আমাদের অনেকের মধ্যেই একটা ভুল ধারণা প্রচলিত আছে যে, ‘অনার কিলিং’ এর মত মানবতা বিরোধী জঘন্যতম অপরাধটি শুধুমাত্র সাউথ এশিয়ান অথবা মিডল-ইষ্টার্ণ দেশগুলির নিজস্ব সমস্যা । কিন্তু এই ধারণা পুরোপুরি সত্য নয় তা বলাই বাহুল্য । খোঁজ নিলে দেখা যাবে বিষয়টি কম-বেশী সারা পৃথিবীতেই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে ছিল এবং এখনো আছে । প্রায় প্রতিটা ধর্ম এবং সংস্কৃতিতেই এর প্রমাণ পাওয়া যায় । যা মূলতঃ এক ধরনের ট্রাইবাল প্রথা । কথায় কথায় ট্রাইব পতি-দের ইজ্জত আর মান সম্মান নিয়ে টানাটানি পড়ে যেত । বিভিন্ন ছোট-বড় গোত্রের মধ্যে এ প্রথা জেঁকে বসেছিল একসময় । আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের মুসলমানদের মত এত ব্যাপকহারে না হলেও এই প্রথা হিন্দু এবং শিখদের মধ্যেও বেশ ভালো মাত্রায়ই প্রচলিত আছে । সেই আদ্যিকাল থেকে এখনও পর্যন্ত দেখা যায় পরিবার, গোত্র অথবা গুষ্টি যাই বলি না কেন সবার ‘মান-সম্মান’ এর মত ভারবাহী বোঝাটি মেয়েদের কাঁধে ন্যস্ত করা হয়েছে । এর সামান্য এদিক সেদিক হলে নিজের জীবন দিয়ে হলেও পরিবারের মান-সম্মান ঊর্ধ্ব তুলে ধরতে অনেক মেয়েকে বাধ্য করা হয় ।

অন্যান্য উন্নত বিশ্বের দেশগুলি চিত্র এ ব্যাপারে ঠিক কেমন ততটা যদিও জানা নেই – কিন্তু ‘তথাকথিত’ অনারের নামে মেয়েরা আজও প্রাণ দিচ্ছে খোদ এই ব্রিটেনের মত দেশেও । এখানকার সামগ্রিক বিষয়টি চোখের সামনে ফুটে উঠলে সত্যি এক ভয়াবহ চিত্র পাওয়া যায় । যে কোন মানবিক বোধ-সম্পন্ন মানুষ এমন সংবাদে হতাশ হতে বাধ্য । হতাশার একটি বড় কারণ হল এ দেশের পুলিসের ভাষায় ‘সেন্সেটিভ’ এই ইস্যুটি অনেকাংশেই থেকে যায় চোখের আড়ালে । এখানে আইন কানুনের কঠোরতা থাকা সত্ত্বেও এই সব ক্রিমিনালরা বেশীর ভাগ সময় থাকে ধরা ছোঁয়ার বাইরে । ‘সেন্সেটিভ’ ইস্যু কারণ অনার কিলিংকে ধর্মীয় এবং নিজস্ব সংস্কৃতিজাত বলে রঙ ছড়িয়ে একে গ্লোরিফাই করার উৎকট চেষ্টা থাকে সব সময় । তাছাড়া এতে জড়িত থাকে ভিক্টিম এর নিজেরই পরিবারের লোকজন তথা, মা-বাবা, ভাই-বোন, চাচা-মামা-খালা ইত্যাদি নিকট সম্পর্কের মানুষেরা । যাদের বিরুদ্ধে সহজে কোন মেয়ে পুলিসের কাছে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিতে এগিয়ে আসে না । অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় পুলিস ‘কল’ করার পর ও মেয়েরা সব খুলে বলতে পারেনা । পিছিয়ে যায় ভয়ে অথবা সংকোচে । যে কারণে পুলিশের পক্ষেও সম্ভব হয় না সঠিকভাবে ঘটনার তদন্ত করা । অন্যদিকে অনেক মেয়ে আছে যারা নিজেরাই ঘটনার ভয়বহতা বুঝে উঠতে পারেনা । অথবা যখন বুঝতে সক্ষম হয়, তখন সময় গড়িয়ে গেছে তার আয়ত্ত্বের বাইরে । তাই পুলিশের কাছে সাহায্য চাওয়া অথবা পাওয়া কোনটাই আর হয়ে উঠেনা । তাছাড়া ক্রিমিনালরা তাদের অপরাধ ঢাকার জন্য হেন অপকৌশল নেই যা নেয় না । ক্ষেত্র বিশেষে এমনকি মেয়েদের আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হয় ।

