পাক সাবমেরিন গাজী।

পাক সাবমেরিন গাজী।

পিএনএস গাজী। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান নৌবাহিনীর ফ্ল্যাগশিপ সাবমেরিন; ফ্ল্যাগশিপ মর্যাদা সেসব রণতরীই পায় যারা পুরো নৌবহরের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য যুদ্ধজাহাজ। সে হিসেবে ৭১ সালে গাজীর এই পদমর্যাদা ন্যায্য প্রাপ্য। যদিও গাজীর ডিজেল চালিত ইঞ্জিন নিঃসন্দেহে আধুনিক পরমানু শক্তি চালিত ইঞ্জিনের মত দক্ষ নয়, কিন্তু সামগ্রিক বিচারে; বিশেষ করে প্রতি যাত্রায় ১ মাস বা ১১,০০০ মাইল পাড়ি দেবার দীর্ঘ ক্ষমতাসম্পন্ন গাজী দুরপাল্লার যুদ্ধের জন্য সে আমলে পাক নৌবহরের একমাত্র উল্লেখযোগ্য সাবমেরিন। গাজীর জন্ম আমেরিকায়, ১৯৪৪ সালে। পাক নৌবাহিনী ১৯৬৪ সালে আমেরিকা থেকে সামরিক সহায়তা চুক্তির আওতায় গাজীকে পায়। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে গাজী কোন জাহাজ সরাসরি না ডোবাতে পারলেও যুদ্ধে কৃতিত্ত্বের জন্য মোট ১০টি পুরষ্কার পায়। তখনকার দ্বিতীয় কমান্ডার তাসনীম আহমেদ পান সিতারা-ই-জুরত পদক।

৭১ সালের মাঝামাঝি থেকেই ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ অনেকটা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাড়ায়। যুদ্ধের আগাম প্রস্তুতি হিসেবে ভারতীয় নৌবাহিনী নভেম্বর মাসে সেসময়কার তাদের একমাত্র বিমানবাহী জাহাজ আইএনএস ভিক্রান্তকে বাংলাদেশ অভিমূখে পূর্ব দিকে বংগোপসাগর অভিমুখে সরানো শুরু করে। এ খবর পাকিস্তানী নৌবাহিনী জেনে যাবার পর পালটা ব্যাবস্থা হিসেবে তারাও বংগোপসাগর অভিমুখে ভিক্রান্তকে ঠেকানোর উপযুক্ত ব্যাবস্থা নেওয়ার কথা চিন্তা করতে থাকে। তখন বাংলাদেশের সীমানায় পাকিস্তানের যেসব নৌযান ছিল তার কোনটাই ভিক্রান্তের মত বিশাল অত্যাধুনিক বিমানবাহী জাহাজকে ঠেকাবোর মত ছিল না। তাই কতৃপক্ষকে করাচী বন্দর থেকে পুরো আরব সাগর ঘুরে বংগোপসাগরে পাড়ি দেবার একমাত্র নির্ভরযোগ্য যুদ্ধজাহাজ হিসেবে গাজীকেই পাঠাবার সিদ্ধান্ত নিতে হয়।

কমান্ডার জাফর মোহাম্মদ খানের নেতৃত্বে মোট ৯২ জন নৌসেনা সমেত ৭১ এর ১৪ই নভেম্বর গাজী করাচি বন্দর থেকে তার যাত্রা শুরু করে। গাজীকে পাড়ি দিতে হবে পুরো ৩ হাজার মাইল। পাক ইন্টেলিজেন্সের কাছে পাকা খবর আছে ভিক্রান্ত তখন ভারতীয় নৌবাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় সদর দফতর বংগপোসাগরের তীরে বিশাখাপতনামে অবস্থান করছে। তাই গাজীর মিশন; আইএনএস ভিক্রান্তকে ডুবিয়ে দেওয়া। সাথে সাথে বিশাখাপতনাম বন্দরের আশে পাশে মাইন ফেলে আসা যাতে ভারতীয় নৌবাহিনীর অন্য জাহাজগুলিও বন্দর থেকে বের হতে না পারে। গাজীর সফলতার সাথে পূর্বাঞ্চলের যুদ্ধের গুরুত্ত্ব অনেক, কারন গাজী সফল হতে পারলে বংগোপসাগরে পাক নৌবাহিনী একচ্ছত্র আধিপত্য কায়েম করতে পারবে, আবার সফল হতে না পারলে ভারতীয় ভিক্রান্ত একতরফাভাবে বংগোপসাগরে আধিপত্য বিস্তার করবে।

