মন রেখেছি আমি


বাল্যকালে বাংলা সিনেমার বেজায় ভক্ত ছিলাম আমি। বুড়োকালে এসেও যে সেই বদ অভ্যাস বন্ধ হয়েছে সেটা বুকে হাত দিয়ে বলা যাবে না কিছুতেই। বাল্য বয়সে যেখানে বাহাদুর, বেদ্বীন, বানজারান, নওজোয়ান, বাগদাদের চোর, তুফান, হুর এ আরব ধরনের আকর্ষনীয় বহুবর্ণের সিনেমা দেখতাম, এখন তার বদলে সত্যজিত, অপর্ণা, বুদ্ধদেব বা ঋতুপর্ণ-র দুই একটা বিবর্ণ এবং বিরস সিনেমা দেখে রাখতে হয় ভদ্র সমাজে নিজেকে সমঝদার প্রমাণের জন্য। গোপনে গোপনে অবশ্য আকণ্ঠ ভালবাসা পড়ে আছে সেই সব খাসা খাসা সিনেমার জন্য।

সেই পিচ্চি বয়সে আমার প্রিয় নায়ক ছিল ওয়াসিম। শুধু আমার একার নয়। আমার সব বন্ধুদেরও প্রিয় নায়ক ছিল ওয়াসিম। ওয়াসিমের অষ্টাশি কেজি ওজনের ওজনদার শরীর আর বিয়াল্লিশ ইঞ্চি ব্যাসের বুক দেখে মেয়েরা কী প্রেমে পড়বে, আমরা গুড়োগাড়ারাই তাকে নিয়ে গুনগুন গুঞ্জন করতাম গলাগলি করে। যদিও আমাদের সকলেরই স্বাস্থ্য তখন ইথিওপিয়ার দুর্ভিক্ষ পীড়িত লোকজনের মত, তবুও আমরা সবাই ফুসফুসে যতখানি বাতাস ঢোকানো সম্ভব ততখানি ঢুকিয়ে সিনা উঁচু করে হাটার চেষ্টা করতাম ওয়াসিমের মত।তার অনুকরণে বুকের বোতাম খুলে দিতাম একটা দুটো যাতে করে মেয়েরা আকৃষ্ট হয়। সব সিনেমাতেই ভূড়িওয়ালা ভিলেন জসিম আর তার জ্যাম্বস গ্রুপের ষন্ডা পান্ডাদের জন্মের মত সিধে করে দিত সে খালি হাতে পেদিয়ে। অবশ্য ওরাও কেন যেন একসাথে সবাই ওয়াসিমকে আক্রমণ করতো না। বোকার মত এক একজন করে আসতো আর মার খেয়ে মাটিতে শুয়ে পড়তো। কেউ কেউ আবার এমনি বোকা ছিল যে, ওয়াসিম যখন ঘুষি চালাতো সেই ঘুষি খাবার জন্য দুই হাত দুইপাশে ছড়িয়ে দিয়ে মুখটাকে এগিয়ে দিত। তারপর ঘুষি খেয়ে একেবারে শুন্যে উড়ে দশহাত দূরে গিয়ে পড়তো। ওদের বস বিটকেলে জসিম ছিল আরো বেয়াক্কেল। তার সাগরেদরা যখন সাগু হয়ে যাচ্ছে মার খেয়ে কোথায় তাদের সাহায্যে আসবে। তা না সে বেটা দেখতাম ওই সময় বড় বেশি ব্যস্ত থাকতো নায়িকার সাথে ওড়না কাড়াকাড়ির খেলায়। মুশকো বেটা মেয়েদের ওড়না দিয়ে কী করবে কে জানে?


ওয়াসিমের ভক্ত হিসাবে কত কষ্টই না করেছি আমরা তার সিনেমা দেখার জন্য। আমাদের পিচ্চিকালে দোস্ত দুশমন নামের একটা সুপারহিট সিনেমা বানানো হয়েছিল। ছবিটা ছিল বোম্বাইয়া ছবি শোলের নকল। তখন অবশ্য এত কিছু জানতাম না। আমরা সব বন্ধুরা মিলে সেই খিলগাঁও থেকে হেঁটে হেঁটে চলে গিয়েছিলাম জোনাকী সিনেমা হলে তা দেখার জন্য। কালোবাজারীতে থার্ড ক্লাসের টিকেট কিনতে পেরে বিশ্বজয়ের যে আনন্দ পেয়েছিলাম সেই আনন্দ আর পাইনি কখনো এই জীবনে।


