মোকছেদ আলী*

[মোকছেদ আলী বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন কাগজে বা খাতায় যেখানেই ফাঁকা জায়গা পেয়েছেন সেখানেই তার নিজের লেখা সম্বন্ধে লিখেছেন, যেমন-]

বাল্যকালে লেখক হবার আকাঙ্খা সম্পর্কে লিখেন-
বাল্যকালে যখন পাঠশালায় অধ্যয়ন করি, তখন মদন মোহন তর্কালংকার কৃত শিশু শিক্ষা বই খানার লাল মলাট আমাকে খুবই আকৃষ্ট করিয়াছিল। মলাটের উপর একটি ছাত্র। ছাত্রের পরিধানে ধুতি। কোঁচা দেওয়া। এক হাতে বই, আর একহাতে ছাতির বাট শক্ত করিয়া ধরা। বইখানা যখন হাতে লইতাম তখন ভাবিতাম এই বই যে তৈরী করিয়াছে সে কত বড় পণ্ডিত, কত বড় বিদ্বান। বইয়ের লেখকের বিষয় ভাবিতে ভাবিতে কল্পনা রাজ্যে আমিও একজন বইয়ের লেখক হইয়া উঠিতাম।

হাতের লেখা ভালো করা এবং লেখাপড়ার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করা সম্পর্কে একটি খাতার কভার পেজে তিনি লেখেন-
এই খাতায় কলার চাষ সম্বন্ধে যে সব কথাবার্তা লেখা হল, তার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে- হাতের লেখা সুন্দর করা। আমার দুর্ভাগ্য- আমি স্কুলে মাত্র কেলাচ থিরি পর্যন্ত পড়েছিলাম। তারপর দীর্ঘ ৫০ বৎসর লেখাপড়ার সঙ্গে কোনই সম্পর্ক রাখতে পারি নাই। প্রথম জীবনে চাষ বাসের কাজে লিপ্ত ছিলাম। তারপর গেঞ্জির ফ্যক্টরীতে বডি মেসিন চালনার কাজ করতাম। পরবর্ত্তী জীবনে মোজা মাফলার ছোয়েটারের কারাখানা করে পরিচালনা করতে লাগলাম। সেই সময়ে লেখাপড়ার প্রয়োজন অনুভব করতে লাগলাম। কারণ আমার কারখানায় প্রায় ১১ জন শ্রমিক কর্মরত ছিল। তাদের হাজিরা খাতা লেখা, কে কত কাজ করল তার হিসাব লেখা এবং সপ্তাহ শেষে তাদের বেতন পরিশোধ করা, আবার মহাজনের নিকট থেকে সুতা রং বাকি আনা, বিক্রয়ের সময়ও বাকী বিক্রয় করা ইত্যাদির হিসাব সংরক্ষণের জন্য লেখার প্রয়োজন হল। এর জন্য মহুরী নিয়োগ করে কাজ পরিচালনা করব তাও সম্ভব হল না। তখন নিজেই চিন্তা করলাম আমি যদি একটু চেষ্টা করি তবে হাতের লেখা সুন্দর না হোক হিসাব রাখার মত জ্ঞান তো পাবো। সেই ইচ্ছাটা মনের মধ্যে প্রবল হল। অমনি কাগজ কিনে লেখা শুরু করলাম। এই লেখা কোন বই পুস্তক দেখে না লিখে মনে যা আসত তা-ই লিখতাম। এতে আস্তে আস্তে আমার লেখার স্পৃহা জাগ্রত হল। মনে মনে ভাবলাম- দুনিয়ার অনেক মনিষী ব্যক্তিও তো স্কুল কলেজে পড়ে নাই অথচ তারা শুধু নিজের চেষ্টায় বা আগ্রহ থাকার জন্য জগতে মনিষীরূপে ইতিহাসে অমর এবং প্রাতঃস্মরণীয় হয়ে আছেন। সুতরাং বাপ লেখা পড়া শিখাতে পারে নাই বলে আফসোস করা উচিত নয়। আমি শুধু যেখানে একটা সাদা কাগজ পেয়েছি অমনি তাতে যা মনে হয়েছে, লিখেছি। এতে আমার বানান অশুদ্ধ হত। তাতে আমি হতদ্দোম হতাম না। কথায় আছে-গাইতে গাইতে গায়েন আর বাজাতে বাজাতে বায়েন। তুমি যদি প্রতিদিন মনোযোগ দিয়ে গান গাইতে থাক তবে দেখবে ২/৪ বৎসর পরে তোমার কণ্ঠস্বর সুললিত সুমধুর হয়েছে। তোমাকে বড় গায়করূপে লোকেরা শ্রদ্ধা করবে। যেমন আব্বাছ উদ্দীন, আবদুল আলীম প্রভৃতি গায়কগণ জগতের বুকে এক অবিস্মরণীয় উপমা হয়ে রয়েছেন। আবার বাজাতে বাজাতে বায়েন। আমাদের গ্রামে এক লেংড়া ছেলে বাঁশের বাঁশি বাজাতো। তার কোন দল বা শিক্ষক ছিলো না। সে শুধু বাজাতো। ৮/১০ বৎসর পরে দেখা গেল তার বাঁশীর সুরে মধু ঝরে।

