ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন [০১] [০২] [০৩] [০৪] [০৫] [০৬] [০৭] [০৮]

০৯
বৃহস্পতিবার ১৬ জুলাই ১৯৯৮
ইয়ারা ইয়থ হোস্টেল

গীর্জার ঘন্টা শোনা যায় না এখানে। হাতঘড়ি বলছে রাত আড়াইটা। হোস্টেলের আর কেউ মনে হয় জেগে নেই এখন। কোথায় বসে তোমাকে লিখছি জানো? লাউঞ্জ রুমের সোফায়। রুমে বসে লেখার সাহস পেলাম না। আমার রুমে আজ আরো একজন ঘুমাচ্ছে। এত রাতে লাইট জ্বালালে তার যদি অসুবিধে হয়! অন্য একটা কারণেও অস্বস্তি লাগছে। সে কথায় আসছি একটু পরে। আগে বলি আজ সারাদিনে কী কী করলাম।

সকালে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের সাত তলায় লিফ্‌ট থেকে বেরিয়েই দেখা হয়ে গেলো মিকির সাথে। তার প্রিয় রঙ মনে হয় লাল। আজও তার পরনে লাল সোয়েটার, সামনের দিকে তিনটি সাদা বৃত্ত আঁকা। গাঢ় লাল লিপস্টিক আর একই রকম সাজসজ্জা। হাতে কিছু কাগজপত্র নিয়ে হেড অব দি ডিপার্টমেন্টের অফিসের দিকে যাচ্ছিলেন।

“হাই প্রদীপ, আই ওয়াজ জাস্ট আস্কিং কেন্‌ এবাউট ইউ। এনরোলমেন্ট অফিস হ্যাজ সেন্ট ইওর পেপার্‌স। আই উইল এরেঞ্জ ফর ইওর অফিস-কী। জাস্ট গিভ মি এ মিনিট” বলেই প্রফেসর নুজেন্টের অফিসে ঢুকে গেলেন মিকি। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে। এক মিনিট হবার আগেই বেরিয়ে এসে বললেন, “ও-কে। লেট মি শো ইউ দি ফেসিলিটি রুম্‌স”।

কিথ্‌ নুজেন্টের রুমের সামনের বিশাল রুমটা হলো স্টাফ রুম। ঢুকতেই বেশ বড় একটা কিচেন। ফ্রিজ, মাইক্রোওয়েভ, ইলেকট্রিক স্টোভ, অলটাইম বয়েলিং ওয়াটার, চা, কফি সব আছে এখানে। ডিপার্টমেন্টের স্টাফ আর রিসার্চ স্টুডেন্টরা ব্যবহার করে এই কিচেন। বেশ কয়েকটি ছোট ছোট মিটিং স্পট আছে রুমের ভেতর। বিভিন্ন রিসার্চ গ্রুপের প্রোগ্রেস মিটিং হয়। ঘরের চারপাশের দেয়াল জুড়ে নিচু শেল্‌ফ-এ নানারকম ফিজিক্স রিসার্চ জার্নালের সাম্প্রতিক কপি। এই রুম অফিস আওয়ারে খোলা থাকে। আফটার আওয়ারে ঢোকার জন্য প্রত্যেকের কাছে চাবি আছে। মিকি বললেন, “ইউ উইল গেট এ কী ফর দিস রুম টু”।

অন্যদিকের করিডোরের একেবারে কোণার দিকে ছোট্ট একটা রুম- ফটোকপি রুম। দুটো ফটো-কপিয়ার আছে এখানে। একটি বেশ বড়, অন্যটি সাধারণ মানের। মিকি বললেন ডিপার্টমেন্টে আরো অনেক ফটোকপি মেশিন আছে। ছয় তলার লাইব্রেরিতে আছে দুটো, আর নিচের তলায় আছে সবচেয়ে বড় মেশিন। কয়েক শ’ পৃষ্ঠা এক সাথে ফটোকপি করতে হলে নিচের মেশিনে করা ভালো। “ইউ নিড এ ফটোকপি কার্ড টু ইউজ দিজ মেশিন্‌স”।
“কেন্‌ হ্যাজ গিভেন হিজ কার্ড টু মি” বলে কপি-কার্ডটা বের করলাম।
“ডু ইউ নো দি কোড নাম্বার?”
“কোড?”
“ফর কপিইং – সোয়াপ দিস কার্ড ইন দিস স্লট” – মেশিনের সাথে লাগানো একটা আলাদা যন্ত্র দেখালেন মিকি। সাইজে বড় একটা ক্যালকুলেটরের মত।
“দেন ইট উইল আস্ক ফর কোড নাম্বার। ডিফারেন্ট রিসার্চ গ্রুপ হ্যাজ ডিফারেন্ট কোড নাম্বার। রিটার্ন কেন্‌’স কার্ড টু কেন্‌। আই উইল গেট এনাদার কার্ড ফর ইউ ফ্রম রাসেল”।

নিচের তলায় নেমে মিকির পিছু পিছু ঢুকলাম রিসেপশানে।
“মর্নিং মিকি”
প্রথম দিন যাকে দেখেছিলাম সেই মোটা মেয়েটি।
“মর্নিং ট্রেসি। ইজ রাসেল ইন?”
“হি ইজ উইথ মিশেল”
“উই উইল ওয়েট দেন”

ট্রেসি মনে হয় হাসতে জানে না। গম্ভীর মুখে আবার কম্পিউটারে মন দিলো। দরজার কাছে দেয়ালজুড়ে অনেকগুলো ছোট ছোট মেইলবক্স। ডিপার্টমেন্টের সবার আলাদা আলাদা মেইল বক্স আছে। মিকি বললেন ডিপার্টমেন্টের সব চিঠি আগে এখানে আসে। এখান থেকে যার যার মেইলবক্সে রেখে দেয়া হয়। আমার নামেও একটা মেইল-বক্স দেয়া হবে। কবে যে চিঠি পাবো!

মিকি একটা কাঠের আলমিরা খুলে বললেন, “ইফ ইউ নিড এনি স্টেশনারি, জাস্ট টেক ইট ফ্রম হিয়ার। দেন এন্ট্রি দি আইটেম ইন দিস বুক”। আলমিরা ভর্তি খাতা, নোট-প্যাড, ফাইল, কলম, রাবার, পেন্সিল। কোন কিছুই কেনার দরকার নেই এখানে! রিসার্চ গ্রুপের নামে বাজেট থাকে। খাতায় লিখে দিলেই হলো কে কোন্‌ গ্রুপের এবং কী নিলো। আমি আসার সময় অনেকগুলো খাতা আর কলম কিনে নিয়ে এসেছি চকবাজার থেকে। তখন কি আর জানতাম যে রিসার্চের জন্য যা যা লাগে সবকিছুই দেয়া হয় এখানে।

রিসেপশানের ভেতরে আরো একটা দরজা। সেখান দিয়ে হাসতে হাসতে বেরিয়ে এলেন বেশ লম্বা একজন মহিলা। দ্রুত কী যেন বললেন আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। যাকে উদ্দেশ্য করে বললেন তাঁর দিকে চোখ গেল। কেনের বয়সী একজন মোটা-সোটা মানুষ। পরনে জিন্‌স আর কালো সোয়েটার। গলায় একটা মাফলার। মাথার লম্বা চুল ব্যান্ড দিয়ে বাঁধা।
“হ্যালো মিকি। হোয়াট্‌স আপ?” গলার স্বর ভরাট।
“হাই রাসেল। ইট্‌স প্রদীপ। কেন্‌’স নিউ স্টুডেন্ট”
“হ্যালো প্রদীপ। হাওয়াইয়া?”

রাসেলের কোমরে কোন সমস্যা আছে মনে হয়। সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না তিনি। মনে করো তুমি একটা চেয়ারে বসেছো, কিন্তু উঠতে গিয়ে দেখলে চেয়ারটা আটকে গেছে তোমার শরীরের সাথে। চেয়ারটা সহ তুমি যেভাবে দাঁড়াবে – রাসেল সেভাবে দাঁড়িয়ে আছেন, ওভাবেই হাঁটছেন। এটা কি সাময়িক – নাকি তিনি সবসময়েই এরকম আমি জানি না। সেটা কোন সমস্যা নয়। কিন্তু তাঁর ইংরেজি আমি বুঝতে পারছি না। কোন রকমে “হ্যালো” বললাম, কিন্তু ‘হাওয়াইয়া’ মানে কী? অনেকক্ষণ পরে অবশ্য বুঝতে পারলাম ‘হাওয়াইয়া’ মানে “হাউ আর ইউ”। কিন্তু ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। মিকির সাথে তাঁর কী কী যেন কথা হলো। আমি মিকির সাথে রাসেলের রুমে ঢুকে তার ডেস্কের সামনের চেয়ারে বসে পড়েছি। এতক্ষণ পরে হঠাৎ করে যদি বলি “আই এম ফাইন” – বুঝতে পারছো কী অবস্থা হবে?

