(১)
মুক্তমনাতে অবিশ্বাসী বা নাধার্মিকরা নিজেদের বিশ্বাসের বিবর্তন নিয়ে লিখছেন। ব্যাপারটা বেশ ইন্টারেস্টিং । সভ্যতা, মানব চেতনা, বুদ্ধি-সব কিছুরই বিবর্তন হয়। তবে ব্যাক্তিগত বিবর্তন একটা ফিকশনাল টাচ।

মানব মনের বিবর্তনের মূলে আছে দ্বন্দ। জিডু কৃষ্ণমূর্তির মতে বিশ্বাসের সাথে অভিজ্ঞতার সংঘাতেই জন্ম নেয় মনের বিবর্তন। যারা কমিনিউস্ট, হিন্দু, মোল্লা ইত্যাদি বিশ্বাসে বিশ্বাসী-এবং ঠিক সেই ভাবেই মারা যায়,তারা প্রতিনিয়ত নিজের মনের এই দ্বন্দকে অস্বীকার করে চলেছে। এতে তাদের কি লাভ হয় আমি জানি না। তবে মানব মন এবং মননের বিবর্তন কচুরী পানার মতন হিন্দুত্ব, কমিনিউস্ট, ইসলামিস্ট ইত্যাদি ঘাটে আটকে যাওয়া সমাজ এবং রাজনীতির জন্যে ক্ষতিকর।

কিভাবে মনের বিবর্তন হয়-সেটা নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই বলি। আমি একদম ছাপোষা মধ্যবিত্ত শিক্ষক পরিবারের সন্তান। যেখানে মদ্যপান ও অশৌচ। বাঙালী মধ্যবিত্ত বামপন্থী পরিবারগুলি কিছু বিশ্বাস এবং মুল্যবোধের গোডাউন। তাই আই আই টিতে যাওয়ার আগে মদ্যপায়ীদের নিয়ে আমার খুব ভাল ধারনা ছিল না। একধরনের বিশ্বাস। মিথ এর একটা উদাহরন । মধ্যবিত্তদের মিথিক্যাল ভালোমানুষদের স্বপ্নের স্বর্গপুরী। সেখানে প্রথমবর্ষে আমি বিয়ার খাওয়া ধরলাম-মালসেবনে আমার গুরুদেব ছিলেন জ্যাকোরিয়া চাকো বলে একজন সিনিয়ার যে এখন কলেজ পার্কে পার্টিকল ফিজিক্সের বিখ্যাত অধ্যাপক। কেন ভাংল এই মিথ? যেখলাম এই দাদাটি আমার থেকেও অনেক বুদ্ধিমান, ‘ভদ্র’ এবং জ্ঞানী-এবং এর পরেও সুরাপায়ী! তাহলে সুরাপান বাজে হতে পারে না!

আরো অনেক মিথের শিকার আমরা। কিছু মিথের সাথে আমরা বড় হই-সেটাই আমাদের ধর্ম হয়ে দাঁড়ায়। আমার ধারনা ছিল যারা কোম্পানীর সি ই ও টাইপের হয়-তারা বোধ হয় খুবই ব্যাবসায়ী বুদ্ধির-ব্যাবসা নিয়েই সারাদিন ভাবে। সাধারন লোকদের সাথে মেশে না। ইটালিতে আমি প্রথম যে চাকরিতে ঢুকি-আমাদের সি ই ও ছিল ডঃ মার্কো বালদাসারি। তার সাথে হঠাৎই ভালো বন্ধুত্ব হল-কারন ইতিহাস। ইতিহাস আমাদের দুজনেরই খুব প্রিয় ছিল। অন্যান্য কোম্পানীতেও দেখেছি সি ই ও যারা হয়, তাদের দর্শন এবং সাহিত্যের ভিত ব্যাবসার মতনই পোক্ত। যেকোন কমিনিউস্টকে জিজ্ঞেস করুন। কোম্পানীর সি ই ও দের নিয়ে তাদের বিশ্বাস এবং ধারনা এর ১৮০ ডিগ্রী বিপরীতে। তাই বলে ভাববেন না আমি ধণতন্ত্রের পক্ষে সাফাই গাইছি। আয়ান র‌্যান্ডের অবজেক্টিভিজম পড়ে মনে হয়েছিল-তিনিই ঠিক। কর্পরেট এবং ব্যাবসার জীবনে ধনতন্ত্রে ঘানি টানতে গিয়ে অবজেক্টিভিজমের মিথও এখন বাস্প। অভিজ্ঞতা মিথকে ভাঙে।

