জেলখানার কবি

 

যখন আকাশে একটি একটি করে তারা ফুটে ওঠে,

নিশ্চয়ই কেউ না কেউ কোথাও,

সেই তারাগুলোর জন্যে অপেক্ষা করে, কেউ যে চায়

আরও একটু উজ্জ্বল হয়ে ফুটুক ওই তারাগুলো,

কেউ যে বলতে চায় মণিখণ্ড, ঝিকমিক করছে-

 

                                           ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কি 

 

 

বাম আদর্শের প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন বাংলাদেশে এমন কোন লোককে খুঁজে পাওয়া যাবে না যিনি তুরস্কের কবি নাজিম হিকমতের কবিতা পড়েননি বা শোনেননি। বিপ্লবী কবিতা লিখে দেশে দেশে যারা গণমানুষের হৃদয়ে স্থায়ী আসন করে নিয়েছেন, নাজিম হিকমত তাদের মধ্যে অন্যতম। জেলখানার কবি তিনি। সারাটা জীবন তিনি সাধারণ মানুষের জন্য লড়েছেন, জ্বালাময়ী সব কবিতা লিখেছেন, আন্দোলন করেছেন। মানুষের অধিকার আদায় আর শ্রেণী-বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে জীবনের বেশিরভাগ সময় তাঁকে কাটাতে হয়েছে জেলে।

 

nazim_hikmet

 

নাজিম হিকমত শুধু তুরস্কের কবি নন। তিনি পৃথিবীর কবি, সমস্ত শোষিত, বঞ্চিত মানুষের কবি। তার কবিতা অনূদিত হয়েছে পৃথিবীর নানান দেশে, নানান ভাষায়। বাংলা ভাষাও ব্যতিক্রম নয়। বাংলাদেশে নাজিম হিকমতের জনপ্রিয়তা ঈর্ষণীয়। কবিতা ভক্তদের অসম্ভব প্রিয় তিনি। তাঁর জেলখানার চিঠি কবিতাটিতো মনে হয় অনেক কবিতাপ্রেমীরই মুখস্ত। প্রায় সব আবৃত্তিকারই তাঁর কবিতা আবৃত্তি করার জন্য রীতিমত মুখিয়ে থাকেন।

 

বাংলাতে নাজিমের শ্রেষ্ঠ কিছু কবিতার অনুবাদ করেছেন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায়। সাহিত্যের যে কোন শাখার অনুবাদই অসম্ভব রকমের দুরুহ এক কাজ। এক ভাষায় যে জিনিষ অসম্ভব আকর্ষণীয়, কুড়কুড়ে বা মুড়মুড়ে, অন্য ভাষায় রূপান্তরের পরেই তা প্রায়শই হয়ে পড়ে একেবারে ম্যাড়মেড়ে পানসে ধরনের। সাহিত্যের অন্য যে কোন শাখার চেয়ে কবিতার ক্ষেত্রে এই অবনমন হয় সবচেয়ে বেশি। অনুবাদ দিয়ে আসল কবিতার আসল রূপরস ছন্দের সামান্য একটু অংশই পাওয়া যেতে পারে মাত্র। তার বেশি আশা করাটা একেবারে বাতুলতা মাত্র। বিভিন্ন লোকজনের করা হিকমতের কবিতার ইংরেজী অনুবাদ পড়ে দেখেছি। বড়ই বিবর্ণ সেগুলো। সেই তুলনায় নাজিমের কবিতা অনুবাদের ক্ষেত্রে সুভাষ মুখোপাধ্যায় সকল আশা প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে গিয়েছেন। নিজে বাংলা ভাষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ একজন কবি হবার কারণে তার অনুবাদ, অনুবাদের নিরস জলো জলো পর্যায় ছাড়িয়ে মৌলিক কবিতার অসামান্য শৈল্পিক স্বাদ, গন্ধ, বর্ণ নিয়ে পাঠকের সামনে উপস্থাপিত হয়েছে। এরকম উত্তুঙ্গ মানের অনুবাদ করতে শুধুমাত্র একজন শ্রেষ্ঠ কবিই পারেন আরেকজন শ্রেষ্ঠ কবির কবিতার ক্ষেত্রে। আশ্চর্য হতে হয় যখন কবি সুভাষ মুখোপাধ্যায় বলেন যে, নাজিমের কবিতা দিয়েই শুরু হয়েছিল আমার কবিতার অনুবাদের হাতে খড়ি

