এলবার্ট এক্কা, পরম বীর চক্র

এলবার্ট এক্কা, পরম বীর চক্র

আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের ২০০০ সৈনিক প্রান দিয়েছেন। ভারতীয় সামরিক বাহিনীতে আমাদের বীর শ্রেষ্ঠের মত সর্বোচ্চ পদকের নাম পরম বীর চক্র। ১৯৪৭ সালে জন্মের পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ২১ জন ভারতীয় পরম বীর চক্র পেয়েছেন। এর মধ্যে ৭১ সালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে পেয়েছেন ৪ জন। এই ৪ জনের মাঝে ৩ জনই পেয়েছেন পশ্চীম রনাংগনে, একজন মাত্র পেয়েছেন পূর্ব রনাংগন, মানে আমাদের প্রিয় বাংলাদেশে। এই একজনের নাম ল্যান্স কর্পোরাল এলবার্ট এক্কা।

৩রা ডিসেম্বর সরকারীভাবে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হবার পর ভারতীয় সেনাবাহিনী উত্তর, পূর্ব, ও পশ্চিম তিন দিক থেকেই বাংলাদেশের ভেতর প্রবেশ করা শুরু করে। পূর্ব দিকে আখাঊড়ার সীমান্তে গংগাসাগরে ছিল পাক বাহিনীর একটা শক্ত ঘাটি। এই ঘাটির পতন না ঘটাতে পারলে মিত্র বাহিনী পূর্ণ শক্তিতে পূর্ব দিক দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে না। তাই যুদ্ধ শুরু হবার রাতেই এই সীমান্তে দুপক্ষের বেধে যায় তুমুল লড়াই। ভারতীয় বাহিনী ৪ঠা ডিসেম্বর ভোর ৪ টায় পাক ডিফেন্সের উপর শুরু করে প্রচন্ড আক্রমন।

তবে আক্রমন ভারতীয়রা শুরু করলেও মোটেই সুবিধে করতে পারছিল না। পাক বাহিনীর ভারী মেশিনগান ও দুরপাল্লার কামানের প্রচন্ড শেলিং এ ভারতীয় পদাতিক বাহিনীর এগুনো হয়ে দাড়ালো খুবই কঠিন। তবে ধীরে ধীরে হলেও ভারতীয় বাহিনী শত্রু অবস্থানের বেশ অনেকটা কাছাকাছি এসে পড়ে। শুরু হয়ে যায় দুপক্ষের তুমুল হাতাহাতি লড়াই।

২৯ বছরের যুবক এলবার্ট এক্কা ছিলেন হামলায় অংশ নেওয়া ভারতীয় ১৪ গার্ড ব্যাটেলিয়নের একজন ল্যান্স কর্পোরাল। এলবার্টের কোম্পানী পড়ে যায় শত্রু পক্ষের একটি এলএমজি পোষ্টের লাইন অফ ফায়ারে। সুবিধেজনক একটি বাংকারে থাকা পাকিস্তানী এই এলএমজি ধারী সৈনিকদের অনবরত গুলিবর্ষনে বেশ কজন হতাহত হবার ফলে এলবার্টের কোম্পানীর এগুনো পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে পড়ে। নিজের বাহিনীর এই বেহাল দশা দেখে নিজের নিরাপত্তার বিন্দুমাত্র পরোয়া না করে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে এগিয়ে এলেন এলবার্ট। তিনি লক্ষ্য করলেন শত্রূর মেশিনগানের অবস্থাওয়ালা বাংকারটি, তারপর অনেকটা চুপিসাড়ে বুকে হেটে পৌছে যান সে বাঙ্কারের কাছে। শত্রুপক্ষকে সম্পূর্ণ হতবিহবল করে আচমকা উদ্যত বেয়োনেট হাতে লাফিয়ে পড়লেন তাদের বাংকারে। মেশিনগান চালক দুই পাক সেনা বেয়োনেটের ঘায়ে সতর্ক হবার আগেই ঘায়েল হল। ভারতীয়দের অগ্রযাত্রার পথে বাধা হয়ে দাঁড়ানো মেশিনগানটি হল নিস্তব্ধ। তবে সাথে সাথে এক খান সেনার পালটা গুলিতে এলবার্ট নিজেও হলেন মারাত্মকভাবে আহত।

তবে মারাত্মকভাবে জখম হলেও এলবার্ট এগিয়ে চললেন তার দলের সাথে, একের পর এক শত্রুর বাঙ্কার তাদের হাতে হল পরাভূত। এভাবে সীমান্তের ভেতর ঢুকে গেলেন আরো প্রায় দেড় কিলোমিটার। আবারো এলো শত্রূর তীব্র বাধা। এবার আরো মারাত্মক। একটা দোতলা বাড়িতে অবস্থান নেওয়া পাক মিডিয়াম মেশিনগানের সহজ টার্গেটে পরিণত হল এলবার্টের বাহিনী। হতাহতের সংখ্যা ক্রমশ বাড়ছেই। বিপদ থেকে উদ্বারে আবারো এগিয়ে এলেন এলবার্ট। মারাত্মকভাবে যখন হওয়া সত্ত্বেও প্রচন্ড গোলাগুলির মাঝে খুব সাবধানে বুকে হেটে ক্রল করে তিনি পৌছে গেলেন সেই বাড়ির কাছে। তবে বাড়িটির আগেই বাইরে এর প্রতিরক্ষায় আছে একটি বাংকার, সেটি না পেরিয়ে মেশিনগানওয়ালা বাড়িতে ঢোকা যাবে না। এলবার্ট দ্রুত একটি গ্রেনেড ছুড়ে দিলেন সেই বাংকারের মধ্যে। একজন খান সেনা নিহত হল, আরেকজন হল মারাত্মকভাবে যখম। তবে মূল সমস্যা সৃষ্টিকারী সেই মেশিনগান এখনো কাবু করা যায়নি, সেটা বিল্ডিং এর দোতলায়। এলবার্ট জখম নিয়েও টপকে পার হয়ে গেলেন বিল্ডিং এর দেওয়াল, পৌছে গেলেন দোতলায়। বেয়োনেট চার্জ করে কাবু করে ফেললেন মেশিনগান চালক পাকসেনাদের।

এর ফলে তার কোম্পানীর অগ্রযাত্রা হল সুনিশ্চিত। কিন্তু মারাত্মকভাবে আহত এলবার্ট চুড়ান্ত বিজয় দেখে যেতে পারেননি, আঘাত জনিত কারনে তার সেদিনই মৃত্যু হয়। পতন হয় গংগাসাগরের সুরক্ষিত পাক ঘাটির। এর ফলে পূর্ব সীমান্তে আখাউড়ার দ্রুত পতন হয়।

এই বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য এলবার্ট এক্কাকে দেওয়া হয় মৃত্যু পরবর্তী সর্বোচ্চ পরম বীর চক্র পদক, তার নামে তার জন্মস্থান রাচীতে একটি রাস্তার নাম দেওয়া হয়। ২০০০ সালে তার সম্মানে বের করা হয় একটি ডাকটিকেট।

সূত্রঃ