ইয়ারার তীরে মেলবোর্ন [০১] [০২] [০৩] [০৪]

০৫
রবিবার ১২ জুলাই ১৯৯৮
ভিক্টোরিয়া ভিস্‌তা হোটেল

কুকুর নামক প্রাণীটির সাথে আমার সম্পর্ক বরাবরই খারাপ। আমি তাদের সাথে যথাসম্ভব সহনশীল আচরণ করার চেষ্টা করলেও তারা আমার ব্যাপারে মোটেও সহনশীল নয়। নিজের দেশে যে অনেকবার কুকুরের তাড়া খেয়েছি তা মোটামুটি মেনে নেয়া যায়। কিন্তু এই প্রবাসে চতুর্থ দিবসের সকালেই কুকুরের তাড়া খেতে হবে কখনো ভাবিনি। ব্যাপারটা গোড়া থেকে বললে তোমার বুঝতে সুবিধে হবে।

সকালে বাথরুম থেকে বেরিয়ে করিডোরে পা রাখতেই – ঘেউ ঘেউ ঘেউ। লেডিজ বাথরুমের সামনে দাঁড়ানো একটা সাদা লোমশ কুকুর ভীষণ জোরে চিৎকার শুরু করেছে আমাকে দেখে। সাইজে মোটাসোটা একটা বেড়ালের সমান – কিন্তু ডাকটা বিশ্রী রকমের কর্কশ। হোটেলের করিডোরে কুকুর দেখার মানসিক প্রস্তুতি ছিল না। আমার মনে রাখা উচিত ছিল যে এদেশের লোকজন পোষা কুকুর বেড়ালকে নিজের সন্তানের মত স্নেহ করে। মাঝে মাঝে নাকি সন্তানের চেয়েও বেশি ভালবাসে। কারণ সন্তান বড় হয়ে মা-বাবাকে ছেড়ে দূরে চলে যায়, কিন্তু কুকুর-বেড়াল তাদের প্রভুকে ছেড়ে যায় না।

সে যাই হোক। কুকুরের ডাক শুনেই ভয়ের চোটে দিলাম দৌড়। এক দৌড়ে রুমের দরজায়। পেছনে কুকুরটি তেড়ে এলো আরো জোরে। মনে হচ্ছে বর্ণবাদী কুকুর। কালো মানুষ দেখেই চিৎকার করছে, হা করে কামড়াতে আসছে। নাকি আমার পোশাক দেখে রেগে গেছে কুকুরটা? লুঙ্গি পরা মানুষ দেখেনি কখনো? এরকম জানলে বাথরুমে যাবার সময়ও প্যান্ট পরে যেতাম। ভয়ে আমার হাত কাঁপছে। কুকুরের দিকে চোখ রাখতে গিয়ে দরজার তালায় চাবি ঢুকাতে পারছি না। মনে হচ্ছে অনন্তকাল ধরে চেষ্টা করছি রুমের তালা খুলতে। কুকুরটি ঘেউ ঘেউ করছে তো করছেই। ভয়ের সাথে সাথে এক ধরণের লজ্জাও হচ্ছে আমার। আমাকে দেখে কুকুরের এত রাগের কারণ কী?

“শাট আপ্‌ লুসি। কাম হিয়ার”।

বাথরুম থেকে বেরিয়ে এসেছেন কুকুরের মালকিন। কুকুরটার গায়ের রঙের মতই ধবধবে সাদা মেয়ে। লুসি নামের কুকুরটা নিতান্ত অনিচ্ছায় ফিরে গেল তার প্রভুর কাছে। লুসির মালকিনের গলা শোনা গেল আবার – “সরি!”। হয়তো আমাকে উদ্দেশ্য করেই বললেন। ততক্ষণে আমার রুমের দরজা খুলে গেছে। সরি’র জবাবে কী বলতে হয় জানি না। এদেশে মানুষ কুকুর সাথে নিয়ে হোটেলে থাকতে আসে!