 

 

১৯০২ সালে তুরস্কের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে নাজিম হিকমতের জন্ম। অল্প বয়স থেকেই কবিতার দিকে  ঝুঁকে পড়েন। মাত্র সতের বছর বয়সে তাঁর লেখা কবিতা প্রকাশিত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে মিত্রবাহিনী অধ্যুষিত তুরস্ক ছেড়ে মস্কো চলে যান তিনি। এ সময়ে রুশ কবি ভ্লাদিমির মায়াকোভস্কির সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠে। হিকমত কমিউনিস্ট পার্টির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। তার কবিতা আরো জোরালো ও প্রতিবাদী হয়ে উঠে। ১৯২৪ সালে তুরস্কের স্বাধীনতার পর তিনি ফিরে আসেন। একটি বামপন্থী পত্রিকায় কাজ করার অপরাধে তিনি গ্রেপ্তার হন। কিন্তু হিকমত মস্কোয় পালিয়ে যেতে সক্ষম হন এবং সেখানে কবিতা এবং নাটক লিখতে থাকেন। ১৯২৮ সালের এক সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার কারণে দেশে ফিরে আসতে সক্ষম হন। কম্যুনিষ্ট পার্টি ততদিনে নিষিদ্ধ ঘোষিত হয়ে গিয়েছে। সারাক্ষণই সাদা পোশাকের পুলিশের লোকজন তাকে নজরদারিতে রাখতো। পরের দশ বছরের পাঁচ বছরই তিনি নানান ধরনের বিচিত্র সব হাস্যকর অপরাধের অভিযোগে জেলখানায় কাটান। কিন্তু এই দশ বছরেই তিনি সুদীর্ঘ কবিতাসমৃদ্ধ চারটি বইসহ সর্বমোট নয়টি কবিতার বই প্রকাশ করেন। এই সমস্ত কবিতা তুরস্কের কবিতায় বিপ্লব সাধিত করে। তুরস্কের প্রধানতম কবি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যান তিনি।

 

১৯৩৮ সালে তুরস্কের সামরিকবাহিনীকে বিপ্লবে উস্কানী দেবার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয় তাকে। তার অপরাধ ছিল তার দীর্ঘ কবিতাগুলো মিলিটারী ক্যাডেটরা পড়ছে এবং এতে করে তাদের মধ্যে বিপ্লবী চেতনা জন্ম নিচ্ছে। ২৮ বছরের জেল সাজা দেয়া হয় তাকে।

 

১৯৪৯ সালে পাবলো নেরুদা, পল রবসন এবং জ্যা পল সার্ত্রে প্যারিসে একটি আন্তর্জাতিক কমিটি গঠন করেন। উদ্দেশ্য ছিল হিকমতের মুক্তির জন্য আন্দোলন গড়ে তোলা। ১৯৫০ সালে পাবলো নেরুদার সাথে যৌথভাবে বিশ্ব শান্তি পুরস্কার জিতে নেন। এই বছরেই আঠারো দিনের আমরণ অনশনে যান তিনি। তুরস্কে গণতান্ত্রিক সরকার ক্ষমতায় আসায় মুক্তি পান। কিন্তু তার যন্ত্রণার অবসান ঘটে না। দুই দুইবার তাকে হত্যা করার প্রচেষ্টা চালানো হয়। পঞ্চাশ বছর বয়সে রাশিয়ান সীমান্তে সামরিক দায়িত্ব পালন করানোর চেষ্টা করা হয় তাকে দিয়ে। এই সব যন্ত্রণা থেকে রক্ষা পাবার জন্য ছোট্ট একটা মোটর বোটে করে বসফরাস পাড়ি দিয়ে বুলগেরিয়া হয়ে রাশিয়াতে পালিয়ে যান তিনি। পরের বছরই তুরস্ক সরকার তার নাগরিকত্ব বাতিল করে দেয়।১৯৬৩ সালে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মস্কোয় মৃত্যুবরণ করেন এই মহান কবি।

