ডায়েরীর মূল কপি এখানে দেখা যাবে।

ইচ্ছা ছিল ফেব্রুয়ারী মাসের মধ্যেই এ লেখাটি নামাবো। তবে, অনিবার্য কারন বশতঃ সেটা সম্ভব হল না। আশা করি তাতে মূল আকর্ষন ক্ষুন্ন হবে না।

১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আমার বাবা ছিলেন বুয়েটের পূর্বপুরুষ ততকালীন আহসানউল্লাহ ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের প্রথম বর্ষে ভর্তি হওয়া উনিশ বছরের সদ্য তরুন। তার সে বয়সেই ডায়েরী লেখার অভ্যাস ছিল। তার বেশ কটি ডায়েরী আছে অনেক বিচিত্র বিষয়ের উপর লেখা। ভাষা আন্দোলনের সেই সময়টায় বেশ কিছু ঘটনা তিনি নিজের চোখ দেখেছেন ও প্রতিদিন তার ডায়েরীতে লিপিবদ্ধ করেছেন। এ মাসের শুরু থেকেই মনে হচ্ছিল এই লেখাগুলি সবার সাথে শেয়ার করি। তার লেখায় হয়ত কোন জটিল রাজনৈতিক বিশ্লেষন থাকবে না, তবে একজন সাধারন বাংগালীর সে সময়কার অনুভূতি ও পরিস্থিতি হয়ত খানিকটা বোঝা যাবে।

রক্তঝরা দিনের ডায়েরী
চোখে যা দেখেছি
১৯৫২

অদ্য ২০শে ফেব্রুয়ারী। ষোল তারিখ থেকে কলেজে exhibition চলছে পূর্নোদ্যমে। Exhibition এর কাজে, বিশেষ ব্যাস্ত। হঠাত শুনতে পেলুম রাস্তায় সরকারী Publicity Van থেকে ঘোষনা করা হচ্ছেঃ আগামী কল্য ২১শে ফেব্রুয়ারী হতে ঢাকা শহরের সর্বত্র একমাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হইল। চারজনের অধিক লোকের সমাবেশ অথবা জেলা ম্যাজিষ্ট্রেটের অনুমতি ব্যাতিত শহরে কোনরকম শোভাযাত্রা বা সভা সমিতি করা যাইবে না।

মনে হঠাৎ ‍ খটকা লাগল। এ সময় ১৪৪ ধারার দরকার ছিল কি? মনে পড়ে গেল – রাষ্ট্র ভাষা আন্দোলনের জন্য ২১ শে ফেব্রুয়ারী প্রদেশের সর্বত্র ধর্মঘট আহবান করা হয়েছে। ছাত্ররা না হয় শান্তিপূর্ণ উপায়ে শোভাযাত্রা বের করে বাংলা ভাষার সমর্থনে দু’একটি শোভাযাত্রা বা সভাসমিতি করবে, এজন্য ১৪৪ ধারার প্রয়ো্যনটা ছিল কি? এর আগেও তো চার তারিখে শান্তিপূর্ণ উপায়ে হরতাল ও শোভাযাত্রা হয়েছিল – তাতে তো শহরের কোথাও অতটুকু শান্তিভংগ হয়েছে বলে জানা যায়নি। আগামী কালই বা শান্তির ব্যাঘাত ঘটার সম্ভাবনা সরকার কোথা থেকে আবিষ্কার করলেন? যাকগে দেখা যাবে।

