জাপানের অধিকাংশ লোকেই ধর্মের ধার ধারে না, নাৎসুমির পরিবারও তাই। ‘সেন্টার ফর জাপানিজ ল্যাঙ্গুয়েজ এন্ড কালচার’এর সব বিদেশি ছাত্রদেরকে পড়াশুনায় টুকটাক সাহায্য করার জন্য ওসাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একজন করে জাপানি ছাত্র ঠিক করে দেওয়া হয়, এদেরকে ডাকা হয় টিউটর বলে। আমার টিউটর ছিল নাৎসুমি। দেশে টিউটর শব্দটার মাঝে কেমন যেন একটা শিক্ষক-শিক্ষক ভাব চলে আসে। গৃহশিক্ষকরা বয়সে হয়তো তেমন বড় না হলেও, ‘ভাইয়া’ বা ‘আপু’ না ডেকে ‘স্যার’ বলে ডাকার প্রচলনই বেশি। জাপানে টিউটর শব্দটার ভাবার্থ আলাদা। সমবয়সী হওয়ায় নাৎসুমির সাথে আমার আলাপচারিতাগুলো হত বন্ধুত্বের পর্যায়েই। ওর মাঝে একটা বাচ্চাবাচ্চা ভাব ছিল। পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছিলাম, বেশিরভাগ জাপানি মেয়েরাই এরকম।

নাৎসুমি ছোটবেলা থেকে বড় হয়েছে নিধার্মিক পরিবেশে, এখন সে একজন প্রোটেস্ট্যান্ট খৃস্টান। কেন খৃস্টান হল, জিজ্ঞেস করেছিলাম একদিন। আমার দুর্বল জাপানিজ দিয়ে যা বুঝেছিলাম তা হল, সে তার কিছু খৃস্টান বন্ধুবান্ধবের সাথে এমনিতেই কয়েকদিন চার্চে যাওয়া-আসা করেছিল। সেখান থেকে খৃস্টানিটি সম্পর্কে জানতে পারে সে। ঈশ্বরের অস্তিত্বের কথা আগে শুনে থাকলেও, অশরীরী অস্তিত্বের মতোই এটা তার কাছে ছিল ভয়ের ব্যাপার। চার্চে গিয়ে সে জানতে পারে, ঈশ্বর ভীতিকর কেউ নন, বরং তিনি নাৎসুমিকে ভালবাসেন। ঈশ্বরের ভালবাসার বাণী ভাল লাগে নাৎসুমির। ওর ব্যাপ্টাইজেশন হয়েছে, এক বছর হয়ে গেল।

এক বিকেলের আলাপচারিতায় প্রসঙ্গক্রমে ধর্মের ব্যাপারটা চলে এল। নাৎসুমিকে জিজ্ঞেস করলাম, প্রোটেস্ট্যান্ট আর ক্যাথলিকদের পার্থক্য কি? বলল, ‘প্রোটেস্ট্যান্ট চার্চের বিশপরা বিয়ে করতে পারে, ক্যাথলিক চার্চের বিশপের বিয়ে করা নিষেধ। আরো কি কি জানি আছে? আমি অত ভাল জানি না।’ আমি একটু অবাক হলাম, বিশপদের বিয়ের অধিকারের জন্যই কি প্রোটেস্ট্যান্টরা প্রোটেস্ট করেছিল! বললাম, ‘কেউ বিয়ে করতে চায় কি না চায়, সেটা তো তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। কিন্তু বিয়ে করার ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও বাধা দেওয়াটা কি মানুষের সামাজিক অধিকারের লঙ্ঘন নয়?’ ‘ঠিক’, বলল ও, ‘নিয়মটা একটু আজব।’ ভাবছিলাম, শুধু খৃস্টধর্ম নয়, অন্যান্য ধর্মেও তো শ্রেণিভেদ কম নয় – যেমন ইসলাম ধর্মে শিয়া, সুন্নি। এদের থেকে সৃষ্টি হয়েছে আরো কিছু গোত্র, উপগোত্র। ভি. এস. নাইপলের ‘অ্যামোং দ্য বিলিভার্স’ বইটাতে পড়েছিলাম, ইরানি শিয়াদের মধ্য থেকে উৎপন্ন হয়েছিল বাহা’ই গোত্র। এদিকে ভারতবর্ষে সুন্নিদের একদল হয়ে গেল আহম্মদী বা ক্বাদিয়ানী; পাকিস্তানে আবার জুলফিকার আলী ভুট্টো প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে আইন করে এদেরকে অমুসলিম ঘোষণা করেছিলেন। এছাড়াও চার মাযহাবের ব্যাপারটাওতো বেশ গোলমেলে। হাইস্কুলে পড়ার সময় ধর্মশিক্ষার এক শিক্ষককে জিজ্ঞেস করেছিলাম; বলেছিলেন, চার মাযহাবই নাকি সঠিক। একই সাথে কীভাবে বামে এবং ডানে যাওয়া যায়, সেটা বোধগম্য হয়ে ওঠে নি।

নাৎসুমিকে বললাম, ‘তুমি তো প্রোটেস্ট্যান্ট। সে হিসেবে ক্যাথলিকদের মতবাদকে কি ভুল মনে কর না?’ সে বলল, ‘সব মানুষ তো আর একরকম না, তাই তাদের চিন্তাচেতনাও এক হবে না। ক্যাথলিকরাও বাইবেল পড়ে। বাইবেল পড়ে ঈশ্বরের বাণীকে ওরা যেভাবে বুঝেছে, সেভাবে চলছে। ওদের বোঝাটাকেও তো আমরা সরাসরি ভুল বলে দিতে পারি না।’
‘তাহলে বলছ, ক্যাথলিকরা প্রোটেস্ট্যান্টদের থেকে আলাদা হলেও দুইদলেরই স্বর্গপ্রাপ্তিতে কোন বাধা নেই?’