(২)
ধর্ম বা বিশ্বাস, মিথোলজীর একটা সিস্টেম। সমাজ তার রিপ্রোডাক্টিভ ফিটনেসের জন্যে কিছু কিছু মিথকে নির্বাচন করেছে-কালক্রমে সেগুলোই ধর্ম। ঈশ্বর এমনই একটি মিথ। সবথেকে শক্তিশালী মিথই বটে। কারন, এই মিথটি ছিল নৃততাত্বিক প্রয়োজন। পশুদের ত আর ঈশ্বর নামক মিথের দরকার নেই। মানব সমাজ জটিল বলেই এই মিথটার জন্ম হল। সামাজিক এবং রাজনৈতিক সেলফ অর্গানাইজেশনের কারনে ( যুথবদ্ধ জীবনের প্রয়োজনে) এই মিথগুলো প্রাক-মিডিয়ার যুগে দরকার ছিল। এই নিয়ে আমার আগের কিছু লেখা আছেঃ
[১] [২]

সুতরাং অবিশ্বাসী কেন হলাম, সেটাকে এই ভাবে লিখি। কিছু মিথের মধ্যে আমরা জন্মে ছিলাম। কিন্ত যেদিন বুঝলাম এই মিথক্রিয়া আসলেই বিষক্রিয়া-পরিত্যাগ করিলাম। পরের প্রশ্ন-কেন এই মিথগুলিকে বর্জন করে চলেছি।

[৩]
আমার কাহিনীটা মোটেও বিশ্বাসী থেকে অবিশ্বাসীতে উত্তরোনের কাহিনী না। আমি বিশ্বাসী কোনদিনই ছিলাম না। কারন ওই মিথগুলো আমার মাথায় কেও ঢোকায় নি। তাই আমাকে নাস্তিক হওয়ার জন্যে কিছুই পড়তে হয় নি। এই অবিশ্বাসীর জীবনটাই আমার কাছে ছিল স্বাভাবিক। বাড়িতে অজস্র বিজ্ঞানের বই ছিল। কিশোর জ্ঞানবিজ্ঞান বলে বাচ্চাদের জন্যে একটা ভাল বিজ্ঞানের ম্যাগাজিন ছিল শৈশবে। ওটা নাস্তিকতা প্রচার করত না বটে-কিন্ত বৈজ্ঞানিক মনের উন্মেষ ঘটাতো। আমার বিচারে নাস্তিকতার চেয়েও দ্বিতীয়টা আরো বেশী দরকার। কমিনিউস্টরাও নাস্তিক-কিন্ত তাদের মধ্যে কোন বিজ্ঞানচেতনা নেই। বিজ্ঞানচেতনাহীন নাস্তিকরা আস্তিকদের চেয়ে আরো বেশী ভয়ংকর। পৃথিবীর বৃহত্তম গণহত্যাগুলি স্টালিন পলপটের মতন অর্ধশিক্ষিত নাস্তিকদের কাজ। তাই নাস্তিক বলে উল্লাসিত হওয়ার কিছু নেই-যদি না তার মধ্যে প্রকৃত বিজ্ঞানচেতনার উন্মেষ না ঘটে থাকে। আমার কাছে বিজ্ঞান চেতনার উন্মেষ-সায়েন্টিফিক এনলাইটমেন্ট আস্তিকতা-নাস্তিকতার থেকেও বেশী দরকার। ভুলভাল আদর্শবাদের পাঁকে এই পৃথিবী ভর্তি-তারা আস্তিক না নাস্তিক তাতে কিছু যায় আসে না। কারন এদের মধ্যে সত্যিকারের কোন বৈজ্ঞানিক চিন্তা ভাবনা নেই।

