Cover Page of Yukti (3rd Issue)

যুক্তি
সংখ্যা ৩
প্রকাশকাল
জানুয়ারি ২০১০
প্রচ্ছদ ছবি
ডারউইন দিবস উপলক্ষে নেচার ওয়েবসাইটের ডারউইন সংকলন থেকে সংগৃহীত
সম্পাদক
অনন্ত বিজয় দাশ
ইমেইল যোগাযোগ
[email protected]
মূল্য
বাংলাদেশ : ১২০ টাকা
বিদেশ : ৮ ডলার (ইউএসএ)
প্রাপ্তিস্থান
তক্ষশিলা, নীচতলা, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা। ফোন: ০২-৯৬৬০১৫৮
শুদ্ধস্বর, ৯১, তৃতীয় তলা, আজিজ সুপার মার্কেট, শাহবাগ, ঢাকা।
বইপত্র, দ্বিতীয় তলা, রাজা ম্যানশন, জিন্দাবাজার, সিলেট।
নাজমা বুকডিপো, দ্বিতীয় তলা, রাজা ম্যানশন, জিন্দাবাজার, সিলেট।
বি.দ্র. : দেশের ভিতরে কোথাও থেকে কুরিয়ারে যুক্তি সংগ্রহ করতে চাইলে আজিজ সুপার মার্কেটের তক্ষশিলায় যোগাযোগ করুন।

সূ চি
প্রবন্ধ
শেষ-অধিনায়ক: চার্লস ডারউইন / দ্বিজেন শর্মা ৯
বিবর্তনতত্ত্বের দর্শন / শহিদুল ইসলাম ২২
সুদূর অতীতে গেলে আমরা একই পূর্বপুরুষ দেখবো / আসিফ ২৭
বিবর্তনের সহজ পাঠ / অভিজিৎ রায় ৩৪

সাক্ষাৎকার
সন বি. ক্যারল ৬১

অনুবাদ
বিবর্তন নিয়ে চারটি ভ্রান্ত ধারণা /
মূল : চার্লস সুল্লিভান ও ক্যামেরন ম্যাকফেরসন স্মিথ ৭৩

প্রবন্ধ
বিবর্তনতত্ত্ব গ্রহণে বাধা কোথায় / বিরঞ্জন রায় ৮৭
আর্ডি-আমাদের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিল / বন্যা আহমেদ ৯২
ডারউইন থেকে ডাবল হেলিক্স / দিগন্ত সরকার ১০৪
প্রসঙ্গ ‘বিবর্তন’: জাকির নায়েকের মিথ্যাচার / শিক্ষানবিস ১১৯

সাক্ষাৎকার
প্রবীর ঘোষ ১৪২

অনুবাদ
ঈশ্বরবাদ খণ্ডন / মূল: ড্যান বার্কার ১৫৯

প্রবন্ধ
নারী জাগৃতির প্রান্তিক সমীক্ষায় রোকেয়া ও তসলিমা / রণজিৎ কর ১৭২
‘মিরাকল ১৯’-এর উনিশ-বিশ! / সৈকত চৌধুরী ও অনন্ত বিজয় দাশ ১৮৫

***************************************************

একটা বছর বিরতিতে যুক্তি তৃতীয় সংখ্যা প্রকাশ পেল। আমাদের সীমাবদ্ধতা-সংকট চীনের প্রাচীরের মত বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল ফলে শত সাধ থাকা সত্ত্বেও সাধ্যে কুলায়নি। জানি, পাঠকের দরবারে এ ওজর-আপত্তি ধোপে টিকবে না। তবু চরম সত্যি কথা, আগামীতেও আবার কবে যুক্তি নিয়ে হাজির হব অথবা আদৌ সম হব কি-না নিশ্চিত নই। শুধু আশা রইলো দেখা হবে আবার।