রকমারি সংবাদ এর ফাঁক-ফোকর গলিয়ে সম্প্রতি একটা রায় ব্রিটেনের সংবাদ মাধ্যমে বেশ খানিকটা স্থান দখল করে নিয়েছিল । আজকাল ‘খবর এমনি ডাল-ভাত হয়েছে – যত ভয়াবহই হোক মানুষ আর তেমন গা করেনা । দুদিনের বেশী তিন দিন মনে রাখতে পারেনা অনেকেই । জীবনটাই চলছে অদ্ভুত এক ঘোড়দৌড়ের উপর । একটা রায়কে কেন্দ্র করে আমাদের কারো কারো ঘোড়দৌড়ের এ জীবনে খানিকটা হলেও রেখাপাত করেছে । কিছুটা হলেও চিন্তিত করেছে, ভাবিয়েছে কিছু মানুষকে । বিষয়ের অন্ধকার দিক এবং এর ভয়াবহতা কিছুটা হলেও টের পাওয়া গেছে । ইতোমধ্যে অনেকেই উচ্চারণ করেছেন ব্রিটেনে অনার কিলিং বিষয়টি আসলেই নতুন এবং বিচ্ছিন্ন কিছু নয় । অনেক আগে থেকেই এটি ঘটে আসছে । যদিও ঘটছে খুবই গোপনে । কিন্তু গোপনে হচ্ছে বলেই, সব সাফ-সুতরো – তা আর দাবি করা যাচ্ছে না । সংবাদে প্রকাশ ব্রিটেনের ওল্ড বেইলী আদালত মেহমুট গোরান নামের এক টার্কিশ পিতাকে বাইশ বছরের যাবজ্জীবন জেলদন্ড দিয়েছে নিজ মেয়েকে হত্যার দায়ে ।