‘মনে হয় না।’, নাৎসুমির কণ্ঠে দ্বিধা বাজে, লুকানো।
আমি বলে চলি, ‘কিন্তু, একজন মানুষের বিয়ে করা উচিত না অনুচিত, সে বিষয়ে মতভেদ তৈরি হয় কীভাবে? বাইবেলে যদি এবিষয়ে কোথাও বলা হয়ে থাকে, তাহলে তো সেটা সোজা ভাষাতেই, হয় ‘বিয়ে কর’ নয় ‘বিয়ে কর না’, এভাবে বলা হয়ে থাকার কথা, ঠিক না? সেখান থেকে তো আর ভিন্নমত সৃষ্টির অবকাশ থাকে না।’
নাৎসুমি বলল, বাইবেলে কোথাও এবিষয়ে লেখা আছে কিনা, সে জানে না। ‘আরেকটা ব্যাপার’, আমি বলতে লাগলাম, ‘তোমার কথামত ধরে নিলাম, মানুষের চিন্তাচেতনা যেহেতু এক নয়, তাই, কেউ বাইবেল পড়ে প্রচলিত ধারণার থেকে অন্য কিছু বুঝে থাকলেও, তাকে ঠিক বলেই ধরে নেয়া যায়। খৃস্টানদের মাঝেই একটা ভাগ আছে, যাদের বলে ইউনিটারিয়ান বা সোসিনিয়ান। তারা তোমাদের কিংবা ক্যাথলিকদের মত ট্রিনিট্রিতে নয়, বরং ঈশ্বরের একটিমাত্র রূপে বিশ্বাস করে। অথচ তারাও কিন্তু বাইবেল পড়ে এবং নিজেদের খৃস্টান বলে দাবি করে। আবার মুসলিমদের দাবিও কিন্তু প্রায় একই, তারাও জেসাসের ঈশ্বরেই বিশ্বাসী, জেসাসকে মনে করে ঈশ্বরের বার্তাবাহক। তোমার কি মনে হয়, ইউনিটারিয়ান এবং মুসলিমদেরও স্বর্গে যাওয়ার সুযোগ আছে?’
নাৎসুমি একটু থামে। তারপর বলে, ‘যেতে পারে, এ ব্যাপারে আমার তেমন ধারণা নেই। তবে মুসলিমরা তো বাইবেল মানে না।’
‘হ্যাঁ, তা ঠিক। কিন্তু তারা কিন্তু বলে না, বাইবেল পুরোটাই মিথ্যে। বরং এটা বলে যে, বাইবেল বিভিন্নজনের মাধ্যমে বিভিন্ন সময়ে বিকৃত হয়ে যাওয়ায় তা আর ঈশ্বরের বাণীরূপে মেনে চলার যোগ্য নয়। তারা তাদের নিজেদের ধর্মগ্রন্থ কোরানকে ঈশ্বরের অবিকৃত বাণী বলে মনে করে এবং সেকারণে তা মেনে চলে।’
‘বাইবেল যদি কারো মাধ্যমে পরিবর্তিত হয়েই থাকে, তাহলে কোরানও যে পরিবর্তিত হয় নি, তার নিশ্চয়তা কি?’, প্রশ্ন ছুঁড়ে দেয় নাৎসুমি।
বললাম, ‘তা ঠিক। আমি কিন্তু এটা বলতে চাচ্ছি না যে, মুসলিমদের মতবাদটাই সঠিক। আমি শুধু তোমার কথার প্রেক্ষিতে জিজ্ঞেস করলাম মাত্র। জেসাস যে ঈশ্বরের কথা বলে গেছেন, মুসলিমেরা সেই একই ঈশ্বরে বিশ্বাস করে, একই ঈশ্বরের কৃপার আশায় প্রার্থনা করে। পার্থক্য যা আছে, তা তোমার ওই দৃষ্টিভঙ্গিগত পার্থক্যের সীমারেখাতেই পড়ে যায়। তারা তাদের নিজেদের মত করে তোমার ঈশ্বরকেই তো খুঁজে পেয়েছে, তাও কি তারা ঈশ্বরের অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত হবে?’