বিবর্তন তত্ত্ব : ইহজাগতিক বোধের প্রথম পাঠ
চার্লস ডারউইনের (১৮০৯-১৮৮২) নাম শিক্ষিতজনের কাছে মোটেই অপরিচিত নয়। ডারউইনের কীর্তি সম্পর্কে পুরোপুরি অবগত না হলেও অন্তত তাঁর নামটা অনেকে জানেন। গত ১২ ফেব্র“য়ারি, ২০০৯ ডারউইনের জন্মদ্বিশতবার্ষিকী এবং গত ২৪ নভেম্বর তাঁর দুনিয়া কাঁপানো বই অরিজিন অব স্পিসিজ’র দেড়শ বছর পূর্তি-ঘটা করে উদযাপিত হল সারা বিশ্বে। ২০০৯ সাল আন্তর্জাতিকভাবে ডারউইন বর্ষ হিসেবে ঘোষিত হয়েছে। এ ধারাবাহিকতায় আমাদের দেশে শিক্ষা আন্দোলন মঞ্চ, বিজ্ঞান চেতনা পরিষদ, ডিসকাশন প্রজেক্ট প্রমুখ বিজ্ঞানভিত্তিক প্রতিষ্ঠান-সংগঠন ডারউইনের জন্মদ্বিশতবার্ষিকী উদযাপনের পাশাপাশি বছরব্যাপী তাদের কর্মসূচি ঘোষণা করে। বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল-ও সীমিত সাধ্যের অংশ হিসেবে যুক্তি’র এবারের মূল বিষয় হিসেবে বেছে নিয়েছে চার্লস ডারউইন ও জৈববিবর্তন তত্ত্বকে। স্মরণিকায় প্রবন্ধ, সাক্ষাৎকার, অনুবাদের মাধ্যমে ডারউইন ও তাঁর জৈববিবর্তন তত্ত্ব প্রস্তাবনার পটভূমি, তত্ত্বের মূল বার্তা, জৈববিবর্তন প্রক্রিয়া, এবং প্রজাতির উৎপত্তি-বিকাশ সংক্রান্ত নানা জিজ্ঞাসা-অনুসন্ধিৎসার একটা সাধারণ পরিচয় দেবার চেষ্টা চালিয়েছি। কারণ আমরা মনে করি বিবর্তন তত্ত্ব একজন মানুষের ইহজাগতিক বোধের প্রথম পাঠ। এ তত্ত্ব ব্যতীত মানুষের ইহজাগতিক জ্ঞান পূর্ণতা পায় না, ইহজাগতিক বোধও গড়ে ওঠে না। এটি শুধু নিছক বৈজ্ঞানিক তত্ত্বই নয়, মানুষের চিরায়ত দৃষ্টিভঙ্গি, দর্শন, জীবনাচরণকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। পৃথিবীতে ইতিহাস-সৃষ্টিকারী, মানুষের মননে-চেতনায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসতে সম গুটিকয়েক প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের তত্ত্বের মধ্যে এটি অন্যতম।