জানা যায় ঘটনার সূত্রপাত আজ থেকে প্রায় দশ বছর আগে । তুলে গোরান নামের মাত্র পনেরো বছরের উচ্ছল এক কিশোরী একদম আচমকাই একদিন হারিয়ে যায় । পরিবারের কেউ এমনকি তার কোন নিকট বন্ধু-বান্ধব ও হদিস করতে পারেনা মেয়েটি কোথায় । তন্ন তন্ন করে খুঁজাখুঁজি চলে, কিন্তু কেউ কিচ্ছু বলতে পারেনি – একেবারে লাপাত্তা যাকে বলে আর কি । সালটা ছিল ১৯৯৯। যখন সে হারিয়ে যায় তখন তার সাথে মেয়েটির থেকে পনেরো বছরের বড় এক ফ্যাক্টরি ওয়ার্কার হালিল উনাল নামের এক ভদ্রলোকের সম্পর্ক ছিল । যা তুলের পরিবার, বিশেষ করে তার পিতা মিঃ মেহমুট কিছুতেই মেনে নিতে রাজী ছিলেন না । এই রাজী না হওয়ার পেছনে কারণ ছিল, মেয়ের সাথে তার বয়ফ্রেন্ডের বয়সের পার্থক্য, আর সবচেয়ে বড় বাঁধাটি ছিল দুজনের পারিবারিক এবং ধর্মীয় ব্যাকগ্রাউন্ড । তুলে গোরান এবং হালিল উনালের পারিবারিক ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে যা জানা যায়, তা হল – দুই পরিবারই ব্রিটেনে বসবাস করতে আসে টার্কি থেকে । টার্কির যে দুটি জায়গা থেকে ওরা এসেছিল সে জায়গার দূরত্ব ছিল মাত্র ষাট মাইলের মত । কিন্তু জায়গার দূরত্ব যাই হোক না কেন, তাদের মধ্যে মানসিক দূরত্ব ছিল অনতিক্রমণীয় । দুই পরিবারই নিজেদের মুসলমান দাবি করলেও, তাদের মধ্যে ধর্মীয় বৈরিতা চলে আসছিল যুগ যুগ ধরে । তারা কেউ কাউকে প্রকৃত মুসলমান বলে স্বীকার করত না । সঙ্গত কারণেই দুই গোত্রের ছেলে মেয়েদের মধ্যে সম্পর্ক বা বিয়ে শাদি মেনে নেওয়ার মত মন-মানসিকতা কখনই গড়ে উঠেনি । মিঃ উনাল সুন্নি মুসলমান হলেও তুলের পরিবার মুসলমান দের মধ্যে ক্ষুদ্র একটি শাখা Alevi গোত্র-ভুক্ত । যেমন আগেই উল্লেখ করেছি, ওদের দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিয়ে-শাদী ছিল প্রায় নিষিদ্ধ এবং অত্যন্ত গর্হিত অন্যায় । তুলে গোরানের পিতা মিঃ মেহমুট তাই ব্যাপারটাকে সেই তথাকথিত ‘ইজ্জত কা সওয়াল’ হিসেবে ধরে নিয়ে মাঠে নামেন ।

সম্প্রতি কোর্টে দাঁড়িয়ে, দশ – দশটা বছর পর এই প্রথমবারের মত তুলের পিতা নিজ মেয়ে হত্যার কথা স্বীকার করেন । বিস্তারিত বর্ণনা দেন নিজের এবং পরিবারের মান-সম্মান বজায় রাখার স্বার্থে তিনি মেয়েকে হত্যা করেছেন – সম্পূর্ণ ঘটনার বিবরণ দেন অত্যন্ত নির্বিকার চিত্তে, সামান্যতম অনুশোচনা ছাড়া । সারা জীবন স্বামীর ভয়ে ভীত-সন্ত্রস্ত তুলের মা নীরবে চোখ মুছেছেন, সন্দেহ পোষণ করেছেন কন্যার নিরুদ্দেশ হওয়ার পেছনে জড়িত স্বামীকে- তবু চুপ করে থাকতে বাধ্য হয়েছেন । কিন্তু সেদিন কাঠগড়ার অপর পাশে দাঁড়িয়ে তিনি সকল ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে স্বামীর উদ্দেশ্যে চিৎকার করে জানতে চেয়েছেন, তাঁর মেয়ের অন্তর্ধান রহস্য ! ব্যক্ত করেছেন প্রথম থেকে তার সন্দেহ আর অবিশ্বাস এর এক করুণ কাহিনী । তুলের ২৮ বছর বয়সী বড় বোন পিতার কাছে আকুল আকুতি জানিয়ে জানতে চেয়েছেন একটাই কথা, ‘ আমাদের অন্তত এটুকু জানাতে দাও, কোথায় আমার বোনকে কবর দিয়েছ, আমি শুধু তার শেষ ঠিকানা টুকু জানতে চাই তোমার কাছে’ !

