putul-1আন্তর্জাতিক নারী দিবস উপলক্ষে যখন ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে হাজার রাজনৈতিক দলের লক্ষ লক্ষ গনসংগঠণ নারীদের মর্যাদা রক্ষার্থে গলা ফাটাচ্ছেন সেই সময় এই দেশেরই একটি ঘটনা তুলে দিতে বাধ্য হচ্ছি। এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং ভারতের বেশীরভাগ মেয়েদের জীবন সংগ্রামের সাথে খুবই মিল আছে এতে।
বাঁকুড়া জেলার তালডাংরা ব্লকের সাতমৌলি গ্রামপঞ্চায়েত। পুরো পঞ্চায়েতটিতে জঙ্গলে ঘেরা ছোটো ছোটো অনেকগুলি আদিবাসী অধ্যুষিত গ্রাম রয়েছে। এখানের হাউসিবাদ গ্রামের চুনারাম টুডুর মেয়ে পুতুল টুডুর বিয়ে। পাত্রীর বয়স ১১। পাত্র ওন্দা ব্লকের জামবনি গ্রামের বাসুদেব সোরেনের ছেলে ফাগু। এমনিতে আদিবাসীদের মধ্যে বাল্যবিবাহের চল নেই, তবে কখনও সখনও যে এক আধটা হয়না তা নয়। গোলমাল বেধেছে পুতুল টুডুর বয়ানে, তার বিয়ে না করার ইচ্ছে সে প্রকাশ করেছে সাংবাদিকদের সামনে। দঃক্ষিণ বাঁকুড়ার বিশিষ্ট সমাজকর্মী এবং সাংবাদিক কার্তিক ঘোষ প্রথম যখন পুতুলের বাল্য বিবাহের খবর আমাদের যুক্তিবাদী সমিতির বাঁকুড়া শাখাকে জানালেন আমরা তৎক্ষণাৎ ঠিক করেছিলাম বিয়েটি বন্ধ করতেই হবে। এমনিতে সাঁওতাল পরিবারে ১১-১২ বছর বয়সী মেয়েদের বিয়ে দেওয়ার খুব একটা রেওয়াজ নেই। কার্তিক ঘোষ যখন আক্ষেঃপ করে বললেন গত দু বছরে সাবড়াকোণ অঞ্চলে প্রায় ১৩ টি নাবালিকার বিয়ে হয়েছে যাদের প্রত্যেকের বয়স ১২-র নীচে, কোনটাই আটকানো যায়নি স্রেফ প্রশাসনিক উদাসীনতায়, আমরা ঠিক করলাম যে কোনো মূল্যে পুতুলের বিয়ে রুখতেই হবে। এই বিয়ে রোধ করতে পারলে তা হয়তো ঐ অঞ্চলে এক দৃষ্টান্ত স্থাপিত হবে যাতে ভবিষ্যতে আরো নাবালিকার বিয়ে আটকে দেবে গ্রামের লোকেরাই।
সামনে আর মাত্র দুদিন সময় ছিল, ১০ মার্চ বিয়ে। ৮ তারিখ সকালে দেখা করলাম ঐ অঞ্চলের সেসব মানুষদের সাথে যারা বিয়েটা চাননা। এদের মধ্যে অনেকেই দিশম পার্টির সদস্য। দিশম পার্টির জেলা সম্পাদক পূর্ণচন্দ্র মুর্মু সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। দিশম পার্টির সাথে ক্ষমতাসীন সিপিএমের মারকাটারি সম্পর্ক। ৩২ বছর রাজ করে যাওয়া সিপিএমের লাল দূর্গের বহু আদিবাসী প্রভাবিত অঞ্চলে দিশম রা প্রভাব ফেলতে শুরু করেছে যা সত্যিই বিপদের বলে মনে করে সিপিএমের নেতারা। তাই গত বছর লালগড় আন্দোলন চরমে থাকাকালীন ফোঁসফাস করা দিশমের ৭২ জন নেতাকে একই দিনে জেলে ভরে বিস্তর মারধোর করেছিল পার্টিটিকে নির্মূল করার জন্য। তবুও দিশম শেষ হয়ে যায়নি। প্রভাব আরও বেড়েছে। সিপিএমের জেলা