কম্বল বিতরণের দিন সকাল সকাল উঠে রওনা দিলাম আমরা। এই দিকটায় যারা শীতবস্ত্র দিতে আসেন, তারা সবাই আশেপাশের রাস্তার ধারেই বিলিয়ে চলে যান, কারণ এতো লোড নিয়ে ভেতরে যাওয়াটা বেশ কষ্টকর। এই কারণে বান্দরবন ও তার আশেপাশের গ্রামের একজন একাধিক কম্বল পেলেও গভীর পাহাড়ে বসবাসকারীরা অসহায়ই থেকে যান। আমরা তাই ঠিক করলাম ভেতরে যাবো। বয়স কম, সুতরাং কষ্ট নামক পক্রিয়ার কথা মাথাতেও আসেনি আমাদের। এছাড়া তৈমু নামে যে এনজিওর সাথে যৌথভাবে কাজ করতে গিয়েছি, তার প্রধান গ্যাব্রিয়েল দাও আমাদের ভেতরে নিয়ে যেতে আগ্রহী। সকাল সাতটায় পিকআপে করে রওনা দিলাম, বান্দরবন থেকে চিম্বুক, নীলগিরি হয়ে থানচি যাবার পথ ধরে প্রায় পঞ্চাশ কিলোমিটার (+- হতে পারে কিছু) যাবার পর বলিপাড়ায় থামলাম আমরা। পিকআপ থেকে নেমেই কান ঝাঝা শুরু হয়ে গেছে- বোঝা গেলো বেশ উপরে উঠে এসেছি আমরা। বলি পাড়ার রাইফেলস ক্যাম্পের কর্মকর্তার থেকে পারমিশন নেওয়া শেষে বলিবাজারের বাজারের দিকে এগোলোম আমরা। সামনে হাঁটা পথ বেশ অনেকদূর, ঝিরি পার হতে হবে, ভাবলাম প্যাস্টিকের স্যাণ্ডাল কিনে ফেলি। পাহাড়ে সমতলের মানুষজনের থাকার কথা খুব শুনেছি, বলিপাড়ার মতো ভেতরে যেয়ে তার প্রমান পেলাম। সেখানকার বাজারের অনেক দোকানের দোকানদার বাঙালি। গ্যাব্রিয়েল দা’র সবাইকে ভালো করে চিনেন, তিনি প্রতিটা দোকানে যেয়ে যেয়ে আলাপ আলোচনা, হাসি তামাশা করছেন। এইসব দেখে আমি আরেকটা জিনিস বুঝলাম, ঢাকা থেকে পাহাড়ি-বাঙালি’র মধ্যে যে দা’কুমড়ো সম্পর্কের কথা আমরা শুনেছি সেটা পুরোভাগে সত্য নয়।

তারপর তৈমুর বিভিন্ন মানুষ, কেঁচোপাড়া (বলিপাড়া থেকে একঘণ্টা হাঁটা পথ) গ্রামের বসবাসকারী কয়েকজনের সাথে কথা বলে একটা জিনিস আমি বুঝতে পারলাম। বাঙালি- পাহাড়ি সমস্যা- বাক্যটির একটি ভিন্নমানে রয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক পাহাড়ি ছেলে পড়ে, কই তাদের সাথে তো বাঙালিরা মারামারি করেনা, আমাদের কলেজে দর্পন পড়তো, কই আমরা তো কেউ তাকে কোনওদিন নিজেদের একজন ছাড়া ভিন্ন কেউ ভাবিনাই (তার উদ্ভট উচ্চারণ নিয়ে তাকে টিজ করতাম অবশ্য, কিন্তু সেটা আমরা বরিশাইল্লাদের আরও বেশি করছি)। তাহলে পাহাড়ে গেলেই বাঙালিরা পাহাড়িদের শত্রু হয়ে যায় কেন? আসলে সবাই হয়না, দীর্ঘদিন ধরে সমতলের যারা পাহাড়ে এসে বসবাস করছে তারা আদোপান্ত পাহাড়িদের সাথেই মিশে গেছে। কিন্তু অল্পকয়েকজন (আসুন তাদের আমরা ভুমি দস্যু বলি এবং এরা বাঙালি) এই ইস্যুটাকে ব্যবহার করে। বেশিরভাগ সময়ই তারা পাহাড়ের নেটিভ নয়, হঠাৎ করে উদয় হয়। তারা পাহাড়িদের গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়, তাদের ঠেলে দেয় আরো গভীরে। হ্যাঁ, বসবাসকারী সব বাঙালিরা দুধে ধোঁয়া তুলসি পাতাও হয়তো না, কিন্তু আদোপান্ত সমতলের এই ইমিগ্রেণ্টের ঢালাও দোষ দেবার আগে একটু ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে।