কিন্তু আশ্চর্য্যের ব্যাপার ! এতোকিছুর পরও মিঃ মেহমুট গোরান মুখ তো খুলেনইনি এমনকি নিজের আচরণে অনুতপ্ত হওয়ার মত কোন লক্ষণ পর্যন্ত দেখান-নি । এখানে উল্লেখ্য, সন্দেহ করা হচ্ছে তুলেকে হত্যা করে প্রথমে নিজেদের বাড়ির পিছনের ছোট্ট বাগানে পুঁতে রাখা হয়েছিল-পরে সুযোগ মত সরিয়ে ফেলা হয়েছে । শুধু তুলে গোরান-ই নয় আরো অনেক মেয়েই এভাবে জীবন দিচ্ছে অথবা এদেশ থেকে পাচার হয়ে যাচ্ছে, নয়তো আত্মহত্যা করছে অথবা পরিবার থেকে পালিয়ে থেকে নিজের জীবন রক্ষা করছে । ‘ইজ্জত-সম্মান’ খোয়াতে অনেক অভিভাবক রাজী নয় । দরকার হলে মেয়ের জীবন শেষ করে ফেলতে হবে – তবু ‘মান-সম্মান’ নষ্ট হতে দেওয়া যাবে না কিছুতেই !

এদেশে জন্ম, বড় হওয়া বাংলাদেশী বাবা-মায়ের একটি মেয়ে, ধরা যাক মেয়েটির নাম রাজিয়া, সে মাত্র সতেরো বছর বয়সে ‘এবিউসিভ’ বিবাহিত জীবন সাহস করে ছিন্ন করতে সক্ষম হয়েছিল বটে – কিন্তু ব্যাপারটা তার জন্য সহজ ছিল না মোটেই । কারণ মেয়েটির নিজের-ই পরিবার ছিল সেক্ষেত্রে একেবারেই বৈরী । অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, বিষয়টির সুরাহা করার জন্য পারিবারিক মীটিং বসে – রাজিয়াকে হত্যা করা হবে নাকি আত্মহত্যা করতে বাধ্য করা হবে ! অবশেষে মেয়েটির মা সিদ্ধান্ত নেন হত্যা নয় – মেয়েকে আত্মহত্যা করতে বাধ্য করে পরিবারের ‘মান ইজ্জত’ রক্ষা করতে হবে ! রাজিয়া আরেক আত্মীয়ের মাধ্যমে পারিবারিক সিদ্ধান্ত জানতে পেরে ঘর থেকে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয় । পালিয়ে হয়ত মেয়েটি আপাতত বেঁচে যায়, কিন্তু বহুদূরে অন্য এক শহরে গিয়েও তাকে আপাদ-মস্তক বোরকা আবৃত হয়ে চলাফেরা করতে হয় – মেয়েটি আজ প্রচণ্ড নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে । সে জানে তার আত্মীয়-স্বজন, পরিবার তাকে ধরার জন্য তক্ষে তক্ষে আছে । এসব-ই জানায় বৃটেনের সানডে অবজারভারের এক সাংবাদিকের কাছে । বলে, ‘আমি প্রাণে হয়ত বেঁচে আছি, কিন্তু ভীতি আমাকে ছেড়ে যায়নি, আমি যখনই কোন পাব্লিক প্লেসে থাকি, নিজের অজান্তেই বার বার নিজের চারদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখি – আসলে আমাদের সমাজে ‘বাউন্টি হান্টার’ দের অভাব নেই । সত্যি-ই নেই !