ধর্মতন্ত্রীদের হাজার বছরের জীর্ণ ধারণা ‘পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্ব, ঈশ্বরের সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব মানুষের অবস্থান প্রাণীজগতের শীর্ষে’-ধোঁয়াটে এ ধারণা দূরীকরণে ষোড়শ শতাব্দীতে কপারনিকাস যে বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন, ‘পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণা’র বদলে সৌরকেন্দ্রিক বিশ্বছবি-পরবর্তীতে এগিয়ে নিয়েছিলেন ব্র“নো, টাইকো ব্রাহে, কেপলার, গ্যালিলিও, নিউটন, আইনস্টাইনের মত প্রমুখ বিজ্ঞানীরা। যতই ধর্মতন্ত্রীরা গলার আওয়াজ উচ্চ করুক, আজ আর কেউ পৃথিবীকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের কথা ভাবতেই পারে না। কিন্তু অবশেষরূপে টিকে রয়েছে ‘আশরাফুল মখলুকাত’। ১৮৫৯ সালে ডারউইন তাঁর অরিজিন অব স্পিসিজ গ্রন্থের মাধ্যমে প্রথম সেই অবশেষের মুখতুড়্ জবাব দিয়েছিলেন। প্রাণের উৎপত্তি, বিকাশের উপর আরোপিত দীর্ঘদিনের অলৌকিকতার ধূম্রজাল সরিয়ে তিনি দেখালেন, এ ধরণীতে মানুষসহ সকল প্রজাতির উদ্ভব প্রাকৃতিক নিয়মের মধ্যেই ঘটেছে, কোন প্রাণীই বিশেষ সৃষ্টি নয়। ক্ষুদ্র এককোষী জীব এ্যামিবা, ভাইরাস-ব্যাকটেরিয়া থেকে শুরু করে মাছ, ব্যাঙ, সাপ, কুমির, হাতি, পাখি, বাঁদর, শিম্পাঞ্জি, মানুষ, ময়ুর ইত্যাদি সব প্রজাতির জীবের সাধারণ পূর্বপুরুষ (Common Ancestor) একই। বলা যায়, , দূরের সম্পর্কে হলেও এরা সকলে একে অন্যের আত্মীয়। সাড়ে তিনশ কোটি বছর আগে পৃথিবীতে আদি সরল প্রাণ উৎপত্তির পর হতে মিউটেশন (পরিব্যক্তি), ভ্যারিয়েশন (প্রকারণ)-এর মাধ্যমে ক্রমে বিবর্তিত হয়ে হাজারো প্রজাতির উদ্ভব ঘটে।প্রাকৃতিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় কোনো কোনো প্রজাতি টিকে গেছে আবার অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সকল প্রাণীই বিবর্তনের ফসল। ডারউইনের এ বক্তব্য আজ শুধু মুখের কথা নয়, ফসিলবিদ্যা, ভূজীববিদ্যা থেকে শুরু করে বংশগতিবিদ্যা, কোষবংশগতি বিদ্যা, আণবিক জীববিজ্ঞান, চিকিৎসাবিজ্ঞান ইত্যাদি বিজ্ঞানের নবনব শাখা বিভিন্ন পরিসর হতে প্রমাণ সংগ্রহ করে বিবর্তন তত্ত্বকে পদার্থ বিজ্ঞান, রসায়ন বিজ্ঞানের যে কোন প্রতিষ্ঠিত তত্ত্বের মতই শক্ত ভিত্তি রচনা করে দিয়েছে। গবেষণাগারে বিজ্ঞানীরা বিবর্তনকে আণবিক পর্যায়ে পরীণ-পর্যবেণ-বিশ্লেষণ করে চলছেন। মানুষসহ বিভিন্ন প্রাণীর জিন বিশ্লেষণ করে জানা যাচ্ছে, আমরা কতটা একে অন্যের আত্মীয়; যেমন শিম্পাঞ্জি ও মানুষের ডিএনএ-র মিল প্রায় ৯৮.৬%, ওরাওটাঙের সাথে ৯৭%, এমন কী ইঁদুরের সাথে আমাদের ডিএনএ-র মিল প্রায় ৮৫%-এর অর্থ হচ্ছে, যে প্রজাতি যত পূর্বে সাধারণ পূর্বপুরুষ থেকে বিবর্তিত হয়েছে, তাদের সাথে আজকে মানব প্রজাতির ডিএনএর মিলের পরিমাণও কম। মানুষের অন্য কোনো প্রজাতি যেহেতু বেঁচে নেই সে হিসাবে বর্তমানে শিম্পাঞ্জি-ই আমাদের নিকট আত্মীয়!

কপারনিকাস যে বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন, পৃথিবীকে সৌরজগতের কেন্দ্র থেকে সরিয়ে একটি সাধারণ গ্রহে’ বানিয়ে দিলে ধর্মতন্ত্রীরা দীর্ঘদিন হম্বিতম্বি করে একসময় মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু ডারউইন করলেনটা কী? একেবারে ইতর প্রাণীর সাথে মানুষের আত্মীয়তার বন্ধন রচনা করলেন! ধর্মতন্ত্রীদের উন্নাসিকতা-অহমিকায় প্রচণ্ড আঘাত লাগে। বিজ্ঞান যতই চাক্ষুস প্রমাণ হাজির করুক না কেন, সবটাতেই তাদের আপত্তি। মানুষের জীবন হতে ঈশ্বরের ভূমিকা বিলুপ্ত হয়ে যাবার আশঙ্কায় গত দেড়শ বছর ধরে প্রতিষ্ঠিত এই বৈজ্ঞানিক তত্ত্বের বিরুদ্ধে তারা দ্বন্দ্ব-বিরোধ-কুৎসায় লিপ্ত। সত্যকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্র আঁটে। যেমনটা আমরা স্মরণ করতে পারি : অরিজিন অব স্পিসিজ গ্রন্থটি প্রকাশিত হবার ৭ মাস পর ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশন ১৮৬০ সালের জুন মাসে অক্সফোর্ডে তাদের সম্মেলনের সময় উক্ত গ্রন্থ নিয়ে একটি পর্যালোচনা সভার আয়োজন করে। স্বাভাবিকভাবেই সভাটি পরিণত হয় এক চাঞ্চল্যকর, উত্তপ্ত বির্তকে, যা পরবর্তীতে ‘অক্সফোর্ড বিতর্ক’ নামে খ্যাত। বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে এই বির্তকে ধর্মতন্ত্রীদের খ্যাতিমান প্রতিনিধি অক্সফোর্ডের বিশপ স্যামুয়েল উইলবারফোর্স ডারউইনের প্রতিনিধি টমাস হাক্সলির কাছে নাস্তানাবুদ হয়ে গেলে গোটা হলরুম জুড়ে শুরু হয়ে যায় ধর্মতন্ত্রীদের লম্ফঝম্ফ। সেসময় উরসেস্টারের বিশপের স্ত্রী বলতে থাকেন : ‘ঈশ্বরের দোহাই, ডারউইনের এই তত্ত্বটি যেন সত্য না হয়-কিন্তু যদি সত্য হয়, তবে ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি তত্ত্বটি যেন সাধারণ মানুষেরা কখনো জানতে না পারে।’

