ধর্মীয় বিভাজন ও অসহিষ্ণুতার শিক্ষা- কতদূর প্রোথিত এর শেকড়? 

আব্দুর রহমান আবিদ 

ডাক্তার সেগাল (Segal) আমার খালাতো বোন হ্যাপীর প্রথম ভাড়াটে। হ্যাপীরা তখন থাকতো নিউ ইয়র্কের ব্রুকলিনে। নিউ ইয়র্কে বাড়ির দাম আকাশ ছোঁয়া বলেই হোক কিম্বা আমি তখন নিউ জার্সি থাকি বলেই হোক, হ্যাপীরা সাউথ জার্সির ভুর্‌হিস্‌ (Voorhees) শহরে হুট করে সুইমিং পুলসহ সুবিশাল এক বাড়ি কিনে ফেললো। থাকার জন্যে না, বরং বাড়িটা ওরা কিনলো ইনভেষ্টমেন্ট হিসেবে। কেননা হ্যাপীর স্বামী আজাহার ভাই ইউ.এস. আর্মিতে চাকরি করেন এবং যদ্দিন তিনি আর্মিতে আছেন, তাকে ঘুরে ঘুরে আর্মি পোষ্টগুলোতেই থাকতে হবে। ব্রুকলিন থেকে সাউথ জার্সির দূরত্ব না হলেও একশ মাইলের উপরে। হ্যাপীদের পক্ষে তো আর অতদূর থেকে এসে বাড়ির দেখাশোনা করা সম্ভব নয়একটা প্রপাটি ম্যানেজমেন্ট কোম্পানীকে এককালীন একটা পেমেন্ট-এর বিনিময়ে ভাড়াটে খুঁজে দেয়ার দায়ীত্ব দিলো ওরা এবং বাড়ির দেখাশোনার দায়ীত্ব দিলো আমাকে। ডাক্তার সেগাল কোলোরাডো থেকে সাউথ জার্সির কুপার হসপিটালে চাকরি নিয়ে মুভ করে এলেন এবং হ্যাপীর বাড়ি ভাড়া নিলেন। 

নভেম্বরের কোনো এক রোববার সকালে মিসেস সেগালের সাথে কথা বলার জন্যে আমি ডাক্তার সাহেবের বাড়ী গিয়ে হাজির হলাম। ডাক্তার সেগাল ইহুদী; আমেরিকায় বর্ন এ্যান্ড ব্রট-আপ (অর্থাৎ আমেরিকায় জন্ম এবং এখানেই বড় হয়েছেন)টেলিফোনে দুচার বার যৎসামান্য যতটুকু কথা হয়েছিল ভদ্রলোকের সাথে, তাতে ইতিমধ্যেই আমার ধারনা হয়েছিল ভুদ্রলোক যথেষ্ট স্মার্ট এবং বুদ্ধিমান। আমি জানতাম, হাসপাতালে ডিউটি থাকায় ডাক্তার সাহেব বাসায় থাকবেন না। টেলিফোনে সেভাবেই কথা হয়েছিল আগে থেকে। বাসায় থাকবেন মিসেস সেগালবাসার ছোটখাট সমস্যাগুলো নিয়ে তিনিই কথা বলবেন আমার সাথে 

মিসেস সেগালের জন্ম ইসরায়েলে। তিনি বড়ও হয়েছেন সেখানেই। দেশে তার ফ্যামিলির সাথে এখানে ডাক্তার সেগালের ফ্যামিলির আগে থেকেই জানাশোনা ছিল। সেই সুত্রে ডাক্তার সেগালের সাথে তার পরিচয় এবং পরিনতিতে বিয়ে। মিসেস সেগাল আমেরিকায় আছেন গত বার-তের বছর ধরে। কোঁকড়া কালো চুলের, মিসেস সেগাল দেখতে টিপিক্যাল ইসরায়েলীদের মত হলেও তার তিন ছেলেমেয়েই সাদা আমেরিকান বাচ্চাদের মতো অসাধারন সুন্দর দেখতে। শুধু বড় ছেলে বাদে মেঝো মেয়ে এবং ছোট ছেলে- দুজনেরই ব্লন্ড চুল। ডাক্তার সেগাল যে অত্যন্ত সুদর্শন একজন মানুষ, তা তার ছেলেমেয়েকে দেখেই বলে দেয়া যায়। 