রাসেলের কাছ থেকে একটা ফটো-কপি কার্ড পেলাম। রাসেল বললেন, “ডোন্‌ফরগাডাকোডাম্বার সেক্সটিন”। কী ঝামেলায় পড়লাম রে বাবা! এটা কী ধরণের ইংরেজি? আমার অবস্থা হয়েছে পুরনো টিউব লাইটের মত – সুইচ টেপার অনেকক্ষণ পরে জ্বলে। একেকটা শব্দ শুনি আর মাথার ভেতর অনেকক্ষণ ধরে চলে ওটার জট ছাড়ানো- তারপর বুঝতে পারি। “ডোন্‌ফরগাডাকোডাম্বার সেক্সটিন” মানে হলো “ডোন্ট ফরগেট দি কোড নাম্বার সিক্সটিন”।

চাবির জন্য যেতে হবে বিল্ডিং সুপারভাইজারের অফিসে। মেইন ফিজিক্স বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে আরেকটি বিল্ডিং – নিউক্লিয়ার ফিজিক্স ল্যাবোরেটরি। তার সাথে লাগানো দুটো বড় বড় লেকচার থিয়েটার – লেবি ও হার্‌কাস। বিল্ডিং সুপারভাইজারের অফিস হলো এই দুটো লেকচার থিয়েটারের মাঝামাঝি। মিকির সাথে সেদিকেই যাচ্ছিলাম। পথে দেখা গেলো একজন আধবুড়ো লোক একটা ট্রলিতে করে অনেকগুলো কাগজের প্যাকেট নিয়ে আসছে। কাছাকাছি আসতেই মিকি বললেন, “হিয়ার হি ইজ। রন্‌ দিজ ইজ প্রদীপ। কেন্‌’স নিউ স্টুডেন্ট। হি নিড্‌স সাম কী-জ্‌”।

ইনিই বিল্ডিং সুপারভাইজার! দেখে তো মনে হচ্ছে ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের পিয়ন। এ রকম কাগজ-টাগজ সাপ্লাই দেয়া তো পিয়নদের কাজ। এখানে তো দেখছি সুপারভাইজারদেরও নিজের হাতে কাজ করতে হয়। রন্‌ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন,
“গুডামাইড। হাওয়াইয়া?”
‘হাওয়াইয়া’ বুঝলাম, কিন্তু ‘গুডামাইড’ মানে কী? কোন রকমে বললাম, “গুড”।

রন্‌ মিকির সাথে তার অদ্ভুত বাচনভঙ্গিতে কিছুক্ষণ কথা বললেন। যেটুকু বুঝলাম তাতে মনে হচ্ছে এখন তিনি চাবি দিতে পারবেন না। মিকি বুঝতে পারলেন আমার অবস্থা। বললেন, “হি উইল কাম টু হিস অফিস ইন ফিফ্‌টিন মিনিট্‌স। ইউ ক্যান কাম দেন”। রনের সাথে চলে যাবার জন্য পা বাড়ালেন মিকি। মনে হলো মিকিকে একটা ধন্যবাদ দেয়া দরকার। কথায় কথায় ‘থ্যাংক ইউ’ বলার অভ্যাস করে ফেলতে হবে।
“থ্যাংক ইউ মিকি”
“ইট্‌স অলরাইট” বলে হঠাৎ ঘুরে দাঁড়ালেন মিকি। বললেন, “আই ফরগেট টু টেল ইউ, দেয়ার ইজ এ ওয়েলকাম রিসেপশান ফর ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস ইন দি গ্রাজুয়েট সেন্টার এট্‌ ইলেভেন”।

গ্র্যাজুয়েট সেন্টারের রিসেপশানের কথা আমার মনে ছিল। গতকালের ওরিয়েন্টেশান ব্যাগে এই অনুষ্ঠানের ইনভাইটেশান কার্ড পেয়েছি। এগারোটা বাজতে এখনো প্রায় সোয়া ঘন্টা বাকি। পনেরো মিনিট পরে আসতে হবে রনের অফিসে। কেনের কপি-কার্ডটা ফেরত দেয়া দরকার। আর আমারটাতে কম্পিউটার রুম আর লাইব্রেরির এক্সেস কোড সেট করে নিতে হবে। মিকি চলে গেলেন রনের সাথে। আমি চললাম চারতলায় ডঃ মার্ক মনরোর সাথে দেখা করতে।

মার্ক কম্পিউটার রুমেই ছিলেন। আমাকে দেখে চিনতে পারলেন। বললাম, আমি নতুন কপি-কার্ড পেয়েছি, এটাতে লাইব্রেরি আর কম্পিউটার রুমের এন্ট্রি-কোড সেট করে দিতে হবে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই কাজ হয়ে গেল।

এবার কেনের কাছে। কেনের অফিসের সামনে ছোটখাট একটা ভীড়। চুল-লম্বা ছেলেটিকে দেখা যাচ্ছে – করিডোরে দাঁড়িয়ে কেনের উদ্দেশ্যে কিছু বলছে। এত দ্রুত বলছে যে আমার পক্ষে বোঝা দুঃসাধ্য। আমাকে দেখেই কেন্‌ হাসি মুখে বললেন, “মর্নিং প্রাডিব। হ্যাভ ইউ মেট পিটার? পিটার – প্রাডিব”
“হাই প্রাডিব। উই মেট অন মানডে আই থিংক”

কেনের কপি-কার্ডটা পকেট থেকে বের করে বললাম, “রাসেল গেইভ মি এ কপি-কার্ড। হিয়ার ইজ ইওর্‌স”
“ইয়েস। রাসেল টোল্ড মি। থ্যাংক্‌স ফর দিস। হ্যাভ ইউ গট ইওর কী?
“আই এম গোয়িং টু গেট টু-ডে”

কেন্‌ আমার সাথে কথা বলার সময় খুব ধীরে ধীরে কথা বলেন। ফলে তাঁর কথা বুঝতে আমার তেমন অসুবিধা হয় না। আহা, সবাই যদি এমন হতো ইংরেজি নিয়ে আমার আর কোন সমস্যাই থাকতো না।

কেনের অফিসের সামনের রুমের দরজা খোলা। পিটার কেনের সাথে কথা শেষ করে এসে বসেছে কম্পিউটারের সামনে। করিডোর থেকেই দেখা যাচ্ছে আমার ডেস্ক। এখনো খালি। আজ চাবি পেলে কাল থেকে বই-খাতা কিছু এখানে এনে রাখতে হবে। রন্‌ এতক্ষণে নিশ্চয়ই ফিরেছে তার অফিসে। গিয়ে দেখি চাবি পাই কি না।

অফিসের বাইরে ছোট্ট একটা সাইনবোর্ডঃ ‘রন্‌ হাওয়ার্ড, বিল্ডিং সুপারভাইজার, স্কুল অব ফিজিক্স’। রন্‌ হাওয়ার্ড কি অস্ট্রেলিয়ার প্রধান মন্ত্রী জন হাওয়ার্ডের ভাই? হলেও হতে পারে। অস্ট্রেলিয়ায় বিল্ডিং সুপারভাইজারের ভাই প্রধান মন্ত্রী হতেও পারে। দরজা আংশিক খোলা। নক করতেই রনের গলা, “কামিন্মাইট”। রনের ইংরেজি এরকম কেন? ঢুকতে বলছে নিশ্চয়। রুমে ঢুকলাম। বিশাল একটা রুম। রুমের ভেতর ট্রলি, চাকা লাগানো টেবিল, চেয়ার, দুটো বড় বড় টেলিভিশন, আরো কত সব জিনিসে ভর্তি। এটা কি গুদাম ঘর নাকি? এক কোণায় একটা মানুষের কংকাল দেখা যাচ্ছে।

ছোট্ট একটা টেবিলে বসে কাজ করছেন রন্‌। পেছনে অনেকগুলো ফাইল ক্যাবিনেট। এই রুমে একটাও জানালা নেই।
“হাই রন্‌, আই নিড কি-জ ফর মাই অফিস রুম”
“ইয়াপ্‌। ইয়া নিড আকি ফর ইওর অফিস। আকি ফর বিল্ডিং আন্ড আকি ফর মাইল-বক্স আন্ড আকি ফর স্টাফরুম। ইয়া নিড ফর্‌কিজ”