সম্পাদকও ফোনে আমাদের বললেন তিনি নাবালিকার বিয়ে বন্ধের পক্ষপাতী। যদিও হাউসিবাদ অঞ্চলের অনেকেই জানালেন এই বিয়ের উদ্যোক্তাদের পিছনে খুঁটি রূপে সিপিএমেরই স্থানীয় কিছু নেতা রয়েছেন। ক্রমশ হাতছাড়া হতে বসা এ অঞ্চলের ভোটব্যাঙ্ককে পূনরায় চাঙ্গা করতে তারা এই বাচ্চাটার বিয়ে দিতে চাইছেন। যেহেতু গ্রামের বেশীর ভাগ লোক বিয়ের পক্ষে এবং দিশম পার্টি বাল্যবিবাহের বিরোধীতায় নেমেছে তাই এক ঢিলে দুই পাখি মারার এমন সুযোগ কেউ ছেড়ে দেয়? পুতুলের বাড়ির লোকেদের সাথে কথা বলতে গিয়ে বুঝলাম তারা বদ্ধপরিকর যে পুতুলের বিয়ে দেবেনই। ওর দিদিমা রাগের চোটে ফোঁস্ করে উঠলো, মেয়ে মানুষ হল কালসাপ। বেশিদিন ঘরে রাখাও বিপদ। যত তাড়াতাড়ি বিদেয় করা যায় ততই মঙ্গল। আমরা যুক্তিবাদী সমিতির পক্ষ থেকে যতটা পারা যায় বোঝানোর চেষ্টা করলাম। তালডাংরা ব্লকের বিডিও কে অভিযোগ জমা দিলাম যে – যত সত্বর সম্ভব এই বিয়ে বন্ধ করুন এবং বিয়ের উদ্যোক্তাদের উপযুক্ত শাস্তি দেওয়ার ব্যবস্থা করুন।
অভিযোগের কপি দেওয়া হল তালডাংরা থানার ওসি, এবং জেলার সমাজকল্যান আধিকারিককে। এদিকে গ্রামের মানুষদের বোঝানোর কাজটি চলছিলই যদিও পুতুলের কিছু আত্মীয়দের বোঝানো একেবারে অসম্ভব ছিল। আমরা থানা যাবার কয়েক ঘন্টা আগে তারা জনাদশেক মিলে আকণ্ঠ মদ্যপান করে স্থানীয় আমডাঙ্গা পুলিশ ফাঁড়িতে হাঙ্গামা করে এসেছে। বিয়ের বিরোধীতা যারা করছে তাদের বাপ-বাপান্ত করে দেখে নেবারও হুমকি দিয়েছে পুলিশের সামনে। এই যখন পরিস্থিতি তখন প্রশাসনিক তৎপরতা ছাড়া পুতুলকে বাঁচানো যাবেনা বুঝে বিয়ের আগের দিন আমরা জেলাশাসকের কাছে দরবার করলাম। এস ডি পি ও কে সবিস্তারে জানিয়ে থানাতে চাপ দেওয়ার ব্যবস্থা করলাম এছাড়া তালডাংরার বিডিও অমৃতেন্দু পালের সাথে ফোনে যোগাযোগ ছিলই।
বিয়ে ১০ মার্চ। ৯ মার্চ রাত অবধি বিয়ে বন্ধের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারছিলাম না। তাই ১০ তারিখে ভোর হতে না হতে ছুটলাম বরের বাড়ি। সে আবার ওন্দা থানার এক প্রত্যন্ত গ্রাম জামবনি। অন্য ব্লক, অন্য থানা। প্রশাসনিক ভ্যানতাড়ামো বাড়বে বুঝে সোজা বর এবং তার বাবা বাসুদেব সোরেনের সাথে সাক্ষাত করলাম। জামবনির প্রচুর মানুষ সেদিন বাসুদেব এবং যুক্তিবাদী সমিতির বাক্যালাপে অংশগ্রহন করেছিল। তাদের সকলকে বাল্য বিবাহের কূফল না বোঝাতে পারলে সেখান থেকে আমরা সহজে বেরোতে পারতাম না এটা হলফ করে বলা যায়। গ্রাম থেকে বেরোনোর সময় বাসুদেবকে হাল্কা সুরে বলতে বাধ্য হয়েছিলাম, জেনে রাখুন এ বিয়ে হলে আপনি এবং আপনার ছেলের হাজতবাস কেউ আটকাতে পারবেনা।