এলিমেন্টারি স্কুলে পড়ে ডাক্তার সেগালের বড় দুই ছেলেমেয়ে। ছোট ছেলেটার বয়েস বড়জোর দুই-আড়াই বছরআমি কাছে ডাকলাম ওদের। বড় ছেলে আর মেয়েটা আমার মুখোমুখি সোফাটাই এসে বসলো। একজন পড়ে ফোর্থ গ্রেডে এবং বাকিজন থার্ড গ্রেডে। কোন্‌ স্কুলে পড়ে জানতে চাইলে একেবারেই অপরিচিত বড়সড় একটা নাম বললো। আমি হয়ত আদতেই বুঝতে পারতাম না যে, ওরা কোন্‌ স্কুলে পড়ে যদিনা জটিল শব্দগুলোর শেষে হিব্রু স্কুল (Hebrew School) শব্দ দুটো উচ্চারন করতো ওরাওরা জানালো স্কুল ওদের বাসা থেকে বেশ ভালই দূরে। আশপাশে এত ভাল ভাল পাবলিক এলিমেন্টারি স্কুল থাকতে ওরা অতদূরের হিব্রু স্কুল-এ কেন যায় জানতে চাইলে বললো, These public schools do not teach Hebrew Language or anything about Judaism. Our parents want us to learn Hebrew Language and Jewish culture and thats why they sent us to the Hebrew School.মজার ব্যাপার হলো, ভুর্‌হিস্‌ পাবলিক স্কুল ডিষ্ট্রিক্ট-এর এলিমেন্টারি লেভেলে স্কুল এ্যাচিভ্‌মেন্ট ইন্‌ডেক্স (School Achievement Index) হলো ১০-এর মধ্যে ৯.৬ যা সারা আমেরিকার মধ্যে হাতে গোনা অল্প কিছু স্কুল ডিষ্ট্রিক্ট-এর অর্জন এবং যে কোনো বাবা-মা এমন স্কুল ডিষ্ট্রিক্ট-এ ছেলেমেয়েকে পড়াতে পারলে নিজেদের ধন্য মনে করবেনতারপরও বিনে পয়সায় ঘরসংলগ্ন এত উন্নত পাবলিক স্কুলে ছেলেমেয়েকে না পড়িয়ে ডাক্তার সেগাল গাঁটের পয়সা খরচ করে এবং বাসা থেকে বহুদূর ড্রাইভ করে ছেলেমেয়েকে প্রাইভেট হিব্রু স্কুল-এ পড়াচ্ছেন। 

আমরা নিউ জার্সি থেকে এ্যারিজোনা মুভ করে এসে যেন হাতে চাঁদ পেলাম। ফিনিক্স মেট্রো শহরে দু-দুটো ফুল-টাইম ইসলামিক স্কুল। এ্যারিজোনা কালচারাল একাডেমী (ACA) প্রি-কে থেকে টুয়েল্‌ভ্‌ গ্রেড পর্যন্ত এবং ফিনিক্স মেট্রো ইসলামিক স্কুল (PMIS) প্রি-কে থেকে এইট্‌থ্‌ গ্রেড পর্যন্ত। এদেশে আমার এবং আমার স্ত্রীর সারা জীবনের স্বপ্ন ছিল ছেলেমেয়েকে ইসলামিক স্কুলে পড়ানোরকাজেই, একবছর যেতে না যেতেই আমাদের বড় ছেলে, তাল্‌হাকে ACA তে বছরে ৫,০০০ ডলার টিউশন ফি দিয়ে সিক্সথ্‌ গ্রেডে ভর্তি করিয়ে দিলাম। রেগুলার কারিকুলামের বাইরে বাড়তি হিসেবে এ্যারাবিক ল্যাঙ্গুয়েজইসলামিক ষ্টাডিজ পড়ানো ছাড়াও ছেলে ও মেয়েদের জন্যে সুনির্দিষ্ট স্কুল ইউনিফর্ম রয়েছে। এছাড়া রয়েছে ছেলে ও মেয়েদের মেশার ব্যাপারে কড়াকড়ি। আর মিডল্‌ স্কুল থেকে মেয়েদের জন্যে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে হিজাব পরাকে। স্কুলের মধ্যেই রয়েছে মসজিদ যেখানে প্রতিদিন জোহরের নামাজের ব্যবস্থা ছাড়াও প্রতি শুক্রবারে রয়েছে জুমআর নামাজের ব্যবস্থা। ধর্মভিরু মুসলিম বাবা-মা হিসেবে এর চেয়ে বড় নির্ভরতা, নিশ্চিত ব্যবস্থা আর কি হতে পারে? 