কিন্তু সত্যকে তো দীর্ঘদিন ধামাচাঁপা দিয়ে রাখা যায় না, প্রকাশ পাবেই। গত শতকের চল্লিশের দশক থেকে ডারউইনের প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বকে কোনোভাবেই আর ব্যক্তিগত মতবাদ হিসেবে আটকে রাখা গেল না। বিংশ শতাব্দীর শুরু দিকে বিজ্ঞানীরা যতই বংশগতি সম্পর্কে জানতে পারছিলেন, বিশেষ করে যখন জোহান মেন্ডেল, মরগ্যানের বংশাণু প্রবাহের সূত্র প্রকাশ্যে এসে গেল তখন বিবর্তন তত্ত্বও পূর্ণতা পেল। প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বের অসম্পূর্ণতা দূর হল। রচিত হল ‘বিবর্তনের আধুনিক সংশ্লেষণী তত্ত্ব’। জেমস ওয়াটসন আর ফ্রান্সিস ক্রিকের যৌথ প্রচেষ্টায় ডিএনএ-র গঠন আবিষ্কারের পর থেকে জীববিজ্ঞানের নতুন শাখা আণবিক জীববিজ্ঞান-ও বিবর্তনকে একেবারে পরীক্ষাগারে প্রমাণ করতে সক্ষম হল। এখন আর বিবর্তন তত্ত্ব নিয়ে জীববিজ্ঞানীদের মধ্যে কোনো সংশয় বা সন্দেহ নেই।