*** *** *** ***
২১শে ফেব্রুয়ারী। সকাল দশটা পর্যন্ত মনেই ছিল না যে অদ্য প্রদেশব্যাপী ধর্মঘট। মনে না থাকার কারনও ছিল। আমাদের Programme ছিল ধর্মঘট চললেও আমরা আমাদের Exhibition এর কাজ নিয়মিত চালিয়ে যাব। All Student’s Committee of action হতে ছাত্রদের ওপর নির্দেশ ছিল যে- বেলা দশটার সময় যেন সকলে University Compound এ কর্তব্য নির্ধারনের জন্য জমায়েত হয়। আমার বন্ধুবান্ধবদের মধ্যে অনেকে গিয়েছেন ও। আমার যাওয়া সমিচীন মনে করিনি কারন দুটো থেকে College Exhibition এ duty. আজকের Exhibition শুধুমাত্র মহিলাদের জন্য যেমন ছিল ১৮ তারিখ। একটার সময় সেজে গুজে কলেজে রওনা দিচ্ছিলাম। পথে দেখা জনৈক ছাত্র বন্ধুর সংগে। ভীষন উত্তেজিত হয়ে সে আবোল তাবোল বকে যাচ্ছিল। তার কাছ থেকে যা জানা গেল তার অর্থ মোটামুটি এরকম – সে আসছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসভা হতে। পুলিশ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাংগনে ঢুকে নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর কাদুনে গ্যাস আর লাঠি চার্জ করে ছাত্র জনতাকে ছত্রভংগ করে দিয়েছে, ইত্যাদী।…বিশ্বাস হল না। পূর্ব পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ শিক্ষায়তনের অমর্যাদা করে পুলিশ হামলা চালাবে এটা যেন কোনমতেই প্রানে স্থান দিতে পারলাম না। একটু পরেই সত্য ঘটনা কর্ণগোচর হল।…..University Arts buildings এর প্রাংগনে ছাত্র জনসমুদ্র সমবেত হয়েছেন; বিভিন্ন বক্তা জ্বালাময়ী ভাষায় বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবী জোরাল করে তুলছেন। সমবেত ছাত্রসমাজের মধ্যেও বেশ সাড়া পাওয়া যাচ্ছে। সাড়ে চার কোটি লোকের মুখের ভাষাকে কেড়ে নিতে তারা দেবে না। বক্তারা বলছেন – উর্দুর সংগে আমাদের কোন বিরোধ নাই। উর্দুকে আমরা মুছে ফেলতে চাই না। আমাদের দাবী বাংলাকেও উর্দুর সমমর্যাদা দিতে হবে। ভাইস চ্যান্সেলর কতিপয় অধ্যাপক সমভিব্যাহারে এসে ছাত্রদের শান্তভাবে প্রস্থান করতে উপদেশ দিলেন। ছাত্ররাও এ সিদ্ধান্ত গ্রহন করে। সকলে এক সংগে রাস্তায় বেরুলে ১৪৪ ধারা অমান্য করার অজুহাতে পুলিশের কোপ দৃষ্টিতে পড়তে পারে সেজন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলে বিভক্ত হয়ে ছাত্ররা যার যার আবাসস্থানে প্রস্থান করতে সিদ্ধান্ত গ্রহন করল। কিন্তু এতে দুকুল রক্ষা পেল না। প্রথম ক্ষুদ্র দল কটিকে পুলিশ গ্রেফতার করল। এতে ছাত্ররা প্রমাদ গুনল। সত্যি বলতে কি এহেন পাইকারী গ্রেফতার দেখে ছাত্ররা একটু উত্তেজিত হল। ভেতরে বাইরে এ নিয়ে ছাত্র ও পুলিশের মধ্যে বচসা চলতে লাগল। বেরুলেও গ্রেফতার করবে, ভেতরে জটলা পাকিয়ে থাকলেও পুলিশ শাসাবে, এ পরিস্থিতিতে পড়ে ছাত্ররা দিশেহারা হয়ে পড়ে। পুলিশ এর মধ্যে ছাত্রদের চালাকি আবিষ্কার করল। তাই রাস্তায় দাঁড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে তারা ছাত্রজনতার প্রতি কাদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করতে থাকে। ছেলেরা এতে আরো ক্ষুব্ধ হল – তাই চপলতা বশতঃ পুলিশের প্রতি ছিটেফোটা ইটপাটকেল ছুড়তে লাগল। এতে পুলিশের পুলিশত্বে আঘাত লাগল। তাই তারা নিয়ম কানুন শৃংখলা সব কিছু পায়ে মাড়িয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাংগনে ঢুকে পড়ল এবং বেপরোয়া কাদুনে গ্যাস ও লাঠি চার্জ করে ছাত্রদের ছত্রভংগ করে দিল। অগনিত ছাত্র আহত হয়ে Medical College Hospital এ নীত হল। বিক্ষুব্ধ ছাত্রসমাজ তখন মেডিকেল কলেজের হোষ্টেল কম্পাউন্ডে সমবেত হতে লাগল।

গতকাল থেকে প্রাদেশিক সরকারের পরিষদে বাজেট সেশন চলছে। মেডিকেল কলেজের হোষ্টেল হতে পরিষদ ভবন একেবারে কাছাকাছি – রাস্তার এ পার আর ওপার। তাই ছাত্রদের ইচ্ছা ছিল Medical হোষ্টেল হতে স্লোগান দিয়ে তাদের ন্যায্য দাবী পরিষদ ভবনের বড় কর্তাদের কর্ণগোচর করা। আমাদের হোষ্টের পূর্বদিকে খেলার মাঠ। তারপর বক্সীবাজার রোড এবং রাস্তার পরেই মেডিকেল হোষ্টেল; দুমিনিটের পথ।…..

মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টেলে ছাত্ররা শান্তিপূর্ণ উপায়ে পুলিশি হামলার তীব্র নিন্দা করছিল। পুলিশ দ্বারা বিশ্ববিদ্যালয়ের পবিত্রতা ক্ষুন্ন হয়েছে – শান্তিপূর্ণ নিরীহ ছাত্রদের ওপর জুলুম করা হয়েছে এজন্য ছাত্ররা বিশেষভাবে ক্ষুব্ধ। মেডিকেল হোষ্টেলের উত্তর-পশ্চীম কোনে যেখানটা প্রায় এসেম্বলী হলের গা ঘেষে আছে সেখানে ছাত্ররা লাঊড স্পীকার ফিট করেছে। পরিষদে অবস্থানরত দেশ কর্তাদের কানের ভেতর প্রবেশ করছিল ছাত্রদের দাবী – “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” – “পুলিশের জুলুম বন্ধ কর”- “মুসলিম লীগ ধ্বংস হোক” ইত্যাদী। ছাত্রদের মুহুর্মুহু শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ঊঠল। ছাত্রদের এহেন আচরনে পুলিশদের মস্তিষ্কে আগুন ধরিয়ে দিল তাই বাইরে থেকে পুলিশ অবিরত কাদুনে বোমা ছুড়তে লাগল হোষ্টেল কম্পাঊন্ডে। কাদুনে গ্যাসে বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠল। এতে করে নিরীহ ছাত্ররা আরো উত্তেজিত হয়ে উঠল। তারা তো কোন জোর জবরদস্তিমূলক কাজ করছে না- নিজের ভাষার দাবী ও অন্যায়ের প্রতিকার চাইছে মুখে। এতে করে ছাত্রদের একদল এত উত্তেজিত হল যে – ইটপাটকেল ছুড়তে লাগল পুলিশদের প্রতি। ফলে ক্ষনিকের জন্য পুলিশ হঠে যেতে বাধ্য হল। কিন্তু ছাত্ররা যখন আবার তাদের দাবী পেশ করতে শুরু করেছে, ঠিক সে মুহুর্তে বহুসংখ্যক পুলিশ হোষ্টেলে ঢুকে পড়ল এবং বেপরোয়া দিগ্বিদিগ গুলিবর্ষন করতে লাগল। অপ্রত্যাশিতভাবে গুলিবর্ষনের ফলে ছাত্ররা ইতস্ততঃ ছত্রভঙ্গ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে যে যার প্রাণ বাচাতে তত্‍পর হল। স্বাধীন দেশে এরকম বর্বরতা থাকতে পারে এ কেউ ধারনা করতে পারে না। অনুমতি ভিন্ন ছাত্র প্রতিস্থানে ঢুকে বেপরোয়া গুলিবর্ষন ছাত্ররা কেন স্বাধীন দেশের কোন লোক কল্পনা করতে পারে না। পুলিশের বর্বর ক্ষুধা মিটবার পর তারা বেরিয়ে পড়ল। ভীত সন্ত্রস্ত ছাত্রগন হোষ্টেলের অভ্যন্তরে আশ্রয় নিয়েছিল। জানালা দিয়ে দেখা গেল প্রাংগনে দন্ডায়মান কোন প্রানী নেই। হোষ্টেলের প্রাংগনে ও বারান্দায় আহত ও নিহত ছাত্রগন ইতস্ততঃ পড়ে আছে। যে ছাত্রগন একদিন দেশকে স্বাধীন করার জন্য ইংরেজের বুলেটের সামনে পেতে দিয়েছিল নিজেদের কচি বুক। যাদের একনিষ্ঠ ত্যাগ ও আত্মহুতির বদলে হাসিল হয়েছে স্বপ্ন সাধের পাকিস্তান আজ তাদেরই তাজা উত্তপ্ত খুনে রাংগা হল পাকভূমি। যেদিন ব্রিটিশ এর বেয়োনেটের সামনে রুখে দাড়িয়েছিল ছাত্রসমাজ সেদিন কোথায় ছিল এই নাজিমুদ্দিন-নুরুল আমিন-আজিজুদ্দিন-কোরেশী-ফারুকীর দল? পাকিস্তান অর্জনের পিছে তাদের দান কতটুকু? অথচ বিরাট ট্র্যাজেডি হল এই যে তথাকথিত নাজিমুদ্দিন-নুরুল আমিনের জাতীয় সরকারই পাকিস্তানের তরুন মোজাহিদ দলকে এমনিভাবে রক্তাক্ত করে দিচ্ছে। অদৃষ্টের এমনি পরিহাস! ধন্য বাবা নাজিমুদ্দিন আর নুরুল আমিন! তোমাদের বেয়োনেট আর বুলেট দীর্ঘজীবি হোক!