আমার সবচেয়ে পছন্দের নায়িকা ছিল মনমাতানো মনলোভা অতুলনীয়া অলিভিয়া। অলিভিয়া কেন এত পছন্দের ছিল সেকথা বলা যাবে না এখানে। শুধু এটুকু বলছি, আমরা বাচ্চাদের মাসুম চেহারা আর নিষ্পাপ চোখ দেখে যতখানি অপাপবিদ্ধ তাদেরকে মনে করি ততখানি অপাপবিদ্ধ তারা নয়। ওই আপাত নিষ্পাপ চোখের আড়ালে কত যে পাপ লুকিয়ে আছে তা নিজে ছোট না থাকলে কোনদিন জানতেও পারতাম না। ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়েই এক কচি কন্যার প্রেমে দিওয়ানা হয়ে গিয়েছিলাম আমি। সেই প্রেম অবশ্য একতরফা ছিল। এক অনুষ্ঠানে আমি যখন বুকের বোতাম খুলে সিনা উঁচিয়ে সেই কন্যার দিকে প্রেমময় দৃষ্টিতে তাকিয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণে ব্যস্ত, তিনি তখন তার সখিদের সাথে হেসে কুটিকুটি হচ্ছেন। আমার দিকে ফিরে তাকানোর সময়ও তার নেই। জীবনের প্রথম প্রেম আমার অংকুরেই বিনষ্ট হয়েছিল বিপরীতপক্ষের চরম ঔদাসিন্যে। সকালটা দেখলেই যেমন আন্দাজ করা যায় দিনটা কেমন যাবে। প্রথম ঔদাসিন্যের রেশ আর কাটেনি আমার কখনো। সেই ঔদাসিন্য বিপরীত পক্ষীয়রা প্রেমহীন নির্মমতায় লালন করে গেছেন আমার সাথে আজীবন।


দোস্ত দুশমন ছবিতে অলিভিয়া না থাকায় নিদারুণ দুঃখ পেয়েছিলাম আমরা। কচি মনের সেই কষ্ট এখনো ভুলতে পারি না আমি। অলিভিয়ার বদলে ওই ছবিতে শাবানা ছিল। কী কারণে যেন আমরা কেউ-ই শাবানা ম্যাডামকে দুই চোখে দেখতে পারতাম না তখন। বড় বেশি ছিচকাঁদুনে ছিলেন এই ভদ্রমহিলা। সামান্য কিছুতেই কেঁদে কেটে একেবারে চোখের জলের বন্যা বইয়ে দিতে পারতেন তিনি। রূপালী পর্দা অতিক্রম করে সেই বন্যা হলের মধ্যেও চলে আসতো। মহিলা দর্শকদের দেখতাম শাবানার সাথে পাল্লা দিয়ে কেঁদে বুক ভাসাতে। কান্নাকাটির চেয়েও আমরা অবশ্য তাকে অপছন্দ করতাম অন্য কারণে। আমাদের সবারই কেন যেন বদ্ধমূল ধারনা ছিল যে, এই মহিলা নায়িকা না হয়ে নায়িকার মা হলেই মানাতো বেশি।


ওই সময়ে একদিন মুক্তি পায় শিশুতোষ গোয়েন্দা ছবি এমিলের গোয়েন্দা বাহিনী। এই ছবির মূল চরিত্র এমিল হিসাবে অভিনয় করেছিল পার্থ। পার্থ পরে নটরডেম কলেজে আমার সহপাঠী ছিল। এরকম একটি এডভেঞ্চারাস ছবি দেখবো না তা কি করে হয়। তাই একদিন হাফপ্যান্ট পরা বয়সে স্কুল ফাঁকি দিয়ে রওনা দেই গুলিস্তানের দিকে। স্কুল পালানো আমার কাছে তখন পানিভাতের মত ছিল। সিদ্ধেশরী থেকে হেটে প্রথমে মৌচাক আসি। তারপর মুড়ির টিনে করে গুলিস্তান এসে নামি। গুলিস্তান সিনেমা হলের উপরেই নাজ সিনেমা হল। টিকেট কাটতে গিয়ে দেখি পকেটে পর্যাপ্ত পয়সা নেই। মন খারাপ করে হলের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় লুঙ্গিপরা এক লোক এসে বললো, সিনেমা দেখবা? আমি যেন আকাশের চাঁদ হাতে পেলাম, করুণ গলায় বললাম। দেখতেতো চাই। কিন্তু টাকা কম আছে। তিনি হেসে বললেন, ট্যাকা নিয়া চিন্তা কইরো না। এরপর সেই লোক কালোবাজারীর কাছে থেকে দুটো টিকেট কিনলো। আমাকে বললো বাস ভাড়ার পয়সা রেখে বাকীটা দিতে। টিকেট কেটে দুইজনেই গিয়ে বসলাম সিনেমা হলে। সিনেমা শুরু হতেই অবাক হয়ে দেখলাম এমিলের গোয়ন্দা বাহিনী নয়, এপার ওপার ছবি হচ্ছে। আমিই ভুল করে ভুল সিনেমা হলে চলে এসেছি। একটু মন খারাপ হলেও বেশিক্ষণ তা থাকেনি। কারণ এপার ওপারও দুর্দান্ত মারপিটের ছবি। তার উপর আবার একটু বড়দের ইয়ে টিয়েও ছিল। আজ এতদিন পর এসে যখন ওই ছবিটা আবার দেখি তখন একটা জিনিষ আমাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করে। পঞ্চাশ ষাট বা সত্তরের দশকের বাংলা সিনেমার প্রেম মানেই প্লেটোনিক প্রেম। নায়ক নায়িকা মিষ্টি মিষ্টি কথা বলবে, পার্কে একজন আরেকজনের পিছনে ছাগ শিশুর মত একটু ছুটোছুটি করবে আর বড়জোর নায়িকা লাজুক লাজুক নয়নে নায়কের শরীর থেকে তিনহাত দূরে দাঁড়িয়ে মাথাটা আলতো করে তার বুকে ছোঁয়াবে। এর বাইরে প্রেমে যে আর কিছু থাকতে পারে তার কোন ধারনাই পাবেন না আপনি। এপার ওপার সিনেমাটাই খুব সম্ভবত প্রথম বাংলা সিনেমার এই পুতুপুতু প্লেটোনিক প্রেমের যে ব্যাপার স্যাপার ছিল তা ভেঙ্গে দিয়েছিল।