আরেক খাতায় লেখা আছে-
পড়া ও লেখা আমার হবি। লিখতে আমার মোটেই ক্লান্তি লাগে না। আবোল তাবোল যা-ই লিখি, পরে তা পড়তে ভালো লাগে। আমার ছেলেমেয়েরা বলে-আব্বার লেখা পড়তে খুব ভালো লাগে। ওদের খুশি করার জন্য রোজ ৫ টাকা দিয়ে একখানা খাতা কিনে লিখি। লেখার মধ্যে থাকে রোমাঞ্চকর গল্প, তবে লেখাটা এমনভাবে লিখি মনে হবে সত্য ঘটনা। যেমন- সুন্দরবনে বাঘ শিকার। লিখলাম- আমার ভাতিজা হান্নান ফরেস্ট অফিসার। ঈদে বাড়ি এসে বলল- কাকা চলেন সুন্দরবন দেখবেন। এবং হরিণের, নানা জাতের পাখীর গোস্ত খাবেন। আমার বন্দুক আছে- বাঘ শিকার করবেন। ভাতিজার সাথে গেলাম বাঘ শিকারে, বিরাট রয়েল বেঙ্গল টাইগার। না, না, এখানে রয়েল বেঙ্গল মারা আইনে নিষেধ।

তার লেখা সম্পর্কে বন্ধুরা বলে-
বন্ধ-বান্ধব সবাই বলে, আমি চেষ্টা করলে নাকি একজন নামজাদা লেখক হতে পারি। যদি তাদের কথাটা অস্বীকার করি, তবে তাদের মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করা হয়। মিথ্যাবাদী সাব্যস্ত করলেই নির্ঘাত বন্ধু বিচ্ছেদ হবে। তাই বন্ধু বিচ্ছেদের আশংকায় আমার রোজ নামচার একটি দিনকার ঘটনা আপনাদের কাছে বর্ণনা করব। রবিবার অফিস ছুটি। গতকালই ভেবেছিলাম অতি ভোরে উঠে একটা ছোট গল্প লেখব। সময় মত পাঠিয়ে দেব মাসিক বেগমে।
বাচ্চাটা রাত ৪টার সময় বিছানা ভরে হেগে মুতে একাকার করেছে। গিন্নি উঠে ছেলেটাকে বকছে আর পিঠের উপর দুমদাম করে কিলোচ্ছে। হারামখোর, হাগা চেপেছে তা বলতে পারো না, “আমি হাগব। বিছানা ভরে হেগে কোনায় গিয়ে লক করে বসে আছেন বাবু সাব।” গাল পিঁজে ধরে একটা ঝাঁকুনি দিয়েই তার স্বরে বলল, ‘হাগা চাপেছে’ তা কতি পারো না, ক আর হাগবি নাকি, তোকে আজ মেরে শেষ করে ফেলব। বাচ্চাটা এতক্ষণ চুপ করেই ছিল, এবার কল কল করে কেঁদে উঠল। বাচ্চার কান্নায় গিন্নির রাগ এবার চরমে উঠল। পিঠের উপর গোটা ২ বার বেশ জোরে জোরেই দিল। কিছু না বলতেই কাঁদা।

লেখা নিয়ে আক্ষেপ:
শুক্রবার। দুপুর বেলা। কাজ কাম সেরে ঘরে এসে হঠাৎ খাতা খানার দিকে নজর পড়ল। এই খাতাখানা আমার প্রিয় খাতা। এর ভিতর জীবনের আবোল তাবোল অনেক কিছুই লেখা আছে। তাই কৌতুল ভরে খাতা হাতে নিয়ে পাতা ওল্টাতে লাগলাম। এদিকে জৈষ্ঠ্যের গরমে প্রাণটা আইঢাই করছে। ঘামে ভিজে গেছে লুঙ্গি, গাছের গেঞ্জি। প্যাচ প্যাচ করছে। তবুও খাতা খানার প্রতি এক গভীর মমতায় ভুলে গেলাম গরমের অতিষ্টতা। এক পাতা ২ পাতা করে ওল্টাতে ওল্টাতে হঠাৎ থেমে গেলাম এক জায়গায় এসে। তারিখটা দেয়া আছে। কিন্তু গল্পটার নাম দেওয়া হয়নি। চমৎকার একটা, কিভাবে যে লিখে ফেলেছি তা কিছুতেই আর স্মরণ হচ্ছে না। গল্পের ভাষাটাও হয়েছে স্বাবলীল আর প্রাঞ্জল। নিজেকে বার বার ধিক্কার দিতে লাগলাম। কেন আমি রোজ লিখি না। কথায় আছে গাইতে গাইতে গাওনি, আর বাজাতে বাজাতে বাওনি। অর্থাৎ কিনা- মানুষ বিরামহীন অভ্যাস আর চেষ্টা ও অনুশীলন দ্বারা সব কাজেই সাফল্য লাভ করতে পারে। আমি যদি অলসের রাজা হয়ে বসে না থেকে যদি একনিষ্ঠ সাধনা করতাম তবে এতদিনে একজন্য উচু দরের সাহিত্যিক হতে পারতাম। তা না করে কেবল ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে জীবনটা মাটি করলাম।