খুব ভালো করে খেয়াল করলাম রন্‌ কীভাবে কথা বলেন। এ’র উচ্চারণ তিনি করেন আ। যেমন- মেইল-বক্সকে তিনি বললেন মাইল-বক্স। হাতের আঙুল গোণা দেখে বুঝেছি তিনি বলছেন আমার মোট চারটি চাবি লাগবে। ফর্‌কিজ – মানে ফোর কিজ। মনে মনে বললাম, মিস্টার রন্‌ আই আন্ডারস্ট্যান্ড ইউ।

“নোইয়া রুম নাম্বা?”
নিশ্চয় রুম নাম্বার জিজ্ঞেস করছে। বললাম, “সিক্স ওয়ান টু”
“সিক্স হান্ড্রেড আন্ড টুয়াল্ভ” বলতে বলতে উঠে দেয়ালের কাছে চলে গেলেন রন্‌। সেখানে একটা বোর্ডে লাগানো সারি সারি চাবি। চার জায়গা থেকে চারটি চাবি নিয়ে ডেস্কে ফিরে এলেন রন্‌। ফাইল ক্যাবিনেট খুলে একটা ফাইল বের করতে করতে বললেন, “ইয়ানিট্টু ঘিমি টুয়ান্টি বাক্‌স”

‘নিট্টু ঘিমি’ বুঝলাম – নিড্‌ টু গিভ মি। কিন্তু বাক্‌স মানে কী? বক্স? মানে বাক্‌সো? তাকে বিশটি বাক্‌সো দিতে হবে? কিসের বাক্‌সো? আম্‌তা আম্‌তা করে বললাম, “টুয়েন্ট বাক্‌স?”
“ইয়াপ্,। ফাইভ বাক্‌স পার্‌কি” বলতে বলতে একটা রেজিস্ট্রার বের করে লিখতে শুরু করলেন।
“ডুইয়া হাভ ইয়ার স্টুডান্ট আই-ডি উইদিয়া?”

রনের সাথে কথা বলতে গিয়ে আমার কান অনেক শার্প হয়ে গেছে। তিনি আমার স্টুডেন্ট কার্ড চাচ্ছেন। বের করে দিলাম। দেখলাম রন্‌ রেজিস্টারে আমার নামে কোন্‌ রুমের জন্য কোন্‌ নাম্বারের চাবি দিলেন – লিখে রাখছেন। চাবির নাম্বারের পাশের কলামে লিখেছেন $5.00। এবার বুঝলাম ‘বাক্‌’ মানে ডলার। বিশ ডলারের একটি নোট রনের হাতে দিলাম। চারটি চাবির জন্য চারটি স্বাক্ষর করতে হলো। এখন থেকে ফিজিক্স বিল্ডিং এ যে কোন সময় ঢুকতে পারবো আমি।

ছয় তলায় উঠে লাইব্রেরিতে ঢুকলাম। লাইব্রেরির নিয়ম কানুন একটু শিখে রাখা দরকার। ডেস্কে বসে কাজ করছেন কমলা। আমি কাউন্টারে দাঁড়াতেই ডেস্ক ছেড়ে হাসি মুখে কাউন্টারে এলেন।
“হ্যালো, হাউ ক্যান আই হেল্প ইউ?”
“আই ওয়ান্ট টু নো – হাউ টু বরো বুক্‌স ফ্রম লাইব্রেরি”
“ডু ইউ হ্যাভ ইওর স্টুডেন্ট আই-ডি?”

কমলা খুব হেল্পফুল। তাঁর সাহায্যে কিছুক্ষণের মধ্যেই আমি জেনে গেলাম অনেক কিছু। স্টুডেন্ট কার্ড-ই লাইব্রেরি কার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হবে। কার্ডে বার-কোড দেয়া আছে। ওটাই আমার লাইব্রেরির একাউন্ট নাম্বার। এই ইউনিভার্সিটিতে ছোট-বড় বিশটি লাইব্রেরি আছে। যে কোন লাইব্রেরি থেকে বই ধার করা যাবে। পোস্ট-গ্র্যাড স্টুডেন্ট হিসেবে আমি এক সাথে ষাটটি বই ধার করতে পারবো চার সপ্তাহের জন্য। এর পর দরকার হলে বইগুলো আরো দু’বার রিনিউ করা যাবে। লাইব্রেরির ভেতর বেশ কিছু কম্পিউটার রাখা আছে। সেখানে লাইব্রেরিতে কী কী বই আছে, কোন্‌ শাখায় আছে সব তথ্য জানা যায়। কমলা লাইব্রেরি সংক্রান্ত কিছু পুস্তিকা দিলেন। ফিজিক্স রিসার্চ লাইব্রেরি দেখেই আমি আত্মহারা। অথচ কমলা বললেন এই লাইব্রেরিটা হলো ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ছোটটি। আরো সব লাইব্রেরি দেখার জন্য অস্থির হয়ে উঠছি।

এগারোটা বাজার পনেরো মিনিট আগে ১৮৮৮ বিল্ডিং এ ঢুকলাম। আজকের রিসেপশানটির আয়োজক ‘ইউনিভার্সিটি অব মেলবোর্ন পোস্ট গ্র্যাজুয়েট এসোসিয়েশান’ বা ‘উম্‌পা’। দোতলার সেমিনার হলে হবে এই অনুষ্ঠান। কাঠের প্রশস্ত সিঁড়ি – আগাগোড়া পুরু কার্পেটে মোড়ানো।
“হ্যালো”

তাকিয়ে দেখি সিঁড়ির মুখে দাঁড়িয়ে আছেন একজন কালো জ্যাকেট পরা যুবক। গায়ের রঙ আমার মতই, উচ্চতা মাঝারি, মুখে ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। ডান হাত বাড়িয়ে আছেন হ্যান্ডশেক করার জন্য আর বাম হাত জ্যাকেটের পকেটে।
“হাই”
“ওয়েলকাম। মাই নেম ইজ ভিনু। আই এম ভাইস প্রেসিডেন্ট অব ইন্টারন্যাশনাল পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট ইউনিয়ন”।

আমি তো মোহিত হয়ে গেলাম। স্টুডেন্ট ইউনিয়নের ভি-পি নিজে দাঁড়িয়ে আছেন ওয়েলকাম জানানোর জন্য। আমাদের দেশের ডাকসু, চাকসু, রাকসু’র ভিপিরা কখনো এভাবে একা দাঁড়িয়ে একজন সাধারণ ছাত্রকে ওয়েলকাম জানাচ্ছেন – ভাবাই যায় না।

বেশ বড় হলঘর। উঁচু কাঠের দরজা। ঢোকার সময় একটা কাগজে নিজের নাম আর দেশের নাম লিখতে হলো। আরেকটি স্টিকারে নিজের নাম আর দেশের নাম লিখে বুকে লাগিয়ে দেয়া হলো। ব্যবস্থাটা বেশ ভালো লাগলো। বার বার নিজের নাম আর দেশের নাম বলতে হবে না। স্টিকার দেখেই নাম আর জাতীয়তা জানা যাবে।

বিভিন্ন দেশের শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন জায়গায় জড়ো হয়ে কথা বলছে। দেশের বাইরে এসে নিজের দেশের কাউকে পেলে কী যে ভালো লাগে! আমি এখনো বাংলাদেশের কাউকে পাইনি। চারদিকে চোখ বুলাচ্ছি – বাংলাদেশীদের মত কাউকে দেখা যায় কি না। সালোয়ার কামিজ পরা কয়েকজন মেয়েকে দেখলাম একেবারে সামনের দিকে। কাছে গিয়ে তাদের কথোপকথন শোনার চেষ্টা করলাম – যদি বাংলা শোনা যায়। না – তারা হিন্দিতে কথা বলছে। আবার পেছনে চলে এলাম। ‘হাই’ ‘হ্যালো’ করছি – আর চোখ রাখছি তাদের স্টিকারে। প্রচুর চায়নিজ, মালয়েশিয়ান, ইন্দোনেশিয়ান, আর ইউরোপের বিভিন্ন দেশের ছেলে-মেয়ে। ইন্ডিয়ানও আছে অনেক। বাংলাদেশী চোখে পড়লো না একজনও।

