তোমার ঘরে বসত করে কয়জনা

 

আজ ট্রেনিং রুমে  তিল ধারণের জায়গা নেইঅন্য সময়ে ইন সার্ভিস ট্রেনিং এর কথা আসলেই কর্মীদের ওই দিনটিতেই নানান কাজ পড়ে যায় যে যে ভাবে পারে এড়ানোর চেষ্টা করেআজ চিত্র পুরো উলটো কারণ আজকের প্রেযেন্টার একজন ট্র্যান্সজেন্ডার ভদ্র মহিলাবিষয় জেন্ডার এন্ড ডিসক্রিমিনেশন ঔৎসুক্য ক্রমেই বাড়ছেকেউ এসেছে কিছু শেখার জন্যে, কেউ নেহায়েত তামাশা  দেখতে এবং এদের দলই ভারী আর কেউ ট্রেনিং রুমের বাইরে জটলা পাকাচ্ছে যেন চরম পাপাক্রান্ত কিছু ঘটতে চলেছে

 

নিজেকে জিজ্ঞেস করলাম কেয়া রোজারিও তুমি কোন দলে পড়ো? প্রশ্নটা করে স্বভাবসিদ্ধভাবে নিজেকে খুঁতে প্রস্তুত  হলাম নিজেকে খুঁড়ে আমি ব্যাপক আনন্দ পাইআজকে ভয় হলো আমার না জানা কোন কেয়া বেরিয়ে আসতে পারে তাই পরক্ষণে সামাল দিলাম এই ভেবে যে, আমার স্টাফ ট্রেনিং আমি না থাকলে কি চলে?”

 

জনা পঞ্চাশেক মানুষ চরম উত্তেজনায় সময় কাটাচ্ছে কেননা ভদ্রমহিলা এখনো এসে পৌঁছোননিতার সহকর্মী আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেনসবাই ঘড়ি দেখতে ব্যস্ত যেনো এক্ষনি কোন সার্কাস শুরু হবেঝলমলে কাপড় পড়ে কেউ গলায় ঢুকিয়ে দেবে চকচকে তলোয়ার অথবা মুখে পুরে দেবে জ্বলন্ত অগ্নি শলাকা

 

না তেমন কিছুই ঘটলো নাসব প্রতীক্ষার  অবসান ঘটিয়ে ভদ্রমহিলা রুমে ঢুকলেনএক নজরে মনে হলো একজন সুঠাম দেহী পুরষ গালে আর চিবুকে কিছুটা মাং সংযোজন করেছেন অত্যন্ত উত্তেজক কাপড় পরা, ঘাড় বেয়ে নেমে এসেছে ইনপ্ল্যান্ট করা খয়েরী বাদামী চুলভদ্রমহিলার চোখে এক গাদা মাশকারা মাখা না  কিছুতেই  আমার দেখা  কোন মহিলার সাথে এনার মিল খুঁজে পাচ্ছি নানিজকে  প্রশ্ন করি, কেয়া, কেনো তোমার এনাকে মহিলা মনে হচ্ছে না? তোমার দেখা কোন মহিলার সাথে মিল পাচ্ছো না বলেই কি?”

 

ভদ্রমহিলা এসেই একটা খাম্বার পেছনে জড়োসড় হয়ে বসলেনউনি কি নিজেকে নিয়ে বিব্রত? জানি , এতোগুলো জোড়া জোড়া কৌ্তুহলী চোখের সামনে যে কেউই তো বিব্রত বোধ করতেই পারেনাকি ধনুকের টানটান উত্তেজনার মুহুর্তে হঠাৎ বেরিয়ে এসে করতালি চাইছেন? 

