নেদারল্যান্ডে আসার পরপরই একটা ডাচ ফ্যামিলির বাসায় গিয়েছিলাম। পরিবারের ছেলেটি ১০/১১ বছরের নাম উইলিয়াম। প্রাইমারী স্কুলে পড়ে। সোফায় বসতেই ঝটপট কথা শুরু করল আমার সাথে। ওর মা ইনেকার সাথে আমার আগেই পরিচয় এক জ়ন্মদিনের উতসবে। কথা প্রসঙ্গে ছেলেটি বলল তুমি বাংলাদেশের? আমি স্কুলে একটা প্রজেক্ট করেছি বাংলাদেশের ওপর! শুনে অবাক হলাম! আমরা প্রজেক্ট করেছি পড়াশুনার শেষ পর্যায়ে যদিও মাতৃভাষায় নয়। আমি তখনও ডাচ ভাষা আয়ত্ত করতে পারিনি। কথাবার্তা চলছিল ইংরেজিতে যেটা ওর মাতৃভাষা নয়।

এভাবে এদের শিক্ষাব্যবস্থা সম্বন্ধে জেনেছি অনেক পরে। আমার ছেলে লিওন প্রাইমারী স্কুলে শিখেছে প্যানকেক ভাজা। ডিম, আটা, দুধ, স্যাম্বাল(একধরনের পাকামরিচবাটা)দিয়ে ফ্রাইপ্যানে একটু তেল দিয়ে রুটির মত ভাজে।
বাংলাদেশের বাচ্চাদের পরীক্ষার সময় মুখস্থ করে বই গেলানো হয়। এখানে সে বালাই নেই। ক্লাশে পড়ানো, ক্লাশেই পড়া নেয়া, পরীক্ষা ও নম্বর দেয়া। বছরশেষে একটা পরীক্ষা নেয়। সেখানে বছরের সব নম্বর যোগ হয়। প্রাইমারী স্কুলে বাচ্চাদের বাংলাদেশের মত এতো বইও নেই। টিচার মুল বই থেকে প্রয়োজনীয় বিষয় ফটোকপি করে বাচ্চাদের দেন বাচ্চারা শুধু ঐ টুকুই শেখে। এছাড়া পড়ার বইয়ের পাশাপাশি বিভিন্ন গল্পের বই ও ম্যাগাজিনও পড়তে দেয় স্কুলে।

আরও পরে কলেজে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি শিক্ষক বইয়ের বিভিন্ন প্রশ্নউত্তর ও বিভিন্ন বিষয়ের ওপর রচনা লিখতে দিলে ওরা শুধু বইয়ের ওপর নির্ভর না করে কম্পুটারে ঐ বিষয়ের ওপর যত তথ্য আছে সব খুঁজে বের করে তারপর ঐ বিষয়ে লিখে টিচারকে জমা দেয়। সব ছাত্রছাত্রিরাই টাইপে পারদর্শী। সব কাজ ছাপিয়েই শিক্ষকের কাছে জমা দেয়।

একবার দেখি আমার কর্মক্ষেএ মিডিয়াটেকে ছাএ,ছাত্রিরা সব গাছেরপাতা হাতে করে এনেছে, বললাম এসব দিয়ে কি হবে? ওরা বলল সিলভিয়া (অংকের টিচার, এরা টিচারদের নাম ধরে ডাকে) দিয়েছে। এসব ফটোকপি করে দোর্ঘ্য, প্রস্থ মেপে জ্যামিতির সমাধান বের করতে। এদের শিক্ষাব্যাবস্থায় পারতপক্ষে মুখস্থবিদ্যাকে অনুতসাহিত করা হয় বলা চলে। সবকিছু বই থেকে নিয়ে ব্যাবহারিকভাবে প্রয়োগই এদের শিক্ষাব্যবস্থার নীতি। শিক্ষাব্যবস্থা বহুমাত্রিক, কোথাও একঘেঁয়েমি নেই। ছেলেমেয়েরা শেখার আনন্দেই শেখে, শিখতে হবে বলে শেখেনা। ছেলেমেয়েদের মনস্তত্ত অনুযায়ী এদের স্কুল, কলেজে শেখানো হয়।

এবার দেশে গিয়েছিলাম। আমার এক বান্ধবী এসেছিল দেখা করতে। কলেজে পড়ায়, বলল জানো বইগুলো পড়াতে পড়াতে একদম মুখস্থ হয়ে গেছে। এর বাইরে কিছু করবার নেই। তার অবকাশও নেই। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থার পরির্বতন আনতে হলে শিক্ষকদের তার সময়োপযোগী করে গড়ে তুলতে হবে বিভিন্ন কর্মশালা ও ট্রেনিং দিয়ে যাতে তারা এসব ছাএছাত্রিদের শেখাতে পারেন। দেশে অনেকে শিক্ষার ওপর বিভিন্ন উচ্চতর শিক্ষা নিয়ে যান, তারা বিভিন্ন কর্মশালা ও ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে দেশের শিক্ষকদের শেখাতে পারেন এবং যারা শিখলেন তারা মাঠপরযায়ের অন্য শিক্ষকদের শেখাতে পারেন।

শুধু কম্পিউটার কিনে ক্লাশে রাখলেই হবেনা, তাকে কাজে লাগাতে হবে এবং সব শিক্ষকদের কম্পিউটার ব্যাবহারে ও প্রয়োজনীয় তথ্যসংগ্রহে পারদর্শী করতে হবে, যাতে তারা তা ছাএছাত্রিদের ভালোভাবে শেখাতে পারেন।