লেখা নিয়ে আক্ষেপ:
অনেক কিছুই লিখতে চাই, কিন্তু দুঃখের বিষয় লেখার সময় পাই না। আবার যদি সময় পাই, তখন কলম পাই না। আবার কাগজও তো দরকার। যদিও কাগজ কলম পেলাম, তখন কলমে কালি নাই। কালি যদিও জোগাড় করলাম, তখন আর লেখার আগ্রহ থাকে না। জোর করে লিখতে গেলে লেখা খারাপ হয়। তাই বলছি- কী করবো?

আরো এক জায়গায় লিখেছেন-
…সে দিন বিকালে আমাদের প্রশিক্ষণ সমাপ্তি ঘোষণা করে ছুটি দিয়ে দিলেন। আমি মামীকে বললাম মামী আমার খাতা কই? খাতা দেন। মামী আর কি করবেন, অনিচ্ছা স্বত্ত্বেও খাতাখানা আমাকে দিলেন। আমি বসে বসে মজা করে অনেক কথায় লিখলাম। আমার লিখতে খুব ভালো লাগে সারাদিন বসে বসে লিখলেও আমার হাঁফ ধরে না বা ক্লান্ত হই না। কিন্তু দুঃখের বিষয় আমার হাতে লেখা সুন্দর নহে। হস্তাক্ষর সুন্দর না হলে কেউ পড়তে চায় না। আবার আরেকটি অসুবিধা। আমার তো ভাষা জ্ঞান নেই। সেজন্য কোনকিছু লিখলে কেহ পড়তে চায় না। সেদিন তো আমার খাতার একটা লেখা পড়তে গিয়ে আমার এক বন্ধু উপহাস করে বলল- ফোহ্, এই আবার একটা ভাষা হলো নাকি। যাকে বলে জগা খিচুড়ী। জগাখিচুড়ী বোঝেন তো। চাল আর ডাল মিশিয়ে যে যেটা রান্না করা হয় তাকে বলে খিচুড়ী। আর খিচুড়ীর মধ্যে আলু, কচু, বেগুন, কপি মানে হাতের নাগালের কাছে যা সহজে পাওয়া যায় তাই ঢেলে দেয় খিচুড়ীর পাতিলে, তাকেই বলা হয় জগাখিচুড়ী। আমার লেখার ভাষাটাও আমার সেই পরম হিতৈষী বন্ধুর মতে জগাখিচুড়ী হয়েছে। কারণ সাধু ভাষার সঙ্গে চলিত ভাষা মিশিয়ে দিয়েছি। কথ্য ভাষার সঙ্গে লেখ্য ভাষা গেঁথে দিয়েছি। এর ফলে আমার লেখাটা একেবারে পাক্কা জগা খিচুড়ী হয়েছে। বললাম- জগা খিচুড়ী কিন্তু খেতে ভারী স্বাদ লাগে, ভারী মজা লাগে। আমার কথা শুনে বন্ধু বললেন, সেটা ঠিক, স্বাদ ঠিকই লাগে। তবে খিচুড়ীর নামটা আর থাকে না, হয়ে যায় জগা খিচুড়ি। তোমার তো ভাষা জ্ঞানই নেই। আর থাকবেই বা কেন, তুমি তো আর স্কুলে কলেজে পড় নাই। যে ব্যাকরণ পড়ে ভাষাটাকে সর্বাঙ্গীন সুন্দর করে লিখবে। ভাষার ভিতর কত কি আছে তাতো তুমি আর জানো না। ভাষার অলংকার আছে। ঠিকমত অলংকার না সাজালে, না পড়ালে কিম্ভূতকিমাকার হয়ে যায়। ধর এক মহিলা পরমা সুন্দরী। তার দেহে যদি জড়োয়া গহনা ঠিকমত পড়িয়ে দেয়া যায় তখন তার রূপ আরোও ফুটে উঠে, ঠিক কিনা। আর যদি সেই অলঙ্কারগুলো যথাস্থানে না পড়িয়ে পায়ের মল যদি হাতের বাজুতে পড়াও আর হাতের বাজু যদি নাকের ছিদ্রে দাও তবে কেমন দেখাবে, তার একটি কার্টুন ছবি আঁকাও দেখি।

আর এক জায়গায় লিখেছেন-
লিখতে ভালো লাগে। কিন্তু এক সময় এমন ছিল না। তখন লিখতে নয় পড়তে ভালো লাগতো। এখন পড়তে ভালো লাগে না। লিখতে ভালো লাগে। এমন এক সময় আসবে, এর কোনটাই ভালো লাগবে না, আমার জীবন থেকে এই দুটোই বাতিল হয়ে যাবে।

————
অনুলেখক- মাহফুজ

*মোকছেদ আলী (১৯২২-২০০৯)। স্বশিক্ষিত।