উঃ মেডিকেল কলেজ হোষ্টেলের অবস্থা এত হৃদয় বিদারক যে পাষানের ও চোখ ফেটে জল পড়বে। আহতদের আর্ত চিত্‍কারে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে উঠল। হোষ্টেল প্রাংগনের অবস্থা তখন যুদ্ধশেষে যুদ্ধক্ষেত্রের অবস্থার সাথে তূলনীয়।

নিহতদের মধ্যে সর্বপ্রথম মনে পড়ে শহীদ সালাহউদ্দিনের কথা। বেচারা এমএ ক্লাশের মেধাবী ছাত্র। ২০ নং শেডের বারান্দায় ইজি চেয়ারে বসেছিল সে। পুলিশের নির্মম বুলেট তার খুলি উড়িয়ে নিয়ে গিয়েছে। সংগে সংগেই তার প্রানবায়ু নির্গত হয়।

২০ নং শেডের সামনে দাঁড়িয়ে ছিল বিশ্ববিদ্যালয়েরই এমএসএসি ক্লাশের ছাত্র আব্দুল জব্বার। পুলিশের গুলি তার পাজর ভেদ করে নিয়েছে। হাসপাতালে নেওয়ার সংগে সংগেই বেচারা পঞ্চত্ব প্রাপ্ত হয়।

শহীদ বরকত আলী। বিএ অনার্স ক্লাসের কৃতিছাত্র বরকত। রাজনীতির সে ধার ধারত না। তার এক বন্ধুর সংগে মেডিকেল কলেক হোষ্টেলে দেখা করতে এসে আটকা পড়ে যায়। মাত্র কদিন আগে সে বিয়ে করেছে; অর্থকষ্ট লাঘব করার জন্য। ১২ নং শেডের একটা রুমের দরজা খুলে প্রান বাচানোর তাগিদে প্রায় ঢুকে পড়েছিল। মাথাটা কোনরকমে ঢুকিয়েছিল রুমের ভেতরে, কিন্তু ঠিক সে মুহুর্তে বর্বর পুলিশের অগ্নিমাখা বুলেট তার ডান পাজর ভেদ করে যায়। বারান্দাতেই সে ঢলে পড়ে। হাসপাতালে নেয়ার একটু পরেই বেচারা শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে।

আহতদের মধ্যে ২২ জনের অবস্থা একেবারে গুরুতর। সকলকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হয়।

দেখলা ছাত্ররা তবুও দমেনি। পরিষদ ভবনের দিকে মুখ করে মাইক বসিয়ে তারা খুনি জালেম বিশ্বাসঘাতক নুরুল আমিনের কানে আকুল ফরিয়াদ জানাতে লাগল।…..১২ নং ফুলার হোষ্টেলের কাছে দাঁড়িয়ে শুনছিলাম বন্ধুদের কাছে সে রক্ত ঝরা দিনের বিভিন্ন ইতিহাস। মেডিকেল কলেজের মাইক হতে আকুল ফরিয়াদ কানে এসে বাজছে। সমস্ত পৃথিবী চোখের সামনে লাটিমের মত ঘুরতে লাগল।

হাদিসে উল্লেখ আছে – যদি কোন জাতিকে ধ্বংস করতে চাও তবে তার ভাষাকে ধ্বংস কর। আজকে এ ভাষার লড়াইতে যারা প্রান দিল এ জাতিকে বাচিয়ে রাখতে তারা জাতির নিকট শহীদ বলেই পরিগনিত হবে। মনে একেবারে খারাপ হয়ে গেল। College Exhibition আর হল না। কলেজের গেটই খোলা হয়নি। সামনের রাস্তার দিকে চেয়ে দেখলুম – পরিষদ ভবনের সামনের রাস্তায় পুলিশ ও মিলিটারী গিজ গিজ করছে। হাবভাব দেখে মনে হচ্ছে, রক্ততৃষ্মা তাদের এখনো মেটেনি।