তাল্‌হার হোম-রুম টীচার পাকিস্তানী। ভদ্রমহিলা একাডেমীকালি অসাধারন ভাল টীচার। আমার ছেলেমেয়ের সাথে আমার সম্পর্ক বন্ধুর মত। স্কুলের ছোট-খাট বিষয়গুলো নিয়েও ওরা আমার সাথে গল্প করে। তাল্‌হা একদিন স্কুল থেকে ফেরার পথে গাড়িতে আমাকে ওর টীচারের বলা একটা গল্প শোনালো। ভদ্রমহিলার হাজবেন্ডের কাজিনদের কয়েকজনকে আমেরিকার কোনো একটা ডমেষ্টিক ফ্লাইট থেকে নামিয়ে অনেকক্ষণ আটকে রাখা হয়েছিল এয়ারপোর্টের মধ্যে এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে ব্যাকগ্রাউন্ড চেক্‌ করার পর অবশেষে তাদেরকে ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। তাদের দোষ ছিল, তারা নাকি প্লেনের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসেছিল এবং প্লেন ছাড়ার খানিকক্ষণ আগে তাদের প্রত্যেককে সেল্‌ ফোনে কথা বলতে দেখা গিয়েছিল যা দেখে কোনো কোনো যাত্রীর সন্দেহ হয়েছিল যে, তারা হয়ত মুসলিম টেররিষ্ট এবং সেই সূত্র ধরেই বাকি ঘটনার সূত্রপাত। গল্পটা শেষ করে তাল্‌হা বললো, ড্যাড্‌, এদেশে মুসলমানদের ওরা ডিসক্রিমিনেট করেআমি যখন জানতে চাইলাম তার এই ধারনা এই ঘটনা থেকে হয়েছে কিনা, তখন সে জানালো এটা তার টীচারের ধারনা এবং গল্পটা শুনে এটা এখন তার নিজেরও ধারনা। নাইন-ইলেভেনের টুইন টাওয়ার ধ্বংসের রেফারেন্স টেনে যখন ছেলেকে বুঝালাম যে, প্লেনের একজন সাধারন যাত্রীর জন্যে কারো সন্দেহমূলক কর্মকান্ড দেখে ভয় পাওয়া কেন অমূলক নয় এবং তার টীচারের হাজবেন্ডের কাজিনদের সাথে এয়ারপোর্ট অথরিটি যা করেছে তা বাড়তি সাবধানতা ছাড়া আর কিছুই নয়, ছেলে তা বুঝলো এবং এদেশে মুসলমানদের ডিসক্রিমিনেশনের ব্যাপারে তার ধারনা বদেলেছে বলেই আমার বিশ্বাস। 