নভেম্বর এর শেষ নাগাদ গাজী পৌছে যায় বিশাখাপতনামের কাছাকাছি। তবে যেমনটি আশা করা হয়েছিল, এর মিশন আর গোপন থাকে না। ভারতীয় ইন্টেলিজেন্স এর উপস্থিতি জেনে ফেলে। ভারতের ততকালীন নেভাল ইন্টেলিজেন্স প্রধান মিহির কুমার বোস পরে জানান যে গাজী থেকে চট্টগ্রাম বন্দরে পাক নৌঘাটিতে পাঠানো একটি মেসেজ তারা সফলভাবে ইন্টারসেপ্ট করতে পারেন। সে মেসেজের মূল বিষয় ছিল একটি বিশেষ ধরনের লুব্রিক্যান্ট অয়েল, যা শুধুমাত্র সাবমেরিনেই ব্যাবহার করা হয়। এর থেকেই ভারতীয় নৌবাহিনী সাবমেরিনের উপস্থিতি নিশ্চিতভাবে টের পায় ও কোনরকম ঝুকে না নিয়ে গাজীর চোখ এড়িয়ে দ্রুততার সাথে বিক্রান্তকে বিশাখাপতনাম থেকে আন্দামানে সরিয়ে নেয়। সাথে সাথে ভারতীয় নৌ কর্তাদের মাথায় খেলে যায় উলটো শিকারীকেই শিকারে পরিণত করার এক পরিকল্পনা। পূর্বাঞ্চলীয় নৌপ্রধান এডমিরাল কৃষনন সিদ্ধান্ত নেন গাজীকে ভিক্রান্তের টোপ দেখিয়ে ফাদে ফেলার। তারা ভান করার সিদ্ধান্ত নেন যে ভিক্রান্ত এখনো বিশাখাপতনামের উপকুলেই আছে। গাজীর কাছে তা প্রকাশ করতে তারা ইচ্ছাকৃতভাবে সিকিউরিটি সাইলেন্স ভেঙ্গে ভিক্রান্তের ছদ্মনামে একটি ভূয়া মেসেজ প্রচার করেন। তাতে ভিক্রান্তের একজন নৌসেনা তার অসূস্থ মায়ের শরীরের খবর জানতে চাচ্ছে। তাদের কৌশল কাজে দিল। গাজীর ট্রান্সমিটারে এ খবর ধরা পড়ল ও তারা শিকার ভিক্রান্তের উপস্থিতি সম্পর্কে নিশ্চিত থাকল। ভারতীয় নৌবাহিনীর আরেকটি ডেষ্ট্রয়ার রাজপুতকে দায়িত্ব দেওয়া হল ভিক্রান্তের ভূমিকায় অভিনয় করার।