 

ইতিহাসের কী চরম লীলাখেলা। পঞ্চাশ বছর আগে যাকে বিশ্বাসঘাতক বলে রায় দিয়ে নাগরিকত্ব ছিনিয়ে নিয়েছিল তুরস্ক সরকার তাকেই আবার সসম্মানে মরণোত্তর নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে হয়েছে। ২০০০ সালে পাঁচ লাখ তুর্কী নাগরিক সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছিল নাজিম হিকমতের নাগরিকত্ব পুনর্বহালের জন্য এবং তার দেহাবশেষ মস্কো থেকে তুরস্কে ফিরিয়ে আনার জন্য। আর সে আবেদনে সাড়া দেয়া ছাড়া তুরস্ক সরকারের কিছু করারও ছিল না। নাজিম হিকমতের তুরস্ককে কোন প্রয়োজন নেই, কিন্তু তুরস্কের নাজিম হিকমতকে যে বড়ই প্রয়োজন।

 

 

নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেবার প্রতিক্রিয়া হিসাবে তুরস্কের ডেপুটি মিনিস্টার কেমিল সিচেক বার্তা সংস্থা এপিকে জানান যে, নাজিম হিকমতের বিষয়ে সরকারের মনোভাব পরিবর্তনের এটাই সময়। যে অপরাধের জন্য সরকার তার নাগরিকত্ব সেই সময়ে বাতিল করেছিল, সেই অপরাধ এখনকার যুগে আর কোন ধরনের অপরাধের পর্যায়েই পড়ে না।

 

 

নাজিম হিকমত শিল্পকে জীবন থেকে আলাদা করেননি। জীবন আর শিল্পের মাঝে কোন ফারাকও করেননি তিনি। বরং যে শিল্প জীবনকে প্রতিনিধিত্ব করে, জীবনকে প্রতিফলিত করে সেই শিল্পই আসল শিল্প বলে মনে করেছেন তিনি। ফলে তার কবিতায় মানুষের জীবন উঠে এসেছে শৈল্পিকসমৃদ্ধতায়। নাজিমের নিজের ভাষাতেই,

 

সেই শিল্পই খাঁটি শিল্প, যার দর্পণে জীবন প্রতিফলিত। তার মধ্যে খুঁজে পাওয়া যাবে যা কিছু সংঘাত, সংগ্রাম, প্রেরণা, জয়, পরাজয় আর জীবনের ভালবাসা। খুঁজে পাওয়া যাবে একটি মানুষের সব কটি দিক। সেই হচ্ছে খাঁটি শিল্প, যা জীবন সম্পর্কে মানুষকে মিথ্যা ধারণা দেয় না।

 

পাঠকদের জন্য নাজিম হিকমতের কবিতা আমি জেলে যাবার পর এর আবৃত্তি তুলে দিচ্ছি। আবৃত্তিটি করেছেন শিমুল মুস্তাফা। এই সুযোগে নিজেকেও একটু কেউকেটা লোক বানিয়ে নেই। নিজেতো আর জীবনে কিছু হলাম না। অন্যের নাম বেঁচে যদি কিছু পাওয়া যায় তাতেই বা মন্দ কী। সিদ্ধেশ্বরী স্কুলে শিমুল আমার সহপাঠী ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও আমরা একসাথে পড়াশোনা করেছি। তবে দুইজন দুই বিভাগে।

 

 

 

Get this widget | Track details | eSnips Social DNA

 