আজ রিসেপশানে কাজ করছে একেবারে কিশোরী একটা মেয়ে। ইংরেজি উচ্চারণ শুনে মনে হলো ইউরোপের কোন একটা দেশ থেকে এসেছে। পোস্ট অফিস কোথায় জিজ্ঞেস করাতে বললো,
“টু ডে ইজ সান ডে। পোস্ট অফিস ইজ ক্লোজড। ইফ ইউ নিড স্ট্যাম্প – ইউ কেন গেট হিয়ার”।

হোটেলে ডাকটিকেটও পাওয়া যায়। বাংলাদেশে চিঠি পোস্ট করতে কত ডলারের ডাকটিকেট লাগবে তা সে জানে না। বাংলাদেশ বলার পর যেভাবে তাকালো – মনে হলো বাংলাদেশের নামই শুনেনি আগে কখনো। ইউরোপে পাঠাতে নাকি এক ডলার বিশ সেন্ট লাগে। এক ডলার বিশ সেন্ট মূল্যের তিনটি টিকেট কিনলাম। কাল রাত জেগে বেশ কয়েকটি চিঠি লিখেছি। আমার মনে যাদের নিত্য আসা যাওয়া – তাদের সবার কাছে। লিখেছি – কত বড় শহর, কত বড় ইউনিভার্সিটি, কত কত সব আধুনিক ব্যবস্থা, আর কত ভালো আছি আমি।

হোটেলের লবিতে একটা ডাকবাক্স আছে। এদেশেরও ডাকবাক্সের রঙ লাল। লাল রঙের তরঙ্গদৈর্ঘ্য বেশি বলে অনেক দূর থেকে দেখা যায়। এই কারণেই কি? চিঠি পোস্ট করার পর মনটা হঠাৎ খারাপ হয়ে গেল। এই চিঠি কতদিনে তাদের কাছে পৌঁছাবে আমি জানি না। চিঠিতে আমার কোন ঠিকানা দিতে পারিনি। তারা ইচ্ছে করলেও আমাকে লিখতে পারবে না। আমি এখনো ঠিকানাবিহীন মানুষ।

রবিবারের সোয়ান্সটন স্ট্রিট আরো জমজমাট। ঝকঝকে রোদ আজ। তবে এ রোদে কোন উত্তাপ নেই। হাঁটতে হাঁটতে কলিন স্ট্রিট পেরিয়ে এলাম। সোয়ান্সটন স্ট্রিটের উপরেই মেলবোর্ন সিটি হল। বাইরে থেকে বেশ পুরনো বিল্ডিং বলে মনে হচ্ছে। যে শহরের বয়স প্রায় দুশ’ বছর সেখানে সিটি হলের বয়স তো হবেই। এখানে বিল্ডিংগুলোর রক্ষণাবেক্ষণ দেখলেই বোঝা যায় – এরা সৃষ্টি যেমন করতে পারে যত্ন করে তা টিকিয়েও রাখতে পারে। রাস্তার ওপারে আলো ঝলমলে খাবারের দোকান- ম্যাকডোনাল্ডস। অনেক ভীড় সেখানে। দোকানের সাজগোজ দেখেই বোঝা যাচ্ছে খুব হাইফাই দোকান। পেটে ক্ষুধা থাকলেও পকেটের অবস্থা বিবেচনা করে দ্রুত হাঁটতে লাগলাম অন্যদিকে।

ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিটের মোড়ে বিশাল একটা গীর্জা। এই গীর্জার ঘন্টার শব্দই হোটেল থেকে শোনা যায়। সামনেই ফ্লিন্ডার্স স্ট্রিট স্টেশান। মেলবোর্নের সবচেয়ে ব্যস্ত ট্রেন স্টেশান। ভিক্টোরিয়ান ধাচের হলুদ বিল্ডিং। ঝকঝকে সুন্দর। স্টেশানের বাইরে দেয়ালজুড়ে অনেকগুলো ঘড়িতে বিভিন্ন লাইনের ট্রেনের সময়সূচি দেখানো হচ্ছে। স্টেশানের কাছ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই এসে পড়লাম প্রিন্সেস ব্রিজে। নিচে ছোট্ট একটা নদী – ইয়ারা। প্রথম দেখাতেই ভীষণ ভালো লেগে গেলো।

ইয়ারার উত্তর তীরে মেলবোর্নের বাণিজ্যিক এলাকা আর দক্ষিণ তীরে সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। আর্ট সেন্টারের ঢেউ খেলানো বিশাল ধাতব স্তম্ভ সোজা উঠে গেছে আকাশের দিকে। তার পাশেই অপেরা হাউজ। যতই দেখছি – অবাক হয়ে যাচ্ছি।

