বিজ্ঞানী ডারউন অনেক বড় কাজ করে রেখে গেছেন জীব জগতের উৎপত্তি (সৃষ্টি নয়), তার ক্রম বিবর্তনের রূপ পদ্ধতি বর্ননার মাধ্যমে। সংক্ষেপে আমরা যাকে বলি বিবর্তন তত্ত্ব। এ তত্ত্ব বলে মানুষের উৎপত্তিও এ পৃথিবীর আর সকল প্রাণীর মতোই প্রাকৃতিক নির্বাচনের মাধ্যমে টিকে থাকা এক প্রজাতি বৈ আর কিছুই নয়। চিন্তাশীল, যুক্তিবাদী, বিজ্ঞান সচেতন সকল মানুষ আজ এই তত্ত্ব সঠিক বলে মেনে নিয়েছেন। জীব বিবর্তনের তত্ত্ব আজ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত সত্য।
এই সত্য সরাসরি বিরোধিতা করে এতদিনকার জানা, ধর্মগ্রন্থ বর্নিত, পারিবারিকভাবে জানা, যা প্রায় আজন্ম লালিত অন্ধ বিশ্বাস হয়ে আমাদের মাথায় বসে থাকা সৃস্টিকর্তা রূপী আল্লাহ্ ইশ্বর বা গডের ধারনাকে। অবশ্য এখানে সচেতনভাবেই অপ্রাসঙ্গিক হবে বিধায় এই এক ইশ্বর ধারনার পূর্ববর্তী বহু ইশ্বর বা দেব দেবীর ধারনার বিবর্তন নিয়ে আলোচনা বাদ রাখলাম। জৈবিক বিবর্তনই শধু নয় বা চিন্তাগত জগতেও তথ্য-উপাত্ত এবং সমেয়র হেরফেরে পরিবর্তন হয়। বিবর্তন তত্ত্ব বিরোধীদের / পরীক্ষা-নিরীক্ষা বিহীণ, অযৌক্তিক অন্ধবিশ্বাসের বিরুদ্ধে এ এক মোক্ষম তত্ত্ব।
এ তত্ত্ব জ্ঞান একটি বৈজ্ঞানিক সত্য। এর সঙ্গে আমার কোন বিরোধ নেই। গোলবাঁধিয়েছেন এর প্রয়োগকারীরা এর অপপ্রয়োগের মাধ্যমে। আণবিক শক্তির আবিষ্কার একটি বৈজ্ঞানিক তত্ব, একটি সত্য জ্ঞান এখন এর প্রয়োগ কী মানুষের কল্যানে হবে না মানুষের ধ্বংসের কাজে ব্যবহার হবে সেটাই হলো আমার এই প্রবন্ধের মূল কথা। বন্দুক নিজে কোন শত্রু-মিত্র বা খারাপ-ভাল কিছুই নয়, এই বন্দুক দিয়ে ডাকাতি করা যেমন যায় আবার ডাকাতি থেকে নিজেকে রক্ষাও করা যায়। এভাবে কেউ যখন বলে আমি আল্লাহর সৃষ্টি, ভগবানের বা গডের এমনকি কেউ যদি বলে আমি আল্লাহ ভগবান সৃষ্টিকর্তা এসব কিছুই মানি না, আমি নিরীশ্বরবাদী, আমি প্রকৃতি সৃষ্ট তাতে কারোর কী কোন অসুবিধা হওয়ার কথা বা হয়?