হলের মাঝামাঝি একটা সিটে বসে পড়লাম। একই সারিতে আমার পাশের কয়েকটা চেয়ার খালি রেখে বসেছে তিনজন মেয়ে – পরনে জিন্‌স আর মোটা জ্যাকেট – কিন্তু মাথায় হিজাব। বেশ উচ্চস্বরে কথা বলছে তারা। মনে হচ্ছে ইন্দোনেশিয়ান।

“হিয়ার ইউ আর” –
চমকে পাশ ফিরে দেখি কারস্টিন। টকটকে লাল একটা জ্যাকেট পরনে আর পিঠের বিশেষ ব্যাগে তার প্রিয় সঙ্গী লুসি। কারস্টিন বসলো আমার পাশের সিটে। মুখ বাঁধা না থাকলে লুসি এতক্ষণে চিৎকার করে প্রতিবাদ জানাতো।

“হাউ আর ইউ?”
কারস্টিনের প্রশ্ন। অদ্ভুত একটা গন্ধ এসে নাকে লাগলো। বুঝতে পারছি না কার গা থেকে আসছে – কারস্টিনের নাকি লুসির। যথাসম্ভব ক্যাজুয়েলি বললাম, “গুড। হাউ আর ইউ?”
“ভেরি গুড। হাউ ইজ দি হোস্টেল?”
“হোস্টেল ইজ গুড”
“উই আর অল্‌সো মুভিং আউট টুমরো”
“হোয়ার?”
“ব্রাঞ্চউইক”

কারস্টিন বলে যাচ্ছে মেলবোর্নে বাড়ি খোঁজা কত ঝামেলা। বেশির ভাগ ভাড়া-বাড়িতে পেট্‌স এলাউড না। লুসিকে থাকতে না দিলে তারা থাকে কীভাবে! অবশেষে তার হাজবেন্ড উল্‌রিখ কাল সারা বিকেল ঘুরে এই বাড়িটি জোগাড় করেছে।
“ইউ স উল্‌রিখ ইয়েস্‌টারডে”

হোটেলের সেই ছ’ফুটি সাদা দৈত্যটাই তাহলে উল্‌রিখ, কারস্টিনের হাজবেন্ড। তাকে আমার দেখা না দেখায় কারো কিছু যায় আসে না। কারস্টিন কথা বলতে ভালবাসে। আইনের ছাত্রী বলেই হয়তো – কথায় প্রচুর ডিটেল্‌স। তাদের বাড়িটিতে ক’টি রুম, ব্রাঞ্চউইক ইউনিভার্সিটি থেকে কত দূরে, কোন্‌ ট্রামে যেতে হয় – বলেই যাচ্ছে।

“নাইস ডগ। হোয়াট্‌স হিজ নেম?”
পেছনের সারি থেকে প্রশ্নটা এসেছে। কারস্টিন আর আমি দু’জনই ফিরে তাকালাম। একজন সুদর্শন শ্বেতাঙ্গ যুবক। ভালো করে তার দিকে তাকানোর আগেই উচ্ছসিত কারস্টিন।
“নট্‌ হিজ, হার – নেম লুসি”
“লুসি, নাইস নেম্‌” বলে ছেলেটি লুসির মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতে শুরু করলো। মুহূর্তেই কারস্টিনের সমস্ত মনযোগ যুবকটির দিকে। আমাকে যেন সে চেনেই না।

“গুড মর্নিং এন্ড ওয়েলকাম” – মাইক্রোফোনের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন একজন প্রৌঢ়।
“মাই নেম ইজ জন রস্‌। আই এম দি ডিরেক্টর অব গ্র্যাজুয়েট সেন্টার”

প্রফেসর রস সত্যিই খুব রসিক মানুষ। সুন্দর করে কথা বলেন। সবগুলো শব্দের অর্থ ঠিক ঠিক বুঝতে না পারলেও তাঁর বক্তব্য মোটামুটি বুঝতে পেরেছি। তাঁর পরে গ্র্যাজুয়েট সেন্টারের ম্যানেজার ন্যান্সি ডোভার বক্তৃতা দিলেন। অনেক কিছু জানা গেলো তাঁদের কথা থেকে। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের জন্য – বিশেষ করে কোর্স-ওয়ার্ক যারা করছে তাদের জন্য এই সেন্টারে অনেক সুযোগ সুবিধা আছে। তিনতলায় ছোট ছোট পার্সোনাল স্টাডি রুম আছে। পোস্ট-গ্র্যাড স্টুডেন্টরা এপ্লিকেশান করে এই রুম-গুলো পড়াশোনার কাজে ব্যবহার করতে পারে। থিসিস লেখার জন্য নিরুপদ্রব রুমের দরকার হলে থিসিস জমা দেয়ার ছ’মাস আগে থেকে কিছু রুম পাওয়া যায়। যেখানে কম্পিউটার, প্রিন্টার সব ব্যবস্থা আছে। এই বিল্ডিং-এই থিসিস বাইন্ডিং এর ব্যবস্থা আছে। ইংরেজি যাদের মাতৃভাষা নয় – তাদের ইংরেজিতে লেখা থিসিস জমা দেয়ার আগে চেক করিয়ে নেয়ার ব্যবস্থা আছে। ছোট-বড় অনেকগুলো কিচেন আছে, বাথরুম আছে, শাওয়ার নেবার ব্যবস্থা আছে। পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্টদের সব রকমের সাহায্য করাই এই সেন্টারের প্রধান কাজ। আর যারা পি-এইচ-ডি করছে তাদের নিজেদের ডিপার্টমেন্টেই অফিস, ডেস্ক, টেলিফোন, কম্পিউটার ইত্যাদির ব্যবস্থা করছে। যেমন আমি আজ সকালেই সব কিছুর চাবি পেয়েছি।

পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টদের পক্ষ থেকে বক্তৃতা দিলো ভিনু। তার বক্তৃতা কেমন যেন একটু আক্রমণাত্মক। তার বক্তব্য হলো ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা লোকাল স্টুডেন্টদের চেয়ে অনেক বেশি টিউশন ফি দেয়, কিন্তু সুযোগ সুবিধা পায় অনেক কম। অস্ট্রেলিয়ানরা বিদেশী শিক্ষার্থীদের টাকায় নিজেদের শিক্ষার্থীর উন্নয়ন ঘটাচ্ছে। পৃথিবীর সব দেশের নিয়মই তো এরকম। বাংলাদেশ থেকে অনেক শিক্ষার্থী ইন্ডিয়ায় পড়তে যায়। তারাও নিশ্চয় ইন্ডিয়ান স্টুডেন্টদের চেয়ে বেশি বেতন দিয়ে পড়াশোনা করে সেখানে। এদেশে পড়তে আসা শিক্ষার্থীদের কাছে কোন তথ্য তো এরা গোপন করে নি। ভিনুর সাথে পুরোটা একমত হতে না পারলেও তার বক্তব্যে কেউ বাধা দিলো না। মনে হচ্ছে মতামত প্রকাশের সম্পূর্ণ স্বাধীনতা আছে এদেশে।

বক্তৃতা শেষে চা-কফি-কেক-বিস্কুট। লাইনে দাঁড়িয়ে সেল্‌ফ সার্ভিস। কারস্টিন আর পেছনের যুবকটি আবারো গল্প শুরু করেছে। আমি চুপচাপ সরে এলাম অন্যদিকে। গতকালের মৌলভী সাহেবকে দেখা গেলো। কালো জ্যাকেটের বুকে সাদা স্টিকারে লেখা- জিয়াউদ্দিন খান, বাংলাদেশ।

ইনি বাংলাদেশের মানুষ! দ্রুত সামনে গিয়ে বাংলায় বললাম, “ভাইয়া, আপনি বাংলাদেশের?”
“আরে, তুমিও বাংলাদেশের! আমি আরো ভাবছিলাম – বাংলাদেশ থেকে বুঝি আমি একা”

তারপর সময় যেন উড়ে চলে গেল কিছুক্ষণ। জিয়াউদ্দিন সাহেব বুয়েট থেকে পাস করে সিঙ্গাপুরে চাকরি করেছেন কয়েক বছর ধরে। এখন এ-ডি-বি স্কলারশিপ নিয়ে এখানে এসেছেন এনভায়রেন্টাল ইঞ্জিনিয়ারিং এ মাস্টার্স করতে। নিজের মুখেই বললেন,
“বড় চমৎকার স্কলারশিপ এই এ-ডি-বি স্কলারশিপ। টিউশন ফি, প্লেন ফেয়ার, মেডিকেল এগুলো তো দেবেই – তার ওপর থাকা-খাওয়ার জন্য বছরে বাইশ হাজার ডলার, বই কেনার জন্য আরো পাঁচ হাজার। এত লাগে না-কি?”