এ সময় ভারতীয় নৌবাহিনী কয়েকবার চেষ্টা করেও গাজীর অবস্থান বের করতে পারেনি। অবশেষে এলো ৩রা ডিসেম্বর, ভারত-পাকিস্তান আনুষ্ঠানিক যুদ্ধ শুরু হল। যুদ্ধ শুরুর মাত্র কয়েক ঘণ্টা পরের ঘটনা, ঠিক মধ্যরাত। ভিক্রান্তের ভূমিকায় অভিনয় করে যাওয়া ভারতীয় ডেষ্ট্রয়ার রাজপুত এমনই একটা অভিযানে বন্দর থেকে বের হয়ে আসছিল। এ সময় রাজপুতের ক্যাপ্টেন ঈন্দর সিং বন্দরের সরু প্রবেশমুখের মাত্র আধা মাইল দুরে পানিতে অস্বাভাবিক আলোড়ন দেখতে পান। তার অভিজ্ঞ চোখ এই আলোড়নকে সাবমেরিনের সম্ভাব্য অবস্থান হিসেবে হুশিয়ারি দিল। তিনি কোন ঝুকি না নিয়ে দ্রুত সে যায়গায় গিয়ে দুটো ডেপথ চার্জ (সাবমেরিন ধংসের বড় ড্রামের মত বোমা) পানিতে ফেলে ওই অঞ্চল ছেড়ে চলে যান। রাজপুত সেই ডেপথ চার্জের আর কোন ফল সেরাতে বুঝতে পারেনি। কিন্তু এর প্রায় আধা ঘণ্টা পর বিশাখাপতনাম উপকুলে প্রচন্ড বিষ্ফোড়নের আওয়াজ শোনা যায়। সেই বিষ্ফোড়ন এতই জোরালো ছিল যে অনেক বাড়ির কাচের জানালা ভেঙ্গে যায়। যদিও কেউ তখনো বুঝতে পারেনি সেই বিষ্ফোড়নের উতস কি। সে রাতে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষন শুনতে বহু লোক জেগে ছিল, এই বিকট আওয়াজে তাদের ধারনা হয়েছিল ভূমিকম্প হচ্ছে।

এর দুদিন পর সকালবেলায় দুজন জেলে বন্দরের নৌদফতরে সাগর থেকে কুড়িয়ে পাওয়া কিছু উপকরন দেখাতে নিয়ে এলো। সেগুলির মধ্যে ছিল কোন জাহাজের লগ বই এর কিছু পাতা, একটি মার্কিন ছাপ ওয়ালা ছিড়ে যাওয়া লাইফ জ্যাকেটের অংশ যা ভারতীয় নৌবাহিনী ব্যাবহার করে না। সাথে সাথে ভারতীয় নৌবাহিনীর উদ্ধারকারী জাহাজ নিশতার কে জেলেদের নির্দেশিত স্থানে পাঠানো হয়। নৌবাহিনীর ডুবুরীরা পানিতে ডুব দিয়ে সাগর তলে নাক ভাংগা অবস্থায় মৃত গাজীকে দেখতে পায়। গাজীর সাথে তার ৯২ জন ক্রু সবারই মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। ভারতীয় নৌবাহিনী ৩ জন পাক নাবিকের মৃতদেহ উদ্ধার করে নাবিকদের প্রচলিত উপায়ে সতকার করে বলে পরে জানিয়েছে। এটাই বংগোপসাগরর প্রথম ও এখন পর্যন্ত একমাত্র সাবমেরিন ডুবির ঘটনা।

তবে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ কোনদিন গাজীর ডুবে যাওয়াকে ভারতীয় নৌবাহিনীর কৃতিত্ত্ব বলে স্বীকার করেনি। তাদের মতে গাজী নিছক দূর্ঘটনার স্বীকার। হয় গাজীর নিজের ১০টা টর্পেডোর কোনটা রাজপুতের ডেপথ চার্জের শক ওয়েভের কারনে বিষ্ফোড়িত হয়, অথবা নিজের পাতা মাইনের কোনটার সাথে তার নিজেরই আঘাত লেগে সে ঘায়েল হয়। প্রকৃত ঘটনা মনে হয় কোনদিনই জানা যাবে না কারন সেরাতে গাজীর একজনও নৌসেনাও সাক্ষ্য দেবার জন্য বাচেনি। যুদ্ধের পরে মার্কিন এবং রুশ দুই দেশের পক্ষ থেকেই নিজ খরচে সাগরতল থেকে গাজীকে তুলে আনার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছিল যা ভারত প্রত্যাখান করে। ভারতীয় ভার্ষনেও কিছুটা অমিল আছে। ভারতীয় নৌ ইন্টেলিজেন্সের মিহির কুমার রায় পরে তার বইতে নিজেই স্বীকার করেছেন যে গাজী ডোবার মুহুর্তে সে অঞ্চলে কোন ভারতীয় যুদ্ধ জাহাজ ছিল না। যদিও এডমিরাল কৃষনন তার বইতে বলেছেন যে ডেষ্ট্রয়ার রাজপূত যে অবস্থানে ডেপথ চার্জ ফেলে বলে রিপোর্ট করে ঠিক সে যায়গাতেই গাজীকে পাওয়া যায়। সময়ও মিলে যায়। গাজীর উদ্ধার করা একটি ঘড়িতে দেখা যায় যে সেটা ঠিক ১২:১৫ মিনিটে বন্ধ হয়, রাজপুত ডেপথ চার্জ ফেলে মোটামুটি একই সময়ে। অসমর্থিত কিছু সূত্রে জানা যায় যে ভারতীয় নৌবাহিনী ২০০৩ সালে আরেবার ১০ জন ডুবুরীকে সাগরতলে গাজী ডোবার যায়গায় পাঠায়। সেসব ডুবুরী রায় দেয় কোন আভ্যন্তরীন বিষ্ফোড়নের ফলেই গাজী ডুবে যায়, যদিও কারনটা জানা যায়নি।