 

ভদ্রমহিলা এবারে উঠে এসে সবার সামনে বসলেনবললেন আমার নাম রাজিন্দর নাহঃ মোটেও মেয়েলী কোন কন্ঠস্বর নয়তিনি শুরু করলেন তার জীবনের গল্প , বললেন তার শারীরিক গঠন পুরুষের  হয়ে জন্মালেও তার মন সর্বদাই নারীদের মত  ভেবেছে, আচর করেছে

 

সে কারনেই প্রাইমারী স্কুল থেকেই সহপাঠীরা ঠাট্টা করেছে, অনেক নামে ডেকেছেআমাদের বোধ হয় ধারণাই নেই কত ছোট বয়স থেকেই এধরণের নানা ঠাট্টা মশকরা করে বাচ্চারা  রাজিন্দর কিছু উপাত্ত দিলেন যে কত বাচ্চা এ ধরনের আচরণের স্বীকার হয়, উপাত্ত দিলেন স্কুল শুটিং এর সাথে এই ঠাট্টা বা বুলিং এর কি সম্পর্ক রয়েছে

 

 

এর মাঝে আমাদের একজন সহকারী বললেন তাদের  পরিবারে একটি শিশুর জন্ম হয় পুরুষ মহিলার শারীরিক  উভয় অঙ্গ নিয়েবাবা মা সিদ্ধান্ত নেয় নারী অঙ্গের অপসারণেবাচ্চাটির বয়স এখন দশআয়নার সামনে দাঁড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে মায়ের  কাছে  জানতে চায় কবে সে মেয়েতে রুপান্তরিত হবে? তার শরীরের পরিচয় ভিন্ন হলেও তার মনের পরিচয় ভিন্ন।। বাবা মা যতই শরীরের অঙ্গ অপসারণ করুক না কেনো বাচ্চাটি মেয়ে হয়েই জন্মেছিলো

 

রাজিন্দর এ সময়ে উল্লেখ করেন  সিএনএনদেখানো ৬০ মিনিটের একটি পর্বের কথা, যেখানে পুরুষ পরিচয়ে জন্মানো একটি বাচ্চা কথা বলা শুরু  থেকেই মা কে জানিয়ে দেয় সে একটি মেয়েসে নিজেকে মেয়ে হিসেবেই সনাক্ত করেআমার আবারো মিশ্র অনুভুতি হয়, একটা দুবছরের বাচ্চা মাকে বললো সে মেয়ে আর মা  বাবা ও তাই মেনে নিলোপরক্ষণে মনে হলো তবে কি আগের ঘটনার মত বাবা মায়ের  সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত যা পরবর্তীতে বাচ্চার জন্যে ভালো নাও হতে পারে?

 

রাজিন্দর  এবার বলা শুরু করলেন তার পরিবারের কথাবাবা বিশাল দেহী ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান, মা বেশ কিছু রেসের সংমিশ্রন  মা তার এই জীবনকে মেনে নিয়েছেন কিনা বোঝা যায় না কারণ, মা এ নিয়ে কোন কথা বলেননি  কিন্তু বাবা তাকে ত্যাজ্য করেছিলেনওর বাবা ক্যান্সার আক্রান্ত হবার পর শেষ তিন মাস ফোনে কথা বলেছে, বাবার নানা আকুতির সাড়া দিতে পারে নি রাজিন্দরমৃত্যু শয্যায় বাবা ছেলেকে  দেখতে চেয়েছেরাজিন্দর পরিবর্তিত মুখাবয়ব, পরিবর্তিত দেহ নিয়ে বাবার সামনে যেতে  সংকোচ বোধ করেছেততদিনে রাজিন্দর মেয়েদের মত গলা খাদে নামিয়ে কথা বলা রপ্ত করে নিয়েছিলো কিন্তু বাবার সাথে পুরুষালী কন্ঠেই কথা বলেছেএতটুকু বলে রাজিন্দর কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেনএবারে ওর সেই নিকষ কালো মাশকারা চোখের জলে গলে গাল বেয়ে নামতে শুরু করেছেসহকর্মীর দিকে হাত বাড়িয়ে দিতেই সহকর্মী রুমাল  এগিয়ে দিলেনসবার চোখ অশ্রুসিক্তআমারো মন খারাপ হলো এই দুঃখী মানুষটার জন্যেকিন্তু সাথে সাথে এও মনে হোল তবে কি গাঢ় করে মাশকারা পড়ার কারণ এটাই ? এটাও কি আজকের প্রেযেন্টেশনের মহড়া দেয়া কোন অংশ?