এ-ডি-বি স্কলারশিপ পাওয়ার জন্য শক্ত খুঁটি দরকার। বুঝলাম জিয়াউদ্দিন খান সাহেবের খুঁটির জোর অনেক। একটু ঈর্ষা হচ্ছে আমার। কিছু বলার আগেই হঠাৎ প্রশ্ন করলেন তিনি – “খাবার দাবার কোত্থেকে কিন্‌ছো?”
“সেইফ-ওয়ে থেকে”
“ওসব তো হালাল না”

আমি একটু অবাক হলাম। আমার ক্ষেত্রে হালাল হারামের প্রশ্ন আসছে কোত্থেকে? নিজের বুকে লাগানো স্টিকারের ওপর হাত বুলিয়ে নিশ্চিত হলাম যে ওটা এখনো আছে ওখানে। হয়তো জিয়াউদ্দিন খানের নজর পড়েনি সেখানে। বললাম,
“ভাইয়া, আমার জন্য যে কোন খাবারই হালাল”
“নাউজুবিল্লাহ্‌, আজে বাজে কথা বলবে না। মসজিদে তো দেখি না তোমাকে। নামাজ কোথায় পড়?”
“নামাজ তো কখনো পড়ি নাই ভাইয়া, কীভাবে পড়তে হয় তাও জানি না”
“মালাউনদের মত কথা বলছো কেন?”
“জ্বি, আমি তো মালাউনের বাচ্চা”

এতক্ষণে তাঁর নজর গেল আমার নামের দিকে। দাড়ি-সমৃদ্ধ মুখের অভিব্যক্তি বোঝা গেল না। মনে হলো চোখে এক ধরণের ঘৃণার আগুন জ্বলে উঠলো। সেদিন আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল যে সব মাতাল যুবক – তাদের চোখেও আমি এ ধরণের ঘৃণা দেখেছিলাম।
“চলো চা-বিস্কিট খাওয়া যাক”
প্রসঙ্গ পাল্টালেন খান সাহেব। আমার মনটা তেতো হয়ে গেছে। বললাম, “এখানের চা-বিস্কুট হালাল না ভাইয়া”
খান সাহেব আর কিছু না বলে দ্রুত চলে গেলেন অন্যদিকে।

গ্র্যাজুয়েট সেন্টার ঘুরিয়ে দেখানোর ব্যবস্থা করা হলো একটু পর। দুটো গ্রুপ করা হলো। একটা গ্রুপের গাইড হলো ভিনু। তার দলে বেশির ভাগই ইন্ডিয়ান ছেলে-মেয়ে। ইন্ডিয়ার বিভিন্ন প্রদেশ থেকে এসেছে বলেই হয়তো – ইংরেজিতে কথা বলছে সবাই এখন। ইন্ডিয়ানদের ইংরেজিতে এক ধরণের অন্যরকম একটা টান আছে। খট্‌ করে কানে লাগে।

ভিনু গ্র্যাজুয়েট সেন্টারের ফ্যাসিলিটিজগুলো দেখালো। বাঁ হাত জ্যাকেটের পকেটে আর ডান হাতের তর্জনি উঁচিয়ে ভিনু যখন বিভিন্ন রুমের বর্ণনা দিচ্ছিলো – মনে হচ্ছিলো লিডারশিপ ব্যাপারটা আছে তার মধ্যে। ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্ট ইউনিয়নের ভি-পি তো সে এমনি এমনি হয়নি।

ট্যুর শেষে তাকে জিজ্ঞেস করলাম- বাসা খোঁজার সহজ উপায় কী? ভিনু জিজ্ঞেস করলো আমার বাজেট কত? খুবই বেসিক প্রশ্ন। আসলেই তো আমার বাজেট কত? সপ্তাহে আমি কত দিতে পারবো বাসা ভাড়া বাবদ? ঠিক জানি না। সে-ই সাহায্য করলো আমাকে। বললোঃ সপ্তাহে সত্তর-পঁচাত্তর ডলারের নিচে শেয়ার একোমোডেশান পাওয়া মুস্কিল। স্টুডেন্ট সাপোর্ট সেন্টারে খোঁজ নিতে বললো। আমার বর্তমান হোস্টেলের ঠিকানা আর রুম নাম্বার চেয়ে নিলো সে। ইন্টারন্যাশনাল পোস্ট-গ্র্যাজুয়েট স্টুডেন্ট ইউনিয়ন বা ইপ্‌সুর ভি-পির সাথে সরাসরি কথা বলতে পেরে বেশ ভালোই লাগলো।

ইউনিয়ন হাউজের ফুড-কোর্টে ঢোকার আগে দেয়ালে একটা বিশাল নোটিশ বোর্ড আছে। এখানে ঘরভাড়ার বিজ্ঞাপন থাকে। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পড়লাম অনেক। সবগুলোই শেয়ারে থাকার বিজ্ঞাপন। একটা একটা রুম – কোনটাতে আবার একটা রুমে দু’জন। ৭০-৮০ ডলারের নিচে যেগুলো আছে – সেগুলো মনে হচ্ছে ইউনিভার্সিটি থেকে অনেক দূরে। কোন্‌ এলাকা কত দূরে তা আগে জানা দরকার। স্টুডেন্ট সাপোর্ট সেন্টারে গেলে জানা যাবে নিশ্চয়।

ইউনিয়ন হাউজ থেকে বেরিয়ে স্পোর্টস সেন্টারের দিকে হাঁটলে যে রাস্তা পড়ে – তার নাম ‘টিন এলে’। রাস্তার নাম এরকম কেন – আমাকে জিজ্ঞেস করো না। এখানেই স্টুডেন্ট সাপোর্ট সেন্টার। আজ অনেক ভীড়। কর্মখালির বিজ্ঞাপনের সামনে খাতা-কলম হাতে অনেক স্টুডেন্ট। পার্ট-টাইম কাজ খুঁজছে। বাসা-ভাড়ার বিজ্ঞপ্তিগুলো এরিয়ার ভিত্তিতে দেয়া আছে। এখানে পার্ট-টাইম কাজের জন্য রেজিস্ট্রেশান করিয়ে রাখা যায়। পছন্দের কোন কাজ এলে এরা ফোন করে জানাবে দরখাস্ত করার জন্য। এক কোণায় বাসা-ভাড়ার পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

আমি জানতে চাইলাম এখানে বাসা ভাড়া পাওয়ার সিস্টেমটা কী। সিস্টেমটা বেশ সোজা। অন্তঃত বাংলাদেশে বাসা খোঁজার চেয়ে শতগুণ সোজা। নিজের নামে একটা বাসা ভাড়া করতে হলে প্রথমে রিয়েল-এস্টেট এজেন্টগুলোতে যেতে হবে। তাদের কাছে খালি বাসার লিস্ট থাকে। কয়টা বেড-রুম, কোন্‌ এলাকা ইত্যাদি দেখে কয়েকটি বাসা প্রাথমিক ভাবে নির্বাচন করতে হবে। পরে রিয়েল-এস্টেটের কাছ থেকে ওই বাসার চাবি নিয়ে বাসা দেখে পছন্দ হলে নির্দিষ্ট ফরমে দরখাস্ত করতে হবে। আর শেয়ারে থাকতে হলে বিজ্ঞাপন দেখে – উল্লেখিত নাম্বারে ফোন করে কথা বলতে হবে। খুব দরকারি একটা ম্যাপ পাওয়া গেল – যেখানে কোন্‌ সাবার্ব ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস থেকে কত দূরে, ট্রাম-বাস-ট্রেনে আসতে কত সময় লাগবে সব লেখা আছে। বাসা খোঁজার ব্যাপারটা মনে হচ্ছে বুঝতে পারছি আস্তে আস্তে। শুধু ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টরা বাসা খুঁজলে কোন সমস্যা ছিল না। দেখা যাচ্ছে বাসা যারা খুঁজছে তাদের বেশির ভাগই লোকাল অস্ট্রেলিয়ান। এদেশে ইউনিভার্সিটিতে পড়ুয়ারা মা-বাবার সাথে থাকে না কেউ। তাতে নাকি তাদের মান যায়! বড় অদ্ভুত এদের মানের যাওয়া-আসা।