মনে রাখতে হবে, বিবর্তন তত্ত্বের বিরোধিতা বা কুৎসা লেপন শুধু ধর্মতন্ত্রীদের দ্বারাই হয়নি, ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে ইউরোপ-আমেরিকার রণশীল রাজনীতিবিদ ও অতিমুনাফালোভী ধনিকশ্রেণী জৈববিবর্তন ভালোভাবে না বুঝেই এই তত্ত্বকে তাদের মুনাফা লাভের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে; জন্ম দেয় সামাজিক ডারউইনবাদ (Social Darwinism), ইউজেনিক্স, বর্ণবাদের। যেহেতু জৈববিবর্তনের সূত্রানুযায়ী যোগ্যতমের টিকে থাকা হচ্ছে-প্রাকৃতিক নির্বাচন, অতএব ধনকুবেরা তাদের অনৈতিক ব্যবসা, শ্রমিক শোষণ, অধিক মুনাফাকে স্বাভাবিক ঘটনা হিসেবে বর্ণনা করে, জৈববিবর্তনের মত তথাকথিত ‘সমাজ-বিবর্তন’-এর অছিলা হাজির করে! হার্বাট স্পেন্সার, ফ্রান্সিস গ্যালটনের মত কতিপয় ব্যক্তিরা সময়ে সময়ে ‘অগ্নিতে ঘি প্রদান করেন’ এ বিষয়টি চমৎকারভাবে বর্ণিত হয়েছে দিগন্ত সরকারের লেখায়। লেখক আরেকটি বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে চেয়েছেন, সেটা হল, ডারউইনের বিবর্তন তত্ত্ব বলতে বোঝায়, প্রাকৃতিক নির্বাচন তত্ত্বকে। ডারউইনের সময় বংশগতি সম্পর্কে মানুষের তেমন কোন বৈজ্ঞানিক ধারণাই ছিল না। ডারউইনও বিষয়টি স্পষ্ট জানতেন না। সরাসরি বললে বলতে হয়, ডারউইনের বংশগতি সম্পর্কে প্যাঞ্জেনেসিস ধারণাটি আজ পরিত্যক্ত। তিনি অরিজিন অব স্পিসিজ-এর ভ্যারিয়েশনের বিধি অধ্যায়ে এবং ভেরিয়েশনস্ অব অ্যানিমেলস্ অ্যান্ড প্ল্যান্টস আন্ডার ডমেস্টিকেশন গ্রন্থে যে ক্ষুদ্র ভ্রƒণ (Gemmule) নামক অনুকল্প হাজির করেছিলেন তা আজ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। তাই আজকাল কেউ আর ঐতিহাসিক জ্ঞান অর্জনের একান্ত ইচ্ছা না হলে ডারউইনের বংশগতির অনুকল্পটি পাঠ করে না। এখানেই বিজ্ঞানের সার্থকতা। ডারউইন বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানী হলেও তার অনুকল্পের যে অংশ ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়েছে, তা নির্দ্বিধায় বাদ দিয়ে দেওয়া হয়েছে আর যে অংশ বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত হয়েছে তা ‘তত্ত্ব’ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। আজ সবাই জানে বংশগতি জীবদেহে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয় মেন্ডেল-মরগ্যানের সূত্রানুসারে।

আমরা ইতিহাস হতে দেখেছি, কায়েমী শাসকগোষ্ঠী আর তাদের মিত্ররা যখন দেখে সত্যকে ধামাচাঁপা দিয়ে রাখা সম্ভব নয়, তখন আশ্রয় নেয় সত্য বিকৃতির! এটাই সবচেয়ে সহজ পথ মানুষের চেতনা থেকে সত্যকে দূরে সরিয়ে রাখার। আজকের যুগে বিবর্তন তত্ত্ব বিভিন্নভাবেই প্রমাণিত, তারপরও বিবর্তন তত্ত্বের কিভাবে বিকৃতি ঘটানো হচ্ছে, সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে, তার চমৎকার উদাহরণ হচ্ছে ‘প্রসঙ্গ বিবর্তন : জাকির নায়েকের মিথ্যাচার’ শীর্ষক লেখাটি। বৈজ্ঞানিক কোনো তত্ত্বের বিরোধিতা করতে গেলে ন্যূনতম কাণ্ডজ্ঞান, এবং বক্তব্যে প্রমাণ ও যুক্তি থাকতে হয়, এগুলো না থাকলে বিরোধিতা আর বিরোধিতা থাকে না, ভাঁড়ামিতে পরিণত হয়।