গভীর মনযোগ দিয়ে সিনেমা দেখছি আমি। একটা দৃশ্য, একটা ডায়ালগ যেন মিস না হয়ে যায়। কারণ এই সিনেমার গল্প আমার বন্ধুদেরকে বলতে হবে। আমরা বন্ধুরা যে যেখানেই যে সিনেমা দেখি না কেন তার বিস্তারিত গল্প অন্যদেরকে বলতাম। এমনকি মারপিটের দৃশ্যগুলোও আমরা রিমেক করে দেখাতাম। এতে করে পয়সার অভাবে সিনেমা না দেখার দুঃখ কিছুটা হলেও ঘুচতো। হঠাৎ করেই টের পেলাম একটা হাত আমার নগ্ন উরুর উপর দিয়ে খেলে বেড়াচ্ছে। চমকে তাকিয়ে দেখি সেই লুঙ্গি পরা ভদ্রলোক গভীর আনন্দে আমার উরুতে হাত বুলিয়ে যাচ্ছেন। আমি হাত দিয়ে সরিয়ে দেই তার হাত। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করে হাসেন। কোন কিছুর ধারনা না থাকা সত্ত্বেও কীভাবে কীভাবে যেন ভোজবাজির মত বিষয়টা বুঝে যাই আমি। আতংক চেপে ধরে আমাকে। মনের মধ্যে খুঁচখুঁচানি নিয়ে বাকী সিনেমা দেখতে থাকি। অভির আর্টিকেল পড়া ছিল না তখন। কাজেই জানতাম না যে এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়। জিনের দোষে ওই লোক এমন করছে। কিছুক্ষণ পর আবারো সেই লোমশ কুৎসিত হাতের স্পর্শ পাই আমি। এবার সজোরে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেই সেই হাত। তার কাছ থেকে দূরে সরে বসি। এভাবেই ছবি দেখা চলে আমার। কিছুক্ষণ পর পর অনাহুত হামলা আর সেই হামলা প্রতিহত করা। আমার উপর অনাহুত হামলার সেটাই প্রথম এবং শেষ হামলা। আর কোনদিনই কোন অনাহুত বা কোন আহুত হামলার স্বীকার হইনি আমি। আগে যেখানে সিনেমা শেষ হবার পরে সমাপ্ত লেখা না দেখা পর্যন্ত উঠতাম না, সেই আমিই সিনেমা শেষ হচ্ছে হচ্ছে এমন সময়ে দ্রুতগতিতে সিনেমা হল থেকে বের হয়ে আসি।

সিনেমা নিয়ে এত কথা বলছি কেন? আমার গত লেখা কনওয়ে টুইটিঃ একটু গান হলে কী ক্ষতি? যারা পড়েছেন বা যারা আমাকে একটু চেনেন তারা ঠিকই আমার মতলব ধরে ফেলেছেন। জ্বী আপনাদের অনুমান সম্পূর্ণ নির্ভুল। আজও একটা গান শোনাবো আপনাদের। হ্যাঁ, এপার ওপার ছবির গান। আরো ধরে ফেলেছেন, ভালবাসার মূল্য কত গানটা, তাই না? জ্বী না, এবারে আপনাদের অনুমান পুরোপুরি ভুল। এটাও প্রেমের গান, তবে অন্য গান। সূর্যের প্রখর কিরণে যেমন চন্দ্র ঢাকা পড়ে থাকে তার শুচিস্নিগ্ধ সৌন্দর্য নিয়ে, তেমনি ভালবাসার মূল্য কত গানের আড়ালে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল এই গানটা। অথচ আমার মতে এটি বাংলা সিনেমার অন্যতম সেরা একটি প্রেমের গান। দুধের সর নাকি সবসময় উপরেই ভেসে উঠে। কথাটা কিন্তু ঠিক না। লিওনার্দোর কত কত ভাল কাজের কথা কেউ জানে না, কিন্তু তার মাঝারি মানের কাজ মোনালিসা দেখার জন্য সবাই ঝাঁপিয়ে পড়ে। চুমকি চলেছে একা পথে-র মত একটা চটুল গান সবার মুখে মুখে, অথচ অসাধারণ এই গানটা হারিয়ে গেছে সবার স্মৃতি থেকে।


httpv://www.youtube.com/watch?v=Mb0gpipx5fY