কত সব তুচ্ছ কারণে যে মেয়েরা অনার কিলিং এর শিকার হয় তা ভাবতে অবাক লাগে । এখানে কয়েকটি উদাহরণ দেখা যেতে পারে । ওয়েষ্ট লন্ডনে বসবাসরত, কূর্দিস ওরিজিন, মাত্র ষোল বছর বয়সী হেশু উনেস কে এগারো বার কুপিয়ে গলা কেটে হত্যা করে তার-ই পিতা আব্দেল্লা উনেস । কারণ হিসেবে বলা হয় হেশুর পিতা আব্দেল্লার কূর্দিস বন্ধুদের কেউ কেউ মনে করেন হেশুর ‘বয়ফ্রেন্ড’ আছে ! বিচারে ২০০৩ সালে আব্দেল্লার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় । ১৯ বছর বয়সী আরেক কূর্দিস বানাজ মাহমদ, যে পরিবারের সাথে সারেতে বসবাস করত, মৃত্যুর আগে পাঁচ পাঁচবার পুলিসকে ফোন করে – তাকে হত্যা করা হতে পারে বলে তার আশংকা কথা জানায় – কিন্তু যতবার পুলিস আসে সে নীরব থাকে, ভয়ে মুখ খোলে না । সেই মেয়ের পরিণতি হয় ভীষণ মর্মান্তিক । তারই পরিবার তাকে ‘অনারের’ নামে নির্মমভাবে হত্যা করে । সালটি ছিল ২০০৬ । অন্য আরেকটি মেয়েকে হত্যার কারণ সঠিক ভাবে জানা না গেলেও – সন্দেহ করা হয়, কোন এক কমিউনিটি রেডিওতে মেয়েটিকে উৎসর্গ করে একটি গান বাজানো হয়েছিল ! কি বিচিত্র সব কারণ ! মেয়েদের জীবন এখনও কত তুচ্ছ ! কি অকিঙ্চিৎকর ! কত সব তুচ্ছ কারণে যে অনার কিলিং এর মত ঘটনা ঘটে থাকে তা ভাবতেও অবাক লাগে । তাও ব্রিটেনের মতো দেশে !

অনার কিলিং এর কারণ সমূহে এমন সব বিষয় ও অনেক সময় থাকে যা ভাবলে এর সাথে জড়িত মানুষগুলোর মস্তিষ্কের সুস্থতা নিয়ে অনায়াসে প্রশ্ন তোলা যায় । এখানে কিছু কারণ উল্লেখ করা যাক । যেমন, সাজগোজ করা, ওয়েষ্টার্ণ ড্রেস পরা, এমনকি ছেলেদের সাথে কথা বলার মতো নিরীহ বিষয়-আশয় ও আছে । তাছাড়া অন্যান্য যে কারণ সমূহ-কে সর্বতোভাবে চিহ্নিত করা হয়েছে সেগুলো হল-জোর-পূর্বক বিয়েতে অসম্মতি জ্ঞাপন, এডাল্ট্রি, অথবা এমন কোন সম্পর্ক এ জড়িয়ে পড়া যা পরিবারের ‘তথাকথিত’ সম্মানহানির কারণ ঘটায় ।

আমাদের ভারতীয় উপমহাদেশের পিতা-মাতার ‘রোগ’ হল জোর-পূর্বক মেয়েকে বিয়ে দেওয়া । মেয়ে মেনে নিলে তো কথাই নেই । ল্যাঠা চুকে-বুকে গেল । আর যদি না মানে অথবা মেনে নেওয়ার পর নিজের জীবন বিপন্ন বোধ করে সম্পর্ক ছিন্ন করতে চায় তখনই বাধে সব গোল ! এ ক্ষেত্রে কি ভারতীয়, কি বাংলাদেশী আর কি পাকিস্থানী – কম বেশী সবার অবস্থা-ই এক এবং অভিন্ন ।