মজার ব্যাপার হলো, তাল্‌হার টীচার কিন্তু আদোতেই রেডিক্যাল মনোভাবাপন্ন নন। তাল্‌হার পুরো সিক্সথ্‌ গ্রেডকালীন সময়ে ভদ্রমহিলার সাথে না হলেও ৩/৪ বার কনফারেন্সে বসেছি আমিইসলামিক স্কুলের টীচার এবং স্কার্ফে মাথা ঢাকা হলেও পোষাক-আষাকে ও কথাবার্তায় ভদ্রমহিলা রীতিমত মডার্ন, স্মার্ট এবং যথেষ্ট ফরোয়ার্ড। আমি নিশ্চিত, ভদ্রমহিলা বিশেষ কোনো উদ্দেশ্য নিয়ে তার ছাত্র-ছাত্রীদেরকে ঐ গল্পটা শোনাননি কিম্বা এদেশে মুসলমানদের ডিসক্রিমিনেশনের ব্যাপারটাও বলেননি। এদেশে আমরা অনেকেই তার মতো একই ধারনা পোষন করি এবং এটা আসলে আমাদের এক ধরনের মাইন্ড-সেট। আর মজার ব্যাপার হলো, এদেশে প্রথম বা দ্বিতীয় জেনারেশন হিসেবে আমাদের এই মাইন্ড-সেট হয়ত অস্বাভাবিকও নয়। কিন্তু সমস্যা হলো, গল্পের উপসংহারের আল্টিমেট টোন্‌ (Tone) টা নিয়ে। এদেশে মুসলমানদের ওরা ডিসক্রিমিনেট করেএই ওরাটা কারা?- অমুসলিমরা? ইহুদী-খ্রীষ্টানরা? নাকি সাদারা? এই যে মেসেজটা ভদ্রমহিলা নিজের অজান্তে তার ছাত্র-ছাত্রীদের দিলেন, এটাই তাদের কোমল মনে ধর্মীয় বা এথনিক বিভাজন ও অসনশীলতার প্রথম বীজ। জ্ঞাতসারে হোক বা অজ্ঞাতসারে হোক, ধর্মভিত্তিক স্কুলগুলোতে বাচ্চারা অনেকসময় ধর্মীয় বা এথনিক বিভাজনের ও অসনশীলতার শিক্ষা পায় যা পরবর্তীতে তাদেরকে কখনো কখনো প্রতিক্রিয়াশীল বানিয়ে ফেলে। আমি নিশ্চিত, খবর নিলে দেখা যাবে ডাক্তার সেগালের ছেলেমেয়েরাও জ্ঞাতসারে বা অজ্ঞাতসারে জুয়িশ সুপ্রিমেসি ও পাশাপাশি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অসনশীলতার কোনো না কোনো শিক্ষা পাচ্ছে তাদের হিব্রু স্কুল থেকে। আমেরিকার প্রায় প্রতিটা শহরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ক্রিশ্চিয়ান স্কুলগুলোও যে এর ব্যতিক্রম নয় তা বুঝার জন্যে সুবিশেষ কোনো গবেষনার বোধহয় প্রয়োজন নেই। 

তাহলে কি ধর্মভিত্তিক স্কুল এদেশের জন্যে খারাপ নাকি আমেরিকান সমাজের জন্যে ক্ষতিকর? না, তাও সত্যি না। এদেশে প্রাইভেট ও চার্টার স্কুলগুলোর পড়ালেখার মান অধিকাংশ ক্ষেত্রেই পাবলিক স্কুলের চেয়ে অনেক ভাল ও উন্নত। এছাড়া ন্যাশনাল মেধাভিত্তিক টেষ্টগুলোতেও এসব স্কুলের ষ্টুডেন্টদের স্কোর পাবলিক স্কুলের ষ্টুডেন্টদের চেয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনেক ওপরে। আমেরিকার যে কটা ইউনিভার্সিটিকে বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম ইউনিভার্সিটি ধরা হয়, তার সবগুলোই প্রাইভেট। ইউটাহ্‌ ষ্টেটের ব্রিঘ্যাম ইয়াং ইউনিভার্সিটি (Brigham Young University) হলো মর্‌মন্‌দের (Mormon) চার্চ, The Church of Jesus Christ of Latter-day Saints-এর মালিকানাধীন একটা ধর্মভিত্তিক প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি যার প্রায় ৩৪,০০০ ছাত্রসংখ্যার মধ্যে ৯৮%-ই হলো মর্‌মন্‌। আমেরিকায় ওয়াটার রিসোর্সেস ইঞ্জিনিয়ারিং ফিল্ডে যে যুগান্তকারী মডার্ণ সফ্‌ট্‌ওয়্যারগুলো আবিষ্কৃত হয়েছে (যেমনঃ WMS, SMS, GMS, ইত্যাদি), তার সবগুলোই এই ইউনিভার্সিটির সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের ডেভেলপ করা। মজার ব্যাপার হলো, আমেরিকার মতো খোলামেলা, ওপেন সোসাইটির দেশেও সুনির্দিষ্ট ড্রেসকোড ছাড়াও বিয়ে বহির্ভূত সম্পর্কের ক্ষেত্রে ও ড্রাগ/এ্যালকোহল ব্যবহারের বিষয়ে অত্যন্ত কড়াকড়ির প্রচলন রয়েছে এই ইউনিভার্সিটিতে। তবে এও সত্যি, প্যাট রবার্টসনের (Pat Robertson) মত চরম ইসলাম ও মুসলিম বিদ্বেষী Evangelical Priest-এর কিম্বা বব্‌ ম্যাক্‌ডোনেলের (Bob McDonnell, the Republican governor-elect of Virginia) মত রেডিক্যাল খ্রীষ্টানের জন্ম দিয়েছে কোনো না কোনো ক্রিশ্চিয়ান স্কুল, ক্রিশ্চিয়ান কলেজ বা ইউনিভার্সিটি। 