আমি তো এতে কোন অসুবিধা দেখতে পাচ্ছি না। অসুবিধাতো সৃষ্টি হয় তখন যখন এসব বলে অন্যের সম্পদ কেড়ে নেয়া হয়, জোর করে বা প্রতারণার মাধ্যমে, অর্থাৎ ছলে বলে কৌশলে। কাউকে অপমান, অসম্মান করা হয়, সামাজিক অন্যায় বা রাষ্ট্রীক আইনের মাধ্যমে সুবিধাভোগী ও সুবিধাবঞ্চিতের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করে সমাজে মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়। এক্ষেত্রে সুবিধাভোগীরা অন্ধ-বিশ্বাসী না মুক্তমনা, ইশ্বরবাদী না নিরীশ্বরবাদী, সৃষ্টিবাদী না বিজ্ঞান সচেতন, পুরাতন না আধুনিক বিবেচ্য নয়। সমাজে মানুষের মধ্যে সুযোগ-সুবিধার সমানাধিকার দিতে আগ্রহী কিনা এটাই হলো বড় বিবেচনার বিষয়।
এটাই একজন মানুষের জ্ঞান মেধা যোগ্যতা যাচাইয়ের কঠিন পরীক্ষা। এখানে দেখছি অনেকেই এ ব্যপারটা একবারেই গুলিয়ে ফেলছেন। কেউ বলছেন আগেকার যুগের লোকেরা রাজতন্ত্রীরা, মন্ত্রী যাজকেরা প্রজা নামের মানুষদের শোষণ করেছেন, তাদের উৎপাদিত ফসল/ সম্পদ ইশ্বরের নাম করে কেড়ে নিয়েছেন, অত্যাচার করেছেন, বড় অন্যায় করেছেন। আমরা এখন গণতন্ত্রী, সকলে ভোট দিয়ে আমরা আমাদের শাসক নির্বাচন করি, এই শাসকদের পছন্দ না হলে, অন্যায় করলে পাঁচ বছর পর আবার নতুন শাসক নিয়োগ দেই। আমরা মানুষের পশ্রিমের কষ্ট অনেক লাঘব করেছি, যন্ত্র বানিয়েছি। মেধা খাটিয়ে, পুজিঁ খাটিয়ে, বাঁচার জন্য, ভেগের জন্য পণ্য বানিয়েছি, আর এই পণ্য লেনদেনের জন্য টাকা ও বাজার বানিয়েছি। যার যা দরকার সবই এখন বাজারে পাওয়া যাবে। বিক্রি করতে হলেও বাজারে যাও। এই বাজার একেবারেই খোলা, উন্মুক্ত সকলের জন্য, খাটিঁ মুক্ত বাজার, কোন বাঁধা নিষেধ নাই। তোমার টাকা নাই, তোমার প্রয়োজনীয় পণ্য কিনতে পারছ না, তাহলে সুদখোর মহাজন/ ব্যাংকের নিকট থেকে ধার নাও, এমনিতে ধার দিচ্ছে না তো বন্ধক রাখো কিছু, বন্ধক রাখার মতো কিছু নেই, থাকলে তো বাজারে বিক্রিই করতে পারতে? তাহলে বন্ধক রাখো নিজেকেই, বেগার খাটবে। তা নাহলে না খেয়ে মর। এসমাজে বেঁচে থাকার তোমার কোন যোগ্যতা নেই, অধিকার নেই। প্রাকৃতিক নিয়মে যোগ্যতমেরই শুধু টিকে থাকার অধিকার স্বীকৃত। এটাই প্রকৃতির নিয়ম, সমাজ এভাবেই চলবে, প্রকৃতির বিধান এর কোন ব্যত্যয় নেই। এটাই শেষ কথা।
পুজিঁ কোথায় পেলে? এমন বেয়ারা প্রশ্ন কেউ করো না। পুঁজি মুনাফা ছাড়া টিকতে পারে না, সংবর্ধিত হতে পারে না। আর কারোর মুনাফা মানেই অন্যের ভাগে কম পরা। পুঁজি তাই মুনাফার মাধ্যমে, উদ্বৃত্ব শোষণের মাধ্যমেই টিকতে পারে। পুঁজি তাই বাজারের মাধ্যমে, মুণাফার মাধ্যমে সম্পদ কুক্ষিগত বৈষম্য সৃষ্টি করে। মানুষে মানুষে বৈষম্য সৃষ্টিকারী এ বাজার ব্যবস্থাকে জীব বিবর্তনের তত্ত্ব দ্বারা ব্যাখ্যা করা যায় না।
