তুমি,

 

ভাবছো মুখে  যা বলা  যেতো তা’  চিঠিতে  লিখছি কেনো?   কারণ আমি চাই এই চিঠিটা তুমি সময় নিয়ে পড়ো। বারবার পড়ো।

 

তোমার সাথে আমার পরিচয় কত দিনেরই বা হবে?  বছর দুয়েকের বেশী তো নয়। এর মাঝে জীবনের তুঙ্গতম আনন্দের সময়ে আমরা পরষ্পরের সান্নিধ্যে কাটিয়েছি। তোমার কাছেই নত হওয়া যায়,তোমাকেই বাঁধনহীন সব বলা যায়, তাই তোমার পরামর্শ চাইবার জন্যেই এই চিঠি লেখা।

 

পরশু বিকেলে আমাদের দুজনের জীবনেই বিশাল এক পরিবর্তন ঘটতে চলেছে এমন একটা পরিবর্তন এসেছিলো যেদিন দমকা হাওয়ার মত তুমি আমার জীবনে যুক্ত হয়েছিলে। আমিও তোমার ।

 

প্রথম দেখা রিহার্সাল রুমে,আমার পরিপাটি সাপ বেনীতে হাত রেখে উশকো খুশকো চুল আর রোগাটে মুখের  তোমাকে দেখেছিলাম। আমার মোটা কাঁচের চশমার ভেতর দিয়ে দেখেছিলাম তোমার হাতে ধরা বই আজিজুল হকের ‘নকশালদের শেষ সুর্য্য’ আর  সুনীলের ‘ছবির  দেশে কবিতার দেশে’। এর পরের সময়টা মহা ঘোরের সময়,মহা মোহের সময়। মোহভঙ্গের আশা করিনি আমরা কিন্তু আশংকায় ভুগেছি পরিচয়ের পরদিন থেকেই। যদিও জানি এ মোহ ভাঙ্গা নয়।

 

বোধহয় বেশ খানিক বাড়াবাড়িও করে ফেলেছিলাম সম্পর্কটা নিয়ে। তুমি আমার এক ব্যাচ নীচে পড়তে। এমনটা হয় না তাই না? অসম প্রেম! সমপ্রেম কি আমাদের তা’ জানা ছিলো না। শুধু জানতাম একই  চিন্তার, একই কল্পনার মানুষ আমরা। আমরা গাঢ়তম বন্ধুত্বে জড়িয়ে ফেলেছিলাম পরস্পরকে।

 

তোমার কোন প্রিয় শিক্ষক বললেন জয়দেবপুরে পাতা ঝড়েছে ভীষ, তাপ মাত্রা বেড়ে যাবে। ওমনি তুমি আর আমি ছুটলাম দেখবো বলে, খালি পায়ে ঝড়া পাতায় হাঁটবো বলে। এমন করে ছুটেছি শীতের পাখী দেখতে জাহাঙ্গীর নগর  বিশ্ববিদ্যালয়ে ঝিলের ধারে।  কার্তিক  সন্ধ্যের ঠান্ডায় নিঃশ্চুপ ঝিলে ওদের ভাসতে দেখেছি। একসাথে উপভোগের মাত্রাটা যেনো  বেশীই ছিলো। তুমি বলতে এই কেমিষ্ট্রি ঠেকাবে কি করে? মনে মনে বলতাম, ঠেকাচ্ছে কে?

 

মনে আছে একবার রথের মেলা দেখবো বলে লোকাল বাসে গাদাগাদি করে পৌঁছে গেছি ধামরাইয়ে। বাসের ছাদে মাছের ঝাঁকা থেকে ঝাপটায় ঝাপটায় মাছের জল এসে গা ভিজিয়েছে। সারা গায়ে মাছের আশঁটে  গন্ধ। তবু সে কি আনন্দ।

 

মাছের কথায় মনে হলো, একবার  সোয়ারী  ঘাটে এক হাঁটু জলের মধ্যে দাঁড়িয়ে মাছ ধরা দেখেছি আর  ফাটা  কাপে চা খেয়েছি তুমি অভিমান করেছিলে তোমার কাপের হাতলও নাকি ভাঙ্গা ছিলো। বড় কসরত করে ধরেছিলে কাপটা। তোমার অভিমানের নাগাল পেতাম না, তবে জানতাম কীভাবে একটা দুটো মিষ্টি কথায় তোমার অভিমান ভেসে যায় নিমিষেই। 

 

ভাষা নস্টিটিউটের কাছে গুরুদুয়ারায়  তুমি আর আমি চত্বরে বসে গানের সুরে মেতে উঠতাম । ধর্মের বাইরে শান্তি খোঁজার জন্যে আমাদের কি আমুদে প্রয়া ছিলো। আমরা দুজনেই প্রকৃতিকে ভালবাসি বলেই হয়তো আশ্বিনের ছলছল  মেঘের দুপুরে  ঘন্টার পর ঘন্টা কথা না বলে পাশাপাশি বসে কাটিয়ে দিয়েছি। শিউলি ফোঁটা সকালে বিরান মাঠে বিধবার সিঁথির মতো মলিন পথ ধরে হেঁটে গেছি কত না সময়। বেলে জোৎস্নায়  যখন বাতাসে হাস্নুহেনা ফুলের মাতলামো, আমরা তখন ২০ এর রাতে শহীদ মিনারের সামনে আলপনা আঁকা দেখেছি। প্রতিটা ক্ষ আমরা ভালো লাগায় ভেসেছি,  প্রতিটা পল আমার মনে আছে, জানি তোমারও।আর এও জানি থাকবেও অনন্ত কাল।