এই জন্যেই আমার অনেক দিনের ইচ্ছা বাংলা ভাষাতে বাচ্চাদের জন্যে বিজ্ঞানপত্রিকা চালানোর। ব্যাস্ততার জন্যে আমার মনের খুব প্রিয় এই প্রজেক্টটা পিছিয়ে যাচ্ছে।

[৪]
অবিশ্বাসী জীবন কাটানো আমার জন্যে বেশ সহজ। আমার বন্ধু সার্কলে আস্তিক প্রায় নেই-থাকলেও ধার্মিকত কেওই নেই। বাঙালী হিন্দুদের মধ্যে ধর্ম প্রাবল্য এমনিতেই খুব কম। তাই কে ধার্মিক আর কে না-সেটা নিয়ে আমি মাথা ঘামাই না। প্রয়োজন হয় না। ক্লাশ সেভেনে আমার ঠাকুর্দা মারা যায়। আমাকে মাথা কামাতে বলা হয়েছিল-আমি কামাই নি। ক্লাশ সিক্সেও আমি চ্যালেঞ্জ করে লক্ষীর প্রসাদে পা দিয়েছি। আমি উন্নাসিক-এটা সবাই জানত। বাবা-মায়ের কাছে অনেক অভিযোগও আসত। আমার কিছু যায় আসে নি। আমি সত্যিই আস্তিকদের ব্যাপারে উন্নাসিক ছিলাম । আজও আছি। জ্ঞান-বিজ্ঞান-দর্শন বোঝে না বলে লোকে ঈশ্বরে বিশ্বাস করে। এই ধারনা আমার ছোটবেলাতেও ছিল। আজ্ও আছে। ঈশ্বরে বিশ্বাসীদের আমি ইন্টেলেকচুয়ালি ইনফেরিয়র বলেই মনে করি।

পরবর্তীকালে ক্লাশ এইটে বিবেকানন্দ রচনাবলী পড়া শুরু করি। ধর্ম দর্শন নিয়ে সেটাই জানার শুরু। নরেন্দ্রপুর রামকৃষ্ণ মিশনে ছিলাম উচ্চমাধ্যমিকে। তখন আরো বেশী ধর্ম এবং দর্শন নিজে জানার সুযোগ হয়েছে। ভাল লাইব্রেরী ছিল। সন্নাসীদের মধ্যে কেও কেও অবশ্যই পন্ডিত ছিলেন। কিন্ত ধর্ম নিয়ে আমার পড়াশোনা আমাকে ধার্মিক করে নি-কারন ধর্ম দর্শন নিয়ে আমি যখন পড়াশোনা করছি, তখন বিজ্ঞানের ভিত বেশ দৃঢ় হয়ে গেছে। অধিকাংশ লোক ধর্মদর্শনের শিকার হয়-কারন বিজ্ঞান ঠিক করে বোঝে না। আমি অনেক ধর্মীয় গুরুর সাথে মিশেছি বা মিশি। তাদের যুক্তির দৌড় বোঝার চেষ্টা করি। এখন আর সেটা বিশেষ করি না-কারন এদের সীমাবদ্ধতা, খেলাঘরের গন্ডি আমি ভালো ভাবেই বুঝে গেছি। এই মুহুর্তে ধর্মদর্শনের প্রতিটা দিকই আমার কাছে অতিরিক্ত-আমি মনে করি না এর কোন দরকার আছে। বিজ্ঞান দিয়েই মানব সভ্যতা এবং মানব জীবন দুটোই আরো অনেক ভাল চলে। বিজ্ঞানের দর্শনের চেয়ে শক্তিশালী দর্শন পৃথিবীতে নেই। তাই সেটাই প্রচার করি। এই ব্যাপারে আমাদের আপোসহীন থাকতে হবে সারা জীবন।

