তখন সবে জাপানিজ শেখা শুরু করেছি। প্রথমেই ‘আমি অমুক’, ‘তুমি তমুক’ ধরনের ছোটখাট কথাবার্তার পাশাপাশি দিনের বিভিন্ন সময়ের শুভেচ্ছাবার্তা ও প্রথাগত সম্ভাষণগুলো শেখালো। তখনই শিখলাম, খাওয়ার আগে বলতে হয়, ‘ইতাদাকিমাস’। এমনিতেই বিদঘুঁটে সব নতুন শব্দের ভিড়ে প্রাণ ওষ্ঠাগত, তাই ‘ইতাদাকিমাস’এর শানে নুযূল নিয়ে এত মাথা ঘামালাম না। অর্থগত দিক দিয়ে ফরাসী ‘বোন অ্যাপেটিট’(bon appétit)এর কাছাকাছি কিছু হবে বলেই ধরে নিলাম।

যারা ইতিমধ্যেই দেশ ছেড়ে বিভিন্ন উদ্দেশ্যে বিদেশ-বিভূঁইয়ে পাড়ি জমিয়েছেন, তাদের অনেকেই হয়তো ‘হোস্ট ফ্যামিলি’ কথাটার সাথে পরিচিত। একজন বিদেশি হিসেবে নতুন একটি দেশে গিয়ে সেখানকার অপরিচির সংস্কৃতির সাথে পরিচয়ের ভাল একটা সুযোগ এই ‘হোস্ট ফ্যামিলি সিস্টেম’। ‘হোস্ট ফ্যামিলি’র বাসায় প্রথমদিন রাতের খাবারের দাওয়াতে গিয়েছি। আমার শ্রদ্ধেয় আম্মীজান আগ্রহভরে আমাকে অনেক কিছু শেখাতে লাগলেন। লম্বা চপস্টিক দিয়ে রান্না করে, ছোট চপস্টিক দিয়ে খায় ইত্যাদি ইত্যাদি। খাওয়ার আগে তিনি বললেন, এখন বলতে হবে ‘ইতাদাকিমাস’। এটা জানতাম। তিনি আরো যেটা বললেন এবং যেটা জানতাম না, তা হল, ‘ইতাদাকিমাস’ বলার সাথে সাথে দুই হাতও জোড় করে নিতে হয়। একটু ধাক্কা খেলাম। দেশে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকদের মাঝে প্রার্থনা বা প্রণাম করার সময় করজোড় করার রীতি প্রচলিত। বৌদ্ধ ভিক্ষুদেরও দেখেছি প্রার্থনা করার সময় দুই হাত জোড় করে রাখতে। আম্মীজান ছিলেন বৌদ্ধ। তাই, ‘ইতাদাকিমাস’ শব্দটা বৌদ্ধ ধর্ম থেকে প্রচলিত এক প্রকার আহারপূর্ব প্রার্থনা কিনা, সে ব্যাপারে সন্দেহ জাগল।

ততদিনে জাপানিজ শিক্ষায় বেশ কিছুদূর এগিয়েছি। ‘ইতাদাকিমাস’ শব্দটার অর্থের সাথে পরিচিত হলাম। আহারপূর্ব সম্ভাষণের বাইরেও এর ব্যবহার আছে। শব্দটি একটি ক্রিয়া, অর্থ হচ্ছে গ্রহণ করা। তবে, এখানেও কিছু কথা আছে। বাংলায় বক্তার সাথে শ্রোতার সামাজিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সম্মানপ্রদর্শনের সূচকের উঠানামা ঘটে সর্বনামে আর ক্রিয়ার শেষাংশে। জাপানিজে এসূচকটির ঊর্ধ্বগমন কিংবা অধঃপতনের সাথে সাথে কিছু কিছু ক্ষেত্রে পুরো ক্রিয়াপদটিই বদলে যায়। যেমন, ‘তোমার কাছ থেকে গ্রহণ করলাম’ আর ‘আপনার কাছ থেকে গ্রহণ করলাম’ – বাক্য দুটি জাপানিজে বলতে গেলে দুইটি আলাদা ক্রিয়াপদ ব্যবহার করতে হবে। ‘তোমার কাছ থেকে গ্রহণ করলাম’ এর গ্রহণ হচ্ছে ‘মোরাইমাস’, আর ‘আপনার কাছ থেকে গ্রহণ করলাম’ এর গ্রহণ হচ্ছে ‘ইতাদাকিমাস’। এটা জানার পর আর সন্দেহের অবকাশ থাকে না। ‘ইতাদাকিমাস’ বলার মাধ্যমে যার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা হচ্ছে তিনি ঈশ্বর বা দেবতা পর্যায়েরই কিছু হবেন বলে ধরে নিলাম। তখনও আমার এক মিনিট জাপানিজ বলতে গেলে তিন মিনিট ভেবে নিতে হয় অবস্থা। তাই কোন জাপানিজের সাথে এব্যাপারে আলোচনার ইচ্ছেটা প্রচ্ছন্নই থেকে গেল।