প্রিন্সেস ব্রিজ থেকে পুবদিকে যতদূর চোখ যায় – ইয়ারা নদী চলে গেছে একেঁবেঁকে। এদেশে রবীন্দ্রনাথ আছেন কিনা জানি না। থাকলে ইয়ারাকে নিয়ে নিশ্চয় লিখেছেন – “আমাদের ছোট নদী চলে এঁকেবেঁকে, বৈশাখ মাসে তার হাঁটুজল থাকে”। অবশ্য হাঁটুজলের ব্যাপারে এখনো কিছু জানি না। নদীতে ঢেউ একেবারে নেই বললেই চলে। মাঝে মাঝে ট্যুরিস্ট ফেরী চলছে। ফেরী চলার সময় পানিতে সামান্য ঢেউ উঠে একটু পরেই মিলিয়ে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে ইয়ারা একেবারে শান্ত স্নিগ্ধ। কর্ণফুলী বা ইছামতির স্রোত বা ঢেউ কোনটাই নেই ইয়ারার। তারপরও একধরণের টান অনুভব করছি এই নদীর প্রতি। মনে হচ্ছে এই প্রবাসে ইয়ারাই হবে আমার কর্ণফুলী, আমার ইছামতি, আমার মানসিক আশ্রয়।

আর একটু উপরের দিকে তাকাতেই চোখে পড়ল স্টেডিয়াম। পৃথিবী বিখ্যাত এম-সি-জি – মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড। দূর থেকে মনে হচ্ছে বিশাল একটা লোহার খাঁচা আকাশের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। একদিন সুযোগ নিশ্চয় হবে এম-সি-জিতে যাবার। ক্রিকেটের শহর মেলবোর্ন, টেনিসের শহর মেলবোর্ন, বিশ্বসংস্কৃতির মিলনমেলা এই মেলবোর্নের অপরূপ সুন্দর একটি নদীর উপর আমি দাঁড়িয়ে আছি। ভাবতেই মনটা ভালো হয়ে গেল।

ইয়ারার দুই পাড় সুন্দর করে বাঁধানো। সাইকেল ট্র্যাক আর ফুটপাত পাশাপাশি চলে গেছে যতদূর চোখ যায়। অনেক স্বাস্থ্যসেবী মানুষ হাঁটছে দৌড়োচ্ছে। কত রকমের মানুষ – কত দেশের মানুষ। মনে হচ্ছে শুধু মানুষ দেখে দেখেই কাটিয়ে দেয়া যায় দিনের পর দিন।

ব্রিজ থেকে নিচের দিকে নেমে গেছে পাকা সিঁড়ি। সিঁড়ি বেয়ে একেবারে পানির কাছে চলে যাওয়া যায়। এই পাড়ের নাম সাউথ ব্যাংক। উঁচু উঁচু বিরাট বিরাট বিল্ডিং। আজ এখানে মেলা বসেছে। সান ডে মার্কেট। কত রকমের মনোহারী জিনিসের সমাহার। ছোট ছোট টেবিল পেতে যে যার পসরা সাজিয়ে বসেছে। খাবারের দোকান থেকে শুরু করে হাতে তৈরি গয়না, পোশাক, ঘড়ি, বই – কী নেই! যত দেখছি ততই ভালো লাগছে।

অনেক বড় বড় রেস্টুরেন্ট ইয়ারার এই তীরে। দেখতে দেখতে একটু সামনে গেলেই ক্রাউন কমপ্লেক্স। ক্রাউন – অস্ট্রেলিয়া মহাদেশের সবচেয়ে বড় ক্যাসিনো। ক্রাউন কমপ্লেক্স সত্যিই কমপ্লেক্স। ফাইভ স্টার হোটেল, শপিং কমপ্লেক্স, আটটি সিনেমা হল নিয়ে ক্রাউন সিনেমা কমপ্লেক্স, বার, রেস্টুরেন্ট – কী নেই এখানে! একটা রেস্টুরেন্টের সামনে নোটিশ টাঙানো আছে – জিন্‌স বা কেড্‌স পরে ঢোকা যাবে না। রেস্টুরেন্টে খাবার জন্য মানুষ সুট-টাই পরে আসবে! তাইতো দেখতে পাচ্ছি এখানে।