যুদ্ধের সময়ে এ জাতীয় দাবী পালটা দাবী অনেকসময়ই বেশ ধোয়াশার সৃষ্টি করে। মজার ব্যাপার হল গাজী নিজেই ৬৫ সালের যুদ্ধে একবার এহেন দাবী করেছিল যা পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়। ৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধে গাজী ভারতীয় ফ্রীগেট ব্রক্ষ্মপূত্রকে ৪ টি টর্পেডো আঘাতের দাবী করে, তার ৩ টি নিশ্চিত ছিল বলে গাজীর তখনকার কমান্ডার জোর দাবী করেন। এই দাবীর ভিত্তিতে গাজীকে ব্রক্ষ্মপূত্র “ডোবানোর” কৃতিত্ত্বের জন্য করাচী বন্দরে বীরোচিত সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। যদিও ব্রক্ষ্মপূত্রের সেবার আসলে কিছুই হয়নি বলে পরে জানা যায়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বিশাখাপত্তমে গাজী ডোবানো স্মরন করতে একটি বিজয় স্তম্ভ বানায়, পাকিস্তান ২০০০ সালে গাজী নামে আরেকটি নুতন সাবমেরিন তার বহরে যোগ করে। রাজপুতের কমান্ডার ঈন্দর সিংকে দেওয়া হয় বীর চক্র পদক।

তবে কারন যাই হোক, গাজী ডুবে যাওয়ার ফলে আমাদের বাংলাদেশের উপকুলের নৌযুদ্ধে পাকনৌবাহিনী যুদ্ধ শুরু হবার হবার থেকেই বস্তুত পরাজিত হয়। এরপর ভারতীয় বিমানবাহী জাহাজ ভিক্রান্ত সম্পূর্ণ বিনা বাধায় বংগোপসাগরে প্রবেশ করে, ভিক্রান্ত থেকে কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বন্দরে বিমান হামলা করে ব্যাপক ক্ষতিসাধন করা হয় কোন উল্লেখযোগ্য প্রতিরোধ ছাড়াই। চট্টগ্রাম বন্দরের হামলায় ভিক্রান্তের মাত্র একটি বিমান ভূমি থেকে ছোড়া এন্টি-এয়ারক্র্যাফটের গোলায় সামান্য আহত হয়, যদিও সেটা নির্বিঘ্নে বিমানে ফিরে আসে এবং সামান্য মেরামতির পরেই আবারো পূর্ণ কর্মোক্ষম হয়। নৌপথে পাক বাহিনীর হাই অফিশিয়ালদের পালানোর একটা গোপন পরিকল্পনাও এর ফলে বাতিল হয়ে যায়। যুদ্ধের বাকি কটা দিন ভিক্রান্ত আর ভারতীয় অন্য কয়েকটি জাহাজ মিলে ছোট বড় মোট ২৪টি পাকিস্তানী জাহাজ ডোবায়।