আগের পর্বগুলো এখানেঃ

প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব

দেশে যাওয়ার আগেই হানামি (চেরী ফুল দর্শন) চলে এলো। বসন্তের নাগাসাকি যে একটি অনবদ্য স্বর্গীয় পুস্পোদ্যান এ নিয়ে আমরা যারা সেখানে অতিথি তারা কেউ দ্বিমত করতে পারিনি। যেখানেই যাই, যেই বাড়িতে, যেই রাস্তায়, যেই উঠানে সর্বত্রই ফুলে ফুলে ছাওয়া। মানুষ কিভাবে যে এত পুস্প প্রেমিক হয় তা জাপানীজদের না দেখলে কেউ অনুমান করতে পারবে না। তাদের চাষযোগ্য ভূমি তেমন প্রতুল নয়, বাড়িগুলো আসলেই বেশ ছোট্ট। ঊঠানের বিলাসিতা দুই একজন ভাগ্যবান ছাড়া আর কারো নেই শহরের মধ্যে…তারপরও সিঁড়ির ধারে, বাড়িতে ঢোকার গেটের পাশে, রান্নাঘরের কার্নিশে এবং কোথায় নয়—কি যে মনোহর করে ফুলের গাছ লাগায় তারা, আমি মুগ্ধ হয়ে যাই! মুগ্ধ হয়ে যাওয়া ছাড়া আসলে আর কোন উপায় থাকে না আমাদের।

হানামি দেখতে যাওয়া মানে হলো সারাদিন সারারাত বাইরে থাকার প্রস্তুতি। বনভোজন ধরনের ব্যপার। যোগানদাতা কোকসাই কোরিও জুকু। মানে হলো সমস্ত বিদেশী ছাত্রছাত্রী আর তাদের আত্মীয় পরিজন আমন্ত্রিত। পট-লাক এই আয়োজনের সবথেকে মধুর বিষয়। পৃথিবীর নানান প্রান্তের রান্না, পানীয়ের সাক্ষাৎ মিলবে; যারা হাত দিয়ে খায়, তারা কয়-আঙুল ব্যবহার করে খায়-কিভাবে তার ব্যবহার হয় শেখানো হবে; কারা চামচে খায়, কারা আবার লাঠি দিয়ে খায়- যারা যারা লাঠি দিয়ে খায় তাদের কে একটি লাঠি আর কে দুইটি লাঠি দিয়ে খায় তার টেকনিক শেখা হবে। জাপানীজদের এই ছোট ছোট বিষয় নিয়ে ব্যব্পক আগ্রহ মাঝে মাঝে আমাকে ভীষণ আমোদিতো করতো। হাত দিয়ে ভাত খাওয়ার মতন বিষয় শিখতে তাদের কেউ কেউ সারাদিন সমান আগ্রহ নিয়ে প্র্যাক্টিস করে যাচ্ছে…দেখতে বড়ই ফুর্তি লাগতো!

তাতে-ইয়ামা কোয়েন( তাতে নামক পর্বত এর বাগান) এ এসে আমরা সবাই নিজ ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিতে থাকি। সারা বাগানের হাজার খানেক গাছের সবগুলোই সাকুরা মানে চেরী গাছ। ঠিক এই সময়ে গাছে কোনো পাতা নেই, শাদা ফুলের ফাঁকে ফাঁকে একটুখানি নীল আকাশের চোরা চাউনি! সারা পাহাড় ঢেকে আছে ফুলে। শরৎকালের কাকভোরে যেমন শিউলীতলা শাদা হয়ে থাকে, ঠিক তেমন।তবে সেই সৌরভ নেই এখানে। এখানে এসে আমার ছোট্ট পাখির মতন উড়তে ইচ্ছে করে, ঘুড়ি ওড়ানোর বয়সে ফিরে যেতে ইচ্ছে করে! হাতের কাছে যতগুলো ডাল পাওয়া যায়, আমি তাদের গায়ে হাত বোলাতে বোলাতে শৈশবে পার করা শরৎকালের অসামান্য ভোরে চলে যাই!