 

রাজিন্দরকে বার বার হত্যার হুমকি  দেয়া হয়েছে নির্মম ক্রোধে, পৈশাচিক উল্লাসে রাস্তায় ফেলে পেটানো হয়েছে,  সাবওয়ের নিচে নিয়ে আগুনে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হয়েছে, রাজিন্দর মরতে মরতে বেঁচে গেছেন – তবু  বেঁচে আছেন

 

ওর চাকরী পাওয়ার ঘটনাটা বলতে শুরু  করলেন রাজিন্দরকর্ম জীবনের শুরুটা খুব কষ্টের, কেউ চাকরী দূরে থাক, ইটারভিউতে ডাকে নি কারন ড্রাইভার লাইসেন্সে তার পুরুষ পরিচয় আর এপ্লিকেশনে  নারী পরিচয় খটকা বাঁধিয়েছিলোএক বন্ধু শেষে পরামর্শ দিলো এক কাজ কর না কেনো, টেলিফোনে উত্তেজক কথা বলার একটা চাকরী নাও না কেনো?   এর পরের ছবছর রাজিন্দর বন্ধুর পরামর্শ মত  চাকরীই করেছেআমি অবাক হয়ে ভাবলাম এমন একটা চাকরী এতো সহজে কেনো ও নিলো?  ও পথে পা বাড়ালো কেনো?  রাজিন্দর বলে চলেছে ক্ষিদের কষ্ট কি তা সে জানে, আজকে যেমন আলাদা য়েবসাইট আছে ট্র্যান্সজেন্ডারদের  চাকরীর  জন্যে, আগে এমন ছিলো না এরা সাধারত টেলিফোনে কাস্টমার সার্ভিস অথবা রাতে সবার চোখের আড়ালে ব্যাংকে বা অন্য কোন প্রতিষ্ঠানে ডাটা এন্ট্রির চাকরী পেয়ে থাকে

 

এর পর এমনি একটি ব্যাংকে রাজিন্দরের চাকরী হয়সমস্যা বাধে ও কোন টয়লেট ব্যবহার করবেন তা নিয়েপুরুষ অথবা মহিলা সহকর্মী কেউই স্বাছন্দ্যবোধ করে না তার উপস্থিতিতে

 

পলিটিকালি কারেক্টেড সিদ্ধান্ত নেয়া হলো রাজিন্দর লবিতে ফ্যামিলি টয়লেট ব্যাবহার করবেমজার কথা হলো রাজিন্দরের ডিউটি ছটা থেকে রাত দুটো পর্যন্ত আর লবি বন্ধ হয়ে যায় পাঁচটায়এক বছর একটানা ও কাজে  টয়লেট ব্যাবহার করতে পারে নিতৃষ্ণায় কাতর হলেও ভুলে গলা ভেজায়নি জলে, পাছে টয়লেটে যেতে হয়একবছর পর টেলিভিশনের একটি অনুষ্ঠান কল মি হাওয়ার্ড  এ ফোন করে তার সমস্যার কথা জানায়পরদিনই কর্তৃপক্ষ মহিলাদের টয়লেট ব্যবহারের নির্দেশ দেয়হয়তো বা  ডিসক্রিমিনেশনের কেস এড়াতেই

 

কাজের ওখানে ওকে ইচ্ছে করে স্যার বলে সম্বোধন করেছে কেউ কেউরাজিন্দর মেনে নিয়েছেন এই তাচ্ছিল্যআমি এবার নিজেকে প্রশ্ন করি আবার, রাজিন্দর আমার সহকর্মী হলে আমি কি বলতাম? এমন মেয়েলী কাপড় পড়া পুরুষ কে আমি কি  বলে সম্বোধন করতাম?