সাপোর্ট সেন্টার থেকে কয়েকটি রিয়েল-এস্টেট অফিসের ঠিকানা আর ম্যাপ নিয়েছি। রাথ্‌ডাউনি স্ট্রিটের থমসন রিয়েল এস্টেটে গিয়ে কিছুটা অভিজ্ঞতা হলো। কাচের দরজা ঠেলে ঢুকলাম ভেতরে। দেয়ালে লাগানো অসংখ্য বাড়ির ছবি। সব ‘ফর সেল’। কাউন্টারের সামনে বেশ কয়েকটা প্লাস্টিকের খোপে রাখা আছে রেন্টাল লিস্ট। দেখলাম আজকের তারিখ দেয়া। একেবারে কারেন্ট লিস্ট। সাপোর্ট সেন্টার থেকে শিখে এসেছি কিছু টার্ম – যেমন হাউজ বলতে পুরো একটা বাড়ি বোঝায়, যেখানে সামনে পেছনে লন আছে, গ্যারেজ আছে ইত্যাদি। বাড়ির সামর্থ্য আমার নেই, তাই দরকারও নেই। একটা ওয়ান বেড-রুম এপার্টমেন্ট হলে চলে আমার।

রেন্টাল লিস্টে দুটো ওয়ান বেডরুম এপার্টমেন্ট দেখা যাচ্ছে। ব্রাঞ্চউইকে – মিশেল স্ট্রিটে। ভাড়া সপ্তাহে ১১০ ডলার। ওয়ান বেড-রুমে একটা বেড-রুম থাকে, একটা লাউঞ্জ রুম থাকে, কিচেন আর বাথরুম তো থাকেই। অনায়াসে দু’জন থাকা যায়। ভাড়া নিয়ে পরে আরেকজনের সাথে শেয়ার করলে সপ্তাহে ভাড়া পড়বে ৫৫ ডলার। খুব একটা বেশি নয়।

কাউন্টারের মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম বাসা দুটো আছে কি-না। বললো, “ইয়েস, দে আর এভয়েলভল। ওয়ান্ট টু সি?”
দুটো বাসাই দেখে আসতে পারি যদি চাবি পাই। জানা গেলো একেকটা চাবির জন্য পঞ্চাশ ডলার করে জমা দিতে হবে। মোট একশ ডলার। এক শ’ ডলার আছে আমার কাছে। বিশ ডলারের পাঁচটি নোট বের করলাম। মেয়েটি জিজ্ঞেস করলো,
“ডু ইউ হ্যাভ এ কার?”
“নো”
“হাউ উইল ইউ গো দেয়ার?”
“বাই ট্রাম”
“ইউ হ্যাভ টু রিটার্ন দি কিজ উইদিন এন আওয়ার”

একঘন্টার ভেতর ওখানে গিয়ে আবার আসা যাবে কি না আমি জানি না। মিশেল স্ট্রিট ঠিক কোথায় তাও জানি না। কাউন্টারে বেশ বড় এরিয়া ম্যাপ আছে অনেকগুলো। সেখান থেকে একটা নিয়েছি। মেয়েটি বেশ হেল্পফুল। ম্যাপে কলম দিয়ে এঁকে দেখিয়ে দিল কীভাবে যেতে হবে।
আমি পাঁচটি বিশ ডলারের নোট আবার গুণে বললাম,
“হান্ড্রেড ডলার”
“গিভ মি এ মিনিট, লেট মি গেট দি কি-জ”

চাবি আনতে ভেতরে চলে গেল। বেশ ছিমছাম অফিস। সবকিছু ঝকঝকে পরিষ্কার। ভেতরে অনেকগুলো ছোট ছোট রুম কাউন্টার থেকে দেখা যাচ্ছে। সেখানে কাজ করছে যারা সবাই কালো স্যুট পরেছে। থমসন কোম্পানির অফিসিয়াল ড্রেস। স্যুট পরা মেয়েদের কী যে স্মার্ট লাগে। পোশাক অবশ্যই স্মার্ট করে মানুষকে।

এলোমেলো চিন্তা করতে করতে অপেক্ষা করছি – কখন চাবি নিয়ে আসবে মেয়েটি। কাউন্টার থেকে দেখতে পাচ্ছি মেয়েটি কথা বলছে একজন যুবকের সাথে। কী কথা কে জানে। যা খুশি কথা বলুক, যত খুশি কথা বলুক। সে তো আর সুরঞ্জনা নয় যে আমি বলবো “বলনাকো কথা ওই যুবকের সাথে”। এসময় ফোন বাজলো। যে যুবকটির সাথে মেয়েটি কথা বলছে সে এসে ফোন ধরে হ্যাঁ হুঁ করে ফোন রেখে দিয়ে আমার দিকে সামান্য তাকিয়ে আবার ভেতরে চলে গেল। মেয়েটির সাথে আবার কথা বললো। এবার মেয়েটি ফিরে এলো, হাতে কোন চাবি নেই।

“সরি ফর কিপিং ইউ ওয়েটিং। দোজ প্রপার্টিজ আর নট এভয়েলেভল এট্‌ দিস মোমেন্ট। আই এম সো সরি”।
মানে কী? এতক্ষণ পরে মনে হলো যে বাসা নেই! আজকের লিস্টের বাসা আজকেই ভাড়া হয়ে গেল? নাকি যা সন্দেহ হচ্ছে তাই। আমাকে বাসা ভাড়া দেয়া হবে না! টেলিফোন রিসিভ করার নামে আমাকে এসে দেখে গেল! তারপর বাদামী চামড়া বলে বাতিল করে দিল! এরকম নাও হতে পারে। আসলেই হয়তো বাসা খালি হয়নি এখনো, মেয়েটি জানতো না। মেলবোর্নে কি বাসার অভাব? “ও-কে, থ্যাংক ইউ” বলে বেরিয়ে এলাম।

আরেকটা এজেন্সিতে খোঁজ না নিয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে বলতে পারছি না বাসা পাওয়া কত কঠিন। একই রাস্তায় কিছুদূর গিয়েই আরেকটি রিয়েল এস্টেট অফিস – হকিং স্টুয়ার্ট। অফিসের বাইরের কাচের দেয়ালভর্তি বাড়ির ছবি। সব রিয়েল-এস্টেটের অফিসের এক্সটার্নাল ডেকোরেশান মনে হয় একই রকম। হকিং স্টুয়ার্টের বারান্দাতেই রাখা আছে আজকের রেন্টাল লিস্ট। ওয়ান বেড-রুম এপার্টমেন্ট এখানেও আছে। ভাড়া মোটামুটি একই রকম – সপ্তাহে ১০০ থেকে ১২৫ এর মধ্যে। দেখা যাক চাবি আছে কি-না কোনটার।

এখানেও কাউন্টারে কাজ করছে একজন অস্ট্রেলিয়ান তরুণী। অফিস কাউন্টারে মনে হয় মেয়েরাই বেশি। লিস্টে আঙুল দিয়ে দেখালাম – এ দুটো এপার্টমেন্টের কোনটার চাবি আছে কি না। একটা পাওয়া গেলো। এবার কোন অসুবিধা হলো না। মেয়েটি কাউন্টারে দাঁড়িয়েই পঞ্চাশ ডলার নিয়ে একটা চাবি দিলো আমাকে। এক ঘন্টার মধ্যে ফিরে আসতে হবে। ম্যাপে বাসাটির অবস্থান দেখাতে দেখাতে বললো, খুব একটা দূরে নয়। দশ মিনিটের হাঁটা পথ।

এই অঞ্চলের নাম কার্লটন। ইউনিভার্সিটি থেকে খুব একটা দূরে নয়। খাঁটি রেসিডেন্সিয়াল এরিয়া। ছোট ছোট রাস্তার দু’পাশে ছোট-বড় সারি সারি বাড়ি। বাড়ির সামনে গাছ আছে অনেক, কিন্তু কোন গাছেরই পাতা নেই। শীতকালে পাতা ঝরে যায় এ সব গাছের। ডেভিড স্ট্রিট খুঁজে পেতে সমস্যা হলো না। ফুটপাতের সাথে লাগানো একতলা বাসা। বারান্দায় টিনের ছাউনি। মূল ঘরের ছাউনি দেখা যাচ্ছে না। ছোট একটা লোহার গেট পেরিয়ে বারান্দায় ঢুকলাম। কাঠের দরজা একটু নড়বড়ে মনে হলো। মনে হচ্ছে বেশ পুরনো বাসা। ভেতরে ঢুকলাম। লাইট জ্বালানোর চেষ্টা করলাম – জ্বলে না। সম্ভবত মেইন সুইচ অফ। ঢুকতেই বেশ বড় একটা রুম – এক পাশে কিচেন এরিয়া। কাঠের কিচেন কেবিনেট, দেয়ালে লাগানো স্টোরিং শেল্‌ফ। বেশ ভালো লাগছে। এটা লাউঞ্জরুম। এর পর বেডরুম। মাঝারি সাইজের রুম – সাথে লাগানো বাথরুম আর টয়লেট। বেশ পছন্দ হলো বাসা। ভাড়া সপ্তাহে ১২০ ডলার। ইউনিভার্সিটিতে হেঁটে আসা যাবে। দেখি বাসাটা পাই কি না।