ভারতীয় বংশদ্ভোত জাসভিন্দর সাঙ্গেরা ২০০৮ সালের এপ্রিল মাসে একটি চ্যারিটি হেল্প লাইন প্রতিষ্ঠা করেন ডার্বিতে । উদ্দেশ্য অসহায় মেয়েদের সহায়তায় এগিয়ে আসা । সে প্রতিষ্ঠানটির নাম হচ্ছে, Karma Nirvana . জাসভিন্দারের নিজেরই বোন রবিনা ভালোবাসাহীন বিবাহিত জীবন থেকে মুক্তি পেতে আত্মহত্যা করেন । যিনি ছিলেন ‘জোর-পূর্বক’ বিয়ের শিকার । জাসভিন্দারের পরিণতিও একই হতে পারত – তিনি নিজেও একই ভাবে বিয়ে করতে বাধ্য হন –কিন্তু বোনের সাথে তার পার্থক্য হল, তিনি শেষ পর্যন্ত পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং নিজের জীবন নিজেই যাপন করার দৃঢ় সংকল্প নেন । সেই সাথে যে গুরুত্ব-পূর্ণ সাহসী ভূমিকা তিনি পালন করেন, তা হচ্ছে তারই মত অসহায় মেয়েদের সাহায্যে এগিয়ে আসা । ২০০৮ সালে যখন তিনি হেল্প-লাইন প্রতিষ্ঠা করেন, প্রথম বছরেই প্রায় ৪,০০০ হাজার কল রিসিভ করেন । তারপর থেকে গড়ে প্রতিমাসে প্রায় তিন শত কল পেয়ে থাকেন । সবার একই আর্তি, ‘সাহায্য চাই’ ! এসব কলের বেশীর ভাগেরই প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘জোর-পূর্বক’ বিয়েকে কেন্দ্র করে । জাসভিন্দরের অভিমত, মাত্র ৩% মেয়ে শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেলেও বাকী জীবন তাদের এক ধরনের ভয়-ভীতি মধ্যেই কাটাতে হয় । তাছাড়া এইসব মেয়েদের সাথে শুধু তাদের পরিবার-ই সম্পর্ক ছিন্ন করেনা, তাদের নিজস্ব কমিউনিটির লোকজন এমনকি তাদের বন্ধু-বান্ধবরাও ক্ষেত্র বিশেষে তাদের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করে ফেলে ।

পুলিস এর একটি রিপোর্ট অনুযায়ী, বৃটেনে প্রতি বছর গড়ে প্রায় বারোটির মত ‘অনার কিলিং’ এর ঘটনা ঘটে থাকে । ‘ডমেষ্টিক ভায়োলেন্সের’ শিকার মেয়েদের সংখ্যা তার চেয়ে হাজারো গুন বেশী তা বলাই বাহুল্য । তাছাড়া পুলিসের কাছে কখনই রিপোর্ট হয়না সে সংখ্যাটা যে নেহায়েত ফেলনা নয়, তা আমাদের সাধারণ মগজেই বুঝতে পারি । আরো যে সংবাদটি অত্যন্ত ভয়াবহ তা হল বহু ভিক্টিমকে ব্রিটেনের বাইরে নিয়ে যাওয়া হয় । যেখানে আইন আদালত সহ প্রায় সব ধরনের সাহায্য-সহযোগিতা হাত থাকে মেয়েদের নাগালের একেবারেই বাইরে । আর এসব কিছুই ঘটে থাকে দীর্ঘ প্ল্যান অনুযায়ী, কাক-পক্ষীরও অজানায় । যাতে মেয়েটি কোনভাবেই যাবার আগে বেঁকে না বসতে পারে । এদের কি হয় শেষ পর্যন্ত কে তার হিসেব রাখে । আমাদের উপমহাদেশীয় মেয়েদের ব্যাপারে বলা হয়েছে ১৬ থেকে ২৪ বছর বয়সী মেয়েরা ব্রিটেনের জাতীয় গড় হিসেবের তুলনায় তিন গুন বেশী আত্মহত্যা ঘটিয়ে থাকে- অনুসন্ধানে যার কারণ অনেকটাই অজানা থেকে যায় । যেহেতু প্রকৃত কারণ উদঘাটনে পরিবারের তরফ থেকে তেমন সাহায্য- সহযোগিতা হাত প্রসারিত করা হয়না । ধারণা করতে কষ্ট হবার কথা নয় যে এসব ‘তথাকথিত’ আত্মহত্যার পিছনে পরিবারের ভূমিকা কি হতে পারে !