এবার আসা যাক, সেনাবাহিনী প্রসংগ। সেনাবাহিনী নিজেও ভূমি দখলে জড়িত। নীলগিরি’র কথা আমরা সবাই জানি, সেখানে তারা বিশাল রিসোর্ট তৈরী করেছে, দশ মিনিটের জন্য হলেও গাড়ি পার্কিং চার্জ ২০০ টাকা। সকল জায়গা সরকারের, সেনবাহিনী সরকারের একটি অংশ সুতরাং পাহাড়ের জমি সেনাবাহিনীর নিজেরই জায়গা। তারা যেখানে ইচ্ছা থাকবেন, সেখানে ইচ্ছা যাকে ইচ্ছা তাড়াবেন, ক্যাম্প করবেন।” এই যুক্তি নিয়ে যারা তেড়ে আসার চেষ্টা করবেন, তাদের বলে দেই জ্বী, আমি জানি।

গ্যাব্রিয়েল দা ঐ এলাকার সন্তান। তার পাড়ার নাম, ত্রিপুরা পাড়া। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, বলিবাজার থেকে ভেতরের দিকে যাওয়ার জন্য তার নিজেরও নাম এণ্ট্রি করে যেতে হয়েছে, সন্ধ্যার আগে আগেই ফেরত চলে যেতে হবে নাম কাটিয়ে। এই ব্যবস্থায় তাকে বিশেষ রুষ্ট মনে হলোনা, যখন শুনলাম এই সেনাবাহিনী বিনাঅপরাধে তাকে দীর্ঘদিন আটকে রেখেছিল। পরে ড্যানিশ রাষ্ট্রদূতের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপে তিনি ছাড়া পান। শান্তিবাহিনি জুজুর কারণে তখন পাহাড়ে বসবাস কারীদের সপ্তাহে একবার বাজারে আসতে পারতো, বাজারের পরিমাণও আর্মি ঠিক করে করে দিতো, এর বেশি কিনলে তা জব্দ হতো।

পার্বত্য চট্টগ্রামে সরকার বলে কিছু আছে বলে আমার মনে হয়না। সেখানে সেনাবাহিনীই সরকার, সেখানে চলছে সেনাশাসন। এই সেনাবাহিনীইই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপরে উদিষ্ট ভুমি দখলদার বাঙালি সন্ত্রাসীদের পক্ষ অবলম্বন করে- এখানে উল্লেখ করতে চাই, এই মন্তব্যটি দ্বারা সমগ্র সেনাবাহিনী “ইন্সটিটিউশন” কে প্রশ্নবিদ্ধ করা হচ্ছেনা। তবে সেনাকর্মকর্তাদের অনেকেই যে প্রমোশনের লোভে নিরীহ পাহাড়িকে সন্ত্রাসী বানিয়ে অস্ত্র উদ্ধারের নাটক করেন তা নিয়ে ইন্সটিটিউশনের কেউ দ্বিমত করবেন বলে মনে হয়না। ননকমিশনডরাও বিভিন্নভাবে তাদের পোশাকের ক্ষমতা ব্যবহার করেন। ব্লগে দ্বিমত হতে পারে, কিন্তু ইনফরমাল আড্ডায় কেউ আজ পর্যন্ত করেনি। বুঝলাম, অনেক খারাপ কাজ তারা করেছে, কিন্তু ভালো কাজও কী করেনি? রাস্তা তৈরী করেনি, পাহাড়িদের অসুখ হলে সেবা করেনি? অবশ্যই করেছে, কিন্তু তাদের ভালো কাজগুলোকে এপ্রিসিয়েট করার চেয়ে আমি খারাপ কাজগুলো নিয়েইই কথা বলতে বেশি আগ্রহী। কারণ সেনাবাহিনী দুধের শিশু নয় যে, তাদের “বাবা খুব ভালো কাজ করেছ, আরও করো” বলে উৎসাহ দিতে হবে। তারা যা ভালো কাজ করেছেন, মানুষ হিসেবে সেটা করা তাদের দায়িত্ব ছিল।

অভিযোগ পালটা অভিযোগে লেখা জর্জরিত করে লাভ হয়না, মূল আলোচনা হওয়া উচিত সমাধান কী হওয়া উচিত না নিয়ে। আমাদের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী দেশের সবার পক্ষ থেকে সমাধান দিয়েছেন, “প্রয়োজনে পার্বত্য এলাকায় আরও সেনা মোতায়ন করা হবে”। তার (ত এর উপর ইচ্ছাকৃতভাবে ঁ দেওয়া হয়নি) নির্বুদ্ধিতা প্রসংশার দাবী রাখে। খবরে আরও সমাধান আসছে, বাঙালিদের পুর্নবার্সন করতে হবে, ইউএনডিপি নাকি এই প্রজেক্ট বাস্তবায়নের অর্থ প্রদান করতেও একপায়ে খাড়া। কিন্তু তাতে করেও কী সমতল থেকে উঠে আসা দীর্ঘদিন ধরে বসবাসকারী মানুষকে বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা হবেনা? এটাও কোনও ফল বয়ে আনবে বলে মনে হয়না।