 

তোমার সাথে মতপার্থক্য যে হতো না তা নয়। সত্যজিত রায়ের ‘পিকু’ দেখে তুমি  রায়  দিয়েছিলে অপর্না সেনের পরকীয়ার যুক্তি আছে আমি বলেছিলাম হয়তো। তবে পরকীয়ার  কারণে  সন্তানকে  অবহেলার কোন যুক্তি নেই। তর্ক হয়নি, তবে দুজনে দুজনের সিদ্ধান্তে অটল ছিলাম।

 

আজ তোমাকে লেখার উদ্দেশ্য একটাই আগামী পরশু আমাদের নতুন জীবন, যৌথ জীবনের শুরু। আচ্ছা,আর দশ জনের মত আমরাও কি বলতে পারি আমাদের প্রেমের সফল পরিণতি হতে চলেছে?

 

জানো তো  পরশুর পর থেকে যে  তুমি আমার প্রথম পাওয়া ২৭ পাতার প্রেম নিবেদনের চিঠির  কথা শুনে হাসতে সেই তুমিই বিরক্ত হবে এই আলোচনায়। যে আমি পরকীয়াকে সমর্থন করিনি সে আমিই এর পক্ষে কথা বলবো। যে তুমি বলতে, আমায় আগলে রেখো, বহন করো, সে তুমিই বলবে আমি প্রেমের অত্যাচার করি। দম নিতে পারছো না আমার খবরদারিতে।

 

যে আমি তোমার উশকো খুশকো চুল দেখে  বন্য ঘোড়া পোষ মানানোর, বশ করার আনন্দ পেতাম। সে আমিই  বলবো, দেখতে ঘোড়া গাড়ীওয়ালা  মনে হচ্ছে। প্রফেশনাল লুক দরকার জীবনে উপরে উঠতে গেলে।

 

তোমার বিসিএস পরীক্ষার সময়ে টিফিন ক্যারিয়ারে করে দুটো বাটিতে খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম তোমার তাতে সেকি আনন্দ। আর সেই তুমিই  টেবিলে  তিন ধরনের রান্নার কম দেখলে কপাল কুঁচকে  থাকবে।

 

অসময়ে চুল উঠে যাচ্ছে বলে আমায় টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়েছিলে ডঃ আজমের জোনাকীর তেল আনতে। সে তুমি মেঝেতে চুল পড়ে থাকতে দেখলে বা খাবারে চুল পেলে বলবে, মাথায় একটা কাপড় বেঁধে রান্না ঘরে ঢুকতে পারো না? তোমার অভিমান ভাঙ্গাবার কোন তাগিদ কিন্তু আমি আর বোধ করবো না,তা আমি জানি।

 

মাটির গয়না,তামার গয়না আমার খুব প্রিয়। গাওছিয়ার বারান্দা থেকে একজোড়া পায়েল কিনে দিয়েছিলে মনে আছে?যতদিন রঙ চটে যায়নি, ততদিন আমি ছমছম করে হেঁটেছি  তোমার সামনে ওগুলো পরে। কিন্তু এখন বলি এর পর অমন কম দামী কিছু ঘরে ঢুকলেই লংকা কান্ড বাঁধাবো।।

 

ভাবছো প্রেম বা মোহ থাকলে এগুলো কি ঘটবে? হ্যাঁ,ঘটবে কারন, যৌথ জীবনের  দাবীই অন্যরকম । পেয়ে যাবার পর পাবার আকুতি কমে যাবে এটাই নিয়ম।তোমার আমার কালক্ষেপণ হয়েছিল অবসরে। যখন নিত্য দিন নিত্য বেলা সঙ্গে থাকা হবে তখন কিন্তু এতো আবেগ কাজ করবে না এটাই স্বাভাবিক। তাইই বলি পরশু আমরা কি নতুন জীবনে প্রবেশ করে বাকী জীবন কপাল চাপড়াবো ভুল সিদ্ধান্তের জন্যে। নাকি  কষ্ট সুখের সংসার করবো নাকি অন্য কোথাও সংসার পেতে লুকিয়ে লুকিয়ে  স্মৃতির জানালা খুলে  না পাবার কষ্টে দীর্ঘশ্বাস ফেলবো? বালিয়াড়ী তীরে দীর্ঘ তৃষ্ণাকাতর  কাল ক্ষেপণ করবো?

 

আর এ সমাজে তো একা থাকাও সম্ভব নয়, দুজনেই আমরা প্রশ্নের সম্মুক্ষীন হবো বিয়ে করেননি কেনো? শারীরিক সমস্যা? নাকি  অন্য কিছু? 

 

সত্যিই বলোতো আমাদের কি করা উচিত? কেননা  বিরহেও যেমন  কষ্ট তেমনি  মিলনেও কষ্ট। কোনটা তুলনামুলক কম কষ্টের? আচ্ছা কষ্টের পরিমাপ কি তোমার জানা আছে?

 

আমরা কোন কষ্টটাটা বেছে নেবো বন্ধু?

 

ইতি,

 

আমি