আমি যেখানে জাপানিজ শিখি, সেখানে জাপানিজ ছাড়াও সপ্তাহে একটা ক্লাস হয় জাপানী সংস্কৃতির উপর। একদিন এক্লাসটা শুরু হলে একটু নড়েচড়ে বসলাম, কারণ ক্লাসটা ছিল ‘ইতাদাকিমাস’ প্রথা সম্পর্কে। ওইদিনকার ক্লাসে আমি এমন কিছু জানলাম, যা আমাকে নতুন করে ভাবাল।

‘ইতাদাকিমাস’ হচ্ছে ‘ইনোচি ও ইতাদাকিমাস’ এর সংক্ষিপ্ত রূপ। এর মানে দাঁড়ায়, ‘জীবন গ্রহণ করলাম’। খোলাসা করেই বলি। আমরা খাদ্যের একটা বড় অংশই হয় উদ্ভিজ, নয় প্রাণিজ। উভয়ক্ষেত্রেই খাদ্যের উৎস কিন্তু জীবনের বাহক। সুতরাং, আমরা নিজেদের বেঁচে থাকার উদ্দেশ্যে কিছু প্রাণ হত্যা করি। অন্যভাবে বললে, আরো কিছু জীবের জীবনের বিনিময়ে নিজেরা জীবন ধারণ করে চলি। জীবনদানকারী সেইসব জীবনের প্রতি ধন্যবাদ জ্ঞাপনের মানসিকতা থেকেই খাদ্যগ্রহণের আগে ‘তোমার জীবন গ্রহণ করলাম’ বলার প্রথা জাপানিজদের। এক জাপানিজ বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, সে অন্তর্জাল দেখে জানাল, বৌদ্ধ ধর্ম থেকেই উৎপত্তি এপ্রথার। তাই নাকি? তাহলে পূর্ব এশিয়ার অন্যান্য বৌদ্ধপ্রধান দেশগুলোতেও কি একই ধরনের কিছু প্রচলিত আছে? চীন, থাইল্যাণ্ড, ভিয়েতনাম, কম্পুচিয়ার বন্ধুদের জিজ্ঞেস করলাম। না, আহারপূর্বক সম্ভাষণ আছে বটে, কিন্তু কোনটাই সমার্থক নয়। ‘ইতাদাকিমাস’ জাপানের নিজস্ব বৌদ্ধ দর্শন।

আড়াই হাজার বছর আগেকার গৌতম বুদ্ধের জীবনদর্শনের একটি ছিল, ‘জীবহত্যা মহাপাপ’। তবে, তিনি বোধহয় জীব বলতে শুধু প্রাণীকেই বুঝিয়েছেন। কারণ জীবহত্যা না করে কীভাবে মাটি, পানি আর বায়ু ভক্ষণ করে জীবন ধারণ সম্ভব, সে পথ তিনি বাতলে যান নি। আমাদের কলেজের এক শিক্ষক ছিলেন, যিনি মাছ-মাংস খেতেন না; যাকে বলে একেবারে পুরোদস্তুর নিরামিষাশী। একদিন ক্লাসে আমাদের কোন এক সহপাঠী স্যারকে নিরামিষ ভোজের কারণ জিজ্ঞেস করলে, স্যার জানান, তিনি নিজ স্বার্থে অন্য প্রাণীর জীবন হরণে রাজি নন। ক্লাসের কতিপয় দুষ্ট বালক সমস্বরে বলে ওঠল, ‘স্যার, গাছেরও তো জীবন আছে!’ স্যার তখন আরো জানালেন, ধর্মচর্চায় উনি যে পর্যায়ে আছেন, আমরা তার ধারেকাছেও নেই, তাই আমরা যেন তাঁকে এধরনের প্রশ্ন না করি। প্রসংগত, স্যার ছিলেন বৈষ্ণব মতবাদে বিশ্বাসী। উল্টোপিঠ থেকেও একটু ঘুরে আসি। একদিন ঘটনাক্রমে আমার এখনকার সহপাঠী এক ভিয়েতনামী মেয়ের সাথে রাতের খাবার খাচ্ছিলাম। কথাবার্তা অনেক চড়াইউৎরাই পেরিয়ে ভিয়েতনামের লোকদের খাদ্যাভ্যাসে এসে পড়ল। আর যায় কোথা, সে তার খাদ্যাভিজ্ঞতার লম্বা ফিরিস্তি শুরু করল। গরু, ছাগল, ভেড়া থেকে শুরু করে ব্যাঙ, শূকর, কুকুর সবই আছে সেখানে। যে যে প্রাণীর কথা মাথায় এল সবই বললাম একটা একটা করে, দেখা গেল কোনটাই তালিকার বাইরে নয়। শেষে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, ‘কুমির?’ সে আকর্ণবিস্তৃত হাসির সাথে জানাল, ‘কুমিরের মাংস অনেক সুস্বাদু।’