সেদিনই দুপুরে বিডিও সাহেবের ফোন এল। বিয়ে বন্ধ। শুধোলাম, পুতুলের কি হবে? উনি বললেন, পুতুলকে তালডাংরা বালিকা বিদ্যালয়ে ভর্তি করে দিচ্ছি। শুধোলাম, সে ইশকুল তো পুতুলের বাড়ি থেকে কুড়ি কিলোমিটার দূরে? উনি জবাব দিলেন, ইশকুলের কাছে একটা আদিবাসী ছাত্রী নিবাস আছে, সেখানেই ব্যাবস্থা হয়ে যাবে। সবই সরকারী খরচে। ওই হস্টেলেও থাকা খাওয়ার কোনো খরচ লাগেনা।
তার কথা মত বিয়ের দিনেই পুতুল বিয়ের পিঁড়িতে না বসে ইশকুলের বেঞ্চিতে বসল। অশিক্ষিত এবং দরিদ্র বাবা মা কে আর আইনের মারপ্যাঁচে না ফেলে ওনাদের ভাল করে বুঝিয়ে ছেড়ে দেওয়া হল। অবশ্য একথা ঠিক যে সিপিএমের নির্দেশ না থাকলে পুতুলের ইশকুল এবং হস্টেলে ভর্তি এত সহজে হত না। এটার পেছনেও এক গল্প আছে। বিয়ের আগের দিন ওদের বড় বড় নেতাদের চামচেদের কাছে গোপনে খবর পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল যে এ বিয়ে হয়ে গেলে আন্তর্জাতিক নারীদিবসে সরকার এবং মার্ক্সবাদী সিপিএমএর ভুমিকা নিয়ে আমরা সাংবাদিক সম্মেলন করব। ব্যস এতেই কেল্লা ফতে।
গত এক বছরে বাঁকুড়া জেলায় বেশ কয়েকটি নাবালিকা কে এভাবে বাঁচানো গেছে। মালিয়াড়ার ১৩ বছরের পদ্মা রুইদাস তো সিঁথিতে সিঁদুর পরা অবস্থায় উঠে এসেছিল। পদ্মা এখন ইশকুলে যায়।
নাবালিকা বিবাহ রোধে ভারতে খুব কড়া আইন আছে। বর সমেত (বর নিজে যদি নাবালক না হয়)বরপক্ষ, কন্যাপক্ষ এবং বাল্য বিবাহে উপস্থিত ব্যক্তি ও বিবাহের উদ্যোক্তারা সবাই আইনের চোখে অপরাধী। তবু স্বাধীনতার বাষট্টি বছর বাদেও নাবালিকা বিবাহে ভারত জগতে অন্যতম স্থান অধিকার করে আছে। ৮ মার্চের আন্তর্জাতিক নারী দিবসকে কেন্দ্র করে একদিকে যখন সরকারী খরচায় সংবাদপত্রে ঢাউস ঢাউস বিজ্ঞাপন শোভিত হচ্ছে অন্যদিকে নাবালিকা বিবাহ বন্ধ করতে সেদিনই যুক্তিবাদী সমিতিকে পুলিশ প্রশাসনের দরজায় দরজায় ধাক্কা দিতে হচ্ছে। এর অন্যতম কারন আইনকে বইএর মলাটে বন্দী করে রাখা। পুলিশ প্রশাসন কিছুতেই আগ বাড়িয়ে পদক্ষেপ নিতে চায়না। রাজনৈ্তিক দলগুলি ভোটের বাক্সের দিকে তাকিয়ে প্রতিটি পদক্ষেপ ফেলে। তারা না করে জনসচেতনতার কাজ, না পুলিশ প্রশাসনকে আইন মানতে দেয়। আমাদের মত সংগঠনের সদিচ্ছার বিরুদ্ধে তারা কখনো প্রত্যক্ষ কখনো পরোক্ষ ভাবে তোপ দাগে। অশিক্ষা-কুসংস্কারে ডুবে থাকা মানুষগুলো তাতে গোল্লায় গেলে যাক। জনসাধারণ নামতে নামতে একেবারে তলানিতে ঠেকে গেলেও তাদের কিছু এসে যায় না কারন তাদের এখন মানুষকেও প্রয়োজন হচ্ছে না। ভোট দেওয়ার জন্য হাতের আঙ্গুলগুলি থাকলেই হল।