এ তো গেল ধর্মভিত্তিক অরগানাইজ্‌ড্‌ শিক্ষা ব্যবস্থার সম্ভাব্য নেগেটিভ দিক। আর ধর্মীয় কিম্বা পারিবারিক শিক্ষা? আমার নিয়মিত ডাক্তার (এদেশে যাদেরকে বলা হয় প্রাইমারী কেয়ার ফিজিশিয়ান) পাকিস্থানী। এ্যারিজোনার নাতিদীর্ঘ আড়াই বছরের বসবাসকালীন সময়ে ইনি আমার চতুর্থ ডাক্তার। ডাক্তার না-পছন্দ হওয়ার বাতিক আছে আমার। একজন সাদা, একজন কালো এবং একজন ইরানী ডাক্তার বদলে অবশেষে ইনাকে পছন্দ করেছি আমি। ভদ্রলোক যথার্থই একজন ভাল ডাক্তার। আমি একদিন উনাকে দেখাতে গিয়ে এক্সাম রুমে একা একা বসে একটা নিউজ্‌উইক পত্রিকা ঘাটাঘাটি করছি যার কভার পেজ-এ ইরানের প্রেসিডেন্ট, আহমেদিনেজাদ-এর ছবি রয়েছে এবং ভেতরের পাতায় রয়েছে ইরানের ওপর একটা ফিচার। আমি খালি এক্সাম রুমে বসে ডাক্তারের জন্যে অপেক্ষা করছি এবং ইরানের ওপর লেখা ফিচারটা পড়ছি। ডাক্তার সাহেব ঢুকতেই আমি পত্রিকাটা বন্ধ করে পাশে রেখে দিলাম এবং উনার চোখ পড়লো পত্রিকার প্রচ্ছদে। ভদ্রলোক খুব অর্থপূর্ণ হাসি হেসে বললেন, These Jews people will not stop for nothing…..ভদ্রলোক মুসলিম বিশ্বের বিরুদ্ধে ইহুদী নিয়ন্ত্রিত আমেরিকান মিডিয়ার পরিকল্পিত চক্রান্তের ওপর ছোটখাট একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন। কিন্তু আমি নিশ্চিত, ডাক্তার সাহেব নিউজ্‌উইক-এর ঐ বিশেষ ফিচারটা পড়েননি কেননা ওতে আহমেদিনেজাদ সম্পর্কে তেমন খারাপ কোনো কথা লেখা নেই। ভদ্রলোক যা বললেন, তা তার প্রো-ইসলামিক, এন্টি-জিউস মাইন্ড-সেট থেকে। আমেরিকান মিডিয়া কি জিউস নিয়ন্ত্রিত? হ্যাঁ, মালিকানার প্রশ্নে প্রচলিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী অধিকাংশ আমেরিকান মিডিয়া কোম্পানীর মালিকই জিউসএবং দুঃখজনক হলেও এটাও সত্যি যে, ইসলাম ও মুসলমানদের বিরুদ্ধে অনেক সময় প্রক্রিয়াগতভাবে ডিস্‌টর্‌টেড নিউজ প্রচার করে অধিকাংশ আমেরিকান মিডিয়া। কিন্তু কোনো বিষয়ে মন্তব্য করা উচিত সুনির্দিষ্ট তথ্য ও পরিসংখ্যানের ভিত্তিতে, কেবল প্রো- বা অব্‌সেস্‌ড্‌ মাইন্ড-সেট থেকে নয়। আরেকদিনের কথা; কিছু বাড়তি ডায়াগ্‌নসিস-এর জন্যে উনি আমাকে একজন গ্যাষ্ট্রোএন্টারোলোজিষ্ট-এর (Gastroenterologist) কাছে পাঠাবেন। বললেন, আমাকে যার কাছে পাঠাচ্ছেন, তার কাছে আমাকে না পাঠাতে হলে উনি বরং খুশী হতেন কেননা ঐ গ্যাষ্ট্রোএন্টারোলোজিষ্ট ভদ্রলোক মুসলমান বা পাকিস্থানী হলেও প্রিন্স আগা খান-এর ধর্মাবলম্বী এবং দুঃখের বিষয় তার পরিচিত এর চেয়ে ভাল আর কোনো গ্যাষ্ট্রোএন্টারোলোজিষ্ট ভ্যালীতে নেই। মজার ব্যাপার হলো, এহেন রেডিক্যাল মনোভাবসম্পন্ন একজন মানুষ স্থানীয় একটা মসজিদ তথা ইসলামিক সেন্টারের কেন্দ্রীয় কমিটির একজন সদস্য এবং কমিটির গুরুত্বপূর্ণ একটা পদও দখল করে আছেন। ডাক্তার সাহেবের কয় ছেলেমেয়ে তা কখনো তাকে জিজ্ঞেস করা হয়নি। তারা কে কিসে পড়ে, তাও আমি জানিনা। কিন্তু বাবার মাইন্ড-সেটের কিয়দাংশও যদি তাদের ভেতর ট্রান্সফার হয়ে থাকে, এবং যার আশংকা অমূলক নয়, তবে নিঃসন্দেহে তা ভয়ের ব্যাপার। আমি নিশ্চিত, খবর নিলে দেখা যাবে ডাক্তার সেগালের ছেলেমেয়েরাও বাবা-মায়ের কাছ থেকে জুয়িশ সুপ্রিমেসি ও পাশাপাশি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি অসনশীলতার কোনো না কোনো শিক্ষা পাচ্ছে জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে। এবং সেই একই কথা প্রযোজ্য আমেরিকার লক্ষ লক্ষ ধর্মপ্রাণ খ্রীষ্টান কিম্বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বী পরিবারের ক্ষেত্রেও। 

