কথা দিয়েছিলাম আমার অবিশ্বাসের কথা বলব। এই মার্চ মাস স্বাধীনতার মাস, যেহেতু আমার অবিশ্বাসের সূত্রপাত, এটাই সূবর্ন সময় সবার সংগে শেযার করার।
আইযুব খানের কঠিন শাসনে আমাদের মফস্বল জীবন কেটে যাচ্ছিল নিঃস্তরংগ। ৬৫ এর ভারত পাকিস্হান যুদ্বের পর এক ধরনের প্রবল পাকিস্হান প্রেমে মুগ্ধ আমরা।এই প্রেম আরও গাঢ় হয় যখন স্কুলে স্কুলে মহা ধূমধাম করে পালিত হলো “উন্নযন দশক”।আইযুব তখন আমাদের চোখে হিরো। অবস্হা পাল্টালো ৬৮ এর পর।”পাকিস্হান দেশ ও কৃস্টি” নামক বই যখন পাঠ্য করা হলো, ফেটে পড়লো পুরো পূর্ব পাকিস্হান। জীবনে প্রথম মিছিলে শামিল হলাম। সরকার বাধ্য হলো ব্‌ইটি তুলে নিতে। তারপরের ইতিহাস সবার জানা।শুরু হলো মুক্তিযুদ্ব।আমাদের এমন একটা বযস, পারলাম না যুদ্বে যেতে।২৬ মার্চ থেকে ১৪ই এপ্রিল মুক্ত ছিলো।পাকিস্হান সেনা বাহিনী আমাদের এলাকায় প্রবেশ করার পর আমরা পুরো পরিবার পালিয়ে গেলাম আমাদের গ্রামের বাড়ী।ইতিমধ্যে পাকিসহান সরকার ঘোষনা করলো সমস্ত স্কুল কলেজ খোলার।আমি আমার বাবা চলে এলাম আমাদের বাসায়। স্কুলের দপ্তরি হালিম ডাই রান্না করে, আমরা বাপ বেটা সেই অখাদ্য খেয়ে বেচে রইলাম। স্কুলে যাওয়া আসা করি, ক্লাস হয় কি হয় না। অল্প কয়েক জন ছাত্র আসা যাওয়া করি। তারপর এলো সেই দিন…..১৫ই জুন’৭১…সোনাপুর,নোয়াখালি… স্কুল ছুটি হয়ে গেলো একটু আগে আগে, ছাত্রের অভাবে।দুপুরে খেয়ে বাসার সামনে দাড়িয়ে আছি। হটাৎ দেখলাম কয়েকটি আর্মি ট্রাক এসে দাড়ালো আমাদের স্কুল মাঠে, ধড়াস করে উঠল বুকটা। এই প্রথম দেখলাম পাকিস্হান আর্মি। সবাই লাফিয়ে নামলো ট্রাক থেকে। দাড়িয়ে দাড়িয়ে দেখছি.. তখনো বুঝতে পারিনি কি ভয়াভহ পরিনতি হতে যাচ্ছে আমাদের।ভাবলাম স্কুলে ক্যাম্প করবে।কিন্তু স্কুলে কেউ ঢুকলো না।দেখলাম সব সৈন্য কে চার ভাগে ভাগ করে সবাই চার দিকে রওয়ানা হলো। হটাৎ গুলির শব্দ.. বৃষ্টির মত। ভয়ে তাড়াতাড়ি ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে বসে রইলাম। গুলির শব্দে কানে তালা লাগার উপক্রম, এরমধ্যে শুরু হলো ধোয়া। বিভিন্ন বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেওয়ায় নিঃম্বাশ বনধ হওয়ার উপক্রম।বিপন্ন মানুষের চীৎকার। দরজায় দমাদম রাইফেল এর বাড়ি …ঘরে একা ভয়ে ঠকঠক করে কাপছি। “দরওয়াজা খোলো” চিৎকারে দরজা খলে দিলাম।