দ্রুত ফিরে এলাম রিয়েল এস্টেট অফিসে। চাবি ফেরত দিয়ে পঞ্চাশ ডলার ফেরত পেলাম। মেয়েটিকে বললাম বাসা পছন্দ হয়েছে। দরখাস্ত করতে চাই। সে একটা ফরম দিলো আমাকে। তিন পৃষ্ঠার ছাপানো ফরম। বললো ফিল আপ করে সাপোর্টিং ডকুমেন্ট সহ জমা দিতে।

বাসা পাওয়া খুব সহজ মনে হচ্ছে না? সহজের এখনো দেখেছো কী। দরখাস্তের ফরমটা দেখলে তোমার মেজাজ খারাপ হয়ে যাবে। কী কী তথ্য চাচ্ছে জানো? কী চাকরি করো, উপার্জন কত? ব্যাংকের স্টেটমেন্ট দেখাও। আগে কোথায় থাকতে? রিয়েল এস্টেট এজেন্টের নাম কী? তাদের ফোন নাম্বার কত? ওভারসিজ স্টুডেন্ট হলে কোন্‌ দেশের নাগরিক? রেফারী কে? তোমাকে চেনেন এমন দু’জন ব্যক্তির ঠিকানা ও ফোন নাম্বার, রেফারেন্স লেটার। দরখাস্তের সাথে দেখাতে হবে ১০০ পয়েন্টের কাগজ-পত্র। ড্রাইভার্‌স লাইসেন্স বা পাসপোর্ট – ৫০ পয়েন্ট, ইমিগ্রেশান ভিসা – ৪০ পয়েন্ট, ব্যাংক স্টেটমেন্ট – ২০ পয়েন্ট, বেতনের স্লিপ – ৩০ পয়েন্ট এরকম লম্বা একটা লিস্ট। এখান থেকে কমপক্ষে ১০০ পয়েন্ট হয় এমন কাগজপত্র সাবমিট করতে হবে। এ-তো দেখি চাকরির দরখাস্তের চেয়েও জটিল। কাল কেনের কাছে পরামর্শ চাইবো। তিনি তো বলেছেন যে কোন ব্যাপারে নির্দ্বিধায় তাঁর কাছে যেতে।

কত দ্রুত দিন শেষ হয়ে যায় এখানে। লাইগন স্ট্রিটে কার্লটন কোর্টের সামনে দিয়ে যখন আসছিলাম – মনে হলো কিছু ডিম কিনে নেয়া যাক। হোস্টেলে তো কিচেন আছেই। সিদ্ধ করে পাউরুটি দিয়ে দিব্বি স্বাস্থ্যসম্মত ডিনার। সেফ-ওয়েতে কত রকমের যে ডিম আছে, কত রকমের প্যাকেটে পাওয়া যায়। প্যাকেট নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমার চোখ দামের দিকে। সবচেয়ে কমদামী প্যাকেট হচ্ছে হোম ব্র্যান্ডের। এক ডজনে ৭০০ গ্রাম হয় – এরকম এক প্যাকেটের দাম এক ডলার চল্লিশ সেন্ট। ডলারকে টাকায় রূপান্তর করলে দাম অনেক বেশি মনে হলেও – তুলনামূলক বিচারে এখানকার বেতন কাঠামো অনুযায়ী এখানে খাদ্যদ্রব্যের দাম কিন্তু বেশ সস্তা।

প্রায় চল্লিশ মিনিট লাগলো হেঁটে আসতে। হোস্টেলে অনেক ভীড় আজকে। বেশ বড় একটা গ্রুপ এসেছে মনে হয় বেশিক্ষণ হয়নি। কাউন্টারের সামনে চার-পাঁচজন ছেলেমেয়ের জটলা। তাদের ব্যাকপ্যাকের সাইজ দেখলে আঁৎকে উঠতে হয়। এত বড় বড় ব্যাগ কাঁধে নিয়ে ঘুরে বেড়ায় এই পাতলা পাতলা ছেলেমেয়েগুলো!

রুমে যাবার আগে কিচেনে উঁকি মারলাম। তেমন ভীড় নেই। দৌড়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠে গেলাম দোতলায়। রুমে ব্যাগটা রেখেই কিচেনে চলে যাবো। ভাবতে ভাবতে দরজা খুললাম। ভেতরে ঢুকেই চমকে উঠলাম। দুটো বিছানার উপরই ছড়ানো ছিটানো জিনিস-পত্র, জামা-কাপড়। আমার মনেই ছিল না যে এই রুমে আরো একজন আসতে পারে যে কোন সময়। সকালে যাবার সময় আমি আমার বিছানা গুছিয়ে রেখে গিয়েছিলাম। বিছানায় কোন চিহ্ন রেখে যাইনি বলেই কি এই লোকটি বুঝতে পারে নি কোন্‌ বিছানা খালি? বিছানার পাশে আমার সুটকেসটা দেখেনি? অবশ্য দুটো বিছানা এত কাছে যে বোঝার উপায় নেই সুটকেস কোন্‌ বিছানার পাশে আছে।

ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম- ছড়ানো ছিটানো জামাকাপড়গুলো মেয়েদের। মনে হচ্ছে গা থেকে খুলে খুলে ছুড়ে ফেলেছে যেদিকে খুশি। বিছানার ওপর দেয়াল ঘেঁষে রাখা ব্যাক-প্যাকটাকে মনে হচ্ছে ছোট-খাট একটা পাহাড়। এটা কাঁধে নিয়ে ঘোরে যে মেয়ে – জানিনা সে নিজে কত বড় পর্বত! অজানা অচেনা একজন মেয়ের সাথে রুম শেয়ার করতে হবে আজ! কেমন একটা অস্বস্তি হচ্ছে। কী করবো বুঝতে পারছি না। মেয়েটি জানে তো যে তার রুম-মেট একজন ছেলে! নাকি আঁৎকে উঠবে আমাকে দেখে।

দরজার বাইরে পায়ের শব্দ পাচ্ছি। এখানে রুমের দরজা বন্ধ করলেই অটো-লক হয়ে যায়। বাইরে তালা খোলার শব্দ পাচ্ছি। আমি অকারণে লকার খুলে আমার অন্যব্যাগটা দেখতে শুরু করলাম যেন কত দরকারি কাজে ব্যস্ত। দরজা খুলে যে ঢুকলো তাকে দেখে আমি যতটা অবাক হলাম আমাকে দেখে সে ততটা হলো না।
“হ্যালো”
“হাই! আই এম স্টেফি”
গায়ে জড়ানো বড় তোয়ালেটা বাঁহাতে বুকের কাছে ধরে ডান হাতটা বাড়িয়ে দিলো আমার দিকে।
“প্রদীপ”
স্টেফির হাতটা ভেজা ভেজা। স্নান করে আসছে। কাঁধ সমান লালচে চুল থেকে পানি ঝরছে এখনো। স্টেফির দৈর্ঘ্য প্রায় আমার সমান, কিন্তু প্রস্থ আমার দ্বিগুণেরও বেশি। পেশী-বহুল শরীর, মনে হচ্ছে খেলোয়াড়।
“সরি ফর দ্যা মেস। আই ডিডন্ট নো —”
আমার বিছানা থেকে তার জামা-কাপড় টেনে নিতে নিতে বললো স্টেফি। তার উচ্চারণে কড়া অস্ট্রেলিয়ান টান; কথা বুঝতে বেশ কষ্ট হচ্ছে।

আমাদের সংস্কৃতিতে জামা-কাপড় বদলানোর জন্য আমরা একটু আড়াল খুঁজে নিই। কিন্তু স্টেফির মনে হচ্ছে আড়ালের কোন দরকারই নেই। সে এমন ভাবে জামা-কাপড় পরছে যেন আমার রুমে থাকা না থাকায় তার কিছুই যায় আসে না। কিন্তু আমার এই কালচারাল শক সহ্য হলো না। ডিমের প্যাকেটটা নিয়ে বেরিয়ে সোজা কিচেনে।