পুলিসের রিপোর্ট অনুযায়ী অনার বেজইড ক্রাইম অনেকটা ‘কম্পলিকেটেড এবং সেন্সেটিভ’ ইস্যু হওয়াতে এখানকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে বেশ বিপাকে পড়ে – যেমন, স্বাভাবিক ভাবেই অনেক মেয়ে প্রাথমিক রিপোর্ট করেও পরে সাক্ষ্য-প্রমাণ দিতে গিয়ে পিছিয়ে যায় নানা ধরনের ভয়ে অথবা সংকোচে । নিজের পরিবার,বাবা-মা,ভাই-বোন, চাচা-মামা বা পরিবারের অন্যান্য নিকট আত্মীয়দের বিরুদ্ধে যাওয়া তার পক্ষে সব সময় সম্ভব হয়না । মেয়েটি জানে যে মুহূর্ত সে আইনের দ্বারস্থ হবে ওই মুহূর্ত থেকেই সে সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে । তাকে একা এবং সম্পূর্ণ একাই লড়তে হবে । কারো কারো পক্ষে নিজের বাড়ি-ঘর পরিবার-পরিজন ছেড়ে বেড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ ঘটলেও – সে সারাক্ষণ ভয়ে ভয়ে থাকে ধরা পড়ে যাওয়ার । কারণ, অবধারিত ভাবেই তাকে পরিবার এবং নিকট আত্মীয় – স্বজন রা হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়ায় । এইসব মানসিক পীড়ন অনেকেই শেষ পর্যন্ত সহ্য করতে পারেনা, অথবা পারবে না ভেবেই এক পা এগিয়ে গেলেও শেষমেষ তিন পা পিছিয়ে যায় । যদিও পুলিসের কাছে সঠিক প্রমাণ নেই কতজন ভিক্টিম নীরবে এসব ভায়োলেন্স সহ্য করে চলেছে কিন্তু একটি উদাহরণ পুলিসের রিপোর্ট থেকেই আমরা দেখতে পারি । গত বছর ২০০৮ এপ্রিল থেকে -২০০৯ এপ্রিল পর্যন্ত সর্বমোট ১৩২ টি রিপোর্ট করা হয়েছে – যেগুলো, জোর-পূর্বক বিয়ে দেওয়া এবং ‘অনার বেইজড’ ভায়োলেন্সের অন্তর্ভুক্ত । আবার এপ্রিল এর পর থেকে ২০০৯ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত রিপোর্ট করা হয়েছে ১২৯ টি । তার মানে দেখা যাচ্ছে এই অপরাধ সময়ের সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে ।

আরেকটা তথ্য, যা উল্লেখ করা প্রয়োজন বোধ করছি, এক রিপোর্টে বলা হয়েছে এই প্রবণতা যতটা না নতুন মাইগ্রেট হওয়া লোকজনের মধ্যে-তার চেয়ে বহুলাংশে বেশী তৃতীয় অথবা চতুর্থ প্রজন্মের পরিবার গুলোর মধ্যে । কারণ বোধ হয় এই – তাদের ফেলে আসা পিতৃপূরুষের দেশ যে আর একই জায়গায় অবস্থান করে নেই, এই সত্যটা তাদের জানা নেই অথবা জানলেও তারা ঠিক মেনে নিতে অভ্যস্ত না- যে জীবন কয়েক শতাব্দী আগে তারা পিছনে ফেলে এসেছে, ঠিক ওই জায়গাটাতেই তাদের মন-মানসিকতা এক অদ্ভুত উপায়ে আট্কে আছে । এরা সব অর্থেই নিজেদের উত্তরাধিকারী শিকড়হীন এক ভাসমান প্রজন্মে পরিণত করে থাকে নিজেদের অজান্তেই । যারা আসলে কোনদিকেরই ভালো কিছু গ্রহণ করতে শেখেনা শেষ পর্যন্ত । এরা অস্তিত্ব রক্ষার টানা-পোড়েনে সর্বিদাই খাবি খাওয়া অদ্ভুত এক প্রজন্ম ।