শুধু মানুষই যে অন্য প্রাণীদের ধরে ধরে সাবাড় করে ফেলে তা নয়। জীবকুলের মধ্যকার পারস্পারিক সম্পর্কগুলোর মধ্যে খাদ্য-খাদক সম্পর্কটাই সবচেয়ে বেশি দৃশ্যমান। এধরনের সম্পর্কে গড়ে ওঠা খাদ্যশৃংখলগুলোই বাস্তুতন্ত্রের মূল ভিত্তি, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় যা অপরিহার্য। যেখানে এটাই প্রকৃতির নিয়ম, সেখানে পুষ্টির ভারসাম্য রক্ষা করে প্রাণিজ আমিষ গ্রহণে আমি কোন বাধা দেখি না।

বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অন্য কোন প্রান্তে অন্য কোন পরিবেশে অন্য কোন প্রাণের বিকাশ হয়েছে কিনা তা আমার জানা নেই। তবে, আমাদের এই একটিমাত্র ছোট পৃথিবীকে কেন্দ্র করে প্রাণের স্বতঃস্ফূর্ত উৎসারণে এই যে এক সুবিশাল জীবজগত গড়ে ওঠেছে, তার বৈচিত্র্যতায় আমি মুগ্ধ হই। সুবিশাল জড়জগতের মাঝে হঠাৎ একটি ক্ষুদ্র জীবনকণার উৎপত্তির সৌন্দর্যে আমি মুগ্ধ হয়ে যাই। অন্তহীন বিশ্বজগতের কোন এক প্রত্যন্ত প্রান্তে কোন এক বৈশিষ্ট্যহীন গ্রহে জীবনের ভাষায় প্রকৃতির বলা কথাগুলো শুনে আমি বিমোহিত হই। আকাশে ঢেউ খেলে যাওয়া নানান রঙ, পুকুরের পাড়ে অযত্নে বেড়ে ওঠা কচুপাতাটায় জমে থাকা শিশিরবিন্দুটির হঠাৎ জলপতনে টুপ করে ওঠা নিস্তব্ধতার ভাঙন, বাতাসের সাথে অবিরাম খেলায় রত কাঁচা ধানের ক্ষেতে দাঁড়িয়ে থাকার গন্ধ – সবই তো শুধুই জড়ে গড়া আমার দেহের আয়নায় জীবনের প্রতিফলন। জীবনের চেয়ে সুন্দর আর কী আছে? আমি এর অপার রহস্যময় সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে যাই। কিন্তু আমার মাঝের এজীবনটি কি বিচ্ছিন্ন কিছু? একটু আগে যে প্রথম ক্ষুদ্র জীবকণাটির কথা বললাম, তার মাঝে হঠাৎ বেজে ওঠা জীবনের সাড়াই তো কালের স্রোতে ভেসে এসে ডাক দিয়ে যাচ্ছে আমার অন্তরে। আপনার অন্তরে, সকল মানুষের, সকল প্রাণীর, সকল জীবের অন্তরে। পৃথিবীর জীবকুলের জীবন তো একই সূত্রে বাধা, একই মহান সৌন্দর্যের বাহক। উদ্ভিদ এবং প্রাণিকুলের ওই সৌন্দর্যটুকু গ্রহণ করেই আমরা সুন্দর হয়ে ওঠি আরো। সৌন্দর্যের প্রয়োজনেই আমরা সৌন্দর্য হরণ করে যাই। দিনে তিনবার আহারের পূর্বে কোন এক অক্ষম ব্যক্তির উদ্দেশ্যে লক্ষ স্তুতিবাক্য পাঠের চেয়ে একটিবার জীবনের সৌন্দর্য উপলব্ধির তাৎপর্য আমার কাছে অনেক অনেক বেশি।