আমি ইতিমধ্যে কিভাবে যেন বুঝে গেছি এই দলের সাথে যেখানেই যাই না কেন খুঁজে খুঁজে এরা আমার স্থান নির্ধারণ করে দেবে নিশ্চিত ভাবেই কোনো পাকিস্তানীর আশাপাশে, আর সেই পাকিস্তানীটি তাসনিম হবার খুবই সম্ভাবনা। যা কিছু এড়িয়ে চলতে চাই, আমি দেখেছি আমার পথের মাঝখানে, আমার আশেপাশে সবসময় তারই বিশেষ আনাগোনা। আর আমার চরিত্রের বিশেষ দুর্বল দিক হলো এড়িয়ে যেতে না পারা, ‘না’ বলতে না শেখা। এই দুইটি বিষয়ের জন্য আমার মাকে আমি দায়ী করি। সারাজীবন আত্মীয় পরিবেষ্টিত সংসারে আমাদের সবকিছুর সাথে মানিয়ে চলতে বাধ্য করা হয়েছে। আমরা নিজের একান্ত সংসারে বসে আজও তাই এই বিদ্যা নতুন করে আর শিখতে প্রবৃত্ত হইনি। সুতরাং, আমি ভাবলাম, আজ যদি এই মহিলাটি আমার পাশে এসে মাদুর বিছিয়ে বসে ভারত-পাকিস্তান-বাংলাদেশ শুরু করে আমি কি করব। আমাকে দেখলে সে এইসব বিষয় নিয়ে নিজের অজান্তে( অথবা ইচ্ছে করেই) আমাকে আহত করে যায়; আর আমি বরাবরের মতই প্রবল ধৈর্যের পরিচয় দিয়ে তিক্ততা নিয়ে বাড়ি ফিরে যাই। আমি ভাবলাম, আজ আমি যা মনে আসে বলব-যদিও জানি এসব তর্ক করা মূ্খতা ছাড়া আর কিছু না। জীবনের এই পর্যায়ে এসে মানুষের এতদিন ধরে পুষে আসা বিশ্বাসের ভীত সহজে নড়বার নয়। কিন্তু আমি কেন বলতে পারিনি যে আমি পৃথিবীর যাবতীয় সব পাকিস্তানীদের ঘৃণা করি, এই ঘৃণা আমার ইচ্ছাকৃত নয়; এই ঘৃণা থেকে আমি আন্তরিক চেষ্টা করেও সরে দাঁড়াতে পারিনা। এই একটা প্রশ্নে এসে আমার মানবতাবোধ বাস্পের মতন হাওয়ার উড়ে যায়! এই ঘৃণার কারণ মনে হয় কোনো বাঙালীকে জিজ্ঞেস করা অবান্তর। যেদিন আমি তাসনিমকে নিয়ে হাসপাতালে গেলাম, আমার বর বলেছিল-‘আরেকটা পাকিস্তানী পৃথিবীতে আসতেছে-কেম্নে পারো?’ আমার মনে পড়ে যায় দিদিমার অন্ধ চোখ, আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে মাথায়- গলায় পাকিস্তানীদের বেয়োনেট চার্জের পরে কন্ঠ স্তব্ধ হয়ে যাওয়া আমার দাদুর ঘরঘর করে কথা বলে যাবার চেষ্টার কথা, আমার কল্পনায় ভেসে আসে ধানক্ষেতের চারপাশে ফেলে রাখা আমার মামার চার টুকরো করা দেহ, আমি ভুলতে পারিনা আমার মামীর মুখটি, বিধবা হবার দিন যাকে স্বামীর মৃতদেহ ফেলে সীমান্ত পার হতে হয়েছে পায়ে হেঁটে- যার উদরে ৭ মাসের শিশু তখন আকুপাকু করে কেঁদেছে! আমার মনে পড়ে মাসের পর মাস মায়ের পেয়ারা বাগানের পাশ্ববর্তী ডোবার কচুরিপানার তলায় শরীর ডুবিয়ে বেঁচে থাকার, নিজেকে রক্ষা করার চেষ্টা। একাত্তর আমি দেখিনি, কিন্তু আমার সারা পরিবারের গায়ে কী ভীষণ ভাবে একাত্তর লেগে আছে! সুতরাং আমার বর যখন বলে,’কেম্নে পারো?’ আমি আধুনিক মানবতাবাদীর মতন জবাব দিতে পারিনা।

আমার অনুমান সত্য হয়, তাসনিম তার স্বামী আন্‌ওয়ার কে নিয়ে আসে। আমার বর কানের কাছে ফিসফিস করে বলে-‘এইটা তো কয়দিন আগে আমাকে নামাজ পড়তে মসজিদে নিয়ে যাবার জন্য টানাটানি করছে! আমায় ডাকে -ব্রাদার! শালার পাকিস্তানী আমার ব্রাদার হয় কেম্নে!’ তাসনিম তার স্বামীকে আলাপ করিয়ে দিয়ে আমাদের দেশে যাবার প্রস্তুতি সম্পর্কে জানতে চায়। তারপর জানায় যে সে ও পাকিস্তান যাচছে। এখানে একা একা সন্তান জন্ম দেবার কথা সে ভাবতে পারে না। তাছাড়া আনোয়ার যে তাকে সাহায্য করবে, সেরকম মনোভাব বা অভিজ্ঞতা তার নেই।

সাকুরা ফুলে ছাওয়া তাতে-ইয়ামার নয়নাভিরামর দৃশ্য মনের মাঝে গেঁথে আমরা দেশে বেড়াতে আসি তার তিনদিন পর।