আদিম প্রাইমেটদের থেকে আনুমানিক ৩ কোটি বছর পূর্বে এপ তথা বনমানুষদের বিবর্তন ঘটেছিল। মানুষ, গরিলা, শিম্পাঞ্জি, গিবন, ওরাংওটাং সবাই বনমানুষ। প্রাইমেট একটি বর্গের নাম, বনমানুষ সহ আরও অনেকগুলো পরিবার যার আন্তর্ভুক্ত। ঠিক কোন সময় জীবনবৃক্ষের একটি স্বতন্ত্র শাখার পানে এগিয়ে গিয়েছিল বনমানুষরা- এ সম্পর্কে যতোটা জানা গেছে সে তুলনায় প্রাচীনতম প্রাইমেটদের জন্ম নিয়ে আমাদের ধারণা অনেক কম। এর মূল কারণ এতো প্রাচীন জীবাশ্মের অভাব এবং কোন স্থানে তাদের উৎপত্তি ঘটেছিল সেটা নিয়ে পরষ্পরবিরোধী সব অনুকল্প। সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের বাফেলো মিউজিয়াম অফ সায়েন্স-এর গবেষণা সহযোগী মাইকেল হেডস একটি গবেষণাপত্রে প্রাইমেটদের উৎপত্তির সময়কাল ও স্থান সম্পর্কে একটি নতুন ধারণা ব্যক্ত করেছেন।

এখন পর্যন্ত পাওয়া প্রাচীনতম প্রাইমেট জীবাশ্ম ৫.৫ – ৫.৮ কোটি বছর আগের। জীবাশ্ম রেকর্ডের আলোকে তাই প্রাইমেটদের উদ্ভবের সময়কাল ধরা হয়েছিল আনুমানিক ৫.৬ কোটি বছর পূর্বে। কিন্তু মাইকেল হেডস বললেন, এক্ষেত্রে জীবাশ্মের হিসাব কখনও ঠিক হতে পারে না, কারণ এর আগেও অনেক প্রাইমেট থাকতে পারে যাদের জীবাশ্ম সংরক্ষিত হওয়াটাই অসম্ভব। আণবিক ঘড়ি কৌশলের মাধ্যমে জীবাশ্মগুলোর জিন বিশ্লেষণ করে উদ্ভবের সময়কাল নির্ধারণ করা হয়েছিল ৮ – ১১.৬ কোটি বছর পূর্বে, অর্থাৎ ক্রিটাশিয়াস যুগে। হেডসের এই গবেষণাপত্র প্রকাশের পূর্বে শেষোক্ত সময়কালটাই সর্বাধিক সমাদৃত ছিল। কিন্তু হেডস এসে এই সময়কালকে আরও অনেক পিছিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, প্রাইমেটদের উদ্ভব ঘটেছিল আজ থেকে ১৮.৫ কোটি বছর পূর্বে, অর্থাৎ জুরাসিক যুগের প্রথম দিকে।

এর আগে অধিকাংশ বিজ্ঞানীর ধারণা ছিল, পৃথিবীর কোন এক স্থানে আদি প্রাইমেটদের উৎপত্তি ঘটেছে এবং সেখান থেকে তারা বিভিন্ন মহাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু এই অনুকল্পের কোন শক্ত ভিত্তি ছিল না। এমনকি এটা সিদ্ধ করতে গিয়ে অনেক সময় এটাও মেনে নিতে হতো যে, আদ্যিকালের সেই প্রাইমেটরা তাদের ছোট্ট মস্তিষ্কে সমুদ্র পাড়ি দেয়ার বুদ্ধি রাখতো। মাইকেল হেডসের গবেষণা বলছে, নির্দিষ্ট কোন স্থানে নয় বরং বিভিন্ন স্থানে পৃথক পৃথকভাবেই তাদের বিবর্তন ঘটেছে। সকল প্রাইমেটদের পূর্বপুরুষ এমন এক সময়ে বাস করতো যখন ভূভাগ বিভক্ত হয়নি, সবগুলো মহাদেশ একসাথে প্যানজিয়া গঠন করে ছিল। অবিভক্ত পৃথিবীর আদি পূর্বপুরুষদের থেকে প্রাইমেটদের বিবর্তন এবং প্লেট টেকটোনিক এর কারণে প্যানজিয়া ভাগ হয়ে বিভিন্ন মহাদেশ ও মহাসাগর গঠনের সময়কালের মধ্যে মিল দেখানোর চেষ্টা করেছেন তিনি। আর এটা দেখানোর জন্য বেছে নিয়েছেন জৈব-ভূগোল (Biogeography) এবং ভাইক্যারিয়েন্স (Vicariance) বিষয় দুটোকে। এর সাহায্যে হেডস কিভাবে তার অনুকল্প প্রমাণ করেছেন সেটা দেখার আগে এক নজরে তার গবেষণার ফলাফলগুলো দেখে নেয়া যাক:

অবিভক্ত পৃথিবী তথা প্যানজিয়াতে বাস করতো আরকন্টা (Archonta) মহাবর্গের অন্তর্ভুক্ত স্তন্যপায়ী প্রাণীরা যারা ছিল প্রাইমেটদের পূর্বপুরুষ। আনুমানিক সাড়ে ১৮ কোটি বছর পূর্বে প্যানজিয়া বিভক্ত হয়ে মহাদেশগুলো গঠিত হতে শুরু করে, একই সময়ে আরকন্টা মহাবর্গের আদিম প্রাণীগুলো তিন অঞ্চলে বিভক্ত হয়ে যায়: উত্তর, দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া। উত্তরের আরকন্টানরা Plesiadapiformes (বিলুপ্ত) এ পরিণত হয়, দক্ষিণাঞ্চলীয়রা হয়ে যায় প্রাইমেট, আর দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার আরকন্টানরা বিবর্তিত হয়ে Dermoptera ও Scandentia বর্গের প্রাণীতে পরিণত হয়। আনুমানিক ১৮ কোটি বছর পূর্বে তথা আদি জুরাসিক যুগে যখন বর্তমান দক্ষিণ আফ্রিকার লেবোম্বো পর্বতমালায় মুহূর্মূহু অগ্ন্যুৎপাত শুরু হয় তখনই প্রাইমেটরা দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় যাদেরকে আমরা স্ট্রেপসারিনি ও হ্যাপ্লোরিনি উপবর্গের মধ্যে ফেলে থাকি। আনুমানিক ১৬ কোটি বছর পূর্বে মোজাম্বিক চ্যানেল গঠিত হওয়ার সময় স্ট্রেপসারাইনরাও বিভক্ত হয়ে যায়- আফ্রিকা ও এশিয়ায় অবস্থানকারীরা বিবর্তিত হয়ে লোরিস ও গালাগো তে পরিণত হয়, আর মাদাগাস্কারবাসীরা পরিণত হয় লেমুরে। ১৩ কোটি বছর পূর্বে অর্থাৎ আদি ক্রিটাশিয়াস যুগে আটলান্টিক প্রশস্ত হওয়ার সাথে সাথে পুরনো দুনিয়ার বানর ও নতুন দুনিয়ার বানররা আলাদা হয়ে যায়। আর এই পুরনো দুনিয়ার বানরদের থেকেই উদ্ভব ঘটে বনমানুষ অর্থাৎ আমাদের।

ছবিতে দেখানো হচ্ছে প্যানজিয়া বিভক্ত হওয়ার সময়টাতে পৃথিবীর কোন অংশে কোন বর্গের প্রাণীদের উৎপত্তি ঘটেছে। ৪ টি বর্গ দেখানো হচ্ছে: Plesiadapiformes, Primate, Dermoptera ও Scandentia.

ছবিতে দেখানো হচ্ছে প্যানজিয়া বিভক্ত হওয়ার সময়টাতে পৃথিবীর কোন অংশে কোন বর্গের প্রাণীদের উৎপত্তি ঘটেছে। ৪ টি বর্গ দেখানো হচ্ছে: Plesiadapiformes, Primate, Dermoptera ও Scandentia.

এবার এই ঘটনাগুলো কিভাবে ঘটেছে সে সম্পর্কে হেডসের বক্তব্য ব্যাখ্যা করা যায়: প্লেট টেকটোনিক তত্ত্বানুসারে মহাদেশীয় সঞ্চারণ শুরু হয় যার ফলশ্রুতিতে নতুন নতুন মহাদেশ তৈরি হতে থাকে এবং মহাসাগর দিয়ে তারা একে অপরের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এর ফলে দুই মহাদেশের প্রাণীরা একে অপরের থেকে ভৌগলিকভাবে আলাদা হয়ে যায়। আর এমন ভৌগলিক বিচ্ছিন্নতাই অ্যালোপেট্রিক স্পেসিয়েশন (Allopatric speciation) এর মাধ্যমে নতুন প্রজাতির জন্ম দিতে পারে। প্রকৃতপক্ষে প্লেট টেকটোনিক এর মাধ্যমে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ভূখণ্ডগুলোতে নতুন প্রজাতি সৃষ্টির প্রক্রিয়াকেই বলা হয় ভাইক্যারিয়েন্স। এই অনুকল্পের পক্ষে সবচেয়ে পড় প্রমাণ ছিল নতুন দুনিয়ার বানররা। এদের জীবাশ্ম কেবল আমেরিকা মহাদেশেই (পাতাগোনিয়া ও ক্যারিবিয়া) পাওয়া যায়। হেডস নিজেকে প্রশ্ন করেছিলেন, অন্য কোন স্থান থেকে অভিবাসিত হয়ে এদের পক্ষে আমেরিকায় আসা কি আদৌ সম্ভব? উত্তর ছিল, না। তাহলে অবশ্যই তারা আমেরিকাতেই ভিন্ন পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়েছে। এছাড়া মাদাগাস্কারে কেন শুধুই লেমুর পাওয়া যায় এই প্রশ্নের উত্তরও প্রমাণ যুগিয়েছে।

এই গবেষণাপত্রের ভিত্তিতে বলা যায়, এক জায়গায় উদ্ভূত হয়ে পড়ে প্রাইমেটরা বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েনি, বরং ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা পূর্বপুরুষদের থেকে পৃথক পৃথকভাবেই একেক অঞ্চলে বিবর্তিত হয়েছে। ২০০৯ এর ৭ সেপ্টেম্বরে নরওয়ের Zoologica Scripta জার্নালে গৃহীত এই গবেষণাপত্র প্রাইমেট গবেষণায় কতোটা প্রভাব বিস্তার করবে সেটা সময়ই বলে দেবে।

তথ্যসূত্র:

-> New Theory on the Origin of Primates – Science Daily
-> Evolution and biogeography of primates: a new model based on molecular phylogenetics, vicariance and plate tectonics – Michael Heads