নাস্তিক হিন্দু ধর্ম বা বৌদ্ধ ধর্মের সাথে বিজ্ঞানের সংঘাত আছে-তবে অতটা নয়। হিন্দু ধর্মের নাস্তিক্যদর্শনগুলো আস্তিকতার সাথে দীর্ঘদিন যুদ্ধ করে মোটামুটি একটা যৌত্বিক অবস্থানে এসেছে। বৌদ্ধ ধর্ম সম্পূর্ন নাস্তিক ধর্ম-কিন্ত এদের প্রচারকরা একেও আস্তিক বানিয়েছে। শাক্যমুনি যে জন্যে বৌদ্ধ ধর্ম শুরু করেছিলেন-তার উদ্দেশ্য অনেকটাই ব্যার্থ। একেশ্বরবাদি ধর্মগুলোর সাথে বিজ্ঞানের সংঘাত বেশ তীব্র। কারন ইসলাম বা খৃষ্টধর্ম আরো বেশী ক্যানোনিক্যাল-বা বই ভিত্তিক। আত্মজিজ্ঞাসাভিত্তিক না।

ধর্মের ব্যাপারে আনকম্প্রোমাইজিং থাকা উচিত। বিবেকানন্দ, গৌতম বুদ্ধের ধর্মসংস্কারে নীট ফল শুন্য। জঞ্জাল জঞ্জালই থেকেছে। সেটাকে বিদায় করাই উচিত ঝেঁটিয়ে। নইলে ভারতের বৃহত্তম কমিনিউস্ট পার্টিটির মতন ক্লাস পলিটিক্স ছেড়ে কমিউন্যাল পলিটিক্স করতে হবে। তবে এটাও আমি বারবার বলে এসেছি ধর্ম মানুষের কিছু প্রয়োজন মিটিয়ে থাকে-আত্মজিজ্ঞাসার অনুসন্ধান। সেই জায়গটাকে বিজ্ঞান দিয়ে ভরাট করতে হবে। এই নিয়ে আমাদের আরো বেশী লেখালেখি করা দরকার। এটা না হলে প্রকৃত ধর্ম নিরেপেক্ষ সমাজ আসবে না। ধর্ম থাকবে-আবার সমাজ হবে ধর্মনিরেপেক্ষ এসব হাঁসজারু মার্কা পলিটিক্যালি কারেক্ট চিন্তাধারা ছাড়তে হবে।

অন্যের ধর্মানুভূতিতে আঘাত করব না-এসব বালখিল্যের মতন কথাবার্ত্তা। কোরানে প্রায় ৫০০ আয়াত আছে প্যাগানদের বিরুদ্ধে। তাহলে, ইসলাম যে পালন করছে, সে প্যাগানিস্ট হিন্দুদের ঘৃণা করতে বা নিদেন পক্ষে হিন্দুধর্মকে ঘৃণা করতে বাধ্য। তবে আমার দেখা মতে অধিকাংশ মুসলমানই এমন নয়। কারন তারাও কোরানে কি আছে সেটা জেনে ইসলাম পালন করে না। সুতরাং সেই ধর্মকে ত্যাগ করা ছাড়া ধর্ম নিরেপেক্ষ রাষ্ট্রের ভিত অসম্ভব। তবে কেও আত্মজিজ্ঞাসার কারনে ধর্মেই আসতেই পারে। সেটাকে আটকানো দরকার। কারন তাহা চোরাবালি।

মোদ্দা কথা ধর্মের ব্যাপারে আমরা পলিটিক্যালি কারেক্ট ব্যাটিং করার চেষ্টা করি। এই মিথ্যাচারে ধর্ম নিরেপেক্ষ রাষ্ট্র এবং সমাজের ভিত আরো দুর্বল হয়।
ইসলামে কত রক্ত-সেটাই বলতে হবে। হিন্দু ধর্মে কোথায় কে হেগে গেছে-সেই নোংরাটা দেখাতে হবে। ধর্ম কত মহান বলে নিজেকে জনপ্রিয়তার সিঁড়ি দিয়ে নামানোটা খুব সহজ-শ্রোতের বিরুদ্ধে সাঁতার কাটাই কিন্ত ‘জীবনের’ স্পন্দন। মৃত্যু যখন অলঙ্ঘ্য নিয়তি-তখন সত্যের জন্যে আপোসহীন সংগ্রামী মৃত্যুই নিজের কাছে আমার একমাত্র প্রত্যাশা।