রক্তজবার মত চোখ নিয়ে উদ্যত চায়নিজ রাইফেল হাতে ঢুকে পড়ল বাসায়। পুরো ঘর তন্ন তন্ন করে খুজে আমার দিকে তাকিয়ে বললো “ইধার আও” । এগিয়ে গেলাম, ” প্যান্ট উতারো” … ভাবলাম ভূল শুনছি…এবার রাইফেল এর বাট দিয়ে বাড়ি দিয়ে চীৎকার করে আবার বললো..”প্যান্ট উতারো” । “ভাইয়া ভাইয়া” বলে পা ধরলাম। লাথি খেয়ে দুরে গিয়ে পড়লাম….তারপর ওরা পরপর দুজন আমাকে “…………….”। ঠিক তখন পাশের বাসায় মহিলা কন্ঠে চীৎকার, বুঝলাম আমার মতই অবস্হা। ওরা চলে যাওয়ার পর কতক্ষন কেটেছে বুঝতে পারিনি।হুইসেল এর শব্দ শুনে বের হলাম।দেখলাম সব সৈন্য আবার স্কুলের মাঠে জড়ো হলো। তারপর সবাই লরীতে চড়ে ফিরে গেলো। ওরা চলে যাওয়ার পর বেরোলাম এলাকায়। স্তম্ভিত হয়ে গেলাম….চারি দিকে লাশ আর লাশ। স্কুলের মাঠে পাচ জন, পুকুরের ঘাটে চার জন, ওই বাড়িতে আট জন… মোট দুশ জনের মত, মাত্র দু ঘন্টায়। পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতা সম্পর্কে এতদিন শুনেছি, এবার দেখলাম।
পাকিস্হানিরা নাকি আমাদের “আসলি মুসলমান” মনে করত না।তারা নাকি “আসল মুসলমান”। এই তবে ইসলাম? এতদিন ইসলাম মানে আমার কাছে ছিল, কোরান তেলোয়াত, নামাজ পড়া, রোজা রাখা, সব কিছুই না বুঝে। কোরানের অনূবাদ পড়া শুরু করলাম। থমকে গেলাম সুরা মুমেনুন পড়ে.. “যুদ্বে ধর্ষণ সিদ্ধ”। ভাবলাম এ হতেই পারে না। নিঃম্চয় কেউ কোথাও না কোথাও ভূল করছে।বিশ্বাস হারাইনি।
কলেজে ভর্তি হওযার পর আমাদের এক আড্ডা চক্র গড়ে উঠে। “কাসেম স্যার” এক আশ্চার্য্য প্রতিভা । নাটক লিখেন, অভিনয় করেন, গান করেন। উনার সানিধ্যে আমার পুরনো সব প্রশ্নের উত্তর খুজে পেতে লাগলাম। নামাজ রোজা বাদ পড়তে লাগলো। এরমধ্যে এক রোজার দিনে দুপুরে এক রেস্টুরেন্ট এ খাওয়ার অপরাধে ব্যাপক মার খেলাম হুজুরদের কাছে। এত লোকের সামনে মার খেয়ে লজ্জায় মাটিতে মিশে যেতে ইচ্ছে হলো।ইসলাম সম্পর্কে সমস্ত মোহ কেটে গেলো।ব্যাপক পড়া শুনা শুরু করলাম।পড়ি আর ভাবি এসব কি? কোরানের পাতায় পাতায় শুধু ঘৃনা,ভয়, লোভ, অন্য ধর্মের মানুষকে কি ভয়ন্বর ভাবে ঘৃনা করা যায়, তার বর্ননা পাতায় পাতায়, আর হাদিস গুলো “উদ্ভট,ঘৃন্য,বমন উদ্রেককারী”। সবার সংগে ধর্ম নিয়ে তর্ক শুরু করলাম।বাবা অভিশাপ দেওয়া শুরূ করলো। মা চুপি চুপি কাদত।
একটা কথা এখনও বুঝে উঠতে পারিনি, কোরান বুঝে পড়ার পর একজন শিক্ষিত
মানুষের পক্ষে কি ভাবে এত অসম্ভব কথা হজম করতে পারে। উত্তর আজো খুজে পাইনি।বুঝতে পারিনা, যুক্তির চেয়ে বিশ্বাস কি ভাবে শক্তিশালী হয়।