মজার ব্যাপার হলো, সাধারন ধর্মপ্রাণ মানুষদের অনেকের মাইন্ড-সেটই কিন্তু আমার প্রাইমারী কেয়ার ফিজিশিয়ান-এর মতো আমাদের জেনারেশনে আমরা হয়ত অবচেতন মনে ধর্মীয় অসহনশীলতাকে লালন করলেও নিরীহ ধর্ম পালনকারী হিসেবে জীবনটা পার করে যাবো। কিন্তু সাধারনভাবে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি যে প্রচ্ছন্ন বিদ্বেষ বা অসহনশীলতা আমরা সচেতন বা অবচেতনভাবে অন্তরে লালন করি, তা যদি ট্রান্সফার হয় আমাদের ছেলেমেয়ে কিম্বা তাদের পরবর্তী জেনারেশনের মধ্যে, তবে আমেরিকার মতো রিলিজিয়াস ফ্রিডম-এর দেশেও নিরীহ ধর্মপালন ও ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ভবিষ্যত (অদূর বা সুদূর) যে আশংকাপূর্ণ, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এবং এটা কেবল মুসলমানদের ক্ষেত্রে নয়, জিউস, ক্রিশ্চিয়ান কিম্বা অন্যান্য ধর্মাবলম্বীদের ক্ষেত্রেও একইভাবে প্রযোজ্যগাছের গোড়া কেটে আগায় পানি ঢেলে গাছ বাঁচানোর প্রচেষ্টা যেমন অর্থহীন, তেমনি করে কারো মাঝে শৈশব ও কৈশোরে স্কুল, পারিবারিক কিম্বা ধর্মীয় পরিবেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের ও ভিন্ন এথনিক্‌ গ্রুপের প্রতি বিদ্বেষ ও অসহনশীলতার বীজ বপন করে পরবর্তীতে তার কাছ থেকে ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি সহনশীলতা বা মডারেট এ্যাটিচিউড আশা করাও অর্থহীন।  

কাজেই ছেলেমেয়েকে ধর্মভিত্তিক স্কুলে পাঠিয়ে পরম নির্ভরতায় কিম্বা নিশ্চিন্তে বসে থাকলে চলবে না। বরং স্কুলে তারা কি শিখছে, না শিখছে তার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। পাশাপাশি ধর্মীয় ও পারিবারিক পরিবেশে ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও এথনিক গ্রুপের প্রতি সহনশীলতা ও সন্মানবোধের আলোচনা করতে হবে যেন আমাদের ছেলেমেয়েরা এবং সাথে সাথে আমরা নিজেরাও ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও এথনিক গ্রুপের প্রতি সহিষ্ণুতা, সহনশীলতা ও সন্মান দেখাতে শিখি এবং জাতি, ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে মানুষের প্রতি মমতা ও ভালবাসা দেখাতে শিখি।  