আমাদের দেশের প্রতিষ্ঠিত বিবর্তন-তাত্ত্বিক দ্বিজেন শর্মা তাঁর লেখনীতে ডারউইনের রোজনামচার নান্দীপাঠ করেছেন; একজন বিজ্ঞানীর একান্ত ব্যক্তিগত আবেগ, ভালোবাসা, দৈনন্দিন কার্যাবলী-যা আমাদের সামনে মূর্তিমান করে তোলে ব্যক্তি ডারউইনের মুখচ্ছবি পাশাপাশি তাঁর বৈজ্ঞানিক কর্মস্পৃহা, বিজ্ঞানের প্রতি তাঁর দায়বদ্ধতা শিহরণ জাগায়, নতুন করে ভালোবাসতে-বুঝতে শেখায় বিজ্ঞানকে। অধ্যাপক শহিদুল ইসলাম বিবর্তন তত্ত্বের দর্শন প্রবন্ধে অত্যন্ত চমৎকারভাবেই বিবর্তন তত্ত্বের ইহজাগতিকতার বয়ান দিয়েছেন। অল্প কথায় বর্ণনা করেছেন, মানব চেতনায় এ তত্ত্বের সুদূর প্রসারী প্রভাব। বিরঞ্জন রায় ব্যাখ্যা করেছন বিবর্তন তত্ত্বের বিরোধিতার রকমফের, সেই সাথে পথ বাতলে দিচ্ছেন ইহজাগতিকতা বিকাশে বিজ্ঞান-আন্দোলন কর্মীদের ভূমিকা ও তাদের কর্মকৌশল। বলার অপো রাখে না আসিফ ও অভিজিৎ রায় জৈববিবর্তন তত্ত্বের মূল বার্তা-প্রক্রিয়া সাধারণের বোধগম্য করে তুলেছেন, অনেক ভুল ধারণার ব্যাখ্যা প্রদান করেছেন-বাংলা ভাষায় এ ধরনের লেখা বিরল। বন্যা আহমেদ মানুষের বিবর্তনের ওপর সদ্য প্রকাশিত বৈজ্ঞানিক গবেষণা দিয়ে সাজিয়েছেন ‘আর্ডি-আমাদের ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দিল’ লেখাটি। মানব বিবর্তনের অনেক খুঁটিনাটি বিষয় ব্যাখ্যার পাশাপাশি তিনি আমাদের জানান দিয়েছেন, আজকের ‘জীববিজ্ঞানের শতাব্দীতে’ বিবর্তন বিরোধিতার স্বরূপ। বিরোধিতাকারীদের ‘মুখগুলো সব যায় চেনা।’ অধ্যাপক সন ক্যারলের সাক্ষাৎকার আর যৌথভাবে লেখা চার্লস সুল্লিভান ও ক্যামেরন ম্যাকফেরসন স্মিথের ‘বিবর্তন নিয়ে চারটি ভ্রান্ত ধারণা’ লেখা দুটি নিয়ে বিশেষ কিছু বলার নেই। নবীন লেখকের হাতে প্রথম অনূদিত লেখার বিচারের ভার পাঠকের উপর ছেড়ে দেওয়া হল। আমরা বরং আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি অধ্যাপক সন ক্যারল, চার্লস সুল্লিভান ও ক্যামেরন ম্যাকফেরসন স্মিথের প্রতি। অত্যন্ত উৎসাহের সাথেই আমাদেরকে অনুমতি প্রদান করেছেন তাঁদের লেখা অনুবাদের।

ডারউইন এবং তাঁর জৈববিবর্তন তত্ত্বের বাইরে আরো কিছু লেখা আমরা এ সংখ্যায় প্রকাশ করেছি, যথা : প্রবীর ঘোষের ধারাবাহিক সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় কিস্তি, ড্যান বার্কারের Losing Faith in Faith: From Preacher to Atheist গ্রন্থের ঈশ্বরবাদ খণ্ডন শিরোনামে একটি পরিচ্ছেদের অনুবাদ, নারী জাগৃতির প্রান্তিক সমীক্ষায় রোকেয়া ও তসলিমা, এবং ‘মিরাকল ১৯’-এর উনিশ-বিশ!-প্রবন্ধগুলি অবশ্যই চিন্তাজাগানিয়া, চিরাচরিত ধ্যান ধারণার বাইরে থেকে লেখা; যা প্রকাশ করে লেখকের যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি, নির্মোহ মানসিকতা আর কঠোর অধ্যাবসায়। আশা করি যুক্তি এবারো তার পাঠকপ্রিয়তা ধরে রাখবে, সমাজমানসে বৌদ্ধিক বিকাশে সামান্য হলেও ভূমিকা রাখতে পারবে।