আমার যা মনে হয়ঃ

১। পর্যায়ক্রমে শান্তিচুক্তির সঠিক বাস্তবায়ন করতে হবে।
২। অপহরণের নাটক বন্ধ করতে হবে। প্রমোশনের লোভ ছাড়াও আরও একটা কারণে অপহরণের নাটক মঞ্চায়িত হয়, সেটা হলো পার্বত্য এলাকায় বৈদেশিক ফাণ্ডিং, বৈদেশিক এনজিও এর অতিরিক্ত আগমন ঠ্যাকানো। তাতে লাভ? লাভটা খুব সোজা, যতো এনজিও আসবে, ততো পাহাড়িদের কর্মসংস্থান বাড়বে, ততো তারা স্বাবলম্বী হবে, পার্বত্য চট্টগ্রামে সেনাবাহিনীর হাত ততো দূর্বল হবে। সাধারণ চোখে এটাকে অবাস্তব এনালজি মনে হলেও, এটা এই কারণেই সত্যি যে, আমরা ইউটোপিয়ান সমাজে বাস করিনা, আমাদের সমাজের পলিটিক্স বড় রুঢ়।
৩। বর্ডার গার্ড ছাড়া, অপ্রয়োজনীয় (সত্যিকার অর্থেইইইই অপ্রয়োজনীয়, ভুং ভাং প্রয়োজন না) সকল ধরণের সেনা প্রত্যাহার করতে হবে (শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন হলে এটাও হবে)।
৪। পাহাড়িদের কর্ম সংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি করতে হবে।
৫। স্বাধীনতা পরবর্তী বঙ্গবন্ধু প্রণীত “তোরা সব বাঙালি হইয়া যা” এই তত্ত্ব বাতিল করতে হবে। পাহাড়িদের উপর বাংলার আগ্রাসন কমাতে হবে, তাদের মার্তৃভাষায় তাদের প্রাথমিক শিক্ষা পর্যন্ত পড়াশোনার ব্যবস্থা করতে হবে।
৬। “ডিভাইড এণ্ড রুল” এই মতবাদের সত্যতা প্রমাণের জন্য সরকারের সৃষ্টি ইউপিডিএফ এর কার্যক্রম বন্ধ করতে হবে। ইউপিডিএফ শান্তিচুক্তির বিরোধী, অর্থাৎ তারা জনসংহতি সমিতির বিরুদ্ধ পক্ষ। এই ইউপিডিএফকে খুব সম্ভবত ভাইয়ে ভাইয়ে মারামারি লাগিয়ে সেখানে একটা বিশৃংখলার আগুন জ্বালিয়ে রাখার জন্য সৃষ্টি করা হয়েছে।
৭। আদতে এতো মারামারি কাটাকাটির কথা শুনলেও, পাহাড়ে বসবাসকারী মানুষেরা মারাত্মক অসহায়, তাদের কাছে খেয়ে পরে বেঁচে থাকাটাই সবচেয়ে বড়। আমাদের সবার নিজ নিজ অবস্থানে থেকে তাদের সাহায্য করতে হবে। কীভাবে? আপনি ডাক্তার, যান সাতদিন একটু ঘুরে আসুন, তাদের সাথে কথা বলুন- আপনার হাজার টাকার ওষুধ দিতে হবেনা, আপনার মুখ থেকে সামান্য ভালো কথাই তাদের জন্য অনেক কিছু। তারা আমাদের ভাই এবং আজ পর্যন্ত বান্দরবনে ঘুরতে যাওয়া ব্যতিত সেই ভাইদের কথা আমরা ভাবিনাই, কিন্তু ভাবতে হবে।
৮। পাহাড়িরা খুব খারাপ, ছেড়ে দিলে একদিন তারা স্বাধীন বান্দরবন বা স্বাধীন রাঙামাটি ঘোষণা করে ফেলবে- এইটাইপ তত্ত্ব থেকে বের হয়ে আসতে হবে।

সর্বোপরি, সবগুলোই আমার ব্যক্তিগত মতামত। গতকয়েকদিন ধরে মানসিকভাবে খুব ডিস্টার্বড। এই লেখা তা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য। আমি খুব ভালো করেই জানি, ব্লগের পাতায় হাজার শব্দও চল্লিশমন ধান পুড়ে যাওয়া মানুষটির মুখে কোনোভাবেই হাসি ফোটাতে পারবে না যা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর আর্মি হয়তো পারবে।