এ কথা সত্যি যে, ধর্মীয় সুপ্রিমেসির কন্‌সেপ্ট না থাকলে পৃথিবীতে কোনো ধর্মই হয়ত টিকে থাকতো না। আমার ঘোল্‌ সবচেয়ে ভাল– বাজারের সব ঘোল্‌ বিক্রেতার এই মনোভাব বা দাবী দোষনীয়ও নয়। তবে এই প্রতিযোগী মনোভাব যেন বাড়তি রেশারেশির জন্ম না দেয়, তা খেয়াল করা দরকার। ভারতের ড. জাকির নায়েক কিম্বা সাউথ আফ্রিকার আহ্‌মেদ দিদাত নিঃসন্দেহে উচুঁ মানের মুসলিম স্কলার এবং বিখ্যাত তর্কবাগীশ। পোডিয়ামে দাঁড়িয়ে বিপক্ষের হিন্দু সাধু/পুরোহিত কিম্বা খ্রীষ্টান পাদরীকে তর্কে কুপোকাত করতে তাদের দুজনেরই পারদর্শিতা সর্বজনবিদিত। আমি নিজেও ওনাদের গোটা কয়েক বিতর্ক দেখেছি ইউটিউবে। আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবদের অনেককে এ নিয়ে সন্তুষ্টির ঢেকুরও তুলতে দেখেছি। আমি জানিনা এ জাতীয় বিতর্ক অনুষ্ঠানের আয়োজক কারা। আজকের এই জটিলতম পৃথিবীতে, নোংরা ধর্মীয় রাজনীতি ও আগ্রাশন নীতির ক্রান্তিকালে যেখানে ধর্ম, বর্ণ, নির্বিশেষে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তোলা দরকার শোষক গোষ্টীর বিরুদ্ধে, ধর্মের অপব্যবহারকারী ও ধর্মীয় জঙ্গীদের বিরুদ্ধে, সেখানে এসব মশকরা করার সময় ও সুযোগ কোথায়? আমার ব্যক্তিগত বিচারে, এ ধরনের বিতর্ক তো দুই অন্ধের হাতি দেখে বিতর্ক করার মত। যেখানে পিতা ছাড়া কোনো মানব সন্তানের জন্ম প্রচলিত জ্ঞান-বিজ্ঞান বহির্ভূত ও পুরোপুরি ঐশ্বরিক বিষয়, সেখানে এ যুক্তি-তর্ক কি নেহায়েতই বাহুল্যতা নয় যে তিনি ঈশ্বরের সন্তান নাকি শ্রষ্ঠার আদিষ্ট রূহ? ওনাদের বিতর্কের বিষয়-বস্তুর এমন অনেক উদাহরন দেয়া যাবে যা একান্তভাবেই ধর্ম-বিশ্বাসের অংশ। বিশ্বাসই যেখানে সব এবং একমাত্র উত্তর, সেখানে এসব নিয়ে তর্ক-বিতর্ক কিম্বা জয়-পরাজয়ের প্রচেষ্টা নেহায়েত নির্বুদ্ধিতা ছাড়া কি আর কিছু? তাছাড়া এধরনের ধর্ম-বিতর্কে প্রতিপক্ষকে পরাজিত করার প্রচেষ্টা কি প্রকারান্তরে সে ধর্মের অনুসারী লক্ষ-কোটি মানুষকে অপমান করার সামিল নয়? ধর্ম প্রচার বা স্ব স্ব ধর্ম নিয়ে গবেষনা এক জিনিষ আর কার ঘোল্‌ ভাল তা নিয়ে মঞ্চে বসে ছেলেমানুষি তর্কাতর্কি আরেক জিনিষ। আমার মতে, ড. জাকির নায়েক কিম্বা আহ্‌মেদ দিদাত নয়, এ যুগে আমাদের প্রয়োজন জিয়া ভাইয়ের মত মানুষদের। 