চারটি ডিম সিদ্ধ করে রুমে নিয়ে এসেছি। দুটো ডিম আর দুই পিস পাউরুটি সাথে কোকাকোলা। এই হলো আজকের ডিনার। স্টেফি তখন রুমে ছিল না। রুমে বসে খেতে সমস্যা হয়নি। মনটা খচখচ করছে। দু’দিন ধরে হোস্টেলে আছি – অথচ বাড়ির কেউ জানেই না। ফোন করতে পারছি না। শতকরা সত্তর ভাগ ফ্রি টক-টাইম পাবার লোভে কী যে একটা কার্ড কিনেছি – ফোন করার চেষ্টা করতে করতেই কত ডলার খরচ হয়ে গেল! আজ একটা টেলেস্ট্রা কার্ড কিনে আনা উচিত ছিল। কাল অবশ্যই আনতে হবে। কত্তোদিন কথা হয়না আমার মামামটার সাথে।

সারাদিন অনেক হাঁটাহাঁটি হয়েছে। বেশ কাহিল লাগছে। ভাবলাম স্টেফি রুমে আসার আগেই ঘুমিয়ে যাই। লাইট নিভিয়ে খসখসে কম্বলের নিচে দাদার দেয়া শালটা আপাদমস্তক জড়িয়ে শুয়ে পড়লাম। চোখ বন্ধ করলেই তো বাংলাদেশ চলে আসে। বাবা বলেন রাতে ঘুমাতে যাবার আগে সারাদিনে কী কী করলাম তা একবার রিভিউ করার জন্য। কী ভুল করলাম, কোন্‌ কাজটা আরো ভাল ভাবে করা যেতো। এখন আমি রিভিউ করছি ঠিকই – তবে আজকের ঘটনা নয়, ফেলে আসা কোন্‌ সুদূরের ঘটনা। মিষ্টি মিষ্টি সব স্মৃতি – কত সহজেই চলে আসে মাথায়। আসে আর কষ্ট বাড়ায়।

কতক্ষণ ঘুমিয়েছি জানি না। রুমে আলো জ্বলতেই ঘুম ভেঙে গেল। স্টেফি ফিরেছে। একটু পরেই লাইট নিভিয়ে সেও ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই আমার ঘুম পালালো। কারো নাক ডাকার শব্দ যে এত বিকট এবং এত বিচিত্র রকমের হয় তুমি ভাবতে পারবে না। কখনো মনে হয় ট্যাম্পু স্টার্ট নিচ্ছে, কখনো মনে হয় – বেবি ট্যাক্সির প্লাগে ময়লা জমেছে, কখনো মনে হয় হেলিকপ্টার ল্যান্ড করছে। উপেক্ষা করার অনেক চেষ্টা করলাম। কিন্তু হলো না। শুধু শুধু শুয়ে থাকার মানে হয় না।

ছোট ব্যাগটা মাথার কাছে ছিল। নিয়ে চুপি চুপি বেরিয়ে চলে এলাম। নিচে এসে সিঁড়ির কাছের দেয়ালে লাগানো পাবলিক ফোনটা দখল করলাম। ফোন কার্ডটার একটা গতি করতে পারি কি না দেখি আবার। কিন্তু তখনো জানি না যে এই সস্তা কার্ডটির আরো কত অবস্থা দেখতে হবে। যখন প্রথম চল্লিশ সেন্ট ফেললাম ফোনের কয়েন স্লটে তখন বাজে সোয়া বারোটা। প্রথম চেষ্টাতেই লাইন পেয়ে গেলাম। ওপারে দিদিভাই’র গলা। কিন্তু একি! সে আমার কোন কথাই শুনতে পাচ্ছে না। এদিকে আমার চিৎকারে পুরো হোস্টেল জেগে ওঠার জোগাড়। লাইন কেটে গেল। আবার চেষ্টা করলাম, হলো না। লোকাল লাইনটাও কেটে গেল। ঠিক ঠিক চল্লিশ সেন্ট নেই আর। এই ফোনও কোন রিফান্ড দেয় না। পঞ্চাশ সেন্টের একটা কয়েন গেল এবার। রিং হলো। কেউ যেন ধরলো ওদিকে, কিন্তু আমি কিছুই শুনতে পাচ্ছি না। মন মেজাজ দ্রুত খারাপ হয়ে যাচ্ছে। রেগে গেলে মানুষের স্বাভাবিক বুদ্ধি কমে যায়। আমারও কমে গেল। জেদ চেপে গেল। এই কার্ডটার শেষ দেখে ছাড়বো আমি। হাতে কয়েন আছে দুটো। একটি এক ডলারের অন্যটি দুই ডলারের। যে কোনটা দিয়েই মাত্র একটা লোকাল কল করা যাবে। দুই ডলারের কয়েন-টা ভাঙিয়ে নিতে পারলে হতো। কিন্তু কীভাবে?

লাউঞ্জের ভেন্ডিং মেশিন দুটোর দিকে চোখ গেল। এই মেশিন ব্যবহার করিনি আগে। কিন্তু কঠিন কিছু হবার কথা নয়। পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র হয়ে একটা ভেন্ডিং মেশিন অপারেট করতে না জানলে আমি তো পদার্থবিজ্ঞানের কলংক। দেখে নিলাম একটু। কয়েন স্লটে কয়েন ঢুকিয়ে জিনিস সিলেক্ট করে নাম্বার টিপলেই হয়ে গেল। মেশিনের নিচের দিকে খোপে এসে জমা হবে যে জিনিসটি কিনলাম, আর রিফান্ড স্লটে জমা হবে অবশিষ্ট পয়সা।

স্লটে দুই ডলারের কয়েনটা ফেললাম। ছোট্ট এক প্যাকেট চিপ্‌স – যা সুপার মার্কেটে পঞ্চাশ সেন্টের বেশি নয় – এখানে এক ডলার চল্লিশ সেন্ট। তাতে কিছু যায় আসে না। আমার দরকার বাকি ষাট সেন্ট। চিপ্‌স এর নাম্বার টিপলাম। কিছুই হলো না। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। না – মেশিনের কোন নড়চড় নেই। অথচ আমার দুই ডলার দিব্যি খেয়ে বসে আছে। মেশিনের ক্যান্‌সেল বাটন থেকে শুরু করে সব ধরণের যুক্তিগ্রাহ্য চেষ্টাই করলাম, হলো না কিছুই। ইচ্ছে করছে মাথার চুল ছিঁড়ি।

একটা মাত্র ডলার সম্বল এখন। শেষ চেষ্টা। ফল একই। বা তার চেয়েও খারাপ। বাংলাদেশে কোন লাইন পেলাম না। কার্ডে কাস্টমার সার্ভিসের একটা নাম্বার আছে – সেখানে ফোন করলাম। ধরলো একজন। কোন রকমে বললাম আমার সমস্যার কথা। আমার কার্ডের পিন নাম্বার আর বাংলাদেশের ফোন নাম্বার জানতে চাইলো। মনে মনে খুশি হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে এই মাত্র লাইন পাইয়ে দেবে। কিছুক্ষণ টুং টাং বাজনা শোনালো আমাকে। তারপর বললো বাংলাদেশে লাইন দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বলে তারা দুঃখিত। লাইন কেটে গেল।

দু’ঘন্টা ধরে চেষ্টা করে ফলাফল অশ্বডিম্ব। কিন্তু তুমি কি বুঝতে পারছো কেমন একটা গাধা আমি। যে কয়েনগুলো খরচ করেছি শুধুমাত্র ফোন-কার্ডটার কানেকশান পাওয়ার জন্য – সেই কয়েনগুলো দিয়ে কিন্তু সরাসরি বাংলাদেশে ডায়াল করতে পারতাম। অন্তঃত দুই মিনিট তো কথা বলতে পারতাম। কিন্তু এখন আর করার কিছু নেই। একটু ঘুমানো দরকার। ঠিক মতো তাও পারছি না। সস্তা হোস্টেলেরও যে কত অবস্থা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছি। দেখি রুমে গিয়ে – স্টেফির নাক কিছুটা শান্ত হতেও পারে। না হলেও করার কিছু নেই। ইয়থ হোস্টেলে পেতেছি শয্যা – নাসিকা গর্জনে কী ভয়!

ক্রমশঃ_____________