পরিশেষে একটাই বলার, ‘পরিবার’ হচ্ছে একজন মানুষের সবচেয়ে বড় নিরাপদ আশ্রয় – সেই পরিবার, মা বাবা, ভাই বোন যদি তথাকথিত অনার কিলিং এর নামে একটি মেয়েকে নির্মমভাবে হত্যা করে অথবা করতে উদ্যত হয়, শারিরীক-মানসিক নির্যাতন চালায়, তাহলে একটা মেয়ের কাছে তার পৃথীবিটা কি রকম হতে পারে ভাবতেও শিউরে উঠি ! কিন্তু সত্যি হল নারীদের অনেক-কেই এই সব ঘটনার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় ! সব কালে, প্রায় সব দেশেই দেখা যায় কি ধর্ম, কি সংস্কৃতি সবেতেই প্রাধান্য পেয়ে আসছে ‘নারীর চাল-চলন’ বিষয়টি । আমি নিজে কোন সমাজ-বিজ্ঞানী নই, সামান্য একজন ‘পর্যবেক্ষক’ মাত্র এবং ক্ষেত্র বিশেষে কিছুটা ভুক্তভোগীও বটে । বৃটেনে বাঙ্গালী সমাজের অদ্ভুত ল্যাজেগোবরে অবস্থা দুর্ভাগ্যজনক ভাবে প্রত্যক্ষ করে আসছি দীর্ঘদিন ধরে । নারীর চাল-চলন, তার প্রতিদিনের জীবন যাপন হওয়া চাই নিখুঁত, যাতে পরিবারের জন্য সামান্যতম অসম্মান সে বয়ে না আনে । বিষয়টি কতটা গভীর পর্যায়ের ‘মানসিক অসুখ’ তা বুঝতে পারার মত ক্ষমতাও তাদের অনেকের মধ্যে নেই । কত তুচ্ছ আপাত নিরীহ বিষয়ের বলী হয় মেয়েরা, ক্ষেত্র-বিশেষে জীবন পর্যন্ত দিতে হয় তা ভাববার বিষয় বইকি । তবু আশার কথা হল, আগের চেয়ে বহুক্ষত্রেই মেয়েরা জগদ্দল পাথর সরিয়ে কিছুটা হলেও নীরবতা ভেঙ্গে পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধেও সাক্ষ্য-প্রমাণ দিতে আদালতে এগিয়ে আসছে । পুলিসও এখন আর আগের মত ‘কালচারাল সেন্সিটিভিটির’ নামে ইস্যুটি একপাশে সরিয়ে রাখছেনা । দেরীতে হলেও এই জ্বলন্ত ইস্যুর ভয়াবহতা এবং এর লক্ষণগুলো চিনতে এখন তাদের আগের মত বেগ পেতে হচ্ছে না ।

আরেকটি কথা না বললেই নয় – এই দেশের বাংলাদেশী সংবাদ মাধ্যমে খুব কমই এসব বিষয় উঠে আসে। ঘটনার হয়ত রসাল বর্ণনা উঠে আসে মাঝে সাঝে, ব্যাস, এ টুকুই । হয়তবা তার প্রধাণ কারণ এ দেশের সংবাদ কর্মীদের উপর কমিউনিটি থেকে এক ধরনের চাপ অনুভূত হওয়া অথবা তারা নিজেরাই এইসব সংবাদ প্রচারের বিষয়ে তেমন আগ্রহী নয় ।
সবশেষে লেখাটি শেষ করছি, তুলে গোরান হত্যার রায় দিতে গিয়ে বিচারকের বলা একটি কথার উদ্ধৃতি দিয়ে;

“There is nothing honourable about such a hideous practice or the people who carry it out”

কিন্তু আমাদের চির বধির কর্ণে একথার মর্ম আদৌ কখনও ঢুকবে কি না কে জানে !

তথ্যসুত্রঃ গার্ডিয়ান, সানডে অবজারভার ও বিবিসি ।