সাউথ জার্সির ভূর্‌হিস্‌ মসজিদের একক প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত জিয়া ভাই পাকিস্তানী। আমার এ যাবৎ কালের দেখা আমেরিকার সবচেয়ে সুন্দরতম মসজিদ হলো জিয়া ভাইয়ের বানানো ভূর্‌হিস্‌ মসজিদ। নামকরা আর্কিটেক্ট জিয়া ভাই উনার সারা জীবনের উপার্জনকে উজাড় করে ঢেলেছিলেন ঐ মসজিদ নির্মানের পেছনে। কার্পেট, মার্বেল পাথর থেকে শুরু করে মসজিদের ইন্টেরিয়র ডিজাইনে ব্যবহৃত প্রায় সমস্ত ম্যাটেরিয়াল্‌স্‌ই আমেরিকার বাইরে বিভিন্ন মুসলিম দেশ থেকে ইম্‌পোর্ট করে এনেছিলেন উনি। প্রৌঢ় জিয়া ভাই এবং ওনার স্ত্রী একক প্রচেষ্ঠায় রক্ষনাবেক্ষণ করতেন ঐ মসজিদের। মসজিদের জন্যে এমন অন্তঃপ্রাণ মুসলমান আমি খুব বেশী দেখিনি আমার জীবনে। মজার ব্যাপার হলো, অত্যন্ত ধর্মপ্রাণ এই মানুষটা একই সাথে ছিলেন সাউথ জার্সির মাল্টি-ফেইথ্‌ বেইজ্‌ড্‌ (multi-faith based) একটা অরগানাইজেশনের প্রথম সারির একজন এ্যাক্টিভিষ্ট ও সাউথ জার্সির মুসলমানদের অন্যতম মুখপাত্র। 

জিয়া ভাইয়ের সাথে আলাপের সুবাদে এবং নিজের কৌতুহল থেকে একবার ওনাদের একটা অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম ওনার সাথেএমন ব্যতিক্রমী অনুষ্ঠান আমার জীবনে আগে কখনো দেখিনি। অনুষ্ঠান শুরু হলো কোরআন তেলাওয়াত ও তার ইংরেজী তর্‌জমা পড়ে শোনানোর মাধ্যমে। হিব্রু ভাষায় যার অর্থ শান্তি, সেই শ্যালোম (shalom) শিরোনামে নিজের লেখা ইংরেজী কবিতা আবৃত্তি করলেন ভূর্‌হিস্‌ মসজিদেরই আরেকজন নিয়মিত মুসল্লি (ভদ্রলোকের নাম মনে নেই; উনি বিহারী এবং আমাদের সাথে বাংলায় কথা বলতেন)। গায়ে কমলা রঙের চাদর জড়ানো এক বৌদ্ধ পুরোহিত কিছু শান্তির বাণী পড়ে শোনালেন তাদের ধর্মগ্রন্থ থেকে একজন তর্‌জমাকারীর মাধ্যমেনেপাল থেকে আমেরিকায় ধর্মীয় ট্যুরে এসেছেন, এমন এক ভদ্রলোক কিছু শান্তির বাণী পড়ে শোনালেন তাদের ধর্মগ্রন্থ থেকে। স্থানীয় একটা ক্রিশ্চিয়ান চার্চের প্রিষ্ট ছোট্ট একটা বক্তৃতা দিলেন খ্রীষ্ট ধর্মের শান্তির বাণী নিয়ে। সবশেষে বক্তব্য রাখলেন মাল্টি-ফেইথ্‌ বেইজ্‌ড্‌ অরগানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট (ভদ্রলোক জিউস) যিনি বক্তৃতার শুরুতেই সাউথ জার্সির পাল্‌মাইরা (Palmyra) মসজিদে এফ.বি.আই.-এর সাম্প্রতিক অভিযানের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা জানালেনধর্মীয় ভাব-গম্ভীর পরিবেশ, কন্টেম্‌পরারি ধর্মগুলোর পারষ্পরিক শান্তির বাণী, বক্তাদের ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের প্রতি মমতা ও সহমর্মিতার অকৃত্রিম প্রকাশ- সব মিলিয়ে সেটা ছিল হৃদয় উদ্বেল করা, আবেগআপ্লুত করা, এমন অসাধারন এক অনুষ্ঠান, মানুষের প্রতি মানুষের মমতা আর ভালবাসা প্রকাশের এমন অনবদ্য এক মিলনমেলা, যা দেখে চোখে পানি এসে গিয়েছিল আমার। 

হ্যাঁ, বিভাজন, কটাক্ষ, অসহিষ্ণুতা বা অসহনশীলতার বাণী নয়; জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানুষের প্রতি মমতা ও ভালবাসার বাণী এবং ধর্মীয় শান্তির বাণী প্রচারে অন্তঃপ্রাণ, প্রয়াত জিয়া ভাইয়ের মত মানুষদের আজ একান্ত প্রয়োজন আমাদের। 

সবাইকে মহান বিজয় দিবসের শুভেচ্ছা। ১৬ই ডিসেম্বর, ২০০৯।