একটা জায়গায় আলোর খেলা চলছে। বিরাট হলঘরের উঁচু ছাঁদ থেকে ঝুলছে বিরাট বিরাট ঝাড়বাতি। বাজনার তালে তালে বদলে যাচ্ছে ঝাড়বাতির আলো। আর সাথে সাথে ফ্লোরে চলছে আক্ষরিক অর্থেই জলতরঙ্গ। বেশ কয়েকটি ফোয়ারার মাঝখান থেকে বাজনার তালে তালে ব্যাঙের মত লাফ দিয়ে যাচ্ছে পানির ধারা। আলো শব্দ আর জলতরঙ্গের এমন সমন্বয়- আশ্চর্য সুন্দর।

এর পরের মোড়েই শুরু হয়েছে আসল ক্যাসিনো – সোজা কথায় জুয়া খেলার জায়গা। এখানে ঢোকার মুখে কালো সুট পরে দাঁড়িয়ে আছে দু’জন দৈত্যাকার নিরাপত্তারক্ষী। তাদের একজন আমার পথ আটকালো।
“ক্যান আই সি ইওর ফটো আই ডি প্লিজ”।

ফটো আই-ডি কী বস্তু? এখানে ঢুকতে কি টিকেট লাগে? নাকি মেম্বার হতে হয়? আমার পাশ দিয়েই অনেকে সোজা ঢুকে যাচ্ছে – তাদের কাছে তো কোন কিছু চাইছে না দারোয়ানরা। বললাম,
“হোয়াট আই ডি? আই এম – আই এম” –

আমার অবস্থা বুঝতে একটুও সময় লাগলো না অভিজ্ঞ দারোয়ানের। আমার মত অনেককেই দেখে তারা। বললো-
“ইওর পাসপোর্ট প্লিজ”।

পাসপোর্ট সাথেই আছে। দেশের বাইরে বেরোতেই যে পাসপোর্ট সাথে রাখতে হয় তা আমি মেনে চলি। জ্যাকেটের পকেট থেকে পাসপোর্ট বের করে দারোয়ানের হাতে দিলাম। সে আমার ছবির দিকে একটু তাকিয়েই পাসপোর্ট ফেরত দিয়ে পথ ছেড়ে দাঁড়ালো।

হাজার হাজার আলো জ্বলছে এখানে। সারি সারি জুয়ার মেশিন। পাঁচ সেন্টের মেশিন থেকে শুরু করে পাঁচ ডলারের মেশিন পর্যন্ত আছে। এরকম দু’তিনটা মেশিন আমার হোটেলের লাউঞ্জেও দেখেছি। আগে বুঝতে পারিনি যে এগুলো জুয়ার মেশিন।

শত শত নারীপুরুষ মেশিনে কয়েন ঢেলে সুইচ টিপছে দশগুণ বিশগুণ ফেরৎ পাবার আশায়। বিশাল ফ্লোরে গিজগিজ করছে মানুষ। চারিদিকে শুধু টাকার খেলা। হাজার খানেক মেশিন পেরিয়ে আরো ভেতরের দিকে গেলে তাসের জুয়ার টেবিল। টাকা, মদ আর নারীর ছড়াছড়ি। মদের গ্লাস হাতে অকারণে হেসে হেসে টাকাওয়ালাদের গায়ে ধাক্কা দেয়া মেয়েদের দেখে ভীষণ রকমের মানসিক ধাক্কা খেলাম। প্রথম দেখার কৌতূহল যেমন আছে – তেমনি একধরণের অপছন্দের বিতৃষ্ণাও জেগে উঠছে মনে। আস্তে আস্তে বেরিয়ে এলাম।

এদিকে ইয়ারার উপর আরো কয়েকটি ব্রিজ। হেঁটে চলার ব্রিজ, গাড়ি চলার ব্রিজ। সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আলোয় ঝলমল করছে ইয়ারার দুই পাড়। মানুষের চিরন্তন লোভকে কাজে লাগিয়ে কত বড় বাণিজ্য যে এখানে চলছে দেখে অবাক হতে হয়। সেই মহাভারতের যুগ থেকে চলে আসছে জুয়াখেলা। যুধিষ্ঠিরের মত হেঁটে স্বর্গে চলে যাওয়া মানুষও জুয়া খেলতে বসেছিলেন, নিজের স্ত্রীকে পর্যন্ত পণ রেখেছিলেন। মনে লোভ ছিল বলেই তো!