কৃতজ্ঞতা স্বীকার

যুক্তি’র প্রথম, দ্বিতীয় এবং তৃতীয় সংখ্যা যাদের ঐকান্তিক প্রচেষ্টা, উদ্দীপনা আর নিরন্তর সহযোগিতায় প্রকাশযোগ্য করে তুলেছে, তাঁদের প্রতি সশ্রদ্ধ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি। প্রথমেই স্মরণ করি বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী কাউন্সিল-এর অন্যতম সদস্য, শি ক্ষা আন্দোলন মঞ্চ ও মুক্তমনার ষান্মাসিক পত্রিকা ‘মুক্তান্বেষা’র পরিচালনা পর্ষদের সদস্য মাহবুব সাঈদ মামুন-এর কথা। অন্তরালের এই প্রাজ্ঞ মানুষটি যুক্তি আর মানবতাবোধের অনলে শোধিত একখণ্ড হীরের ন্যায় দ্বীপ্তমান। প্রথা আর মিথে আবদ্ধ এ সমাজে ‘রঙ মেখে সঙ সেজে প্রদর্শনেচ্ছায় তৎপর’ শতশত সুশীল কিংবা নেতা-এর মত ভাণ ধরার প্রতি রয়েছে তাঁর তীব্র অনীহা। দীর্ঘদিন দূর পরবাসে থেকেও নীরবে-নিভৃতে শোষণমুক্ত জনগণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণের লক্ষে কাজ করে যাচ্ছেন। আদর্শ-চিন্তা, কর্মপ্রক্রিয়া আর লক্ষে মিল থাকায় আমরা আজ একই পথের যাত্রী। পথ চলতে অকৃত্রিম বন্ধুর মত আমাদের প্রেরণা যুগিয়েছেন, সাহস যোগান দিয়েছেন, মুক্তহস্তে যুক্তি’র প্রকাশনায় এগিয়ে এসেছেন নির্দ্বিধায়। কৃতজ্ঞ চিত্তে স্মরণ করা ছাড়া এ মানবের প্রতি আমাদের ঋণ অপরিশোধনীয়।

বলতে হয় বি.যু.কা’র প্রাক্তন আহ্বায়ক, তপোবন কিন্ডারগার্টেন-এর প্রধান শিক্ষক মাহমুদ আলী, বর্তমান সভাপতি, সাপ্তাহিক দিবালোক সম্পাদক হাসান শাহরিয়ার, সদস্য কর্মযোগী আনোয়ার হোসেন-এর কথা। যাঁদের নিরলস পরিশ্রম, মেধা, দক্ষতা আর দর্শনে মিলেমিশে গড়ে উঠেছে বি.যু.কা। ২০০৫ সালের ২৭ জুলাই উজানস্রোতে তরী ভাসিয়েছিলাম আমরা ক’জনা। যুক্তির প্রতি তাঁদের মমত্ববোধ, ভালোবাসা অভিবাদ্য। রয়েছেন অত্যন্ত শ্রদ্ধাস্পদ ড. মোস্তাক আহমাদ দীন, স্থিতধী নুরুল ইসলাম-যাঁদের বুদ্ধি, সৎপরামর্শ, আলোচনা আমাদের আঁধার রাতে পথ চলতে আলো দেখিয়েছে। বিশেষ করে মোস্তাক আহমাদ দীন তাঁর পিএইচ.ডি থিসিস জমা দানের শেষ মুহূর্তে অত্যন্ত ব্যস্ত সময়ের মধ্যেও সাগ্রহে যুক্তি’র দ্বিতীয় সংখ্যার প্র“ফ দেখে দিয়েছেন তা কখনো ভুলবার নয়। নুরুল ইসলামের নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি, সমাজসচেতন-নির্দলীয় রাজনৈতিক ভাবনা আমাদের চেতনার জগতকে অনুপ্রাণিত-আলোড়িত করেছে বিভিন্ন সময়। বি.যু.কা’র সদস্য, বর্তমানে ইংল্যান্ড প্রবাসী জাহিদ রাসেল, অসীম দাস, ইটালি প্রবাসী ছাদিকুর রহমান ছাদী-দূর পরবাসে থেকেও নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করে চলছেন। এ মানবত্রয়ের দেহখানি শুধু প্রবাসে কিন্তু চিন্তার জগতখানি সম্পূর্ণটাই সোঁদা মাটির গন্ধে মাখা বাংলাদেশে। প্রয়োজন মুহূর্তেই আমাদের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছেন তাঁদের সহানুভূতিশীল হাত। সবশেষে বলতে হয় বি.যু.কার বাকি সব সদস্য, শুভানুধ্যায়ী এবং যুক্তির লেখকদের কথা। যারা প্রাণ সঞ্চার করেছেন যুক্তির, তিলতিল করে প্রকাশযোগ্য করেছেন পাঠকের কাছে। তাঁদেরকে অন্তহীন অভিবাদন।যুক্তির প্রাপ্য সকল প্রশংসা, ধন্যবাদ অবশ্যই উপরোক্ত ব্যক্তিবর্গের আর দায় নিঃসন্দেহে সম্পাদকের। সবাইকে নববর্ষের শুভেচ্ছা।

যুক্তির পূর্বের সংখ্যাঃ ১। ২।