদ্মনামে মাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানেই ছোট ভাই জন্ময়। মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রী বলে মা হাসপাতালের ডাক্তার-নার্স সকলের বিশেষ সেবা পেয়েছিলেন।

স্বাধীনতার পর আমরা চট্টগ্রামের পাট চুকিয়ে দিয়ে ঢাকায় চলে আসি। কিন্তু অনেক খোঁজাখুঁজি করেও আমরা জানতে পারিনি, আমার বাবা আদৌ বেঁচে আছেন কী না? অথবা কী ঘটেছে তাঁর ভাগ্যে?

এ পর্যায়ে নাদিম ভাইকে আমি জিজ্ঞাসা করি, নাদিম ভাই, আপনারা কী কর্নেল কাদিরের কোনো হদিসই পেলেন না?

নাদিম ভাই একটু দম নিয়ে বলেন, স্বাধীনতার পর পরই রেড ক্রিসেন্ট তাদের নিজস্ব অনুসন্ধানের সূত্র ধরে জানিয়েছিলো, কর্নেল কাদির ওয়াজ কিল্ড ইন অ্যাকশন। কিন্তু তারা এর স্বপে কোনো প্রমান দেখায় নি।

১৯৯৯ সালে মারা যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমার মা কোনদিনই বিশ্বাস করেননি যে, বাবাকে হত্যা করা হয়েছিলো। তিনি বলতেন, আগে যথেষ্ট তথ্য প্রমান পাই, তারপর না হয় বিশ্বাস করবো।

১৯৭৭ সালে এসএসসি পরীার পর ঢাকা থেকে আমি একাধিকবার কখনো একা, কখনো মাসহ চট্টগ্রামে ছুটে ছুটে গিয়েছি, কেউ আমার নিখোঁজ বাবার কোনো সন্ধান দিতে পারেন কি না। আমরা অসংখ্য লোকজনের সঙ্গে কথা বলেছি, বিভিন্ন জায়গায় অনুসন্ধান চালিয়েছি। কিন্তু কেউ আমাদের সঠিক কোনো তথ্য দিতে পারেনি। এ অবস্থায় আমার মা ১৯৯৯ সালে আমার বাবার কোনো তথ্য জানতে না পেরেই মারা যান। আমি ২০০৭ সালে চট্টগ্রাম সেনা নিবাসে একটি বক্তৃতা দিতে গেলে কর্নেল বায়োজিত আমাকে জানান, তিনি চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক একটি বইয়ে একবার পড়েছিলেন, পাক-সেনারা আমার বাবাসহ ১৮ জন পাঁচলাইশে হত্যা করেছে।

এরপর ওই বইটির লেখক ডা. মাহফুজুর রহমানের সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, তিনি এই তথ্য পেয়েছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূরল ইসলামসহ আরো কয়েকজন প্রত্যদর্শীর সহায়তায় বধ্যভূমিটিকে খুঁজে পাই। এরপর মুক্তিযোদ্ধা বিষয়ক মন্ত্রণালয়, সেনা বাহিনী, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ সরকারের উচ্চ পর্যায়ে বহু ধর্ণা দিয়েছি। কিন্তু কেউই বধ্যভূমিটিকে সংরণ বা শহীদদের দেহাবশেষ উদ্ধারের বিষয়ে কোনো উদ্যোগই নেয়নি। উপরন্তু বধ্যভূমিটি দখল হয়ে গিয়ে সেখানে এখন গড়ে উঠেছে চারতলা বাড়ি। আর সরকারের উদ্যোগহীনতায় এখনো সেখানে শহীদদের স্মরণে একটি নামফলক পর্যন্ত লাগানো যায়নি!

.

ছোট্ট একটি বিরতির পর আমি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের প্রসঙ্গ তুলি।

সাংবাদিক নাদিম কাদির ভাই খুব স্পষ্ট করে জানান, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করতে সরকারের ওপর রয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর প্রবল চাপ। এ কারণেই তারা এ বিচার কাজ শুরু করতে গড়িমসি করছে। এছাড়া সরকারের ওপর পাকিস্তানেরও কিছুটা চাপ রয়েছে; তবে তা তেমন মুখ্য নয়। …

তিনি বলেন, দেশের শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীদের পেছনে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মদদ রয়েছে বলে তাদের বিচার যেনো না হয়, সে জন্য সরকারের ওপর মধ্যপ্রাচ্যের প্রবল চাপ রয়েছে। বরং এ জন্য পাকিস্তান সরকারের চাপ অতটা প্রবল নয়। মধ্যপ্রাচ্যে যেহেতু প্রচুর সংখ্যক জনশক্তি রপ্তানী হয়, সে সব দেশ থেকে বিপুল পরিমান বৈদেশিক মূদ্রা আয় হয়, সে কারণে সরকার এই বিচার কাজ শুরু করতে দেরী করছে। এ ক্ষেত্রে শক্ত কূটনৈতিক প্রজ্ঞা ব্যবহার করে সরকারের উচিত হবে মধ্যপ্রাচ্যকে সামাল দেওয়া।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতেই হবে– এ কথা জানিয়ে বিশিষ্ট এই সাংবাদিক আরো বলেন, বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচারের মাধ্যমে আমরা ইতিহাসের একটি পর্ব অতিক্রম করেছি। এখন পুরো জাতি অপো করছে এ বিচারের রায় বাস্তবায়নের জন্য। তেমনি সারাদেশের মানুষ দীর্ঘ প্রতিায় আছে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য। অবিলম্বে আন্তর্জাতিক আদালতের সহায়তায় এ বিচার হতেই হবে। নইলে ইতিহাস কাউকে মা করবে না। আর জাতি হিসেবেও আমরা কখনোই ঐক্যবদ্ধ হতে পারবো না।

আওয়ামী লীগ সরকারের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গিকার, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার — এ কথা উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, এই অঙ্গীকারের জন্যই তারা ৩০ শতাংশ ভোট পেয়ে বিজয় লাভ করেছে। এখন সরকার গঠনের পর তারা যদি এ কাজে ব্যর্থ হয়, আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক দল হিসেবে হবে পুরোপুরি ব্যর্থ। সে েেত্র হয়তো আর কোনোদিন এই বিচার হবে না। কারণ অন্য কোনো সরকার কখনোই এ বিচার করবে না।…


ছবি: ১। শহীদ কর্নেল কাদির, ২। রিকশা পেইন্টিং, ন্যাট জিও মাগাজিন, ১৯৭২, সংগ্রহ লেখক, ৩। গণকবর ও মুক্তিযোদ্ধা, ন্যাট জিও মাগাজিন, ১৯৭২, সংগ্রহ লেখক, ৪। সাংবাদিক নাদিম কাদির।


পড়ুন: বাবার খোঁজে, অমি রহমান পিয়াল।