গতকালের “দি এজ” পত্রিকায় একটি প্রতিবেদন পড়ছিলাম। সারা পৃথিবীতে জুয়া খেলার যত ইলেকট্রনিক মেশিন আছে, তার পাঁচ ভাগের একভাগই আছে এই অস্ট্রেলিয়ায়। অথচ অস্ট্রেলিয়ার লোকসংখ্যা মাত্র দুই কোটি, যা সারা পৃথিবীর মোট জনসংখ্যার তিনশ’ ভাগের এক ভাগ। পৃথিবীতে অস্ট্রেলিয়ানরাই সবচেয়ে বেশি জুয়াড়ী। অস্ট্রেলিয়ার গড়ে শতকরা বিরাশি ভাগ মানুষ কোন না কোন রকমের জুয়া খেলে। এদের মধ্যে শতকরা চল্লিশ জন প্রতি সপ্তাহেই জুয়া খেলে। প্রতিজন সাধারণ মানের জুয়াড়ি এ দেশে বছরে গড়ে ছয় শ’ পঁচিশ ডলার জুয়া খেলে উড়িয়ে দেন। আর যারা জুয়ার নেশায় জড়িয়ে গেছে আপাদমস্তক – তারা বছরে গড়ে বারো হাজার ডলার জুয়া খেলার পেছনে খরচ করে। বাংলাদেশের টাকায় প্রায় চার লাখ টাকা তারা জুয়ার টেবিলে উড়িয়ে দেয়।

হায় রে মানুষের লোভ! এর ফলে যে সামাজিক সমস্যা তৈরি হয়েছে এবং ক্রমাগত হয়ে চলেছে তা ভয়ংকর। অস্ট্রেলিয়ায় প্রতি দশজন জুয়াড়ীর মধ্যে কমপক্ষে একজন আত্মহত্যা করে। আর প্রতি চারজনের মধ্যে একজনের সংসার ভেঙে যায়। শিশুদের মধ্যেও জুয়া খেলার প্রবণতা বেড়ে গেছে। চারপাশে যা দেখছে তাই তো শিখবে শিশুরা। চৌদ্দ বছরের কম বয়সী অস্ট্রেলিয়ান শিশুদের শতকরা একচল্লিশ ভাগ জুয়া খেলায় আসক্ত। ক্রাউনের মত বড় ক্যাসিনোতে বয়স চেক করার জন্য ফটো আই-ডি দেখা হচ্ছে। কিন্তু শহরের আনাচে কানাচে যেভাবে ইলেকট্রনিক জুয়ার মেশিনের ছড়াছড়ি – সেখানে “আঠারো বছরের কম বয়সীদের খেলা নিষেধ” লিখে দিলেই কি কাজ হবে?

হাঁটতে হাঁটতে ভাবতে ভাবতে ফিরে আসছি। হঠাৎ জোরে হৈ চৈ শুনে তাকিয়ে দেখি – একজন মধ্যবয়সী পুরুষ – সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে ক্রাউন কমপ্লেক্স থেকে বেরিয়ে এসেছেন। পায়ে জুতা আর গলায় শুধু টাই ঝুলছে। নির্বিকার হেঁটে চলেছেন তিনি। চারপাশের মানুষ নানারকম মন্তব্য করছেন। লোকটা একটানে টাই-টাও খুলে ছুড়ে ফেলে দিয়ে সামনে হাঁটতে লাগলেন। পাশের ইটালিয়ান রেস্টুরেন্টের আধবয়সী ওয়েটারের কথা কানে এলো-
“হিয়ার গোজ এনাদার লুজার”।

জুয়া খেলে সব হারিয়েছে লোকটা! তাই অভিমানে আক্রোশে জামাকাপড় ত্যাগ করে এরকম দিগম্বর হয়ে গেছে? হয়তো তাই। কিন্তু এতে কি তার শিক্ষা হবে? আরো বড় লোভ কি তাকে আবার ফিরিয়ে আনবে না এখানে?

হঠাৎ আগুন জ্বলে উঠলো আকাশে। ক্রাউনের সামনে ইয়ারার তীর ঘেঁষে একটু পর পর কিছু স্তম্ভের মত আছে। সেখান থেকে আগুন বেরোচ্ছে। সবগুলো স্তম্ভই যেন আকাশে আগুনের নিঃশ্বাস ছাড়ছে। প্রায় সাথে সাথেই গীর্জার ঘন্টাধ্বনি শুরু হয়ে গেছে। সন্ধ্যা ছ’টা বাজলো মেলবোর্নে।

ক্রমশঃ__________