সাধারনভাবে দেখলে মনে হতে পারে জীব বিবর্তনের এ তত্ত্ব বুঝি মৎসান্যায়ের মতো চরম বৈষম্য বাদী নীতিকে সমর্থন করে। এটা আসলে ভুল ধারনা। বড় পুঁজি ছোট পুঁজিকে মাছেদের মতোই গিলে ফেলে স্ফীত হয়। এ রকমের উদাহরন থেকেই এমন ধারনার সৃষ্টি। একটু খেযাল করলে দেখবেন, প্রাকৃতিক নির্বাচনে যোগ্যতমের টিকে থাকার নিয়মেই বড় মাছ ছোট মাছকে গিলছে তা ঠিকই তবে সেটা কিন্তু পুঁটি মাছ পুঁটি মাছকে গিলছে না। আমি বলতে চাইছি এক প্রজাতির পুঁটি মাছকে কিন্তু অন্য প্রজাতির তথা শোল মাছ বা বোয়াল মাছে গিলছে। জীব বিবর্তনের তত্ত্ব এখানে লঙ্গিত হয় নাই। পুঁজির নিয়মকে, প্রাকৃতিক নিয়মের তুলনায়/ বা মিলানোতে এ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে।
এমন অপযুক্তির মুখে এর অগেও আমাকে পরতে হয়েছে। একবার অনেক জ্ঞানী গুনী মানুষদের সংগেই বসছি, কথা হচ্ছে বিশ্বরাজনীতি, আধিপত্য বিস্তারে সাম্রাজ্যবাদীদের পালের গোদা মার্কিনীদের ভূমিকা ও বাংলাদেশের জনগণের করনীয় নিয়ে। এক পর্যায়ে একজন বলে বসলেন “হক ভাই কথাতো সব ঠিকই বলেছেন, কিন্তু বিড়ালের গলায় ঘন্টা বাঁধবে কে?” অন্যরা অনেকেই মুখ টিপে হাসছেন, আমি বুঝতে পারলাম, আমাদের করনীয় নিয়ে ঐক্যমতে পৌঁছানো থেকেও আমাকে ঘায়েল করতে বেশী আগ্রহী। এদের মতো অর্ধ শিক্ষিত কপট লোকদের সঙ্গে কথা বলাটা আসলে সময় নস্ট করা। যা হউক আমার উত্তর এটা একটা ভুল উপমা, উপমার মাধ্যমে অপযুক্তি দাঁড় করানো হয়েছে। ছলে বলে কৌশলে মার্কিন শতক বা নয়া বিশ্ব নীতি (নিউ ওর্য়াল্ড অর্ডার) যারা স্থাপন করতে চান তারাও আমাদের মতোই মানুষ, তারা কোন বিড়াল নয় আর আমরাও ইঁদুর নই। ইভেনজেলিক বুশ তত দিনে বলে বসেছে হোয়াইট হাউসের করিডোরে গডের সঙ্গে দেখা হয়েছে আর তার প্রত্যাদেশ পেয়েই ইরাক আক্রমনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সামন্ত যুগের সম্রাটদের সহায়ক ও ছিলেন এই গড বর্তমান গণতন্ত্রের রক্ষক প্রেসিডেন্টের সহায়ক ও এই গড।
সারা বিশ্বের শোষিত বঞ্চিত অসহায় মানুষদের সহায়তায় এই গড কখনো তার চতুর্থ আসমানের এজলাস থেকে নেমে আসেন নি, আসবেনও না কখনো। কারণ এমন কিছুর আসলে কোন বাস্তব অস্তিত্ব নাই। এজন্যই জার্মান দার্শনিক ফুয়ের বাক বলেছিলেন মানুষই তার প্রয়োজনে ইশ্বর সৃস্টি করেছেন, ইশ্বর কখনো কাউকে সৃস্টি করেনি। সমাজের কায়েমী স্বার্থবাদী, সুবিধাবাদী শাসক শোষকের সেই থেকে অনেক জ্বালা। তার উপড় ডারউইনের এই তত্ত্ব মানুষ সৃস্ট কাল্পনিক এই ইশ্বরকে বৈজ্ঞানিক প্রমাণাদি দিয়ে উৎখাত করে দিলেন।
বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ভুল প্রযোগের মাধ্যমে মানব সমাজের প্রভুত ক্ষতি ইতি মধ্যেই আমরা করেছি, এমনকি পুরো পৃথিবীটাকেই মুনাফা শিকারীরা আজ ধ্বংসের কিনারায় নিয়ে এসেছে যা মোটেই কাম্য নয়। এই তত্ত্ব দ্বারা কাল্পনিক ইশ্বরকে উৎখাত করা গেলেও সমাজের কায়েমী স্বার্থবাদী, সুবিধাবাদী, শাসক-শোষক, সৃস্টিতত্ত্ববাদীদের সৃষ্ট লোক ঠকানো এই বাজার ইশ্বরকে উৎখাত করা সম্ভব নয়। তার জন্য অন্য তত্ত্ব লাগবে, এ নিয়ে আবার লিখব।০২-০২-১০