‘কি জানি? আমি ওই পর্যন্ত বলতে পারি না।’, অসহায় শোনায় ওকে।
‘ঠিক আছে। আরেকটা ব্যাপার, বাইবেল যে সম্পূর্ণ নির্ভুল তা কি তুমি দাবি করতে পার?’, ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সংঘাতে নাৎসুমি কী বলে, জানতে চাচ্ছিলাম আমি।
‘কেন? তোমার কি মনে হয়, কোথাও সমস্যা আছে?’ এবারে একটু বিরক্ত হয়ে ওঠে সে। ‘তুমি কি এটা জানো যে, বাইবেলের কথানুযায়ী, পৃথিবী এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের বয়স ছয় হাজার বছরের কাছাকাছি?’, জিজ্ঞেস করলাম আমি। অবাক হয় নাৎসুমি, ‘এটা বাইবেলে তুমি কোথায় পেলে?’ । আধুনিক বিজ্ঞানের মতে পৃথিবীর বয়স কত হতে পারে, সে ব্যাপারে ওর ধারণা কাছাকাছিই ছিল; এর আগে আরেকদিনের কথাবার্তায় বুঝেছিলাম আমি। বললাম, ‘বাইবেলে সরাসরি একথা লেখা নেই। কিন্তু বাইবেল গবেষকরাই এতে বর্ণিত পৃথিবী সৃষ্টির পর থেকে বিভিন্ন ঘটনাবলির ক্রমধারা আর ঘটনকাল হিসেব করে এতথ্য বের করেছে।’
‘হয়তো ওইসব ঘটনাগুলোর মাঝে অনেক সময়ের ফাঁক ছিল, যেগুলো হিসেবে আনা হয় নি।’ ওর কণ্ঠস্বরে বেজে ওঠা রক্ষণাত্মক সুরটি অপরিচিত লাগল না।
‘হতে পারে। আমি তো আর নিজে গবেষণা করে দেখি নি। তবে অনেক স্বনামধন্য ব্যক্তির রেফারেন্সেই এতথ্যটা পেয়েছিলাম। উইকিপিডিয়াতে খুঁজে দেখলাম। ওরাও তো মোটামুটি একই কথা বলল। তাই ঠিক বলেই ধরে নিয়েছি। যাকগে, তুমি তো বিবর্তন সম্পর্কে জান।’ এর আগে মানবজিন, বিবর্তন নিয়েও একদিন কথা হয়েছিল ওর সাথে। বললাম, ‘বিবর্তন তো ঈশ্বর কর্তৃক মানুষ সৃষ্টির তত্ত্ব একেবারে বাতিল করে দেয়।’
‘কিন্তু, বিবর্তন তো কোন একজন মানুষেরই মতামত, তাই না?’ একটু বিদ্রূপের রেখা যেন ফুটে ওঠে ওর ঠোঁটে।
আমি বললাম, ‘তুমি এভাবে বলতে পার না। তুমি যদি ঈশ্বর সম্পর্কে বলতে চাও, অনেক কথাই বলতে পারবে, কিন্তু প্রমাণ কি একটাও দেখাতে পারবে? বিজ্ঞান সেরকম নয়, বিজ্ঞান যা বলে তা প্রমাণসহকারেই বলে। বিবর্তনও কিন্তু তার ব্যতিক্রম নয়। প্রমাণ আছে বলেই, বিবর্তন একটি প্রতিষ্ঠিত তত্ত্ব।’
‘তাহলে তুমি বিবর্তন বিশ্বাস কর?’ পালটা প্রশ্ন করলো ও।
উত্তরে বলি, ‘উহু, আমি বিবর্তন বিশ্বাস করি না, আমি বিবর্তন জানি।’ কথাটার শেষ শব্দগুলোয় জোর দিতে গিয়ে অজান্তেই মনে হয় আমার চেহারায় কিছু পরিবর্তন এসে গিয়েছিল। সে পিছু হেলে গিয়ে একেবারে হো করে ওঠল। বলল, ‘তোমার চাহনিটা যা ছিল না …’। কথায় অকারণ নাটকীয়তা এসে যাওয়ায় আমি একটু লজ্জা পেয়ে গেলাম।

শেষ করে ওঠার সময় বলছিলাম, ‘আমার কিছু কিছু কথা হয়তো তোমার খারাপ লাগতে পারে, তার জন্য দুঃখিত।’
‘কয়েক জায়গায় অবশ্য খারাপ লেগেছিল। তবে মানুষ হিসেবে তোমার তো ভিন্ন মতামত থাকতেই পারে। তাই কিছু মনে করিনি’, বলল সে।
‘আমি শুধু এটাই বোঝাতে চাচ্ছিলাম যে, যা কিছু সঠিক বলে ধারণা করছ, তা ঠিকমতো ভেবেচিন্তেই করছ কিনা?’, বললাম আমি। নাৎসুমির উত্তর ছিল, ‘সে ব্যাপারে তোমার চিন্তা করতে হবে না। আমি তো বোকা নই।’