আমাদের ফুলার হোষ্টেলের গেট হতে পরিষদ ভবনের গেট তীর্যকভাবে হাত পঞ্চাশেকের বেশী হবে না। আমার কলেজ বন্ধুরা টিনের চোংগ মুখে দিয়ে “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” “রক্তের বদলে রক্ত চাই” “লীগ মিনিষ্ট্রি ধ্বংস হোক” “খুনী-জালেম-শয়তান-বেঈমান-বিশ্বাসঘাতক নুরুল আমিনের পদত্যাগ চাই” “হারামজাদা নুরুল আমিনের ফাসী চাই” ইত্যাদী ধ্বণি করতে লাগল। Assembly হলের গেটের দিকে তাকিয়ে দেখলাম এমএলএ গন অনেকেই গেটে দাঁড়িয়ে এ করুন দৃশ্য দেখছে। মিসেস আনোয়ারা খাতুনকে হলের বাইরে অপেক্ষা করতে দেখা যায়।

আমাদের প্রিন্সিপালের বাড়ির গেট আর পরিষদ ভবনের গেট সামনাসামনি অবস্থিত। দুরত্ব গজ দশেকের বেশী হবে না। ছাত্রগন সেখানে দাড়িয়েই সরকার বিরোধী স্লোগান দিতে থাকেন। পুলিশ মিলিটারি কটমট দৃষ্টিতে চাইছে, যেন চিবিয়ে ফেলবে। S.P. নিজে এসে আমাদেরকে সাবধান করে দিয়ে গেলেন – যদি আমরা কোনরকম বিশৃংখলার সৃষ্টি করি বা ইট পাটকেল ছুড়ি তবে তারা গুলি চালাতে বাধ্য হবেন।… এদিকে হাসপাতাল হতে আহত দেশপ্রেমিকদের মৃত্যু সংবাদ আসতে লাগল। ছেলেরা এতে আরো উত্তেজিত হয়ে উঠল। মেডিকেলের হোষ্টেলের যে দিকটা Assembly হলের একেবারে কাছে সেখানে ছাত্রদের বিরাট জটলা। আকুল ফরিয়াদে তারা খোদার আরশ কাপিয়ে দিচ্ছে। মাইকের শব্দে আর কান্না যেন ফূটে বেরুচ্ছে। ইতোমধ্যে শহীদদের রক্ত মাখা জামা কাপড় আমাদের কাছে এসে পৌছালো। সে রক্ত মাখা জামাকাপড় লগির আগায় বেধে আমরা Assembly হলের দিকে বাড়িয়ে তাদের কীর্তি তাদেরকেই দেখাচ্ছিলাম। আর সংগে সংগে সরকার বিরোধী যতরকম ধ্বণি হতে পারে – যতরকম গালিগালাজ হতে পারে সবই চলল।

ইতোমধ্যে মেডিকেল হোষ্টেলের কোনটায় চার পাচ বা কাদুনে বোমা ছেড়ে ছাত্রদের ছত্রভংগ করে দেওয়া হয় কিন্তু পরমুহুর্তেই আবার সকলে জড়ো হয়। আমরা আমাদের মাঠের যে কোনটায় জড়ো হয়েছিলাম সেখানেও তিন চার বার কাদুনে বোমা ছোড়া হয়।…. Principal এর গেট থেকে আমরা শ্লোগান দিয়েই চলেছি। Assemblyর কাজে ব্যাঘাত ঘটতে লাগল। অবশেষে বেলা পাচটায় ভীষন tear gas নিক্ষেপ করে ছাত্রদের ছত্রভংগ করে দেওয়া হয়।

মাইক চলছে। মেডিকেল কলেজের মাইক আকুল ফরিয়াদ করে চলছে। Tear gas ছাত্র জনতাকে হঠাতে পারছে না- আবার এসে সকলে জটলা পাকায়। রাত আটটা নাগাদ মোট ১০ জন শহীদ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করল।

এমনি করে রক্তমাখা ২১ শে ফেব্রুয়ারী শেষ হয়ে গেল। আগামী দিনের প্রোগ্রাম বীর শহীদানদের পারলৌকিক কল্যানের জন্য মেডিকেল হোষ্টেলের প্রাংগনে জানাজা সমাপন করা এবং সেখান হতে শহীদ ভাইদের মৃতদেহ নিয়ে মিছিল সহকারে শহরের সর্বত্র পরিক্রম করা।

যে রক্তমাখা দিন আজ শেষ হয়ে গেল – যে শহীদ মাতৃভাষার জন্য রক্তলেখার স্বাক্ষর রেখে গেল, তাদের সে তারা রক্তে আমরা নতুন করে শপথ গ্রহন করলাম।

(চলবে)