আমি জেলে যাবার পর

 

জেলে এলাম সেই কবে
তার পর গুণে গুণে দশ-বার সূর্যকে প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী
পৃথিবীকে যদি বলো, বলবে –
কিছুই নয়,
অণুমাত্র কাল
আমি বলব
না , আমার জীবনের দশটা বছর

 

 

যে বছর জেলে এলাম
একটা পেন্সিল ছিল
লিখে লিখে ক্ষইয়ে ফেলতে এক হাপ্তাও লাগেনি
পেন্সিলকে জিজ্ঞেস করলে বলবে :
একটা গোটা জীবন
আমি বলব :
এমন আর কী, মোটে তো একটি সপ্তাহ

 

 

যখন জেলে এলাম
খুনের আসামী ওসমান
কিছুকাল যেতেই ছাড়া পেল
তারপর চোরাই চালানের দায়ে
ঘুরে এসে ছ-মাস কয়েদ খাটল
আবার খালাস হল
কাল তার চিঠি পেলাম বিয়ে হয়েছে তার
এই বসন্তেই ছেলের মুখ দেখবে

 

আমি জেলে আসবার সময়
যে সন্তানেরা জননীর গর্ভে ছিল
আজ তারা দশ বছরের বালক
সেদিনকার রোগা ল্যাংপেঙে ঘোড়ার বাচ্চাগুলো
এখন রীতিমত নিতম্বিনী

 

কিন্তু জলপাইয়ের জঙ্গল আজও সেই জঙ্গল
আজও তারা তেমনি শিশু

আমি জেলে যাবার পর
দূরবর্তী আমার শহরে জেগেছে নতুন নতুন পার্ক
আর আমার বাড়ির লোকে
এখন উঠে গেছে অচেনা রাস্তায়
সে বাড়ি আমি চোখেও দেখিনি

 

যে বছর আমি জেলে এসেছিলাম
রুটি ছিল তুলোর মত সাদা
তারপর মাথাপিছু বরাদ্দের যুগ
এখানে এই জেলখানায়
লোকগুলো মুঠিভর রুটির জন্যে হন্যে হল
আজ আবার অবাধে কিনতে পারো

 

কিন্তু কালো বিস্বাদ সেই রুটি

 

যে বছর আমি জেলে এলাম
দ্বিতীয় যুদ্ধের সবে শুরু
দাচাউ-এর শ্মশানচুল্লী তখনও জ্বলেনি
তখনও পারমাণবিক বোমা পড়েনি হিরোশিমায়

 

টুঁটি-টিপে-ধরা শিশুর রক্তের মত সময় বয়ে গেল
তারপর সমাপ্ত সেই অধ্যায়

 

আজ মার্কিন ডলারে শোনো তৃতীয় মহাযুদ্ধের বোল

 

কিন্তু আমি জেলে যাবার পর
আগের চেয়ে ঢের উজ্জ্বল হয়েছে দিন
আর অন্ধকারের কিনার থেকে
ফুটপাথে ভারী ভারী হাতের ভর দিয়ে
অর্ধেক উঠে দাঁড়িয়েছে মানুষ

 

আমি জেলে যাবার পর
সূর্যকে গুণে গুণে দশ-বার প্রদক্ষিণ করেছে পৃথিবী
আর আমি বারংবার সেই একই কথা বলছি
জেলখানায় কাটানো দশটা বছরে
যা লিখেছি
সব তাদেরই জন্যে

যারা মাটির পিঁপড়ের মত
সমুদ্রের মাছের মত
আকাশের পাখির মত
অগণন,
যারা ভীরু, যারা বীর
যারা নিরক্ষর,
যারা শিক্ষিত
যারা শিশুর মত সরল
যারা ধবংস করে
যারা সৃষ্টি করে

 

কেবল তাদেরই জীবনকথা মুখর আমার গানে

 

আর যা কিছু
ধরো, আমার জেলের দশটা বছর-
ওসব তো কথার কথা