 

টেনিং এ যে পুরুষরা উপস্থিত ছিলেন সেদিন, দেখলাম তারা মোটেও রাজিন্দরকে নিজেদের একজন ভাবছেন নাযারা অন্য পুরুষের প্রতি আকর্ষ বোধ করেন তারাও না  মহিলারা তো নয়ইতাহলে রাজিন্দরের অবস্থান কোথায়? রাজিন্দর ক্রসড্রেসার নয় যে শুধু মাত্র ঝোঁকের কারনেই মহিলাদের পোষাকের প্রতি ই তার আকর্ষনসে নিজেকে একজন পুরুষ দেহে বাস করা নারী হিসেবে দেখেনভাবলাম তোমার মাঝে বাস করে কোন জনা -তুমি জানো নাএবারে আমি রশুনের খোসা  ছাড়াতে বসলামদেখলাম আমার নারী পুরুষের  প্রথাগত সমস্ত ধারণা কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছেআমি কি প্রস্তুত?

 

রাজিন্দর এবারে একেবারে ব্যাক্তিগত কথা শুরু  করলেনবললেন মেয়েদের পোষাক পরার সুবিধে হলো পুরুষ বন্ধুরা ওদের সাথে লুকিয়ে সম্পর্ক করে না বরং রেস্টুরেন্টে খেতে নিয়ে যায়তাই রাজিন্দরও নিজেকে দ্বিতীয় ভাবে  না বা মিসট্রেস সিন্ড্রমে ভোগে না

 

আমি মনে মনে বললাম রাজিন্দর তুমি এমন ভাবে কথা বলছো যেনো তুমি কোন মহিলা -আমাদের চোখে  তো তুমি নারী পোষাকে পুরুষই

 

পরক্ষণে বোঝালাম নিজেকে এই জন্যেই তো আজকের এই ট্রেনিংআমার চোখে রাজিন্দর পুরুষ কিন্তু ওর মন? ওর মনতো জন্মাবধি নারীর biological sex assignment is not gender identity” বারবার বলে চলেছে ও

 

একজন সহকর্মী বলে বসলো- রাজিন্দর এত্তো উত্তেজক  কাপড় পড়েছো কেন? চেয়ে দেখো এই রুমের কেউ তো তোমার মত কাপড় পরেনিরাজিন্দরের চোখে অপ্রস্তুতি, মুখে রক্তের ছোটাছুটি লক্ষ্য করলাম হাসতে হাসতে হড়হড় করে যে রসিকতা বেরিয়ে এলো ওর মুখ দিয়ে তাতে কানে আঙ্গুল দিতে হয়  নিজেকে সামলে নিয়ে বললো, পুরুষরা এভাবে দেখতে পছন্দ করে তাই পরি

 

এবার আমার অবাক হবার পালাআবার সেই পুরোন কথা পুরুষরা যেমন করে দেখতে চাইবে তেমন করেই সাজতে হবে!!  তাহলে তুমি আলাদা হলে কীভাবে রাজিন্দর?

 

নিজেকে বোঝালাম -ওর মন তো মেয়েলী মনই, ভাবতেই পারে ও অন্য মেয়েদের মত একই ভাবনা

 

ট্রেনিং  দুঘন্টার জায়গায় তিন ঘন্টায় ঠেকলোসবার কৌ্তুহলের পর্ব যেনো কাটতেই চাইছে নাটেনিং  শেষ করে যখন বেরিয়ে আসছি খেয়াল করলাম আমি নিজে থেকে রাজিন্দরের সাথে কথা বললাম না বরং ওর পুরুষ  সহকর্মীর সাথে কথা বললামআমি ওদের সমস্যা জানতে চাইছি কিন্তু ওকে মেনে নিতে কি আমার কষ্ট হচ্ছে? আমি এর তাত্ত্বিক দিকটায় আগ্রহ দেখাচ্ছি কিন্তু সামাজিক  দিকটা এড়িয়ে যাচ্ছিহয়তো ব্যাপারটার কোন ব্যাখ্যা দিতে পারছি না বলেই আমার  এই পালিয়ে যাওয়া