এদেরদেশে ছাএছাত্রিরা শুধু লেখাপড়াই করেনা এদের সামাজিক দায়বদ্ধতা অনুকরনযোগ্য। টিচাররা এতে গুরুত্তপুরনো দায়িত্ত পালন করেন। যেমন ক্যান্সারের জন্য, মরনোত্তর বিভিন্ন অর্গান হাসপাতালে জমা দেয়ার জন্য, আফ্রিকার যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্থ শিশুদের জন্য, সুনামির জন্য এরা স্কুল ছুটির পর দলবেধে পাড়ায় পাড়ায় যেয়ে বাড়ি বাড়ি চাঁদা উঠায়। এতে বাবামায়েরাও সহযোগিতা করেন।

স্কুলের পর কম্যুনিটি সেন্টারে ছেলেমেয়েরা খেলাধূলা করে সেখানেও এসব কার্যক্রমে অংশ নেয়া হয়। এসবের ওপর টিভিতে অনুষ্ঠান দেখানো হয় এবং ছেলে, মেয়েরা কে কত অভিনব উপায়ে চাঁদা উঠিয়েছে তা অনেক কৌতুক মিশিয়ে দেখানো হয়, যাতে তারা উতসাহ পেয়ে ভবিষ্যতেও এসব কর্মকান্ডে অংশ নেয়।

এছাড়া প্রাইমারী ও উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়েও ছাএ,ছাত্রিদের বিভিন্ন মিউজিয়াম, দর্শনীয়স্থান, কলকারখানা, ক্যাম্পিং ও বিভিন্ন দেশ পরিভ্রমনে নিয়ে যাওয়া হয়।

এদের দেশের মুলধারার শিক্ষাব্যাবস্থার সাথে রয়েছে মন্টিসরি শিক্ষাব্যাবস্থার যাতে ছাএছাত্রিরা নিজের মেধা ও শেখার ক্ষমতা অনুযায়ী লেখাপড়া করে। এই শিক্ষাব্যাবস্থা নার্সারী থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যয় পর্যন্ত। এতে প্রত্যেক ছাএছাত্রিরা নিজস্ব মেধা অনুযায়ী আপন ইচ্ছায় আপন ছন্দে শেখার আগ্রহেই শুধু শেখে। তাদের ওপর কোনোধরনের চাপ সৃষ্টি করা হয়না। সব কিছুই তারা শেখে শিক্ষকদের ব্যাক্তিগত তত্তাবধায়নে। এই শিক্ষাব্যাবস্থায় তারা মনে করে প্রতেক শিশুই অনুপম!

মনে পড়ে যখন রংপুর সরকারী উচ্চবালিকা বিদ্যালয়ে পড়তাম তখনকার কথা, আমাদের ড্রয়ংস্যার ইসমাইলহোসেন একবার এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিরাট বিরাট শক্ত কাগজ দিয়ে বড় বড় পদ্ম ফুল তৈরি করেছিলেন, সেই পদ্ম ফুলের ভেতর থেকে বেড়িয়ে দুই বোন নেচেছিল শুকনো পাতার নুপূর পায়ে……। অপূর্ব মুগ্ধতায় সেই দৃশ্য দেখেছি। আজ এতদিন পরে এতদেশ ঘুরে সব সুন্দর সুন্দর দর্শনীয় জিনিস দেখেও মনে হয় ইসমাইল স্যারের সেই পদ্মের কাছে ওরা হার মেনেছে! আমাদের শিক্ষকদের হতে হবে সৃষ্টিশীল এবং ছাএছাত্রিদের কাছেও তা ছড়িয়ে দিতে হবে। সৃষ্টিশীলতার আনন্দের মাধ্যমে সবকিছুই শেখা হবে সহজ!

এখানে সব ছাএছাত্রিদের আপ্রেন্টিসশিপ (শিক্ষানবিশি) করতে হয় ব্যাচেলর বা মাস্টারস লেভেলে অন্তত দশমাস শিক্ষাসম্পর্কিত কোনো প্রতিষ্ঠানে। যাতে কর্মজীবনে তাদের নিজসস কর্ম সম্পর্কিত সব ধরনের অভিজ্ঞতা থাকে। তাতে করে চাকরী পেতে কোনো অসুবিধা হয়না।

একজন ডাক্তের, ইঞ্জিনিয়ার, কৃষিবিদ বা প্রশাসনিক কর্মকর্তা যদি শহরে মানুষ হয়ে গ্রামে গিয়ে কাজ করতে পারেন তাহলে একজন শিক্ষক পারবেননা কেন? গ্রামেই তো দেশের সিংহভাগ ছাএছাত্রিদের বাস, সংখ্যাগরিস্ঠ প্রজন্মকে অবহেলা করে একটা জাতি কোনোভাবেই এগুতে পারেনা। অবশ্য সেজন্য শিক্ষকতার পেশাকে অর্থকরীভাবে আকর্ষনীয় করতে হবে সরকারকে। যাতে মেধাবী ছাএছাত্রিরা ভবিষ্যতে এই পেশায় আসেন। একটা দেশের ভবিষ্যত গড়ার কারিগরদের অবহেলা করার কোন অবকাশ নেই। আসলে তাদের প্রাধান্য দেয়া উচিত সবার আগে। একজন ভাল শিক্ষকই একজন ভাল ছাত্রের জন্ম দিতে পারেন!
নেদারল্যান্ড
০৫/১১/২০০৭